গদ্য বিশেষ সংখ্যা

নাটক ও রূপসজ্জা | শুভাশীষ দত্ত তন্ময় | বাংলাদেশ থিয়েটার

বাংলাদেশ থিয়েটার

বহু লড়াই সংগ্রামের পর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত একঝাঁক তরুণ অস্ত্র ফেলে শুরু করে নাটক। তাদের কাছে নাটকই হয়ে ওঠে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নানা কথা, প্রতিবাদ তুলে ধরার মাধ্যম। সময়ের প্রয়োজনে একসময় শুরু হলো গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। ধীরে ধীরে বহু নাট্যদল তাদের নতুন নতুন প্রযোজনা মঞ্চে নিয়ে আসতে থাকলো। দাপুটে অভিনয় দিয়ে দর্শক মাতাতে থাকলেন অনেক নন্দিত অভিনেতা অভিনেত্রী। অনেক নাট্যকার, নির্দেশক আপন গুনেই হয়ে উঠলেন পরিচিত মুখ। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজ বিদেশেও সমাদৃত হয় বাংলাদেশের নাটক। তবে শুধু নির্দেশক, অভিনেতা অভিনেত্রী নন বরং লাইটিং, সেটসহ আরও অনেক মানুষের নানা শ্রমে চলছে আমাদের নাট্যযজ্ঞ। সেখানে আড়ালে আবডালে আরেকটি মানুষও অনেকটা নিভৃতে নেপথ্যে নাটকে অবদান রেখে চলেন। তিনি রূপসজ্জা শিল্পী।

নাটকের অন্য উপাদান – যেমন পাণ্ডুলিপি, মঞ্চ, আলো, সংগীত, পোশাকের মতো একসময় রূপসজ্জাও অতি প্রয়োজনীয় ছিল। তবে এখন অনেকে নাট্য প্রযোজনায় রূপসজ্জা এড়িয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সনাতনি ধারায় নাট্যচর্চা হতো, সেসব স্থানে রূপসজ্জার প্রয়োগ হলেও, যত বেশি দেশ-বিদেশের নাটক মঞ্চায়িত হতে থাকে তত বেশি রূপসজ্জার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব পেতে থাকে। ফলে, পেশাদার রূপসজ্জা শিল্পীরা আমাদের থিয়েটারে একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন, যারা রূপসজ্জাটা নাট্য প্রযোজনার ধরন অনুযায়ী চরিত্র রূপায়নে সক্ষমতা প্রদর্শন করেন। তারা রীতিমতো রূপসজ্জা নিয়ে কিছুটা গবেষণাও করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট রূপসজ্জা শিল্পী বঙ্গজীৎ দত্ত।

বঙ্গজীৎ দত্ত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী থিয়েটার চর্চায় অপরিহার্য একজন রূপসজ্জা শিল্পী। তার সহকারী হয়ে অনেকেই কাজ করতেন; পরে এখনো যারা কাজ করে চলেছেন। বঙ্গজীৎ দত্ত থিয়েটারে রূপসজ্জার আধুনিকায়ন করেন। রূপসজ্জার উপাদানসমূহে ভিন্নতা আনেন। সেই সময় বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই নাট্যচর্চায় অন্য সব কিছুর মতো রূপসজ্জার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। স্থানীয়ভাবে দুই-একজন করে রূপসজ্জাকর পাওয়া যেত, যারা সাধারণত অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। নাটক মঞ্চায়ন হবার ব্যবস্থা হলে নাট্যশিল্পীরা তাদেরকে অনুরোধ করতেন এবং তারা তখন নাটকের রূপসজ্জা করে দিতেন। বঙ্গজীৎ দত্ত শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বহু জেলায় নাট্যকর্মীদের রূপসজ্জা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। পরে যারা নিজেদের দলের রূপসজ্জা করেছেন, অনেক পেশাদার রূপসজ্জা শিল্পীও হয়েছেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাট্যকলা বিভাগ চালু হলে সেখানে কোর্স হিসেবে বিষয়টি পড়ানো শুরু হয়। ফলে রূপসজ্জা বিষয়ে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূত্রপাত হলো। এর ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পেল। রূপসজ্জার ইতিহাস, প্রকারভেদ, উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হতে থাকল। রূপসজ্জা বিষয়টি নাট্যশিল্পীদের কাছে আরও সহজ করে তুলল।

আজকের আধুনিক বিশ্বে রূপসজ্জা অনেক এগিয়ে গেছে। এর উপাদানসমূহ অনেক উন্নত ও নানা বৈশিষ্ট্যসম্বলিত হয়েছে; যার ছোঁয়া আমাদের থিয়েটারেও এসে পৌঁছেছে। এখন আর সনাতন পদ্ধতিতে রূপসজ্জা হয় না। আমাদের নাট্য প্রযোজনা যেমন বিশ্বনাট্য ভাবনার সঙ্গে তালমিলিয়ে চলেছে নানাধর্মী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, রূপসজ্জাও সেভাবেই এগুচ্ছে।

বর্তমানে কিছু তরুণ নাট্যকর্মী রূপসজ্জা-শিল্পে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম, হতাশাজনক। এ শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে, নিরীক্ষাময় করে তুলতে, দরকার নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ।

রূপসজ্জা বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর মাধ্যম। একজন শিল্পীকে পর্দায় বা দর্শকের মুখোমুখি কেমন দেখাবে তা ঠিক করে দেন রূপসজ্জা শিল্পী। এতে যেহেতু নানা রঞ্জক উপাদানের ব্যবহার হয়, তাই ভুলচুক হলে ত্বকের মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ফলে, একজন রূপসজ্জা শিল্পীকে খুব সাবধানে তার উপাদানগুলো বেছে নিতে হয়। জেনে নিতে হয় কার ত্বকের ধরন কেমন, কোন ত্বকে কী জিনিস ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের রূপসজ্জা শিল্পীরা এখনও এসব করছেন অনেকটা নিজ উদ্যোগে শিখেই। তবে বিষয়টি যেহেতু সেনসিটিভ, তাই প্রশিক্ষণ নিয়েই রূপসজ্জা করা উচিত।

রূপসজ্জা বিষয়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য আমাদের দেশে সেই অর্থে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান বা ইন্সটিটিউট নেই। তবে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ফেসবুক, গুগল কিংবা ইউটিউবে রূপসজ্জা সম্পর্কে বহু তথ্যমূলক ভিডিও রয়েছে। এসব ভিডিও থেকে আমাদের শিল্পীরা সমৃদ্ধ হতে পারেন। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।

ভালো রূপসজ্জা শিল্পী হতে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের মানুষের চেহারার গড়ন থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিসের পর্যবেক্ষণ জরুরি। এভাবেই নতুন নতুন রূপসজ্জা বিষয়ে ধারণা আসতে শুরু করবে। দেখতে হবে প্রচুর নাটক, সিনেমা। এছাড়া প্রচুর পড়াশোনাও করতে হবে নানা বিষয়ে। আমাদের রূপসজ্জা শিল্পীরা এটা খুব একটা করেন বলে মনে হয় না। সে কারণেই থিয়েটারের অন্য বিষয় যত এগিয়েছে রূপসজ্জা ততটা নয়। আমি মনে করি শৈল্পিক চিন্তাধারাকে গুরুত্ব দিয়ে এ শিল্পের গভীরে প্রবেশ করতে পারলে একদিন রূপসজ্জা দেখার জন্যই হয়তো থিয়েটার দেখতে আসবেন আমাদের দর্শক।

শুভাশীষ দত্ত তন্ময় : রূপসজ্জা শিল্পী

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field