কথাসাহিত্য ছোটগল্প

গ্রহণলাগা চাঁদের সাধ | সায়মা ইসলাম | ছোটগল্প উৎসব সংখ্যা ২০২৪

স্নো, পাউডার, ঠোঁটপালিশের পরতে ঢাকা মুখখানা অচেনা। চাপা আকৃতির চোখ দু’টো মোটা কাজলের দাগে বড়ো হয়ে আয়নার ওপার থেকে স্থির চেয়ে থাকে রোকসানার দিকে। গরমে ঘামে পরত পরত ফেসপাউডারের তল থেকে চিরচেনা মায়ামায়া মুখখানা উঁকিঝুঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়! যে যাই বলুক, আয়নায় নিজের মেঘবরণ মুখটাই পছন্দ রোকসানার। ইচ্ছে করে, কল চেপে ঠান্ডা পানির ঝাপ্টা মেরে মুখটা ধুয়ে আসে।  কিন্তু ইচ্ছে করলেই এখন তা সম্ভব না। তার চুনকাম করা মুখের ওপর দুই জোড়া চোখের তারা ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। তাদের ফাঁকি দিয়ে কোনোমতেই এখন বাইরে যাওয়া চলবে না। অগত্যা তাদের ঠাট্টা মশকরার ফাঁকে ফাঁকে কটকটে লাল ঠোঁট দু’টো ফাঁক করে হাই তোলে রোকসানা।

‘মাগির বরাত আছে! এই আন্ধার শইলে তিন তিনবার বিয়ার চাঁন উঠল!’ লাল টুসটুসে ঠোঁট দু’টো ফাঁক করে পানের দাগ পড়া উঁচু দাঁতদু’টো বের করে হাসে জয়নব। হ্যারিকেনের আবছা আলোয় তার মুখটা জোৎস্নার মতো ফকফক করে। বড়ো ভাবির মুখের দিকে চেয়ে রোকসানা মরমে মরে যায়। 

দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজের বরাতে ননদের ওপর লাইলির মনটা বরাবরই একটু প্রসন্ন। রোকসানার লজ্জিত মুখের সামনে থেকে লাল ফ্রেমের ছোট্ট আয়নাটা নামিয়ে নেয় সে। মাথার ঘোমটা আরো খানিক টেনে দিয়ে বলে, ‘এইবার আমাগো রুকিরে নিচ্চিত সুখের দিন দিবো আল্লায়।’ ছোটো ভাবির ফরিয়াদে মনে মনে শরিক হতে গিয়ে রোকসানার চোখ দু’টো বুঁজে আসে। তার ঘুম পায়। গভীর ঘুম। গতরাতের ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল মস্তিষ্ক ক্লান্ত দেহটা নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে চায়। চৌকির  মাথায় সাজিয়ে রাখা বালিশ দু’টোর একটায় মাথা ফেলতেই জয়নব খপ করে ধরে ফ্যালে তাকে, ‘অখনি এত ব্যাকুল অইলে অয়! মাওলানা সাব নওশা নিয়া আসুক। কলমা পইড়া এক্কেরে দোর দিয়া বিছনায় গড়াগড়ি যাইবা!’  

 ক্লিপ ফিতায় বাঁধা মাথাটাকে নতুন মড়মড়ে শাড়ির ওপর কোনোরকমে খাড়া করে রাখে রোকসানা। কিছু একটা করা উচিত! কিন্তু কী করা উচিত, বুঝে উঠতে পারে না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা। চোখের সামনে ভারী একটা অন্ধকার পর্দা খালি দুলছে আর দুলছে।  সিনেমার পর্দায় দেখা বিশেষ দৃশ্যের মতো ভেসে ভেসে উঠছে গতরাতটা। 

