গদ্য বিশেষ সংখ্যা

ঈদ ঝিলমিল | সিরাজুল ইসলাম | স্মৃতিকথা

জানি যে সভ্যতা, নগর গড়ে উঠেছে সমুদ্র, নদী, খালের পাড় ধরে। এই নিয়ম মেনে বুড়িগঙ্গা থেকে নেমে আসা দোলাইখালের পার ধরে আমাদের বেগমগঞ্জ লেন, কোম্পানীগঞ্জ লেনের গোড়াপত্তন। ভাবি যে, সত্তর-পঁচাত্তর বছর পরে কানাডায় টাকা রাখার জায়গা করতে বেগমপাড়া গড়ে উঠবে কিন্তু তখনকার গরিবগুর্বো ঢাকা শহরে বেগমদের সামনে আনার দরকার পড়লো কেন? আবার এক ডালে দুটি পাতার মতো লাগালাগির বেগমগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে কোন কারণে কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল খালপাড়ের এই বড় জলাভূমিটি? পরে দেখেছি কোম্পানীগঞ্জের এই বড় চর অংশটি ব্যবহৃত হচ্ছে ধোপাদের ধোয়া কাপড় শুকাতে,আর অদ্ভুত যা মাঠ ভর্তি সারি সারি আলিবাবার গুহার মতো বড় বড় পিঁপে-পিঁপেতে ধনরত্নের পরিবর্তে গলা পর্যন্ত ভরা কাঁচা কদবেল – পিঁপের মুখ কাদামাটি দিয়ে বন্ধ। সেখানে রোদে পড়ে থেকে থেকে কদবেল পাকে। কদবেলের অত সমাদর কেন? আর সারা দেশের কদবেল কি ঐ চরে জমা হতো? খেলার ঝোঁকে ওই চরে গিয়ে উঠে পড়লে ভয় ভয় করত, ভৌতিক লাগতো। কে জানে কোম্পানির হাতে খুন হওয়া আত্মারা সেখানে ঘুরে বেড়ায় কি না?
আমার বাবা ১৯৪৯-৫০ সালে তিন কাঠার একটুকরা জায়গা কিনে ঘর তোলে এখানে, আমি দুই মাস বয়সে এসে উঠি। আমার স্থায়ী ঠিকানা। আমার এই খুঁটির কথা ভুলে থাকি। বিভিন্ন শুভ অশুভ সময়ে আমার পরিচয় ধরে টান পড়ে যখন এই ঠিকানাটা গভীর তল থেকে উঠে আসে। খাল ধরে ছোট চৌকোন ভূমি, জলাভূমি। পায়ের তলায় মাটি। পায়ে চলার পথ বা বাড়ির উঠোন বা ঘরের মেঝে – নরোম,আদি, সাদা মাটির। কত শত কাল ধরে জমা নদীর পলি। এই সীমানার শেষে সীমান্তের মতো ইট খোয়ার পৌরসভা নির্মিত সড়ক শরৎগুপ্ত রোড। দেখা যায়, ছোঁয়া যায় কিন্তু এই সীমান্ত অতিক্রম করা যায় না। অভিজাত শরৎগুপ্ত রোড বেগমগঞ্জ লেন থেকে নিজেকে চিরকাল আলাদা করে রাখে। বেগমগঞ্জের মানুষের সুযোগ হয় না শরৎগুপ্ত রোডে উঠে বসবাসের। সেখানে থাকে অন্য জেলা থেকে উঠে আসা মানুষেরা। দুই পৃথিবীর অধিবাসীদের কথাবার্তা, চালচলন, জীবিকা, মুখের ভাষা আলাদা।
ঢাকাইয়া আমি দুই, চার, ছয় বছর বেড়ে উঠছি, দেখছি – বেগমগঞ্জ, ঢাকাইয়া জগত।
বেগমগঞ্জের ভেতরে প্রথমে আমি পাই আমাদের থেকে আলাদা রংপুরের মানুষ – মুক্তা, মিনুর মা বাবা। হামিদ ডাক্তার আমাদেরও ডাক্তার ছিল। তবে হামিদ ডাক্তার – বেগমগঞ্জের না শরৎগুপ্ত রোডের। আমাদের অসুখ বিভাগ বাড়াবাড়ি না হয়ে গেলে হামিদ ডাক্তার পর্যন্ত পৌছাতাম না। পানি পড়া, তাবিজ, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি ওষুধই রোগ বালাইয়ের নিদান ছিল।
