গদ্য ছোটগল্প

যে প্রেম মাঠে চড়ে, ঘাস খায় | ছোটগল্প ও গল্পলেখা | রাবেয়া রব্বানী

প্রেমের সংজ্ঞাকে আমার মনে হয় একটা পিচ্ছিল মাছ আযে-কারণে লিখলাম গল্পটি | রাবেয়া রব্বানীর চেতনাকে নদী। এক্ষেত্রে এক-এক সময় আমরা এক-একটা মাছ তুলতে পারি, সেই মাছ হাতের মুঠোয় থাকে না, পিছলে যায়, আবার যদি তুলি তবে অন্য একটা মাছই উঠে আসে, প্রেমের সংজ্ঞা তাই চির পলায়নপর। এমনই একটা খোঁজের সময় প্রথমে এই গল্পের নামটা আমার মাথায় আসে, “যে প্রেম মাঠে চড়ে, ঘাস খায়”। গল্প তো প্রথমে লেখক আসলে লেখে না, দেখতে পায়। তখনও বিষয় পাত্রপাত্রী ঠিক হয় নি, যতবারই আমি এই নামটা মনে মনে বলি, টুকরো টুকরো কিছু দৃশ্য দেখতে পাই। একটা কবর, ভালদারোর প্রেমিক যুগলের কঙ্কাল, একটা পরিকল্পনাহীন প্রাকৃতিক বাগান, একটা লাল চপ্পল, ভেজা ভেজা উর্বর মাটি, ভেজে রাখা কাবাব, একটা চিরুনি, নখের কোনে জমে থাকা বালি, পুকুর পাড়ে ধোঁয়া উঠতে থাকা কুকার, কিছু পোড়া মাংস। এরপর দেখতে পাই দ্বিধাগ্রস্ত ললিতাকে, অবিরত কবর থেকে উঠে আসতে থাকা ইলিয়াদকে, ব্র্যান্ডির বোতল হাতে সুভাসকে, জয়া আর শম্পাকে এসবের মাঝে খুবই অগুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বোয়ালির মা, টুপু আর রাশিকেও। তবে সবগুলো দৃশ্যই একে অপরের বিপরীত মনে হয়। বুঝতে পারি না এগুলো দিয়ে কি করব। কিন্তু লিখতে বসতেই শব্দ আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একে একে জুড়ে দিতে থাকে দৃশ্যগুলো। ললিতা প্রকট হয়ে উঠে আশেপাশে বাকি সব চরিত্র জড়ো করে কিন্তু ইলিয়াদ যেন একেবারে অস্পষ্ট হয়ে যায় ঠিক একটা ছবির সবচেয়ে পেছনের দৃশ্যের মতো – যাকে কখনো মন্দিরের চূড়া, কখনো পাহাড় কখনো দিগন্তে মেঘের বিভ্রম বলে মনে হয়। পুরো গল্প জুড়ে ললিতা প্রেমের এক একটা সংজ্ঞা তুলে ধরতে থাকে, বাতিল করতে থাকে, তার দ্বিধা, পরস্পরবিরোধী আচরণ চলতে থাকে আর ইলিয়াদ হারিয়ে যায় নিজের সেই সংজ্ঞা, সেই মাছ হয়ে। গল্প প্রায়ই লেখকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, এখানে তাই হয়েছে, তবে যদি জিজ্ঞেস করা হয় গল্পটা আসলে আমি কেন লিখেছি, তবে বলতেই হবে, কেবল একটা বাক্যের প্রভাব থেকে, “প্রেম মাঠে চড়ে, ঘাস খায়”।