গতরাতেও তাকে এমনি করে সাজানো হয়েছিল। তার মুখের মতোই আঁধার হয়েছিল কৃষ্ণপক্ষের চাঁদশূন্য আকাশ। সেই আঁধারে গা মিশিয়ে এশার নামজের পর নওশা এল বাড়িতে। কোনো সাড়াশব্দ ছাড়াই বাংলা ঘরে নিয়ে বসানো হলো তাকে। এ-ঘর থেকে রোকসানার মুখের কবুল নিয়ে ও-ঘরে বসা নওশার সাথে বিয়ে পড়ানো হলো। বাড়ির কারো মুখে কোনো কথা নাই। সবাই কেমন পা টিপে টিপে চলছিল। রোকসানা তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে। তার অভাবে-স্বভাবে মন্দ কিছু  না পেলেও তাকে নিয়ে আকথা-কুকথা বলবার লোকের অভাব নেই গাঁয়ে। তাই বলে এমন চোরের মতো বিয়ে! বাড়ির ভেতর কেমন দমধরা পরিবেশ।

সন্ধ্যার পরই ঘণ্টাখানেকের জন্য কারেন্ট চলে যায় প্রতিদিন। গতরাতে আর ফেরেইনি। অন্ধকারে বসে ঢিপঢিপ ‍বুকের ছন্দে তাল মিলিয়ে রোকসানা তার মন থেকে প্রথম সংসারের খণ্ড খণ্ড ছবিগুলো মুছে ফেলতে চাইছিল। আর নতুন জীবনে সুখী হবার আশায় মনে মনে আল্লাহতালার কাছে পানা চাইছিল। সেই ধোয়ামোছার ক্লান্তি আর অপেক্ষায় কখন যে চোখদু’টো লেগে এসেছিল! হঠাৎ খুটখুট  শব্দে তন্দ্রা কেটে গিয়ে তার মস্তিষ্ক সজাগ হলো। 

তখন প্রায় মধ্যরাত, প্রায় নিঃশব্দে কপাট ঠেলে ছায়ার মতো মানুষটা ঘরে পা রাখল। বাতিহীন ঘরে জমাটবাঁধা আঁধার হয়ে স্থির বসে রইল চৌকির এক কোণে। বালিশের তলে একটা ম্যাচ রাখে রোকসানা। হাতড়ে সেটাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ঘরের বাইরে তখনও দু’একজন মানুষের নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। সাহস হচ্ছিল না গলা তুলে একটু আলোর কথা বলতে বা নিজেই উঠে গিয়ে নিয়ে আসতে। অন্ধকার ঘরে অচেনা অদেখা ছায়ামূর্তির পাশে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে হাঁপ ধরে গিয়েছিল তার।

কিছু সময় পর খুকখুক করে কেশে উঠল ছায়াটা। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই সরে এল কাছে এবং রোকসানাকে টেনে নিল নিজের ভেতর। রোকসানাও বাধা দেবার চেষ্টা করেনি। এমনকি টুঁ শব্দটিও করেনি। প্রথমে অস্বস্তি তারপর ডুব দিয়েছিল আঁধার কালো জলে। দীর্ঘদিন খরার পর মাটি যেমন বর্ষার অপেক্ষায় থাকে, তেমনি রোকসানাও বুঝি আকুল হয়ে ছিল। চৈত্রের ফাটা ভুঁইয়ের মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুষে নিয়েছিল ঘোলা জলের ধারা। অবগাহনের পর স্যাঁতসেঁতে ভেঁজা শরীর নিয়ে রোকসানা পড়েছিল চুপচাপ, পাশে ছায়াটাও।  মানুষটা নিশ্চয় বোবা কালা না? রোকসানার সঙ্গে কোনো কথা নাই তার! রোকসানারও স্বর ফুটছিল না লজ্জায়। 

কিছুক্ষণ পরই নিঃশব্দে উঠে বসল মানুষটা। যেমন ছায়ার মতো এসেছিল, তেমনি উঠে গিয়ে দরজা খুলল। চৌকাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল একবার। আকাশের আবছা আলোর নিচে বেঁটেখাটো ছায়ামূর্তিটির ইতস্তত দাঁড়ানো দেখে রোকসানা ভাবল, বাইরে যাওয়ার দরকার আছে কি না হয়ত জিজ্ঞেস করবে তাকে। তার বদলে হঠাৎই দরজার ওপাশ থেকে তিরের ফলা ছুটে এল রোকসানাকে লক্ষ্য করে। পরপর তিনটে। তালাক, তালাক তালাক! চমকে উঠে বসল রোকসানা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উঠোনের কাঁঠাল গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল চলন্ত ছায়াটা।

