বিশেষ সংখ্যা কথাসাহিত্য ছোটগল্প

রাষ্ট্র | হামীম ফারুক | ছোটগল্প | গণঅভ্যুত্থান সংখ্যা

গণঅভ্যুত্থান সংখ্যা

অনেক্ষণ ধরেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল বারান্দা থেকে। ধোঁয়ার উৎস কোথায়, দূরে এই আবাসিক এলাকা থেকে ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না। তবে বহুমানুষের চিৎকার এবং দ্রিমদ্রিম শব্দ বাতাসে ভেসে আসছিল। নেটফ্লিক্সে ওয়ারমুভির ভক্ত তিনি। অবচেতনে তেমনই একটি মুভির দৃশ্যের কথা কল্পনা করছিলেন। কিন্তু বাইরে, মেইনরোডের ওপর কী ঘটছে সেটি কল্পনা করে উদ্বিগ্নবোধ করেন তিনি। একবার মনে হয়, বেরিয়ে, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আসবেন।
তার বাসাটি মেইনরোড থেকে বেশ ভেতরের দিকে। অন্ধ গলিতে। ফলে বিকেল হলেই বাসার নিচে গলির রাস্তায় মহল্লার ছেলেপুলেরা নিশ্চিন্তে ক্রিকেট খেলে। কিন্তু গত ক’দিন ধরে সারা শহর জুড়ে যা হচ্ছে, তাতে যেন সবাই বাসার ভেতর সেঁধে গিয়েছে। তার বাসার উল্টোদিকে ট্যানারি ব্যবসায়ী হালিম সাহেবের বাসা। তার টাকাপয়সা বিস্তর। তাতে কী। বাড়তি আরও কিছু আয় হবে ভেবে বাসার নিচে আবার ছোট ছোট দুটো ঘর করেছেন। একটি ঘর ভাড়া দিয়েছেন এক ভাঙ্গারিওলাকে।
অপরটিতে গ্রোসারি শপ। গ্রোসারি না হয় মানা গেল, কিন্তু এর সাথে ভাঙ্গারিওলা! কোনোভাবে যায়। যাহোক বাড়ি তার তিনি যা খুশি করবেন, যাকে খুশি ভাড়া দেবেন, সেটি তার ব্যাপার। কিন্তু ভাঙ্গারিওলা দুনিয়ার পুরনো খবরের কাগজ, ভাঙা বাসনকোশন, চেয়ারটেবিল, নষ্ট ইলেকট্রনিক জিনিস এনে রাস্তার ওপর বিছিয়ে মহাসুখে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু গাড়িটারি কম ঢোকে এই গলিতে, ফলে পুরো রাস্তা দখল করে ফেলেছে তিনি।
বিরক্ত হলেও আবিদুর রহমান এসব নিয়ে কথা বলতে চান না। কী দরকার, ফালতু লোকজনের সাথে অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে। আসলে কাউকে ধমক দিয়ে চোখ রাঙিয়ে কথা বলার ধাতই তার নেই। নিজকে সবসময়ই একটি নিরুপদ্রব বলয়ের ভেতরে রাখতেই তিনি পছন্দ করেন। কিন্তু কদিন হলো, ভাঙ্গারির দোকানটি খুলছে না। মাঝে একদিন গ্রোসারি খুললেও, সেটিও গতকাল থেকে বন্ধ।
বাসার সামনে ছোটো এই চারতলার বারান্দা থেকে সেটিই খেয়াল করছিলেন আবিদুর রহমান। দোকানদুটো বন্ধ থাকায় গলিটি একেবারে নীরব হয়ে গেছে। উল্টোদিকের আরেকটি বাসা। তার নিচে গেটে ঢুকতেই একটি বসার মতো জায়গা রয়েছে। সেখানেই সেই বাড়ির দারোয়ান ইদ্রিস বসে থাকে। আর তাকে ঘিরে থাকে অন্যান্য বাড়ির দারোয়ান-কেয়াটেকাররা। পরিস্থিতির কারণে তাদের নিয়মিত আড্ডাও আর বসছে না।
ভর দুপুরেও গলির ভেতরে যেন ভোরের নির্জনতা। দূরে, মেইনরোডে কোনো মিছিল যাচ্ছে। বহুকণ্ঠের শ্লোগান বারুদের গন্ধের মতো ভেতরে এই নির্জন গলিতেও যেন আছড়ে পড়তে থাকে। একটি ম্যাচকাঠি কেউ জ্বালালে এখনি আগুন ধরে যাবে বাতাসে।
এই গোলযোগে ঘরে বসে থাকতেও স্বস্তি হচ্ছে না। আবার বাইরে বেরিয়ে কী হচ্ছে তা দেখতেও শংকাবোধ হচ্ছে। ছাত্ররা আন্দোলন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা বেরিয়ে এসেছে ক্লাশ থেকে। এমনকি স্কুল কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও এখন রাস্তায়। একসাথে শ্লোগান দিচ্ছে। আবিদুর রহমান নিজেও ভেতরে ভেতরে উত্তেজনাবোধ করছেন ক’দিন ধরে। মন চাইছে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। ছাত্রাবস্থায় তিনি নিজেও একসময় মিছিলে গিয়েছেন। পুলিশের গুলি খেতে খেতে একবার কোনোমতে বেঁচেও ফিরেছেন। তবে সেটি ছিল সামরিক শাসনের সময়। কিন্তু এখন তার শরীর চলে না। রিটায়ার করার পর থেকে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

