কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

সুবন্ত যায়েদ | নিঃসঙ্গ করতলে | ছোটগল্প

ইন্দুদের ছাদ বাগানে তখন সুফলা পৃথিবী অভিজাত হাওয়া দিচ্ছিলো। এমন হাওয়া যেন অনায়াসে বসন্ত ডেকে আনে। কিন্তু সে সন্ধ্যাবেলা ছড়াচ্ছিলো বিষণ্ণতা। ইন্দু বলছিলো, মানুষের জীবন কি বসন্তের পাতার মতো, সারাবেলা ঝরে ঝরে পড়ে। তারপর রিক্ত, অসীম শূন্যতার ভেতর শুধু তলিয়ে যাওয়া। হয়ত তোমার আমার জীবনের মতো, অথবা আমাদের জীবনের প্রতীক হয়ে থাকা জিকো মাস্টারের জীবনীর মতো।
তখন তরুণদের সান্ধ্য আড্ডার মধ্যমনি হয়ে জিকো মাস্টার এভাবেই মর্ত্যে ফিরে আসে।

ঠিক কত বছর আগে জিকো মাস্টার দেহ ত্যাগ করেছিলো, তারা সঠিক হিসাবটা জানে না। তবে অনুমান করে, বছর আষ্টেক হবে হয়ত। এ আর কয়দিন, পেটের নাড়ি শুকানোর মতো ক্ষণকাল। তার গল্প মিথের মতো প্রচলিত হলেও সেটা এই স্বল্প সময়ে মিথ হয়ে যায় নাই। চিরকাল শহরে কাটিয়ে দেয়া জিকু মাস্টারের প্রিয় ফুল ছিলো ঢোলকলমি। একদিন সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে চুপ থাকে সে বেলা। তখন তার জীবনের আলো নিভিয়া আসবার নিকটবর্তী সময়। সে বেলা চুপ থাকলেও অপর বেলায় সে তার শৈশবের কথা তুলে আনে। মূল সড়ক থেকে তাদের বাড়ির দিকে নেমে যাওয়া গলির দুপাশ জুড়ে ঢোলকলমির সমাহার ছিলো। কমবেশি সারাবছর তাতে মাইকসদৃশ্য ফুল ফুটতো। জানা যায়, বৃদ্ধ জিকো মাস্টারের শৈশব গ্রামে বেশিদিন স্থায়ী ছিলো না। ততদিনে শহরে তার বাপের ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে। এলাকায় প্রভাব রাখার মতো একটা শ্রেণির ভেতর সে ঢুকে গেছে। এরপর স্ত্রী সন্তানসহ শহরে স্থানান্তরিত হলে সেই থেকে জিকো মাস্টারের শহুরে জীবনের শুরু।

সান্ধ্য আড্ডায় জিকো মাস্টারের প্রসঙ্গ তুলে আনে ইন্দু। তার আগে কয়েক দফা তুমল বিতর্ক হয়ে গেলো। স্বভাবত ইন্দু তুমুল বিতর্কের বদলে মৃদু তর্কে জড়ালো। এই শতাব্দীতে মানুষের সবচেয়ে বড় সংকট কোথায়, এ বিষয়ে তারা শেষ পর্যন্ত কোনো ঐক্যমতে পৌঁছালো না। ইন্দুর ভাষ্য, এই শতাব্দীতে মানুষের সবচেয়ে বড় সংকট হলো মানুষ একা হয়ে গেছে। মানবজাতি সভ্যতার এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, মানুষ তার স্বজাতি থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মানুষের সামাজিক ঐক্য ভেঙে গেছে। দুঃখের আলাপটা হলো, মানুষের আর ফিরবার পথ নাই।