নিজে পছন্দ করে কলমা পড়ে বিয়ে করে কী কারণে বিয়ের রাতেই মানুষটা তাকে তালাক দিতে পারে! রোকসানা কী কোনো দোষ করেছে? না তার শরীরে কোনো খুঁত পেয়েছে মানুষটা? এ কেমন ঠাট্টা তার সঙ্গে!  বিমূঢ় রোকসানা কিছুতেই তার জন্য তৈরি করা আল্লাহপাকের এই জটিল অঙ্কজট ছাড়াতে পারছিল না।

চৌদ্দ বছর বয়সে তার প্রথম বিয়ে হলো।  সংসারের কাজেকর্মে লক্ষ্মী রোকসানাকে না দেখেই মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছিল ফরিদ মিয়া। বাসর রাতে বউয়ের আন্ধার মুখ দেখে সেই যে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিল, তারপর রাতে শুতেও আসত না লোকটা। শাশুড়ি তাবিজ-কবজ করে ঘরমুখী করেছিল ছেলেকে। কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠার আগেই পরপর দুইবার গর্ভপাত হয়ে গেল রোকসানার। ঘরের সামনের প্রিয় সবরি গাছটার মতোই বৈশাখের সামান্য বাতাসে ভেঙে পড়েছিল কেবল বাড়ন্ত শরীরটা। রোকসানার অনেক চেষ্টায়ও বাঁচেনি সবরি গাছটা । রোকসানা উঠে দাঁড়িয়েছিল নিজের খেয়ালে, স্বামী-সংসার নিয়ে বেঁচে থাকার আশায়। কিন্তু স্বামী ফরিদ মিয়া আর মুখ ফিরে চায়নি। 

রোকসানা চোখের জল ফেললে শাশুড়ি বলত, ‘মাইয়া মাইনষের চোক্ষের পানিতে সংসার ভাইসা যায়! সংসারে কতকিছুই সইয্য করতে অয়। সময়ে সব ঠিক হয়া যায়।’ কিন্তু সময়ে কিছুই ঠিক হয়নি – না রোকসানার শরীর, না ফরিদ মিয়ার উচাটন মন। উঠোনের রোদে ধান শুকোতে শুকোতে রোকসানার শরীর দিন দিন আমাবশ্যার আকাশ হয়ে উঠল। ফরিদ মিয়াও হয়ে উঠল অমাবশ্যার চাঁদ। বাড়িঘর ছেড়ে দিল মানুষটা। দুই মাস দশ দিন পর হঠাৎই একদিন ফিরে এল। রোকসানাকে ঘর থেকে টেনে বের করে ঠা-ঠা রোদে দাঁড় করিয়ে বলল, তালাক! তালাক! তালাক!   

সেইবার তালাকের পর, রাতের পর রাত নোনা জলে কোল ভিজিয়েছে রোকসানা। সেই এগারো মাসের সংসারের মায়া তার এখনো কাটেনি বলা চলে। এতগুলো বছর ধরে, ঘরের পেছনের ঐ শ্যাওলা ঢাকা ডোবার মতো আড়াল করে রেখেছে নিজেকে। সেই ডোবার জলে কখনো কারও ছায়া পড়েনি? পড়েছে! সেই ছায়া সে নিজে ঘেটে দিয়েছে কঠিন সংকল্পে। নানা বয়সি পুরুষলোকের নানা রকম আকার ইঙ্গিত, ভালোবাসার আহ্বানে ভুলেও মুখ তুলে চায়নি। এর মধ্যে চোখমুখ গুঁজে স্কুল পাস দিয়েছে। ব্রাক স্কুলে দু’ঘণ্টা বাচ্চা পড়িয়ে সামান্য উপার্জনের ব্যবস্থা করেছে। যার ‍পুরোটাই খোরাকি বাবদ মিয়াভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। সংসারে বলদের মতো খেটেছে। সন্ধ্যা নামলে বইখাতায় ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে নিজেকে। সামনের পরীক্ষাটা শেষ করতে পারলেই জীবনের এক নতুন বাঁকে গিয়ে দাঁড়ানোর আশায় দিন গুনছিল সে!  