আবিদুর রহমান এতক্ষণ বারান্দায় ছিলেন। বাইরে রোদ। বারান্দায় অনেকটাই তাপ। শরীরে লাগছে এখন। বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে যান। ছেলে কোথায় একটু দেখতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি নিয়ে পড়ছে। এটাই শেষ সেমিস্টার। ক্লাস শুরু হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল ইউনিভার্সিটি। গত কয়েক সেমিস্টারে ভাল ফল হয়নি। সিজিপিএ নেমে গিয়েছে। তাই এবার দিনরাত পড়ে, নিয়মিত ল্যাব করে শেষ চেষ্টা করছিল সে। এখন পরিস্থিতি আরও অনিাশ্চত হয়ে গেল। অনলাইনে ক্লাস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীই আন্দোলনে এখন বাইরে। তাই অনলাইন ক্লাসও বাতিল হয়ে গেছে। শুরুর দিকে আবিদুর রহমানের শংকা ছিল ছেলেকে নিয়ে। তবে ছেলেকে বাইরে যেতে না দেখে ভেতরে ভেতরে কিছুটা স্বস্তিবোধও করে। কিন্তু প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়ে আর টিভির নিউজে রোদে পোড়া, ঘর্মাক্ত, প্রতিবাদী ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে তার কষ্ট হয়।
সবকিছু নিয়ে কিছুটা বিরক্তি রয়েছে তার। এরা লেখাপড়া করবে নাকি আন্দোলনই করবে, এরকমই একটা প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এদের কচিমাথাগুলো কেউ আবার পেছন থেকে বিগড়ে দিচ্ছে নাতো। আর তাদের দাবি মেনে নিতেও বা কেন এতো দেরি হচ্ছে ভেবে একধরনের চাপা অস্বস্তিও মনের ভেতর কাজ করছে। মুশকিল হলো, গতকাল থেকে নেট খুব ধীরগতিতে চলছে। ফলে এতদিন যাও কিছুটা পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখতে পারতেন, এখন সেটিও পারছেন না। ছেলেপুলেরা ফেসবুক ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার করে আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালছে, এরকমই একটা ধারণা তার। সেকারণেই নাকি নেট এই ধীরগতি করে দেওয়া হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা।
ছেলের ঘরের দরজা বন্ধ। পড়াশোনায় ব্যাঘাত যাতে না হয় ঘরের দরোজা সবসময় বন্ধই রাখে সে। নক করতেই দরোজা খুলে দিল। ছেলের চুল উশকোখুশকো। চোখ লাল। সারা রাত জেগে পড়াশোনা করে, আর দিনে ঘুমায়। এই এক অভ্যেস হয়েছে এখনকার ছেলেপেলেদের। বিষয়টি আবিদুর রহমানের একেবারেই পছন্দ নয়। ছেলেকে বারবার বলেও কিছু হয়নি। বাপের কথা দুএকবার শুনে আবারো একই অভ্যেসে ফিরে গেছে। এখন বিরক্ত হলেও আর কিছু বলেন না।
’ঘুমোচ্ছিলে?’ জিজ্ঞেস করেন ছেলেকে।
’না, কিছু বলবে?’
ছেলে উত্তর এড়িয়ে গেছে বুঝতে পারলেন। ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর খুব একটা বাইরেও যায়না সে। দুটো টিউশনি করে। দুটোই সন্ধ্যার পর। এছাড়াও মহল্লার কুকুরগুলোকে সে নিয়মিত খাবার দেয়। মধ্যরাতে সেগুলোকে খাবার দেওয়া সেরে বাসায় ফিরে নিজে খেয়ে ঘরে ঢুকে যায়। এই আন্দোলনে ছেলে নিজেকে জড়িয়েছে কিনা, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। তেমন একটা বন্ধুবান্ধবও নেই তার। তার যত ব্যস্ততা নিজের পড়াশুনো আর পথকুকুরের দেখভাল করে।
আসলে রাস্তার এ কুকুরগুলোকে তার স্ত্রীই দেখাশোনা করতেন। বছর দুয়েক আগে জরায়ুর ক্যান্সারে স্ত্রী মারা যান। তখন কুকুরগুলোকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন আবিদুর রহমান। একদিন দেখতে পেল রান্নাঘরে ছেলে। বড় ডেগচিতে ভাত সেদ্ধ করছে। সাথে মুরগির পা, মাথা। কুকুরের খাবারের জন্য তার স্ত্রীই এই খাবার বাসায় তৈরি করতেন। ছেলেই এ দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল। এতে মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন তিনি।
তবে ছেলে আন্দোলনে জড়িয়ে যাক মন থেকে তেমন সায় পাচ্ছেন না তিনি। কী হবে এসব আন্দোলন করে, জীবনে কম তো দেখলেন না। যারা মারা যায়, তাদের সব যায়। আর হালুয়া খায় সব অপগণ্ডের দল। ছেলের ক্লাস বন্ধ হওয়ার পর থেকে তাই একটা ভয় তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। যেভাবে আন্দোলন দমন করা হচ্ছে, যদি তার ছেলেও হারিয়ে যায় অনেকের মতো। স্ত্রী মারা যাওয়া পর আবিদুর রহমান মানসিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাই ছেলেকে নিয়ে তার এথন চিন্তা বেশি।
ছেলে দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে হয়। বললেন, ‘না, তুমি বেরিয়েছ কিনা দেখতে এলাম। বাইরে তো মনে হয় খুবই খারাপ অবস্থা।’
ছেলে নিরুত্তর থাকে।