কিন্তু মানুষ ফিরতে চায়। অথচ কোনো পথ খোলা রাখে নাই মানুষ। সুতরাং মানুষ ফিরতে পারে না। তাই চারিদিকে অব্যক্ত হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। আর সমাজে মানুষের প্রধান অসুখ হলো হতাশা। সেই হতাশাকে ছড়িয়ে দিতে এ বছরেও লাইভে এসে সুইসাইড করেছে তরতাজা অনেক মুখ। ইন্দু তার কাজিন অহির কথাও তুলে আনে। জীবনের সৌন্দর্য অপার, এমন স্লোগান নিয়ে সে ঘন ঘন পাহাড় আর সমুদ্র ঘুরে আসে। তার অধিক প্রিয় ছিলো পাহাড়ি সবুজের অসমতল ঢেউ। সেসব ঢেউয়ের ভেতরে সে মাঝেই মাঝেই নিরুদ্দেশ হতো। কেমন এক বাঁধনহারা জীবন সে রপ্ত করেছিলো। আমাদের কারো কারো ঈর্ষা হতো এমন একটি জীবন পাবার জন্য। কিন্তু একদিন আমরা মুদ্রার অন্যপিঠ দেখলাম। সম্ভবত আমরা দুঃখে ও বিস্ময়ে ভেসে গেলাম। পাহাড়ে তখন ঘোর বর্ষা। সবুজ পাহাড় নতুন উদ্যোমে আরো সবুজের ডালপালা ছড়িয়েছে। মৃতপ্রায় ঝর্ণা ও গিরিখাদ নতুন যৌবনের মতো চঞ্চল। সেবার অহি পাহাড়ে গিয়ে আর ফিরলো না। তেমনি এক তুমুল বর্ষণমূখর রাতে সে একটা ভিডিও আপলোড দিলো। সে ভিডিওতে দেখা গেলো তুমুল বর্ষণ। তাদের পাহাড়ি ঘর যেন বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছিলো। ঘনকালো আকাশ থেকে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছিলো। সেই বৃষ্টির ভেতরে শ্যাওলাজমা পাথুরে পথের সিঁড়িতে বসে অহি নতমুখে ভিজতে থাকলো। সে ভেজার দৃশ্যটা ভীষণ মায়াবী ও সংক্রামক। আর ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা ছিলো, এমন বর্ষণমুখর রাতে আমার মৃত্যু হবে।

সত্যিই সেরাতে সে স্বেচ্ছায় পরলোকে পাড়ি জমালো। মাথার পাশে পড়ে থাকলো কিছু পাহাড়ি ফুল আর একটি চিরকুট। সেখানে লেখা, নিঃসঙ্গতা আমাকে ক্রমশ ক্ষয় করে দিলো। তবু আমি মূলত পাখিদের ইচ্ছামত উড়ে কোথাও চলে যাওয়ার ক্ষমতাকে ঈর্ষা করি। কিন্তু আমি পাখি নই, অথবা ভীষণ নিঃসঙ্গ ডানাভাঙা এক পাখি। সুতরাং ডানাবিহীন উড়াল দিলাম।

এই ঘটনা সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুললো শুধু এমনই না। বহুদিন পর্যন্ত এই ঘটনাটা ট্রেন্ডিং ছিলো। আর নিঃসঙ্গ ও হতাশাগ্রস্ত অনেকের ভেতরে ঘটনাটা সংক্রামক হিসেবে কাজ করলো। “আমি মূলত পাখিদের ইচ্ছামত উড়ে কোথাও চলে যাওয়ার ক্ষমতাকে ঈর্ষা করি। কিন্তু আমি পাখি নই, অথবা ভীষণ নিঃসঙ্গ ডানাভাঙা এক পাখি। সুতরাং ডানাবিহীন উড়াল দিলাম।” এই ট্যাগ হতাশাগ্রস্তদের অনেকে ব্যবহার করে আত্মহত্যার চেষ্টা করলো। তাদের ভেতরে অনেকে সফল হলো বটে। আমার ভেতরেও কি কিঞ্চিৎ হতাশা সংক্রামিত হয়েছিলো? ইন্দু একদফা ভেবে বললো। সংক্রামিত না হলে সেই বর্ষায় আমি ছাদবাগানে প্রায়শ কেন ভিজতাম ঠিক অহির মতো ভঙ্গিতে! অথচ আমার কোল্ড এলার্জি ছিলো প্রকট। নিউমোনিয়ার চোখরাঙানি আমাকে নিবৃত্ত করতে পারে নাই।