 কিন্তু এর মাঝেই অচেনা এক আঁধারপাকে পা হড়কে গেল তার। মিয়াভাই ফের বিয়ে ঠিক করল তার। বলল, ভালো ছেলে, বিএ পাস। এনজিওতে চাকরি করে। রোকসানাকে কলেজ যাওয়ার পথে দেখে পছন্দ হয়েছে তার। রোকসানা দ্যাখেনি তাকে। বিয়ের আগে বা তালাকের পরেও! গতরাতে, পুরোনো সেই শব্দবাণে নতুন করে বিদ্ধ হওয়ার পর একফোঁটা জলও জমেনি তার মেঘকালো চোখের কোণে। তালাক শব্দটার মানেই যেন সে বুঝতে পারছিল না। রাতের সেই অন্ধকার পর্দাটা গায়ে জড়িয়েই সারাদিন পড়েছিল বিছানায়। শরীরের খাঁজে খাঁজে সেই অচেনা শরীরের গন্ধ আর মস্তিষ্কে ঘোর নিয়ে সারাদিন আঁকুপাঁকু ভেবেও কূল কিনারা করতে পারল না, কোন অন্ধকার ডোবায় ডুব দিয়েছে সে!

 সন্ধ্যার আগে আগে দরজায় টোকা পড়ল । ছোটভাবি গোসল করে চারটে খেয়ে নিতে বলল তাকে। রোকসানার খিদে পেয়েছিল। পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি পাক দিতে শুরু করেছিল। সাবান দিয়ে ভালো করে শরীর ডলে ডুব দিয়ে এসে পাকের ঘরের কোণায় চুপচাপ বসে পড়েছিল ভাতের থালা নিয়ে। কার কাছে কী জিজ্ঞেস করবে, কী দিয়ে কথা পাড়বে বুঝতে পারছিল না। আসলে মাথায় গুছিয়ে কোনো ভাবনাই আসছিল না । মাথা জুড়ে, শরীর জুড়ে শুধু সেই ছায়ান্ধকার তৃপ্তির অবসাদ। দুই ভাবি চুলায় পাক বসিয়ে আকারে ইঙ্গিতে কথা কইছিল। চুলার ওপর ঢাকনা দেওয়া হাড়ি থেকে রোকসানার পালা মুরগির ঝোলের ধোঁয়া উঠছিল! সেই ধোঁয়ার আঁচে রোকসানার মগজের জমাটবাঁধা হিমহিম ধোঁয়াশা একটু একটু করে গলতে শুরু করল।  

ফরিদ মিয়া রোকসানাকে আবার ঘরে তুলতে চায়। তার ভরা পূর্ণিমার মতো বউ কারও সাথে ভেগে গেছে গত ইদুল ফিতরের চান্দের রাতে। তিন বছরের কোলের মেয়েটাকে ফেলে। গাঁয়ের মানুষ বলাবলি করে, রোকসানার অভিশাপেই নাকি ফরিদ মিয়ার সংসার পুড়েছে। রোকসানা অনেক ভেবে দেখেছে, মনে মনেও কোনোদিন সে অভিশাপ দেয়নি কাউকে। তবে, তার কলিজা পোড়া আগুনের শ্বাস বাতাসে উড়ে গিয়ে ফরিদ মিয়ার ঘরে গিয়ে লেগেছে কি না তা সে জানে না! বউ ভেগে যাওয়ার পর অনেকবার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে লোকটা। রোকসানা মাথা পাতেনি। তাই রোকসানার দুই ভাইয়ের হাতে দেনমোহরের পঞ্চাশ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে শরীয়া মোতাবেক তালাক দেওয়া বউ ঘরে তোলার আয়োজন করেছে সে। গত রাতের হিল্লা বিয়ের নওশা তারই জোগাড় করা! 