শরৎগুপ্ত রোডের একটা দোতলা বাড়ির নিচতলাটা ছিল হামিদ ডাক্তারের ডাক্তারখানা । তিনটা ঘর। একটা ঘরে ডাক্তার বসতো রোগী দেখতো, পর্দা টানা ছোট একটা অংশ ছিল প্রাইভেটলি রোগী দেখার। বড় ঘরটায় কাঠের আলমারি, ডাক্তার জিনিসপত্র, প্যাকেট – আরো অনেক কিছু, আমি চিনি না। পাশে চিলতে অংশটা রহমান কম্পাউন্ডারের। কম্পাউন্ডার কত কী গুলিয়ে কাচের পাত্রে গোলাপি রঙের তরল ওষুধ বানায়। কাঁচি দিয়ে ডিজাইন করে করে কাগজ কেটে বোতলের গায়ে সেঁটে দেয়, কোন বেলার ওষুধ কতটুকু খেতে হবে।
রহমান কম্পাউন্ডার হলো মুক্তা ও মিনুর বাবা। আমার বাবা ওষুধ কোম্পানির সাথে কাজ করত, সে কারণেই আমাদের দুই বাবাতে কি সদ্ভাব হয়েছিল?
আমাদের বেগমগঞ্জ, খুব বেশি হলে আমাদের ঢাকা শহরের বাইরে আর কোন জায়গা আছে – সেখানে কেউ বসবাস করে, তারাও মানুষ, এই হিসাব মোটামুটি আমরা ঢাকাইয়া লোকেরা গণ্য করতাম না। কোনভাবে সম্পর্কিতও হতাম না। মুক্তা, মিনুরা আমাদের বেগমগঞ্জের ভেতর বাড়ি নিয়েছে জানতে পারি।
ঈদের দিনটা কার কাছে কিভাবে আসে জানি না। আমি দেখেছি ঈদের দিনটা আমাকে অ্যাডভেঞ্চারাস কিছু করতে প্রলুদ্ধ করেছে। অল্প বয়সে আমার বেশি করে মনে পড়া ঈদের দিনটায় মুক্তা-মিনুদের বাড়িটা আমি খুঁজতে বেরিয়ে যাই। আন্দাজের উপর, কিছু তথ্য হয়তো মা-বাবার কথা থেকে কানে গিয়েছিল; মহল্লায় প্রায় নিজেরা নিজেদের বাড়িতে থাকত, ভাড়াটে বসানো তখনো তেমন শুরু হয়নি। ঈদের প্যান্ট শার্ট পড়ে পাঁচ ছয় বছরের আমি মোটামুটি সহজেই মুক্তা-মিনুদের ঘর আবিষ্কার করে ফেলি। বেড়ার টানা কয়েকটা ঘর তুলেছে একটা বড় বাড়ির ফেলে রাখা পেছনটায়, ছিল হয়তো সেখানে বড় বড় গাছপালা। মুক্তা-মিনুর মা আমাকে দেখে খুশি হয়। ওদের ছেলে সন্তান নেই বা ঢাকাইয়া কেউ আগ্রহ করে এই প্রথম তাদের ঘরে গেলাম। রংপুরের গাঁ-গ্রামের খোলামেলা ঘরবাড়ি ছেড়ে এই এক ঘরের সংসারে তারা মনে হয় তখনো এঁটে ওঠেনি।
মুক্তার মা সেমাই খেতে দেয় সুন্দর একটা ছোট বাটিতে। সেমাইয়ের চেহারা দেখে ও স্বাদে আমার জিভ জড়িয়ে আসে। আমার চেনা সেমাই থেকে একেবারে ভিন্ন। মায়ের হাতের বা খালা-চাচিদের রান্না একরকমের সেমাই খেয়ে এসেছি ঈদে জন্ম হওয়ার পর থেকে এতদিন।
কেন যেন মনে হল ওরা আমাদের থেকে আলাদা। আলাদা একটা কিছুর লোভেই যেন আমি এই বাড়ি খুঁজতে গেছি। কিছুক্ষণ পরে মুক্তার বাবা আসে।
আমাকে দেখে বলে, চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।
ওই একটা সময় ছিল আমরা যার-তার সাথে যেখানে সেখানে চলে যেতে পারতাম, মায়ের চোখের আড়ালে থাকতে পারতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বয়স পাঁচ হোক বা আট। তখন বাচ্চা চুরি, বাচ্চা হারানো এসব মানুষ শিখে উঠতে পারেনি।