তখনো আমার কাঁচা বয়স বলে নিঃসঙ্গতা বিষয়ক ধারণাটা ছিলো অস্পষ্ট। বিষয়টার গভীরতা বুঝতে পারি মূলত অহির মৃত্যুর পর। তারপরেই আমি জিকো মাস্টারের জীবনের ইতিহাস সম্পর্কে একটু একটু জানতে থাকি। সে ছিলো আমার নানার প্রতিবেশি। আমার মা তার জীবনের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। জিকো মাস্টারের শৈশবের একটা অংশই কিঞ্চিৎ সংগ্রামের ছিলো। তার বাপ শহরে এসে খুব অল্পসময়েই ভাগ্য বদলে ফেলে। তারপর থেকেই মূলত তাদের সংসারে অনেক স্বচ্ছলতা আসে। পৈতৃক সূত্রে সে অনেক সম্পদের মালিক হলে তার জীবন নিয়ে মূলত কোনো ভাবনা ছিলো না। সাধারণত এমন দেখা যায় না যে, এমন অগাধ সম্পদের মালিক হয়েও সন্তানটি কখনো উচ্ছন্নে চলে যায় নাই। অথবা ক্যারিয়ার নিয়ে গোছালো কোনো চিন্তা করেছে। তখন মাস্টার না হওয়া জিকো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাস্টারি করার সুযোগ পেলে সেটা সে লুফে নেয়। ততদিনে তার বাপ চরম অসুস্থ হয়ে বিছানাগত। এমন এক চাকরির কথা শুনে তার অসুস্থ পিতা ছাপোষা বলে তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু জিকো তখন ক্যারিয়ার হিসেবে মাস্টারিকেই আদর্শ মনে করে। তার বাপের ভাষ্য মতে সেই থেকে তার ছাপোষা জীবনের সূচনা।

নিঃসঙ্গতা এমন এক আগ্রাসন যে, মানুষ খুব যত্নের সাথে উদ্ভাবন করেছে। মানুষ সম্ভবত বিশ্বনাগরিক হতে গিয়ে নিজের সাথে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়েছে। অন্ধকার একেকটি কূপ কেটে রেখে মানুষ স্বপ্নের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সুতরাং স্বপ্নের ফসল আলোকবর্তিকার মতো কিছু হয় না। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও একজন ছাপোষা জিকো মাস্টারের সুখের কোনো অভাব হয় না তার যৌবনজুড়ে। কিঞ্চিৎ দরিদ্র ঘরের বউটা তার সমস্ত কর্মকাণ্ডই হাসিমুখে মেনে নিয়ে গেছে। সম্ভবত তার পুরো যৌবনে সে জীবন নিয়ে কোনে অভিযোগ আনে নাই। কিন্তু তার বউয়ের আকস্মিক মৃত্যু হলে সে অথৈ সাগরে কোনো কূলকিনারা পায় না। ছোটো দুটি সন্তানের তখনো মায়ের যত্নের প্রয়োজন হয়। দুটি সন্তানের বিদঘুটে ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবে না। বাড়ির পুরনো গৃহকর্মীদের উপর সে ভরসা রাখে।