২.
এই প্রজন্মকে ঠিক বুঝতে পারেন না আবিদুর রহমান। এদেরকে সবসময়ই মনে হয়েছে এরা শেকড়হীন এবং ভীষণরকম আত্মকেন্দ্রিক। কখনো কখনো মনে হয়েছে, এদের নিজ দেশের প্রতি কমিটমেন্টেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একদিন ছেলে কথায় কথায় বলছিল সে কোনো ধরনের জাতীয়তাবোধে বিশ্বাস করে না। দেশপ্রেম কথাটি তার কাছে অনেকটাই আপেক্ষিক। এই বোধ মানুষকে শুধু নিজ জাতির প্রতি একধরনের অন্ধ আনুগত্য তৈরি করতে প্ররোচিত করে। নিজের দেশ বা জাতি ছাড়া অন্য কোনো দেশ বা জাতির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি করে না। পুরো ন্যারেটিভে মানুষ গৌণ হয়ে যায়, জাতি মুখ্য হয়ে ওঠে। পুথিবী জুড়ে এতো যুদ্ধের পেছনে নাকি এই কট্টর জাতীয়তাবোধই দায়ী।
ছেলের কথা শুনে সেদিন একটু থমকে গিয়েছিলেন তিনি। এই ছেলের আর কত বয়স? এই বয়সে এসব চিন্তা করা কিভাবে শিখল সে? ছেলের সাথে তার নিজের তেমন যোগাযোগ ছিল না, যতটা ছিল তার মায়ের সাথে। হ্যাঁ, ছেলেকে সারাদিন ল্যাপটপ বা মোবাইলেই উপুড় হয়ে থাকতে দেখেছেন। আর ভ্রূ কুঁচকিয়েছেন।
গত ক’দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। নেট এখন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাসার ডিশ কানেকশনওলাদের বছরের শুরুতেই না করে দিয়েছিলেন। একেতো চ্যানেলের সংখ্যা কম, তাও আবার প্রতিটি চ্যানেলই ঝিরঝির করে। কমপ্লেন দিয়েও কাজ হতো না। অথচ মাস গেলেই সাড়েচারশ’ টাকা নেওয়ার জন্য দাড়িঁয়ে থাকত। ডিশের লাইন কেটে দেওয়ার পর টিভির খবরটবর তাই নেটেই দেখতেন।
এখন খবর দেখতে হলে হয় নিচে দোতলার ভাড়াটের বাসায় গিয়ে দেখেন। আর একে ওকে ফোন করে খবর নেন যতটুকু সম্ভব। এ এক দমবন্ধ পরিস্থিতি। বাইরে গুলি চলছে। সমানতালে চলছে মিছিল। কে একজন বলল আন্দোলন থামাতে হেলিকপ্টার থেকেও নাকি গুলি চালানো হচ্ছে। আবিদুর রহমানের বাসার ওপর দিয়ে অবশ্য দুএকটা হেলিকপ্টার গিয়েছে। তবে এরকম হেলিকপ্টার মাঝে মাঝেই যায়, তেমনটিই ভেবেছিলেন তিনি।

