গদ্য বিশেষ সংখ্যা

মেঘ মালহার রাগ | তৃণলতা কুরচি | মুক্তগদ্য | উৎসব সংখ্যা ২০২৪

আকাশ দাপানো বৃষ্টির ছাটে, ভেজা নয়নতারার পাপড়িতে জমা জলবিন্দুগুলো, স্বচ্ছ কাচের ছোট্ট ছোট্ট টুকরোর মতো বিছিয়ে থাকার দৃশ্য, নজরবন্দি হতেই বিগত আষাঢ় মনে আসে। মনে পড়ে দিন ফুরিয়ে কদম কদম ঘ্রাণের সন্ধ্যা শুরু হওয়ার ক্ষণ। মুহূর্তকালে জলবিন্দুতে কবেকার স্মৃতিদগ্ধ মুখ, ভেসে উঠে বিলীন হয়ে যায় বিদ্যুৎ চমকের সাথে। তৎক্ষণাৎ কালের রেখায় বিগত হওয়া ঋতু সজল ভরা চোখ মেলে দেয়।

রাজহংসের ডানা ধরে হরেক রঙের কাগজের নৌকা ভাসাতে একটা দিঘি খুঁজেছি তন্নতন্ন করে ভরা বৃষ্টির শহরে কাকভেজা হয়ে। পাইনি। নৌকা না-বানাতে পারা রঙিন কাগজগুলো ব্যাগে করে ফিরতি পথে, নিজেকে ট্রেন ধরতে না-পারা প্ল্যাটফরমের যাত্রী মনে হয়েছিল যেন, হুইস্‌ল বাজিয়ে ছেড়ে গেল শেষ ট্রেন, আমি যেতে না-পারা গন্তব্যের দিকে। পরমহংস ভেজা ডানা নিয়ে, নিরুদ্দেশ হয়েছিল সেইদিন।

অবোধ তখনো টের পাইনি! দৃশ্য থেকে সমস্ত অদৃশ্যে মিলিয়ে গেলে, না-ফেরার বয়স দীর্ঘায়িত হলে সহসা ঘোর ফিরেছিল কোনো দিন।

নিশ্চয়ই কোনো শহর পেয়েছিল দিঘীময়। যেখানে জলকেলিতে দুভাগ হয়ে যায় ফুটে থাকা লালপদ্ম। হলুদ চঞ্চুতে জলে ভেজা শামুক খুটে খায় রাত আর দিন। শ্যাওলাধরা স্কন্ধে ঝুলে থাকে শাপলাপাতা, ডুবে বা ডোবায় ঢেউয়ের দোলে, যখন যেমন ইচ্ছে হয়।

শরতের হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো কোয়া কোয়া মেঘ ভেসে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে, কাগজে বানানো উড়োজাহাজ, বাতাসের অনুকূলে উড়িয়ে দেবার কথা ছিল। সেগুলো জালালি কবুতরের মতো উড়ে উড়ে গিয়ে পড়লে রমনায় অশোকের ডালে; ইচ্ছে ছিল প্রচুর ঘ্রাণ নেবার, লাল নীল কাগজের উড়োজাহাজ কুড়ানোর ছলে।

হেমন্তের হলুদ মাড়িয়ে বসন্ত এলে অশোকবীথির ভেতর, খোঁপার ন্যায় গুচ্ছধরা অশোকফুল গাছের নুয়ে থাকা পাতাদের মতো, নৈবেদ্যে নিমগ্নকালে, নখর শিল্পের হাতেখড়ি হওয়ার সম্ভাবনা তখনো হয়তো ছিল না, তবু্ও অদূরে বাবুইপাখির বাসা বানানোর ছিল সুপ্ত বাসনা : বাতাসের সাঁইসাঁই রেশে কেঁপে ওঠা কানের লতায়, একটা বৃষ্টিবিন্দু পড়া দৃষ্টিগোচর হলে, বুদ্ধের নীরবতায় পলক ফেলা চোখের ভেতরে, রচিত হবে মেঘনাদের চাওয়া নিয়ে দুইশ থেকে তিনশ মিলিয়ন রূপকথা; এ-ও তো মনে পড়ে!