সাইকেলের রডে বসিয়ে নিয়ে গেল মুক্তার বাবা। আমার এই প্রথম সাইকেলে ওঠা। ভয় ভয় করছিল। উত্তেজনাও। কিন্তু স্বপ্নে ওড়াটা দ্রুতই ফুরিয়ে গেল যেন। প্রাচীর ঘেরা বড়সড় একটা বাড়িতে এসে উঠলাম। বড় সাদা বাড়ি। বড় লোহার গেট। বাড়ির পিছনে সবুজ ঘাসে ঢাকা বড় খোলা জায়গা। সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা।
আমরা দুজন বসে আছি। সেখানে একজন এসে ঈদের খাবার দিয়ে গেল – অন্তত তিন পদের সেমাই – রং, নকশা আলাদা; চিনি, দুধ, কিসমিস,বাদাম, খোরমা আলাদা চেনা যায়। পানির কাঁচের জগ, ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন গ্লাস। আমার নতুন অভিজ্ঞতা। সব পদের সেমাইয়ের স্বাদ নিতে ইচ্ছে হলো। বাইরের মানুষের বাসা, লজ্জাও করছিল। মুক্তার বাবা বলে, খাও, আস্তে আস্তে খাও।
অত সুন্দর কাঁচের বাটি, হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় যদি ,ভয় ভয়ও করছিল।
কাঁচা মাথায় এটা কি খেলছিল, ঘর ভেদে ঈদের সেমাইয়ের রং-রূপ-স্বাদ বদলে বদলে যায়।
ওটা যে হামিদ ডাক্তারের বাড়ি মুক্তার বাবার কথা থেকে জানি।
আমার কি ওই সুন্দর বাড়িটায় ঢুকে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল? আমরা সমপর্যায়ে মানুষ ছিলাম না বলে কি আমাদের বাড়িতে না ঢুকিয়ে বাইরে খেতে দিয়েছিল? বড় মেহমানরা নিশ্চয়ই ভেতরে আপ্যায়িত হয়।
হামিদ ডাক্তারকে আগে আমি কয়েকবার দেখেছি। সেমাই খাওয়ার সময় হামিদ ডাক্তারের স্ত্রী কি এসেছিল খোঁজ নিতে? সিনেমার নায়িকাদের মতো একটা মুখ চোখে ভাসে। সামনাসামনি অত সুন্দর নারী আমার প্রথম দেখা। আমার পরী মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমাকে দেখে আমার উপর খুশি হয়ে ঈদের দিনে সবুজ ঘাসের উপর নেমে এসেছে। আমাকে দেখা দিয়ে পাখা নাড়িয়ে আবার উড়ে চলে যাবে।
পরে জানি ,হামিদ ডাক্তারের এই বউ তার সংসারে থাকে নি, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমি নিজে নিজে একটা কার্যকারণ বানিয়ে নিয়েছি। হামিদ ডাক্তার দিনরাত্রি তার রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এরকম দেবীর মতো রমণী দিনরাত্রি স্তুতি না পেলে কি করে তার ঘরে থাকে? ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাজপুরুষ কেউ তাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছে। হামিদ ডাক্তারের জন্য মায়া হয়। আবার ডাক্তারকে একলা করে ছেড়ে যাওয়া বউকেও অপছন্দ করতে পারি না।