খবরের কাগজের হকার ছেলেটিও কদিন ধরে আসছে না। অন্যসময় হলে রাগ করতেন। কিন্তু ছেলেটি এখন কেন আসছে না ভেবে উদ্বিগ্নবোধ করেন।

দুপুর গড়াতেই আরও কিছু খারাপ খবর পাওয়া গেল। পাশের বাড়ির ছেলেটি নাকি গতকাল বাসায় ফেরেনি। আজ গুলিবিদ্ধ লাশ নাকি পাওয়া গেছে যাত্রাবাড়িতে। গুলিতে নাকি বুকপিঠ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। বাসার নিচে হইচই শুনে দ্রুত বারান্দায় এসে দেখতে পেলেন ছেলেটির বাবা-মাকে। রাস্তা দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যাচ্ছে। ছেলেটিকে চিনতেন তিনি। কাছেই একটি কলেজে পড়ত। তারা নতুন এই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে এসেছে। বিকেলে হাঁটতে বেরোবার সময় ছেলেটির সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো। ব্যাকপ্যাক কাঁধে কলেজ থেকে ফিরছে। চোখাচোখি হলেই মিষ্টি করে একটু হাসি দিয়ে সালাম দিত, বলত, ‘আংকেল ভাল আছেন?’

আবিদুর রহমান বুকে একটু চাপবোধ করতে থাকেন। অস্থির লাগছে। ঘরের ভেতরে এসে ইনহেলার নেন। নিজ ছেলের ঘরের কাছে এসে দেখেন দরজা ছিটকিনি দেওয়া। বোধহয় বাইরে গেছে। এইসময় আবার সে বাইরে গেল কেন? অবচেতনেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন তিনি।
কিন্তু একটি নতুন প্রশ্ন আবারও তার ভেতর অস্বস্তি তৈরি করতে থাকে। দেশে সামরিক শাসনের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সরাসরি কোনো দলের রাজনীতি না করলেও সামরিক শাসন বিরোধী প্রায় সবগুলো মিছিলেই যেতেন। দুএকবার পুলিশের লাঠিচার্যের মধ্যেও পড়ে গিয়েছিলেন। সামরিক শাসনের অবসানের পর আশা করেছিলেন একটি মুক্ত, ভয়হীন পরিবেশের। কিন্তু কিছুদিনের মাথায় সেই স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে। তাই কোনো আন্দোলন আর তাকে আর এখন তেমনভাবে আকর্ষিত করে না।
কিন্তু এখন যা ঘটছে তাতেও তো স্থির থাকা যাচ্ছে না। একটি আপাতনিরীহ দাবি আদায়ের একটি আন্দোলন কিভাবে হঠাৎ এত সংক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল? আর তা দমনে রাষ্ট্রইবা এতো মারমুখি হয়ে উঠল কেন?
নিচ থেকে কেয়ারটেকার আনোয়ার উপরে উঠে এসেছে। সে জানে তার বাসায় টিভি নেই। হাঁপাচ্ছে সে। বলল, স্যার সন্ধ্যা ছয়টার থেকা কারফিউ দিছে। ছাত্রেরা সব রাস্তায়। কেউ নাকি কারফিউ মানব না।’
তোমাকে এত কথা কে বলল? পাল্টা জিজ্ঞেস করেন তিনি।
টিভিতে কইতাছে। সবাই কইতাছে। তয় ভাইয়ে কই?
ভাই মানে তার ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছে আনোয়ার।
ওতো বাসায় নেই।’ চিন্তিত গলায় বললেন তিনি।
কন কী স্যার। ভাই রে তো দুপুরবেলায় দেখছিলাম বাইরে যাইতে। এহনো ফেরে নাই?
ছেলে মাঝেমাঝে নিচে গিয়ে দোকান থেকে চিপসের প্যাকেট স্প্রাইট কিনতে বের হয়। কিন্তু বিকেল গড়িয়েছে। তারতো বাসায় চলে আসবার কথা এতক্ষণে।