সম্ভবত জিকো মাস্টারের এই সময় পর্যন্ত খুবই স্বাভাবিক যাপন ছিলো যেটা আলাদা করে চোখে পড়ার মতো না। কিন্তু তার বউয়ের মৃত্যুর পর তার পরিবারের দিকে মানুষের মনযোগ নিবদ্ধ হয়। স্বল্পভাষী একজন মানুষ যেন কথা বলার জায়গাটাই হারিয়ে ফেলে। সন্তানেরা স্কুল, প্রাইভেট টিউটরের টেবিল ও খেলাধুলার মতো বিস্তৃত রুটিনের ভেতরে তলিয়ে যায়। আর তার স্কুলের সময়টুকু দারুণ মুখরতায় কেটে গেলে তারপর তার অঢেল সময়। বাড়িতে বসে বসে গৃহকর্মী ও সন্তানদের অনবরত ছোটাছুটি দেখে। এই নিদারুণ দৌড়াদৌড়ি কি মৃত্যুকেই ছুঁয়ে দিতে নয়! তবু কত সুখের আয়োজন মানুষের। জীবন থেকেও বড় বড় স্বপ্নগুলো মানুষ কতদূর আর টেনে নিতে পারে। কিংবা মানুষের মৃত্যু হলে বিবিধ স্বপ্নেরও কি মৃত্যু ঘটে, নাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে যায় স্বপ্নের ভগ্নাংশ?
প্রিয়তমা বউয়ের মৃত্যুর পর মূলত জিকো মাস্টারকে মৃত্যুভাবনা গ্রাস করে ফেলে। ফলস্বরূপ শরীরের ভগ্নদশা বেরিয়ে পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্য হয় করুণ। ডাক্তার প্রতিনিয়ত তাকে আনন্দের সাথে বাঁচতে বলে। বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে বলে। কিন্তু স্বভাবতই জীবনে সে কখনো ভালো বন্ধু পায় নাই। আর আর্থিকভাবে তারা যত বড় হয়েছে ততটাই তারা আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে সরে গেছে। সুতরাং এর ফলাফলটা দাঁড়ায় এমন যে, প্রতাপশালী মৃত্যুভাবনা তাকে নিকটাত্মীয়ের মতো গ্রাস করে নেবে।

ইন্দুদের ছাদবাগানে সান্ধ্য আড্ডার প্রসার ঘটে। অমবস্যার রাত বলে আকাশে কোনো আলোকচ্ছটা দেখা যায় না। বিশাল এ শহরে তবু সামান্য আলোকস্বল্পতা নাই। ইন্দুর মনে হয়, যাবতীয় অন্ধকার কেবল মানুষের মনে। কতটা অন্ধকার গ্রাস করলে মানুষের মনে আলোর পথিক বিষয়ে ধারণা আসে? অন্ধকার বলেই মানুষ জীবনের উপর তীক্ষ্ণ আলো ফেলে পর্যালোচনা করে। জিকো মাস্টারের জীবনের গল্প বলতে বলতে ইন্দুর ভেতরে এমন বিচিত্র বোধ নাড়া দিলে সে কিঞ্চিৎ দিকভ্রান্ত হয়। ছোটো একটা নীরবতার ভেতরেই সকলের হাতে স্মার্টফোনটা জ্বলে ওঠে। সেখানেই তো তামাম পৃথিবীর গল্প নিরলস ঘুরছে। তবু যেন এটা মানুষকে শিকার করার দারুণ এক ফাঁদ। ইন্দু হঠাৎ ভীত হয়ে পড়লে সবাইকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। একটু একটু করে সবার মনযোগ ফিরলে জিকো মাস্টারের অবসরের কথা পাড়ে। একরকম নিশ্চল ভঙ্গিতে জিকো মাস্টারের লম্বা একটা সময় কেটে গেলেও মাস্টারি থেকে অবসরের পর তার অসহ্য বোধ হতে থাকে। তার মনে হয় এ জীবনের বোধ হয় মৃত্যু ছাড়া আর কোথাও পৌঁছানোর বাকি নাই। সেসব সময়ে সে ভাবতে থাকে জীবনের শেষদিনগুলো কিভাবে কিঞ্চিৎ আনন্দময় করে তোলা যায়। ততদিনে তার সন্তানেরা বড় হয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থিতু হয়েছে পড়াশোনা ও চাকরির সুবাদে। তাদের মনের চক্র এমনি নিষ্ঠুরতায় বাঁধা পড়ে যে, বছর ঘুরে গেলেও বাড়ির দিকে তাদের মন ফেরে না। এতবড় আলিশান বাড়িটাতে শুধু বহিরাগতদের আনাগোনা।

