গদ্য

মনির জামান | এই শহরে একজন কবি ছিলো | গদ্য

কিশোর বয়সেই কবিতা আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। ক্লাসের বইয়ের কবিতায় মগ্ন থাকতে থাকতে সুনীল, শক্তির দু-একটা কবিতা পড়ে ফেলি। ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ আমার মনটাও যেন কেমন কেমন করতে শুরু করে। তখনো বুঝে উঠিনি, কাব্য যে এক মায়াময় ভুবন, অনেক সাঁতার কাটা যায়।
এমন মগ্নতার দিনগুলোতে দুপুর বেলায় লক্ষ্মী বাজারের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম; দেখি, বই বিছিয়ে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। অনেকক্ষণ ধরে বেছে বেছে কয়েকটা বই কিনি খুব সস্তায়। ওগুলোর মধ্যে কালো মলাটের একখানা ছিলো – শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’। রাতে বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে কালো মলাটের বইটা থেকে একটি কবিতা পড়ে মোহিত হয়ে যাই। কবিতাটি ছিলো ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। শুরুতেই লেখা ছিলো :

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তা নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।

আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।

মাত্র কয়েকদিন আগে মরা পাতা মাড়িয়ে প্রভাত-ফেরি করে এসেছিলাম; আর রাতে, সবাই যখন ঘুমিয়ে, কবিতাটি পড়ে উপলব্ধি হয়েছিলো—ভাষা, বর্ণমালা, শিউলি ফুল, মানুষের সংগ্রাম—আরো কত কি! বুঝেছিলাম, শহিদের রক্ত কেন বৃথা যেতে দিতে চাই না আমরা। বইটা এরপর বহুবার পড়েছি, একা একা; কাউকে না জানিয়ে বুঝতে চেয়েছি—দেশ কী, বাঙালির কোথায় সুখ-দুঃখ—আপ্লুত হয়ে গেছি কবিতার মর্মে!
সেই থেকে শামসুর রাহমান নামের কবিটির প্রতি আমার ঝোঁক। যখন যেখানেই তাঁর কবিতা দেখি, লহমায় পড়ে ফেলি। সময়তো সদা আগুয়ান; কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে চলে এসে বুঝতে পারি—আমার ভাবনাগুলো ভুল ছিলো না। সাহিত্য এক বিরাট জগৎ; আর ঢাকার সেই ভুবনে শামসুর রাহমান নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে একটি নাম—বহুবছর ধরে কবিতার ডালি সাজিয়ে যাচ্ছেন, হয়তো শুধু আমার মতো পাঠকের জন্য! আমি হয়ে উঠি এই কবির মগ্ন পাঠক।
এরপর হাতে আসে ‘মাতাল ঋত্বিক’। সে এক অনন্য উপলব্ধি, আধুনিক কবিতাকে বুঝতে গিয়ে। ততদিনে কাব্যের প্রকরণ বিষয়ে পড়েছি। চতুর্দশপদীতে লেখা কবিতাগুলি আমাকে বুঝতে শেখায়, ভাষা কীভাবে কাজ করে; আর উপলব্ধ ব্যঞ্জনা পাঠক-চৈতন্যে কেমন আলোড়ন তোলে। রাহমান বলেছেন :

তোমার উদ্দেশে আমি যখন যা উচ্চারণ করি,
সে ধ্বনি তোমার কানে সকল সময় হোক গান;
মাতাল ঋত্বিক আমি; প্রেমকথা আমার ঋগবেদ।

এই উচ্চারণ আমাকে কাব্য-বুভুক্ষ করে তোলে; হয়ে উঠি তাঁর কবিতার একাগ্র পাঠক। এরপর শামসুর রাহমানের কবিতার ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক-ইতিহাস—প্রেমময়, সংগ্রামের, সূক্ষ্ম জনরুচি বিকাশের—আপন দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ঢাকার কবিতার একক পোস্টার।
এইক্ষণে আরেকটা দিক নিয়ে বলতেই হয়—দেশভাগের পরও ঢাকার কবিতা ছিলো কলিকাতার অনুগামী। সাহিত্যকেন্দ্র হিসাবেও ঢাকা ছিলো নিতান্ত নবীন। স্বাধিকারের উৎফুল্লতায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতর দিয়ে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, গত শতকের ’৫০, ’৬০-এর দশকের কবিদের হাতে তা বিকশিত হয়ে বাংলা কবিতা যে নতুন মাত্রা পায়, তার প্রধান কবি হয়ে উঠেছিলেন শামসুর রাহমান। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন :

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

আবার যখন অপ-রাজনীতির খপ্পরে জনগণ দিশেহারা, তখন আক্ষেপ করেছেন, প্রিয় স্বদেশ উদ্ভট উটের পিঠে উঠে গেছে বলে। যে কবিতাটি সবচেয়ে দুঃখ-জাগানিয়া হয়ে দেখা দেয়, সেটি হলো ‘ইলেক্ট্রার গান’। বুক বিদীর্ণ করে বলেছেন :

মিত্র কোথাও আশেপাশে নাই, শান্তি উধাও; নির্দয়
স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে। নিহত
জনক, আগামেমনন কবরে শায়িত আজ।

শামসুর রাহমানের কবিতা আদ্যপান্ত পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রাম ও বিকাশের ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। ঢাকার কবিতাকে অনুকরণ প্রবণতা থেকে বের করে এনে নতুন কণ্ঠস্বর দিয়েছেন। ঢাকা যে গ্রাম নয়, সাত কোটি বাঙালির প্রাণের শহর—তাঁর কবিতা আমাদেরকে সেই উপলব্ধি এনে দেয়। আজ বলতেই হয়—এই শহরে একজন কবি ছিলো, যে লিখেছিলো :

হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও

আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্থি খাবি,…।

আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস, শামসুর রাহমানের দেহগত মৃত্যু হয়েছে কিন্তু কবিতায় তিনি বেঁচে বাংলা কবিতার এই যুবরাজ।

মনির জামান
প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field