৩.
আবিদুর রহমান নিজেই বাসা থেকে বের হন। যদিও আনোয়ার নিষেধ করেছিল তাকে। ঘরে বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। ছেলের মোবাইলে ফোন দিচ্ছেন। রিং হচ্ছে তবে ধরছে না। এটাও ছেলের বদভ্যাস। ফোন ধরে না। এদিকে তার প্রেশারের ওষুধ ফুরিয়েছে। প্রতিদিন রাতে দুধরনের প্রেশারের ওয়ুধ খেতে হয় তাকে। এতদিন অনলাইনেই অর্ডার দিয়ে ওষুধ আনাতেন। এখন নেট বন্ধ। আনোয়ারকে ওষুধের স্ট্রিপ দিয়ে পাঠাবে সেই উপায়ও নেই। স্ট্রিপগুলো ফেলে দিয়েছেন তিনি।
রাস্তায় নেমে হতবাক হয়ে গেলেন আবিদুর রহমান। মেইনরোডে শত শত মানুষ। অধিকাংশই তরুণ। তরুণীরাও রয়েছে। হাতে লাঠি। মাথায় দেশের পতাকার পট্টি। তাদের জটলায় লুঙ্গি পরা অনেক সাধারণ মানুষকেও দেখতে পেলেন তিনি। সবাই মিলে উপর্যপরি শ্লোগান দিচ্ছে। দূরে একটি নীলচে ভ্যান ওল্টানো। সেটি দাউদাউ করে জ্বলছে। সেই আগুনের আঁচ শরীরে এসে লাগছে। পুরো রাস্তা জুড়ে ভাঙা ইটের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রাস্তার ডিভাইডারগুলো উপড়ানো। লাঠি হাতে এক তরুণ পাশ দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, আংকেল বাসায় যান, বাসায় যান।’

আবিদুর রহমান ঘামতে থাকেন। হঠাৎ কাছেই প্রচণ্ড শব্দে কিছু একটা বিস্ফোরিত হল। একমুহূর্তের জন্য কানে তালা লেগে গেল তার। ফুটপাতের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। বোধহয় পড়েও গেলেন। কোনমতে ফুটপাতের কিনারা ধরে উঠে বসার চেষ্টা করলেন।

ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে বেরিয়ে আসছে দুএকজন তরুণ হামাগুড়ি দিয়ে, রক্তাক্ত শরীরে। তাদের মধ্যে নিজের ছেলেকেও আবিষ্কার করেন তিনি। তাদের পেছনে একটি সাঁজোয়া যান।
আকাশের দিকে চোখ যায় তার। ঝকঝকে নীলচে আকাশ, দুটো একটি সাদা মেঘের টুকরো। ভেসে যাওয়া মেঘের দিকেই শুধু তাকিয়ে রয়েছে। নিচে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে আকাশ কেমন নির্বিকার, নিঃশঙ্ক।
প্রত্যাশিত রাষ্ট্রের যে চেহারাকে তিনি এতদিন লালন করেছেন, সেটি যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ছে এখন তার চোখের সামনে।

ঢাকা
২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field