নিরন্তর অবসর যাপনের এক দুপুরে সবাই তন্দ্রাচ্ছন্ন, তখন বাড়ির গৃহকর্মীদের ডাক পড়ে। ঘুমকাতর চোখে সবাই জড়ো হলে বুড়ো জিকো মাস্টার ঢোলকলমি ফুলের কথা পাড়ে। সম্ভবত বুড়ো বয়সের নিঃসঙ্গতায় শৈশবের ভূত পাকাপাকিভাবে ঘাড়ে চেপে বসে। মালিকে তার বাগানের পথজুড়ে ঢোলকলমির গাছ লাগাতে বলে। কিন্তু মালির বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এমন সুসজ্জিত বাগানে কিনা বিদঘুটে জংলি ফুলের অনুপ্রবেশ! বিষয়টা বোঝাতে গেলে সে জিকো মাস্টারের রোষানলে পড়ে। তবে একটা অদ্ভুত বিষয় দেখা যায় যে, শহরের কোনো নার্সারিতেই ঢোলকলমির চারা পওয়া যায় না। এমনকি শহরের কোনো অলি-গলি জংলা বাগানেও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢোলকলমি তখন এমনি মূল্যবান যে, মালিকে ছুটতে হয় কুমারখালি। জিকো মাস্টারের বাগানের মালি এসেছে শুনে সেখানে এলাকাবাসী জটলা পাকায়। তারা জিকো মাস্টারের নাম শুনেছে বটে কিন্তু চক্ষে দেখে নাই। যুগযুগ ধরে শুধু দেখে আসছে জিকো মাস্টারের ভগ্ন বাড়িটা। তারা কৌতুক চোখে মালিকে ঢোলকলমির ডাল সংগ্রহ করা দেখে। আর গ্রামবাসীর অহেতুক কৌতূহলে মালি বিরক্ত হয়। তবু সে ঢোলকলমি সংগ্রহ করে কয়েকটি স্তূপ করে। তারপর অতি যত্নে সেসব শহরে আনতে আনতে বেশ রাত হয়। শুকিয়ে যাবার আশঙ্কায় সে রাতেই বাগানের দুধারে ঢোলকলমি রোপন করা হয়। এভাবে জিকো মাস্টারের বিশেষ কামরা থেকে একদিন নির্দেশনা আসে গৃহকর্মীদের কাছে। রোজ রাতে তার বিশেষ কামরায় গল্পের আসর বসবে। এ বিষয়ে সকলকে বাধ্য থাকতে বলা হয়। তারপর থেকে রাত্রি সাড়ে এগারোটা বাজলে জিকো মাস্টারের কামরা ভরে ওঠে। কিন্তু গল্পের আসরে গৃহকর্মীরা অদ্ভুতভাবে ঝিমায়। বিশেষ এ কামরায় এলেই তাদের তন্দ্রা পেয়ে যায়। তাই অচিরেই জিকো মাস্টারের এই প্রকল্প ভেস্তে যায়। এভাবে বিবিধ প্রকল্প তার মাথা থেকে আসে, কিছু তার বাস্তবায়ন হলে কিছু নস্যাৎ হয়।
তবু তার নিঃসঙ্গতা কাটে কি! সম্ভবত কাটে না, কারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গ সে পায় না। সবাই কেমন পলায়নপর, কাজের বাইরে তার দারস্থ কেউ হয় না। শেষ দিকে সে ভার্চুয়াল জীবনে কিছুটা অভ্যস্ত হয়, অথবা বই কিনতে কিনতে আস্ত একটা লাইব্রেরি গড়ে তোলে, অথবা নতুন নতুন শখ তৈরি করে সময়ের একটা ভাগ ব্যয় করে, তবু জীবনের অনেক অংশে শূন্যতা ভাগ বসায়।
মানুষ কি সত্যিই নিজেকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যায় নাই যে, মানুষ এখন সবকিছুই পায়। স্তূপীকৃত ভোগের আড়ালে কেবল নিজেকেই পায় না। ইন্দু ড. নওরোজ রেজার কথাও বলে। একদিন বাসা থেকে বের হলে আচমকা তার মনে হয়েছিলো সে একটি কফিনের ভেতর ঢুকে আছে। সম্ভবত কফিনের পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে। একটি অসাড় দেহ কি ভ্রমণে বের হতে পারে? তার ভীষণ দমবন্ধ লাগলে সে তক্ষুনি ঘরে ফিরে আসে। তারপর সকালে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার হয়। তার বিছানার উপর পাওয়া যায় সংক্ষিপ্ত এবং এলোমেলো হাতে লেখা এক চিরকুট। সে চিরকুট যেন তার জীবনের খসড়া আত্মজীবনী। সংক্ষিপ্ত কিন্তু গোটা জীবনটা পড়ে নেয়া যায়। যার জীবনটাই কফিনে বসবাসের মতো নিঃসঙ্গ ও শূন্য, এমন এক মৃত্যুই সেই জীবনের গল্প বলে দেয়। অথচ শহরে তার কয়েকটা ঘর-বাড়ি। বেহিসেবি অর্থের ছড়াছড়ি। যদিও জিকু মাস্টারের একটাই বাড়ি শহরে। কিন্তু তার আয়তন বিশাল। উপভোগের আধুনিক সকল উপাদান প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হয়। ইন্দু গভীর চিন্তা করেও বলতে পারে না তার বাড়িতে মূলত কতগুলো অ্যাপার্টমেন্ট। উপরের তলাগুলোতে ভাড়া দেয়া থাকলেও বেশিরভাগই বাড়ির বিবিধ অনুষঙ্গে ব্যবহার হয়।