ষড়ঋতুর কোনোটিতে ভেদাভেদ নেই কোনো। প্রায়শই ফেলে আসা দিনগুলো নীরবে যাতায়াত করে। ঠিক যেমন, নৌকার বৈঠা ছপছপ করে পানি থেকে উঠে আবার তলিয়ে যায়; নিমগ্ন হয়ে নিজের ভেতর তলিয়ে থাকা, বিগত দিনের ভাসা ডোবার দৃশ্যে চোখ বুলাতে থাকি।

কখনো কখনো দুপুর শেষের পড়ন্ত বেলায় হুহু করে বেজে ওঠে হৃৎপিণ্ড। যেনবা তানসেনের বীণায় মেঘ মালহার রাগ। কিছুক্ষণের ভেতর আকাশে কালো মেঘের হলাহল শুরু হবে।
গগন দাপিয়ে মেঘের ডাকাডাকি শুরু না হলেও, ততোধিক ফালি হওয়া বুকে, দেওয়ার মতো গুড়ুম গুড়ুম ডাক অনন্ত নিস্তব্ধতা গুঁড়িয়ে দেয়; অমনি বহে জলের ঢল…

মনে পড়ে জমিনের পথ ভুলে, বিনি সুতায় বাঁধা ঘুড়ির মতো উড়তে চেয়েছিলাম যুগ্ম। হাওয়ায় দাপটে বেঁকিয়ে কোথাও উঁচু দালানের কার্নিশে ঝুলে থাকতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর শেষ দিন অথবা আয়ুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। অথচ অজান্তেই খুব গোপনে প্রবল বাতাস ছিটকে যাচ্ছিলাম দুদিকে!

ঠিক যেন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি…

আর গান বাজছে—

‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে
মেরা লাল দোপাট্টা মল মল… কা হো জি হো জি…’

তথাপি ফাঁসিতে নয়, ঝুলে ছিলাম ভানের বিভ্রমে। চিলিমের আগুন নিভে যাওয়ার রেশ, কে অত টের পায় নিমগ্নতায়, আর আম্রমঞ্জরির বন্যায় ভেসে যাওয়া ফাগুনের দিনে।

অযাচিত ক্ষণে গীতবিতানে পড়ল টান আর বাঁধ ভাঙল চোখে ডাকা বান; তখনো জানিনি তো, এপ্রিল তার প্রিয় তাই ইংরেজিতে ফুল বানাচ্ছে প্রতিনিয়ত!

বাঁধনহারা সেই রাতের আকাশে ওঠা, বৃষ্টিতে ধোয়া মসস্ত বড় চাঁদ, বেসামাল আলো জ্বেলে আমাকে দেখছিল ঘুরেফিরে বারবার। লুকাতে চাইলেও আঁতিপাঁতি খোঁজে বার করে, হেসে হেসে ‘তুই বোকা তুই বোকা!’ বলছিল যেন।

সেইদিন থেকে আমি চাঁদের চ্যাপলিন!
চাঁদ লুকানো অমাবস্যায় চোখে বান না ডাকলেও
পূর্ণিমার রাতে চাঁদ আমাকেই খোঁজে!

দেখলেই করে তামাশা আর বলে দু-চার স্ল্যাং
স্মৃতি জাগলেই পূর্ণিমায় মারতে আসে ল্যাং…

চোখের জলে জোয়ার এলে, কোন সে মুখ নদীতে নৌকা চেপে ভ্রমণের মতো সারা রাত ভাসে মৃদু ঢেউয়ে দোলে? তা জানেন পঞ্চপ্রাণের বিনিদ্র প্রহরী। মানুষের সাথে সকল কথালাপে অনীহা বলে, আমি চাঁদের কাছে চ্যাপলিন হওয়ার গল্প করি।

কখনো ফুরিয়ে যাবে চোখের শ্রাবণ। চৈত্রের খড়াসম চৌচির ধরা চোখে, পরমহংসের জলকেলি কামনায় ঋতু রোসবে না। নিরুদ্দেশে হংসের অপেক্ষায় রাখা জলাবদ্ধ পুকুর সেচে, নতুন ধানের আবাদ হবে। সেই ধানের শিষের সবুজ, মখমলি চন্দ্রনাথকে ম্লান করে দেবে। মেঘ মালহার সেদিনও আবার উঠবে বেজে!

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field