এখন রোকসানা কী করবে? ফরিদ মিয়ার নতুন বউ হয়ে তার ঘরে যাবে, না পালিয়ে যাবে? কার কাছে যাবে! দুই দুই বার তালাকপ্রাপ্তা মেয়েকে ঘরে জায়গা দেবে কোন আত্মার আত্মীয়! রেললাইনে মাথা দিয়ে মরবে? কেন মরবে! কী অপরাধ করেছে সে! খোদার দেওয়া জীবনের কতখানিই বা দেখা হয়েছে তার! দুই চোখের সামনে চারপাশের মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ কতকিছু ঘটে চলেছে! এতসব সরল-গরলের মাঝে বেঁচেবর্তে থাকাইতো জীবন। ও’পাড়ার মরিয়ম গত বছর ফাঁস নিয়ে মরল। এতদিনে তার হাড়গোড় মাটিতে মিশে গেছে নিশ্চয়! যার জন্য মরল সে তো দিব্যি সুখে বেঁচে আছে!

এই যে, রোকসানা রাত শেষে ভোর হলে নতুন আলো গায়ে মেখে পালানে গিয়ে দাঁড়ায়, মাটি-কাদা নিয়ে খ্যালে, কালো বোর্ডে আঁকিবুঁকি করে বাচ্চাগুলোকে পড়ায়, দিনভর সংসারের কাজের পর পুকুরে সাঁতরে গোসল করে, সন্ধ্যায় গুনগুনিয়ে পড়া মুখস্ত করতে করতে ঘুমে ঢলে পড়ে, নিত্য নতুন স্বপ্ন দ্যাখে! মরে গেলেইতো সব শেষ! 

তাই রোকসানা বেঁচে থাকে। পুরোনো স্বামীর ঘরে নতুন বউ সেজে বিছানায় বসে থাকে চুপচাপ । বিছানাটা আগের চেয়ে নরম হয়েছে । পুরানো পাতলা তোষকের ওপর নতুন তোষক পড়েছে। জানালার ওপর রঙিন পর্দা ফ্যানের বাতাসে দুলছে। বাহারি ফুলের বাগান, সবুজ বন-বনানী আর মক্কা শরীফের ছবিতে ঢাকা পড়েছে  জং ধরা টিনের দেয়াল। সাজানো গোছানো শোকেস দেখে বোঝা যায় ফরিদ মিয়ার শখের বউটা ভারি শৌখিন ছিল । সে শখ পুরোপুরি মেটানোর তাকদ বুঝি দুর্বল পুরুষ ফরিদ মিয়ার ছিল না। তাইতো চাঁদের মতো মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সে রোকসানার কাছে আসে।  তার লাল কুঁচির ভাঁজে মেয়েটাকে বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই ন্যাও তোমার মাইয়া, চাঁদনি।’ 

‘এইটা তোমার নতুন আম্মা!’ বাপের কথায় ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটা নতুন আম্মাকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দ্যাখে, গুনগুনিয়ে কাঁদে। রোকসানা তাকে কোলে জড়িয়ে নিয়ে আদর করে, ‘আসো আম্মা, তোমারে পরির দেশের গল্প বলব। সেখানে পরিরা নাচে-গায়, পড়ে-লেখে আর হাসে। কক্ষনো কাঁদে না।’ গল্প বলতে বলতে তার নতুন মেয়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে যায় ক্লান্ত রোকসানা। ও’পাশে নতুন পাঞ্জাবি পরা পুরোনো নওশা। 

‘বউ, চাঁদনিরে কিনারে দিয়া এই পাশে আইসা শোও!’ ভোর রাতের দিকে চাপা স্বরের ডাকে রোকসানা চমকে ওঠে। কোথায় শুয়ে আছে হুট করে বুঝে উঠতে পারে না। চাঁদনিকে ডিঙিয়ে তার মুখের ওপর ফরিদ মিয়ার আদরভরা মুখ, নিজের পরনের লাল শাড়ি, বুক ঘেঁষে শোয়া শিশুটিকে দেখে তার হুঁশ ফেরে। উঠে বসে কাপড় ঠিক করে। ঘরের চারদিকে চোখ বুলায়।