মানুষ কি জীবনের আলো নিভিয়া আসার কোনো সংকেত পায়? সম্ভবত পায় না, অথবা পায়। এ বিষয়ে জিকু মাস্টারের কথা বলা যায় না। তবে তার মাথায় দারুণ একটা প্রকল্প খুলে যায়। একেবারেই গোপন এক প্রকল্প। ততদিনে তার ঢোলকলমির ডালগুলোতে স্বমহিমায় ফুলের উৎপাদন শুরু হয়েছে। নিয়ম করে জিকু মাস্টার ঢোলকলমির পথটুকুতে মনযোগী ভঙ্গিমায় হাঁটে। সম্ভবত সেখানে হাঁটতে হাঁটতেই মাথায় প্রকল্পটি খুলে যায়। একটা অ্যাপার্টমেন্ট খালি করে সে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেয়। একটা কাজ সে নিখুঁতভাবে করে। অ্যাপার্টমেন্টের দুটি কামরা সে যত্ন করে গুছিয়ে রাখে। আরেকটি কামরায় সে তার প্রয়াত স্ত্রীর ব্যবহার্য অনেক কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে নোংরা করে রাখে। প্রথমত এসব কর্মকাণ্ডে গৃহকর্মীদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। তারা আদৌ বোঝে না এসবের হেতু কি। কিন্তু এমন কর্মের ফলাফল আসতে শুরু করে। এই মেগাসিটিতে এমন এক আলিশান বাড়ির ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে ভাড়াপ্রত্যাশীরা দারুণ সাড়া দেয়। কামরাগুলো কেউ দেখতে এলে জিকু মাস্টার প্রথমে গেস্টরুমে বসিয়ে আপ্যায়নের আয়োজন করে। আর গল্পের পসরা সাজিয়ে বসে। লোকজন দারুণ অভিভূত হয়। সম্ভবত অনেকে নিজের চোখকে অবিশ্বাস করে। তারা কখনো এমন আন্তরিক ও অথিতিপরায়ণ কাউকে দেখে নাই। এভাবে লম্বা একটা সময় কেটে যায় গেস্টরুমেই। তারপর দারুণ ফূর্তিমনে তারা কামরা পরিদর্শনে যায়। কিন্তু তারা তৃতীয় কামরায় এসে হোঁচট খায়। অদ্ভুত বিষয় হলো, জিকো মাস্টার তৃতীয় কামরাটা পরিস্কার করতে অস্বীকৃতি জানায়। জানা যায়, সেখানে সে তার প্রয়াত স্ত্রীকে নিয়ে করুণ এক গল্প ফাঁদে। গল্পটা এমন যে, এই কামরাতেই তার প্রিয়তমা স্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিলো। তার মৃত্যুর সময় কামরাটার দশা ছিলো ঠিক এমনি। তাই স্মৃতি হিসেবে এই কামরায় কোনো পরিবর্তন আনা হয় নাই। সুতরাং এখানে বসবাস করতে হলে এই স্মৃতিসমেত বসবাস ছাড়া আর উপায় নাই।