কায়দা আর সিপারা মা পড়াতে ধরেছিল। তবে সংসারের সব কাজ সামলানোর ভিতরে রোজ সময় বের করতে পারত না। আর আমিও ফাঁকিজুকি দেয়ার চেষ্টা করতাম। তাই কায়দা, সিপারা কোরআন শরীফ পড়া শেখার কাজটার জন্য আমাকে কোম্পানিগঞ্জ মসজিদে পাঠানো শুরু হল। পাকপবিত্র থাকার পথে আমার পায়ে খড়ম পরানোর চেষ্টা হল। এমনিতে নগ্ন পায়ে দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলার সময় কোনো অসুবিধা হতো না। কাঠের খড়ম। পায়ের সামনেটা ধরে রাখার জন্য গাড়ির পুরানো টায়ার জাতীয় কিছুর টুকরা দিয়ে বেল্ট। পা নিয়ে মাথা ঘামানো, পা সাজানোর বিষয়টা আসতো ঈদের সময়। নারিন্দার মোড়ে ছিল খলিফার দোকান, ঈদের আগে আগে বাবা শার্টের, হাফ-প্যান্টের কাপড় কিনে দিয়ে আসতো। বড় ভাই আর আমি মাপ দিতে যেতাম। মনে পড়ে প্রতিবারই খলিফার সাথে বাবার লাগতো, দরকারের চেয়ে বাবা কম গজ কাপড় কিনে আনতো। বছর বছর আমাদের হাত পা বাড়ছে এটা বাবা মানতে চাইতো না। তবে শেষ পর্যন্ত দেখতাম প্রতিবছরই ঠিক ঠিক মাপ মতো আমাদের শার্ট হাফ-প্যান্ট হয়ে গেছে। বাবা আবার খলিফার কাছ থেকে বেঁচে যাওয়া কাপড়ের টুকরো আদায় করে নিতো। দেখা যেত শার্টের কাপড় দিয়ে মাথার টুপি তৈরি হয়ে গেছে বা হাতের রুমাল।
বড় ভাই আর আমি পিঠাপিঠি। বাবা ঈদের সময়টা আমাদের দুজনকে একটা ইউনিটি মনে হয় ধরে নিতো তার সুবিধার্থে।
বাবা যতো ভাব করুক এবার ঈদে হাত খালি, তার কাঠের বাক্স সাপ্লাইয়ের সব টাকা হাতে আসেনি, সব জিনিসের দাম বাড়ছে, বাড়ির খরচ বাড়ছে – আমরা দুই ভাই, পরের যারা আছে তারা তো ছোট, মনে হয় আমাদের সবার থেকে বাবারই ঈদ নিয়ে উত্তেজনা, তোড়জোর বেশি।
কাজের জন্য বাবা নানান জায়গায় যেতো, অনেক জানাশোনা মানুষের সাথে ওঠাবসা ছিল, খবরের কাগজ পড়তো। ঈদ তো বড় উৎসব। এই ঈদ সামনে রেখে কোন কোম্পানি কি আয়োজন করছে বাবা খোঁজ রাখতো।
তখন জুতা মানে ছিল বাটা। এমনিতে মুচিদের হাতে তৈরি জুতা, স্যান্ডেলের নানান রকম দোকান তো ছিলই। প্রতি ঈদে বাটা অভিনব কিছু একটা বের করতো। জুতা, স্যান্ডেল মূলত ছিল সব চামড়ার। পানি পড়লে চামড়ার ভিজে যায়, তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। খুব বেশি কারুকাজ, স্টাইল সম্ভব হয় না। বাটা নানান রকম বিকল্প বের করতো। একেক ঈদে একেক রকম। এক ঈদে বের হলো প্লাস্টিকের দুই ফিতার স্পঞ্জের স্যান্ডেল। জুতা, স্যান্ডেলের জগতে বিরাট বিপ্লব। এই স্যান্ডেল পানিতে দিন-রাত্রি ভিজিয়ে রাখো কিছু হবে না। ধুয়েমুছে আরো ঝকঝকে নতুন। পরতেও কতো সুবিধা, পাখির পালকের মতো হালকা, পা ঢোকাও আর বের কর – নতুন যুগের খড়ম। তবে আকাশছোঁয়া দাম। বাবা ঠিক করল ঈদে নতুন আবিষ্কৃত স্পঞ্জের স্যান্ডেল পাবে বড় ভাই। আমার সস্তার চামড়ার স্যান্ডেল, মুখ ভার করে থাকলেও জানি বাবার নির্বাচনের বাইরে কিছু হবে না। বাবার সাথে দুই ভাই দুই জুতার বাক্স নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বড় ভাই বাক্স থেকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল বের করে করে দেখে, বুঝি যে আমাকে দেখানোও উদ্দেশ্য, আমার বুকে কতটা বাজে! জানি বড় ভাই এই স্যান্ডেল ঈদের পরের কয়েকদিনও আমার কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখবে ,আমি চুরি করে পরে না ফেলি।
