অনুবাদ ছোটগল্প

মনীষা কুলশ্রেষ্ঠ | কুরজাঁ | লিপিকা সাহা অনূদিত | ছোটগল্প

হিন্দি গল্পের অনুবাদ

এই দেখো ডাক্তার, তোমার এই মেডিকেল জার্নালে কী লেখা আছে। এরা বলছে যে শরীরের প্রত্যেক কোষে স্মৃতিগুলো জমা হয়ে থাকে। এই তথ্যটি তখনই সামনে এল যখন আমেরিকায় একটি মেয়ের শরীরে এমন একজন লোকের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যাকে হত্যা করা হয়েছিল…। এরপর থেকে ওই মেয়েটি সেই হত্যাদৃশ্যের স্বপ্ন দেখতে পায়। কেমন করে সেই ডোনারকে খুন করা হয়েছিল। এবার একে তুমি কী বলবে?
সে আমার ক্লিনিকে আসে আর এই ধরনের বিস্ময়কর বিষয় পড়তে এবং শোনাতে ভালবাসে।

আমার এই চিরকুমার রোগী একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ। নিজের চাকরির সময়কার কত গল্প শোনায়। মরুভূমি অঞ্চল, আসামের দুর্গম এলাকা, গুজরাতের কচ্ছ-অঞ্চল এবং অন্য সব জায়গা, যেখানে-যেখানে সে ছিল। একজন শিক্ষাবিদ হওয়ার কারণে সে অনেক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নিজের শেষের দিনগুলিতে আমার সঙ্গে ’উইচ ক্রাফ্ট’, মানে ডাইনি-বিদ্যার ওপরেও আলোচনা করত। সে রকম একদিন একবার এক অদ্ভুত ঘটনা আর মরুভূমি অঞ্চলের এক সুন্দরী ডাইনির উল্লেখ করে। ডাক্তার, সে বলল, যখন তার মা নিজের ওপর কারুর আত্মাকে আহ্বান করত… তারপর বেশ কয়েকদিন নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকত। তার শরীর এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে যেত যে মনে হতো যেন সে কত মাস ধরে অসুস্থ। এটাকে তুমি তোমার মেডিকেল পরিভাষায় কী বলবে? তার এরকম করে প্রত্যেকটা ঘটনার বিশ্লেষণের পর এভাবে ‘তোমার মেডিকেল পরিভাষায়’ হুল ফোটানোর মতো কথাটা আমাকে মাঝে-মধ্যে চটিয়ে দিত।

তার এরকম অদ্ভুতুড়ে গল্প-গাছা শোনার আর শোনানোর শখ দেখে আমি প্রায়ই ওকে বলতাম, তুমি লেখো না কেন? সে সব সময় এই বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেত যে তার এত ধৈর্য নেই। এ সত্বেও আমার বলার পর সে মরুভূমির ডাইনিকে নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলে। আমি সেটাই আপনাদের বলব। এই হলো সেই ফাইল, এই রইল… তার হাতেলেখা পৃষ্ঠাগুলি।

‘ডাইনি – তাও আবার রক্তমাংসের জ্বলজ্যান্ত ডাইনি, যার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। যুবতী-সুন্দরী! আমার স্মৃতিশক্তি হঠাৎ এত দুর্বল হয়ে পড়বে, এই রকমটা তো কখনও হয়নি। আমি প্রতিদিন দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি আসি, দুপুরের খাবার খাই, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি, তরপর স্কুলে চলে যাই। এই বিরতির মাঝে, গতকাল যখন আমি বাড়ির গেট খুলে সবে ভিতরে ঢুকেছি কি ঢুকিনি, সে আমার পিছন-পিছন চলে আসে। যুবতী, দীর্ঘাঙ্গী, রোগা-পাতলা একজন। মুখের ডৌলটা লম্বাটে, দুই গালের হাড় উঠে আছে। গরমে ঝলসে যাওয়া তামাটে ফর্সা গায়ের রঙ। ভাসা-ভাসা নীলাভ সবুজ চোখ দুটো তার চেহারায় এমন দেখাচ্ছিল যেন বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে পাশাপাশি থাকা দুটো নখলিস্তান*। জাম-রঙের ছেঁড়া ওড়নার মধ্যে দিয়ে তার খয়েরি কোঁকড়ানো চুল উঁকি দিচ্ছে। পরনে কুর্তী আর ঘেরওয়ালা কালো লহঙ্গা। গলায় কুঁচফলের দানার মালা। সব মিলিয়ে চোখে পড়ার মতন উপস্থিতি।