লোকজন নিদারুণ হতাশ হয়। প্রত্যাখ্যাত হবার মতো বেদনা নিয়ে নিচু মাথায় তারা ফিরে যায়। এটাই জিকো মাস্টারের আলিশান বাড়িটার রোজকার চিত্র হয়ে ওঠে। গৃহকর্মীরাও বিষয়টা একসময় ধরে ফেলে যে, এটা একটা ফাঁদ। নজিরবিহীন ফাঁদে ফেলে সে মানুষ ডেকে আনে ঘরে। তারপর তাদের সঙ্গে দুঃখ-সুখের আলাপ পাড়ে অথবা তাদের সাথে সময় কাটায়। নিঃসঙ্গতা কাটাতে অথবা মানুষের সঙ্গ পেতে নিশ্চয় এটা এক নজিরবিহীন ফাঁদের প্রকল্প। শোনা যায় অনেক ব্যর্থ প্রকল্পের পর এই প্রকল্পে সে কিঞ্চিৎ সুখ পায়। কিন্তু সেই সুখের মেয়াদ দীর্ঘ হয় না। এক নির্জন দুপুরে সংক্ষিপ্ত ভাতঘুমে চোখদুটো বুজলে সে চোখ আর খোলে না। গৃহকর্মীরা গৃহ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত সময় পার করে কিন্তু গৃহের মালিকের খোঁজ তারা রাখে না। এভাবে সন্ধ্যা গড়ায়। এক গৃহকর্মীর মনে হয় লম্বা সময় জিকো মাস্টারের ডাক পড়ে নাই। তারপর সকলে তটস্থ হলে সে সন্ধ্যায় আলিশান বাড়িটাতে বহুদিন পর চোখে পড়ার মতো হুলস্থুল পড়ে যায়।

তরুণদের সান্ধ্য আড্ডায় জিকো মাস্টারের মধ্যমনি হয়ে মর্ত্যে ফিরে আসাটা তরুণদের জন্য বিমর্ষ স্মৃতির কারণ হয়। অনেক বিতর্ক ছাপিয়ে রাত্রিকালীন শহরের আলো-আঁধারি শূন্যতার দিকে তারা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। সকলের বিদায়ের আগে প্রসঙ্গটা ইন্দুই আনে যে, আমরা আমাদের সবচে ভালো বন্ধু জেনেও বারোমাসেও কিন্তু জমায়েত হতে পারি নাই। অথচ আমরা কতো সন্নিকটে থাকি।

সভ্যতার অমোঘ নিঃসঙ্গ করতলে ঢুকে পড়া বাকি বন্ধুরা বিষাদে পাওয়া মানুষের মতো হাসে।

সুবন্ত যায়েদ

কথাসাহিত্যিক। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটি : কতিপয় মৃত্যুপ্রকল্পের প্রাণ এবং মনোদৈহিক স্মৃতিবেদনারা।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field