কতক্ষণ আর নতুন স্যান্ডেল তুলে তুলে রাখা যায়! বড় ভাইয়ের আর তর সইছিল না। মাঝে মাঝে স্পঞ্জ পায়ে দিয়ে কয়েক পা হেঁটে আসে, ধুলোবালি পরিষ্কার করে আবার বাক্সে ঢুকায়। ঈদের আগে দিন তো সেটা। পাশের বাড়ির সায়রা, বকুল আমাদের সাথে চাড়া খেলতে এলো। আমাদের বাড়ির খোলা জায়গায় ঘর তো কাটা ছিলই। চাড়া খেলতে খেলতে বড় ভাইয়ের নতুন স্পঞ্জের কথা মনে আসে। পাড়া-প্রতিবেশীনিকে একটু চমক দেখানো দরকার। স্পঞ্জ পরেই বড় ভাই চাড়া খেলতে নেমে যায়।
ভালোই চলছিল সব। সায়রা, বকুল বড় ভাইয়ের গোলাপি রঙের স্পঞ্জের স্যান্ডেল দেখে মোহিত।
আল্লাহর বিচার। বড় ভাই চাড়া খেলার দুই ঘর পেরোনোর জন্য জোরে লাফ দেয়। কিছু বুঝবার আগেই দেখে বাম পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেল কুকুরের কানের মতো লটপট করছে। তারপরের ঘটনা – বড় ভাইয়ের চিল চিৎকার। মাটিতে গড়াগড়ি। নতুন আবিষ্কৃত স্পঞ্জের স্যান্ডেল এতটা নমনীয়, একটুতেই ছিঁড়ে শেষ।
পরের ঈদে বাটা আনল দীপক স্যান্ডেল, ধবধবে সাদা, প্লাস্টিকের তবে মজবুত। জুতা ও স্যান্ডেলের মিশ্রণ। পরে আরাম। ওয়াটারপ্রুফ। বাবার নিয়মে আমার ভাগে এবার দীপক স্যান্ডেল। বড় ভাইয়ের নর্মাল স্যান্ডেল। বাড়ি ফেরার পথে ভাইয়ের মুখটা দেখলাম কালো। ভাইয়ের বন্ধুরা অপেক্ষা করছিল খেলার জন্য, ভাইয়ের কালো মুখে আলো ফুটল। দেখলাম আমরা দুই ভাই দুই প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছি। ভাই হেলায় যে কোন কিছু ছেড়ে দেয়। আমি ছোট একটা বিষয় নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকি। মন খারাপ জামা, জুতোর মতো আমার গায়ে এঁটে থাকে।
আরেক ঈদে বাজারে এলো ক্যারোলিন কাপড়, ক্যারোলিনের শার্ট। এর ওর মুখে শুনে আমার নিজেরও মনে হয় এর তুল্য পোশাক পৃথিবীতে এর আগে আসেনি। কী স্মার্ট, ভাঁজ পড়ে না, চকচকে, ধোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে, কাপড় ঝাড়া দিলে বৃষ্টির বিন্দুর মতো পানি গড়িয়ে পড়ে যাবে।
