আমার মুখের দুঃখ চিহ্নগুলি সন্ধ্যার বালিতে
বেঢপ উটের ক্লান্ত পদরেখা যেন, পশুশ্রম
জেনেও তোয়ালে দিয়ে ক্রমাগত ঘষে ঘষে মুছে
ফেলতে চেয়েছি রোজ সেসব অমোঘ রেখাবলী।
স্পষ্টতই নেই গৌরচন্দ্রিকা কিছুই এ গল্পের,
তবু বলা সমীচীন—নিজেকে শরৎ চাটুজ্যের
উদ্ভ্রান্ত নায়ক ভেবে নিষ্কলুষ পতিতার প্রেমে
নাকানি চুবানি আমি খাইনি কখনো ইতস্তত।
প্রত্যহ ক্লাউন সেছে নিজেকে দেখাই কঠিন
সব খেলা ঝুঁকি নিয়ে; কাঁদি কিংবা হেসে হই খুন
দর্পণের মুখোমুখি। সাজঘরে বেশবাস ছেড়ে
পেতে চাই শিল্পসার নিজের ক্ষতের নগ্নতায়।
নাটকীয় একটি বুলেটে কিংবা ঘুমের ওষুধে
ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারতাম বিলক্ষণ—
পারতাম, বুঝেছেন?—কিন্তু তবু কী অধ্যবসায়ে
এখনো রেখেছি জ্বেলে জীবনের ঝঝরে লণ্ঠন!
বরং দুঃখকে কোনো মাননীয় অতিথির মতো
সম্ভ্রমে বসাই ঘরে, কথা বলি পরস্পর আর
নিজেকে বইয়ের মতো খুলে রাখি, পড়বেন তিনি;
কখনো সান্নিধ্যে টেনে তাঁকে আমি করি আলিঙ্গন।
যারা নিত্য গুণ গেয়ে কবরখানার মাতলামি
করে শূন্যতায় আর স্বভাবদোষেই নক্ষত্রের
মুখে থুথু ঘৃণায় ছিটিয়ে দেয় সর্বক্ষণ, দেয় না কিছুরই
কোনো দাম, তাদের দাসখতে আজো লিখিনিকো নাম।
আমার দু’চোখে কত ইতিহাস ফুলের বিস্ময়
হয়ে ফোটে, এবং নৃতত্ত্ব রক্তে গান গেয়ে ওঠে
চৈতন্যের মগ্ন দ্বীপে, ধ্বংসস্তূপে লাগাই পালিশ
কতবার—আমার মানসে ব্যাপ্ত স্বপ্নের স্বরাজ।
কখনো চেঁচিয়ে উঠি এবং মনুষ্য সমাজকে
যথেচ্ছ ধিক্কার দিই, ‘সভ্যতা গোল্লায় যাক’ ব’লে
পা ঢুকিয়ে এক জোড়া বেমানান জুতোর গহ্বরে
ফের এই হতচ্ছাড়া সভ্যতারই ঘনিষ্ঠতা চাই।
দারুণ বিক্ষোভ ফাটে স্বপ্নলোকে পৌরপথে, শুনি
কলরব চতুর্দিকে, নেশাগ্রস্ত মানুষেরা হৃত
স্বর্গের সোনালি শস্য চুরি করে আনার ফিকিরে
পথ খোঁজে, তোলে না কখনো কানে চোর অপবাদ
শস্যের কাঙাল সব দেবতার জ্বলন্ত চাবুকে
জর্জরিত স্বর্গের সিঁড়ির গোল ধাপে, জাগরূক
চোখ দ্যাখে কারা যেন পুরুষানুক্রমে নষ্ট ক’রে
রেখে গেছে শস্যক্ষেত; ছত্রভঙ্গ স্বপ্নের মিছিল।
সত্যকে সর্বদা পাশ কাটিয়ে যায় না চলা, তাই
আয়নায় আমাকে নয়, অতীতের বীরকেই
পুনরাবিষ্কার করি, যিনি তাঁর সর্বাঙ্গে অশেষ
যুদ্ধের ভীষণ ক্ষত করেছেন সহাস্যে ধারণ।
দিকচিহ্ন, নভেম্বর ১৯৬৭