এই তার ঘর। এই ঘর-সংসার নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার! সুগন্ধী তেলে চুল বেঁধে, পাউডার মেখে রাতের পর রাত অপেক্ষায় জেগেছে সে। মানুষটা ফেরেনি তার কাছে। আজ সেই পুরুষ তার চুলে বিলি কেটে তাকে ডাকছে! বিছানা থেকে নেমে ঘুরে ফরিদ মিয়ার দিকে এগিয়ে যায় রোকসানা। বুকটা দুরু দুরু করে। গতরাত থেকে উথাল পাথাল করতে থাকা মনটা সামাল দিয়ে সে স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার কাঙাল চোখে চোখ রাখে স্থির। উষ্ণ আহ্বান নিয়ে রোকসানার হাত ধরে ফরিদ মিয়া, ‘মাফ কইরা দিও আমারে’।

‘মাফ কইরা দিলাম,’ আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নেয় রোকসানা। দুই পা সরে আসে। 

‘তালাক! তালাক! তালাক!’ থেমে থেমে শব্দ তিনটি পরিস্কার উচ্চারণ করে ফরিদ মিয়ার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে দরজা খোলে রোকসানা। শান্ত পায়ে পার হয়ে আসে ঘরের চৌকাঠ। ঠাস করে খিল খোলার শব্দে মেয়েটা কেঁদে ওঠে, আম্মা… 

রোকসানা একবার পেছন ফিরে তাকায়। কিছু একটা ভাবে।  তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবছা অন্ধকারে দ্রুত পা চালায়। সূর্য ওঠেনি তখনো। লাল গোলাপি রঙে রাঙা হয়ে আছে সবুজ খেতের ওপারের আকাশ। আলপথ ধরে হেঁটে গেলে তাদের বাড়ি ঘণ্টা খানেকের পথ। সেখানে সাতসকালে তার অপেক্ষায় বসে থাকবে অনেকগুলো চাঁদপানা মুখ। যে মুখগুলোতে অসময়ে গ্রহণ লাগতে দেবে না রোকসানা। প্রয়োজনে এই পৃথিবী নামক গ্রহটার সামনে আড় হয়ে দাঁড়াবে সে।

ছোটগল্প : গ্রহণলাগা চাঁদের সাধ | গল্পকার : সায়মা ইসলাম | আলোচক : শিল্পী নাজনীন

গল্পটি সায়মা ইসলামের সরল চালে লেখা একটি প্রতিবাদী গল্প। সামাজিক-পারিবারিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ানো আটপৌরে এক নারীর গল্প। নিতান্তই সাধারণ, সাদামাটা মেয়ে রোকসানার গল্প। আমাদের সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি, আমাদের চিরচেনা এক মেয়ে রোকসানা। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোটার আগেই যারা বলি হয় বিয়ে নামক এক সামাজিক দায়বদ্ধতার বেদীতে।

ভাইয়ের সংসারে অনাদরে বেড়ে ওঠা রোকসানাও তার চৌদ্দ বছর বয়সেই বউ হয়ে যায় ফরিদ মিয়ার সংসারে। কালো বলে সেখানে তার ভাগ্যে জোটে অনাদর আর অপমান। শাশুড়ি তাকে পছন্দ করে ঘরে তুললেও বরের অপছন্দকে রোকসানা এড়াতে পারে না, এড়াতে পারে না নিজের দুর্ভাগ্যকেও। কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠার আগেই দু দুবার গর্ভপাতের অপরাধ এবং সংসারের কাছে অষ্টপ্রহর লেগে থাকায় তার গায়ের কৃষ্ণবর্ণ আরো কৃষ্ণকায় হওয়ার অপরাধে বর ফরিদ মিয়া তালাক দেয় রোকসানাকে। আবার তার ঠাঁই হয় ভাইদের সংসারে। সেখানে সে শ্রম দেয়, থাকে, খায়। বরের সঙ্গে এগারো মাসের সংসারে সুখস্মৃতি আঁকড়ে দিন যায় তার। এর মধ্যেই তার দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন হয় চুপিসারে। রোকসানা আমাদের এই সমাজের সেই বোবা নারীর প্রতিনিধি হয়ে ওঠে যাদের নিজেদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই, যাদের মতামত নেওয়ার ভাবনাটাই অবান্তর। রোকসানা রাতের অন্ধকারে ঘটে যাওয়া বিয়ে নামক নাটকটা নির্বিবাদে মেনে নেয়, নিজেকে প্রস্তুত করে নতুন সংসারের স্বপ্নে।

বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে রাত্রির ঘোর অন্ধকারে নতুন বরের মুখটা অদেখা থাকলেও তার বহুদিনের তৃষ্ণার্ত শরীর বরের আদরটুকু শুষে নেয় আশ্লেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে চায়। কিন্তু তার আগেই তার কানে তীরের ফলার মতো এসে বেঁধে পরিচিত তিনটি শব্দ – তালাক! তালাক! তালাক!

রোকসানা বোঝে না তার অপরাধ, জানে না তার অপারগতা। পরদিন অবসন্ন, বিপর্যস্ত, ক্লান্ত শরীর-মনের ঝিমুনির মাঝেই রোকসানা শোনে তার তৃতীয় বিয়ের খবর। পরদিন আবার বিয়ের আয়োজন চলে তার। তার বড় ভাবি জয়নব ঠাট্টা করে বলে, ‘মাগির বরাত আছে! এই আন্ধার শইলে তিন তিনবার বিয়ার চাঁন উঠল!’ 

অবশেষে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় রোকসানার কাছে। তার আগের বর ফরিদ মিয়ার দ্বিতীয়বার বিয়ে করা বউ ছোট মেয়ে রেখে পালিয়ে গেছে আরেকজনের হাত ধরে। তাই সে আবার রোকসানাকে বিয়ে করার জন্য আগের রাতে হিল্লা বিয়ের নাটক সাজিয়েছিল, যাকে সত্যি বিয়ে ভেবে নিয়েছিল রোকসানা।

ফরিদ মিয়া এবার নিজের মেয়েকে তুলে দেয় রোকসানার কোলে, নিজেও সমর্পিত হয় রোকসানার কাছে। রোকসানা ফরিদ মিয়ার মেয়েকে আদর করে, ফরিদ মিয়ার সমর্পণে প্রীত হয়। গল্পের এ পর্যন্ত খুব সাদামাটা, নির্বিরোধী, নির্বিবাদী এক মেয়ে রোকসানার গল্প। কিন্তু এর পরের অংশটুকু পাঠককে চমকে দেয়, মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায় পাঠকের মনে।

গল্পের এই অংশে এসে জানা যায় রোকসানা এতদিন নেহাত ভাইদের সংসারে কলুর বলদ হয়ে সময় কাটায়নি, সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করেছে, এসএসসি পাস করে গ্রামে ব্রাক পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছে। গল্পের এই অংশে এসে পাঠক এক প্রতিবাদী, দ্রোহী রোকসানাকে আবিষ্কার করে। যে ফরিদ মিয়ার নতজানু সমর্পণকে উপেক্ষা করে তার আকুল আহ্বানকে পায়ে মাড়িয়ে তাকে তালাক দিয়ে ভোর রাতের অন্ধকারেই নিজের গাঁয়ের উদ্দেশে যাত্রা করে, যেখানে তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে একপাল অবোধ শিশু, যাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার দায়িত্ব নিয়েছে রোকসানা।

আখ্যানের শেষে এসে রোকসানার এই ঘুরে দাঁড়ানো পাঠককে চমকে দেওয়ার পাশাপাশি আনন্দও দেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে কষে এক চপটাঘাত করার মোক্ষম সুযোগটি সচেতন পাঠক লুফে নেবে, বলা যায। 

গল্পটির বিষয় নির্বাচন, ভাষাভঙ্গী ও বয়নকৌশল প্রশংসার দাবীদার। লেখক সায়মা ইসলামের জন্য অশেষ ভালোবাসা। 

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field