আমার ভাই বোন বেড়েছে, বাবার ইউনিট বেড়েছে, অনেক রকম পোশাক, খরচের ক্যালকুলেশন জটিল হয়েছে। তবে বড় ভাইয়ের সাথে আমাকে আর কম্পিটিশন করতে হয় না। আমি স্কুলের ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হই।। বড় ভাই ফেল করে। নিয়মিত স্কুলে যায় না। স্কুলে যাওয়ার কথা বলে পালায়, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে-ফিরে আসে স্কুল ছুটির সময়। ভাইয়ের কপালে মারধরও জোটে। তবে বড় ভাই সেটা বড় আমলে নেয় না। নিজের দামটা বুঝছি। ঈদে আমার যেটা চাই সেটা চাই-ই। ঈদে চাই ক্যারোলিনের জামা। এই জামা কেনার জন্য বাবা আমাকে নিয়ে সদরঘাট পাটুয়াটুলি ঘোরে। কিন্তু দামে বনে না। ক্যারোলিনের শার্ট ছাড়াই পিতা-পুত্র বাড়ি ফিরলাম। আমি গুম হয়ে বসে থাকি। আমার মনের ভেতর কী ঝড় চলছে আমি জানি। বাবার মনের খবর আমার জানা নেই। বাবার আরো বাজার সদাই বাকি। প্রতি ঈদের মতো মায়ের শাড়ি নিয়ে একবার বড়সড় ঝগড়া হবে। কোনবারই মায়ের বাবার কিনে দেয়া শাড়ি পছন্দ হয় না।
ঈদের আগের রাত তো সহজে শেষ হতে চায় না। চাই যে তাড়াতাড়ি ঈদের সকালটা আসুক। আবার চাই যে চান রাতের সময়টা শেষ না হোক।
ঈদের দিন শুরু হল। আমি আর বিছানা থেকে উঠি না। উঠবো না। আমাকে বুঝিয়েও কেউ তুলতে পারবে না। বড় ভাই তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চলে গেল। অন্য ভাই-বোনেরা নতুন কাপড়-চোপড় পড়ে রেডি, পাড়া বেড়াতে বেরুবে।
ঈদের নামাজ শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমার চোখের পানি বালিশের তুলা শুষে নিচ্ছে। কান্নার পানিতে টান পড়ে না, আবার নতুন করে কাঁদছি।
নিজেরটা ছাড়া আর কিছু না-বোঝা ছেলেটাকে আমার বাবা কি চিনতো?
বাবা বেরিয়ে গেল। ঈদের নামাজ শেষ, বাবা আসে না। আমারও ঈদের নামাজ পড়া হয়নি।
বাবা এলো। হাতে প্যাকেট। ক্যারোলিনের শার্ট। সাদা শার্ট, কালো সুতার মতো সরু লম্বা লম্বা দাগ। যেমনটা আমি দোকানে পছন্দ করে এসেছিলাম।
খুশিতে আমার চোখ বেয়ে টপটপ করে আনন্দের পানি পড়ে। বাবার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাই না। তাহলে হয়তো দেখতে পেতাম আমার জন্য না, বাবা ক্যারোলিনের শার্টটা কিনে এনেছে তার নিজের জন্যই।
পরে মায়ের মুখে শুনি, বাবা আগে গেছে সদরঘাট – সব দোকান বড় বড় তালা ঝুলিয়ে বন্ধ। বাবা গেছে গেন্ডারিয়া। এক পরিচিত দোকানির বাসায়।তাকে ধরে সদরঘাটে এসে দোকান খুলিয়ে আমার জন্য শার্ট নিয়ে এসেছে।

সেমাই খাওয়া, ঈদের নামাজ পড়া, নতুন জামা পরা, কোলাকুলি করা – এটুকুই মনে হয় ঈদ না, অন্তত একটা বয়সে। একটা কাজ ছিল যে বাসায় মেয়ে আছে নতুন কাপড় পরে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটাহাটি। আমার চোখে লাগা একটা বাড়িই ছিল – রিমা ও নির্মা দুই বোন, ইয়াকুব সরদারের ভাড়াটে ওদের বাবা-মা। রাস্তার দিকের জানলাটা খোলা পেলে, রিমার মুখটা দেখতে পেলে আমার ঈদ পরিপূর্ণ। নির্মা বেশি ছোট। আমার বন্ধু দুলুর সেজ ভাইয়ের সাথে রিমার কোন এক রকমের অন্তর্লীন সম্পর্ক ছিল। একথা মনে হলে আবার নির্মার কথা ভাবতাম। ঠিক আছে নির্মাকে দেখলেও চলবে। আর মুখটা যদি সে হাসি হাসি করে রাখে।