আমি ভাবলাম, হবে কেউ… বাড়িওয়ালির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে হয়তো। আমি তাড়াতাড়ি করে অন্ধকার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকি, সেও চট করে ঠিক আমার পিছন-পিছন ওপরে উঠতে থাকে। সিঁড়িতে লুকিয়ে থাকা দুটো চামচিকে ফড়ফড় করে ওঠে। আমি নিজের ঘরের তালা খুলি। সে সেখানেই সিঁড়ির বাইরে চুপচাপ, অন্যমনস্কের মতন দাঁড়িয়ে পড়ে। মধ্যগগনের সূর্যের আলো ঘর খালি পেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়েছে। আমি ভিতরে এসে কপাট বন্ধ করি। ঢেকে রাখা থালা তুলেছি কি তুলিনি, দরজায় একটা অনভস্ত করাঘাত হয়। ওই অচেনা মহিলার এরকম ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। আমি বিরক্ত হয়ে বলি, কে? কী চাই?

মিনমিনে স্বরে উত্তর পেলাম, মাট্সাব, আমি। আপনাকে কিছু বলার ছিল।
আমি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াই, তারপর দরজা খুলে, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি, – কী কাজ?
–মাত্র দু’ মিনিট… আমার কথা একটু শোনো মাস্টার। আমার বাচ্চার ভর্তি নিয়ে কথা…
– স্কুলের ব্যাপার স্কুলে এসে বোলো। এখন যাও। আমার ভুরু কুঁচকেই থাকে।
– স্কুল… সেখানে তো আপনার চাপরাশি কালু ঢুকতেই দেয় না।
– সে কী? কে তুমি? নাম কি তোমার? আমি সন্দেহের বশে প্রশ্নের তুবড়ি ছুটাই।
–এই তো, ভাগ্যহীন আমি। নাম কুরজাঁ… কিন্তু লোকে তো…। তার গলার স্বরটা যে কাঁপছে, সেটা আমার কান এড়ায় না।
–তুমি এই গ্রামের কেউ? থাকো কোথায়?
–হ্যাঁ, এখন তো এই গাঁয়েরই হয়ে গেছি। নোনা বাওড়ির (বিশাল জলাধার, যা উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে দেখতে পাওয়া যায়)… শ্মশান ঘাটের কাছেই থাকি।
–ঠিক আছে… কালুকে বলে রাখব… তুমি এলে যেন না আটকায়। কাল স্কুলে চলে এসো, বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে এসো। আমার কথা শুনে সে চোখের পাতা তুলে তাকায়… নীল, থমকে থাকা সরোবর ঝিলমিল করে ওঠে। মরুভূমিতে পথভোলা তৃষ্ণার্ত পথিকের মতন আমি ওই সরোবর দুটোয় ঝাঁপ দিই।

এরপর আমার আর কিছুই মনে থাকে না, আমি নানান রাস্তা ধরে আত্মবিস্মৃত হয়ে চলতেই থাকি… চলতেই থাকি। তারপর শুকিয়ে যাওয়া নোনা জলাশয়ের সামনে দ্বিধান্বিত একা দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে কালু আবিষ্কার করে।

–ওই অদ্ভুত নামের নারী… কুরজাঁ… এক্ষুনি তো আমার আগে-আগে যাচ্ছিল। কিন্তু সে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?
–কে, কুরজাঁ? সেই ডাকিনি? সে তো ডাইনি… কিছু বুঝলেন? কালু আমার ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া হাতে চাপ দেয়। আমি নিজেকে সামলে নিই।
–আমি এসব ফালতু কথা বিশ্বাস করি না…
–পুরো গাঁ জানে তাকে। আপনি নতুন কি না। কালু বলে।
–পাগল নাকি তুমি? সে ডাইনি হবে কেন? সে তো জ্বলজ্যান্ত এক যুবতী।

কালু সত্যিই উন্মাদের মতন দাঁত বের করে হাসতে থাকে। তারপর জোরে একদিকে থুতু ফেলে জামার হাতা দিয়ে মুখ মুছে বিড়বিড় করতে থাকে,
–হেডমাস্টার সাব… তাহলে বলেন, পুরা ঘর খোলা রেখে, থালায় অর্ধভুক্ত খাবার রেখে আপনি স্কুল ছেড়ে এই শুকনো বাওড়ির দিকে কি করতে এসেছেন?
– ওহ্, মনে পড়েছে… সে বলছিল যে তার ছেলেকে সে স্কুলে ভর্তি করাবে, জনি না কোন বেখেয়ালে… আনমনা হয়ে… আমি এইখানে…
–বেশ… বোঝা গেল।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field