আমার বয়স বাড়ে। ঈদের বর্ণ পাল্টায়। রুবি আর আমি এক প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়ি, একসাথে দুজনে এসএসসি পরীক্ষা দেব। এক রোজার ঈদে আর কোরবানির ঈদে ওদের বাসায় যাই। আমাদের এইচএসসির সময়ও সম্পর্কটা ভাঙেনি। এবার ঈদে রুবিকে আমাদের বাসায় আসতে বলতে হয়। কিন্তু আমাদের বাড়ি, বাড়ির লোকজনের কথা ভাবলে মন ছোট হয়ে আসে। আমাদের বাড়িটা রাস্তার উপর না। তিন ফুটি একটা গলি, দুইট ঝিকড়গাছের তলা দিয়ে লোহার ড্রাম কেটে বানানো গেট দিয়ে আমাদের বাড়ি ঢুকতে হয়। রুবিদের অবস্থা ভালো, ওদের বাড়ি কি গোছানো। আমার বোনগুলো একেবারে গ্যাদা গ্যাদা, ছোট। আমার মা একালের রুচির কথা জানবে কোথা থেকে? আমাদের বাড়িতে খেতে বসার সুন্দর টেবিল নেই। প্লেট,বাটিও সস্তা রকমের, অরুচিকর। খাবার তুলে দেওয়ার একটা ট্রেও নেই। টেবিল, বাসনকোসনের তো ব্যবস্থা করতে পারবো না। কলেজের স্কলারশিপের টাকায় একটা ট্রে কিনবো মনস্থ করি। নিউমার্কেটে ঘোরাঘুরি করি। ছাতার এসব জিনিস চিনি আমি! মাকে ট্রে এনে দিলাম। মা কি বুঝলো কে জানে! ঈদের আগের দিন হঠাৎ করে রুবিরা ওদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে ঈদ করতে চলে গেল। মন্দের ভালো। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এক ঈদে আমার ছোট বোনকে নিয়ে যাই তেজগাঁও নীরুদের বাসায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ। বেকার ,কাজ খুঁজছি। নীরুর খোঁজ করতে সে একবার দেখা দিয়ে গেছে। কিন্তু পাশে এসে বসেছে নীরুর বাবা। তাকে বলি আমি একটা জব পেয়েছি। বেতন ভালো। তবে এই চাকরিতে থাকব না। একটা সরকারি চাকরি পেয়ে যাচ্ছি, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। নীরুর বাবা খুশি হয় কি হয় না বুঝতে পারি না। উঠে চলে যায়। ইচ্ছে ছিল আমার ছোট বোন ও নীরু অনেকক্ষণ ধরে বসে গল্প করবে। আমাদের সম্পর্কের বোঝাবুঝিটা ভালো হবে। হয় না।
দুই বছর পর চাকরি নিয়ে চাটগাঁ চলে যাই। ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এসে মেজ বোনকে নিয়ে ইস্কাটনে যাই অফিসের বসের বাসায়। বসকে চাটগাঁয় কাঁচুমচু মুখে বলেছিলাম আপনার বোনের প্রতি আমি ইন্টারেস্টেড। বাংলায় এ কথাটা কিভাবে বলা যেত মনে আনতে পারিনি।
বোনকে নিয়ে এসেছি ওর হতে যাওয়া ভাবীকে দেখে গেলো বাসায় গিয়ে বলতে পারবে।
সেমাই, পোলাও খাওয়া শেষ। কিন্তু বসের বোন আসে না।
আমরাও উঠে পড়ি না। পড়ে দেখি আমার ভাবী, বসের স্ত্রী উসখুস করে ঘোরাফেরা করছে। আমি বললাম, সে কই?
ভাবী বলল, জানেন না, আপনাদের খোঁজখবর নিয়ে আমার শ্বশুর তো আপনার প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে।
মেজ বোনের কাছে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। আমি ওকে বলি, ইভিনিং শো-তে তোকে একা একটা সিনেমা দেখাবো।


রুশ গল্পকার আন্তন চেখভ বলেছিলেন, গল্পের শুরুতে যদি দেখা যায় বৈঠকখানা ঘরের দেয়ালে বন্দুক ঝুলছে তাহলে গল্পে সেই বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া দেখাতে হবে।
এই লেখাটা গল্প কি গল্প না নির্ধারণ করতে পারি না। যা সরাসরি আমার না তা নিয়ে আমি লিখতে পারি না। জানা বিষয়টা কখন কীভাবে গল্প হয়ে ওঠে এটা খুঁজতে খুঁজতে দেখি ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে।
মুক্তা ও মিনুর কি হলো? হামিদ ডাক্তার , রহমান কম্পাউন্ডার, মুক্তা-মিনুর মা?
আমার আর আমার বড় ভাইয়ের প্রতিযোগিতা ছিল মুক্তাকে খুশি করার। ও হ্যাঁ, মুক্তারা ততদিনে আমাদের বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছে। আমাদের বড়দের খেলায় মুক্তাকে নিতাম। মুক্তা আমার কোন মার্বেল পছন্দ করলে দিয়ে দিতাম। বড় ভাইয়ের বন্ধুরা খেলার জন্য ডাকতে এলে চলে যেতো। আমি সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। মুক্তার সাথে আমি হাড়ি পাতিল পুতুল খেলায় বসে যেতাম।
হঠাৎ করে মুক্তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী অসুখ। আমাদের ঘরের ভাড়া হয়তো দিতে পারে না এই ঘর ছেড়ে চলে যায় তারা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকি ওদের খোঁজ আর জানি না। আমার তখন তেজগাঁয়ের মেয়ের সাথে পরিচয়। মুশকিল হলো মেয়েটা পরিষ্কারভাবে হ্যাঁ কিংবা না বলে না। এখন তো বেশি কিছু চাই না। একটা স্বীকৃতি চাই – বলো না, হ্যাঁ তোমাকে ভালোবাসি। বলে না। তারপর এক ঈদে ছোট বোনকে নিয়ে গেলাম তো তেজগাঁওয়ের বাড়ি।
একসময়ে নিজের ঘর-সংসার হলো। নয়াপল্টনে বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় বাবুই পাখির বাসা। মা বললো, নতুন বৌ, এবারের ঈদ আমাদের বাসায় এসে করবি। সেটা যে আমারও বাসা, আমি ভুলে গেছি। নতুন বৌয়ের কাছে বেগমগঞ্জ লেন তো বিশেষ কিছু না।
ঈদের দিন গিয়ে দেখলাম মুক্তার মা আমাদের বাসায়। আমি তো অবাক। আমার প্রথমে মনে পড়ল কোন কালে এক ঈদের দিনে তাঁর হাতের ভিন্ন রকম স্বাদের সেমাই খেয়েছিলাম। তারপর হামিদ ডাক্তারের বাড়ি। পরীর মতো এক নারী। আমার শিশুচোখে নতুন একটা পৃথিবী উন্মোচিত হচ্ছিলো।
মুক্তার মায়ের কাছে মুক্তা, মিনুর খোঁজ নিতে গেলাম। মুক্তার মা তেমন করে আমার সাথে মিশছে না। আমার কথা জবাব দিচ্ছে না
আমার মা এসে বললো, এখানে কি ঘরে এসে বসো।
মা মুক্তার মাকে ধমক দিলো, তোমাকে এ-বাড়িতে কাজে ঢোকানো ভুল হয়েছে। তোমার এই এক বাজে স্বভাব, মানুষ পেলে গল্প জুড়ে দাও।
দরজার কোন থেকে ঝাড়ু টেনে নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে চলে গেলো মুক্তা-মিনুর মা।
আমার বউ দিনাজপুরের। রংপুর ও দিনাজপুর কাছাকাছি। তবে বেগমগঞ্জ লেন থেকে বেশ দূর।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field