প্রতিবার কবরে শুয়ে পড়ার পর ইলিয়াদ এমন করে হাসে আর ললিতা মাটি চাপা দেয়। ঘটনাটা আনন্দের দেখায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য ললিতার অবশ্য মনে হয় তারও শুয়ে পড়া উচিত কি না ভালদারোর প্রেমিক যুগলের মতো, যারা ছয় হাজার বছর ধরে শুয়ে আছে, একসাথে জড়াজড়ি করে। একটু পরই তার আবার মনে হয়, না, প্রেমের কোনো গন্তব্য নেই। তাছাড়া যেহেতু পৃথিবীর সকল কিছুরই একটা মেয়াদ আছে, তিন-চার দিন যেতেই পাউরুটিতে ছাতা পড়ে, তরমুজ টকে যায়, মানুষের চামড়ার কোলাজেন কমে যায় সেহেতু একসাথে দুজনের একটা কবরে শুয়ে থাকাই প্রেম টিকিয়ে রাখার কায়দা হতে পারে না।
কবরটার এদিকে কেউ আসে না। বার বার খোঁড়া মাটিগুলো উর্বর হয়ে ওঠে, হাওয়া ঢোকে, পানি পায়, দ্রুত ঘাস জন্মে। ললিতা তাই সবসময় একটা লাল চপ্পল উলটে রেখে দেয় কবরটার পাশে। দেখে মনে হয় কেউ পা ফসকে পড়ে যাওয়ায় চপ্পলটা উলটে আছে।
আজও ললিতার অভ্যস্ত হাত দ্রুত কাজ সারে। ঝুরঝুরে মাটি, ভাঙা পাথর, তারপর কিছু লতা আর ঘাস, যেন জায়গাটা একটা কবর বলে বোঝা না যায়।
দিদি চপগুলো কি তেলে ভাজব না ছ্যাকব?
বাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ আসে। বোয়ালির মা অবশ্যই কিছু দেখে নি। পূর্ব দিকের জানালাগুলো বন্ধ থাকে এসময়। টুপু আর রাশি যার যার টিভি মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। বোয়ালির মাকে ঢুকতে হয় সদর দরজা দিয়ে। বন্ধ জানালার ভেতর থেকেই বোয়ালির মা আবার চেঁচায়,
দিদি, ও দিদি!
ভেজে ফেল, আজ সুভাস আগেই চলে আসবে।
নিচতলার বেসিনে হাত ধোয় ললিতা, ইলিয়াদের সাথে কিছুক্ষণ থাকলেই নখের ভেতর বিচ্ছিরি মাটি জমে। খুটে খুটে পরিষ্কার করে সে।


সুভাস এসেই ধুপধাপ উপরে উঠে যায়, জুতো খোলে না। বিছানায় কাবাবের সাথে ব্র্যান্ডি নিয়ে বসে। ললিতা জিজ্ঞ্যেস করে না এই ভরসন্ধ্যায় ব্রান্ডি কেন? সে টুপু আর রাশির ঘর ভেজিয়ে দিয়ে আসে।
সুভাস মোজা খোলে আর অফিসের ঝামেলার কথা বলে, ললিতা চুল আঁচড়ায় আর বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা বলে, টাকার হিসেব করে। সন্ধ্যা নামে। সুভাস পূর্ব দিকের জানালাটা খুলে দেয়।
উফ্, বাগানটা অসভ্য হয়ে থাকে ললিতা, দেয়াল নেই।
দেয়াল দিলে বাগান ছোট হয়ে যায়, সুভাস।
যা ছোট তা ছোটই, শুধু শুধু এই বড় করে দেখা, কোনো বিপদ হতে পারে।
সুভাসের চোখ বাগানের চারপাশে দেয়াল দেয়ার পায়তারা করে। ললিতা ইলিয়াদের কবরটার দিকে আড়চোখে তাকায়, লাল চপ্পলটা অন্ধকারেও দেখা যায়।


প্রেম একটা জিওল মাছ, ঘাই দেয়, হাতে নিলেই পিছলে যায়। না না, প্রেম হচ্ছে একটা গরু। শুধু ঘাস খায়, ঝিমায় আর জাবর কাটে। উম… আসলে প্রেম একটা কুকুর। বুকোওস্কি বলেছেন, প্রেম জাহান্নাম থেকে পালিয়ে আসা একটা কুকুর।
গা ঘষতে ঘষতে কথাগুলো বলল শম্পা। শম্পার স্বামী পশু অধিদপ্তরে চাকরি করে বলেই কথাগুলো ধুমধাম মেনে নিতে ললিতার বাধে।
উইমেন্স সুইমিং ক্লাবে ললিতা আর শম্পার সাথে আছে জয়াও। জয়া বাকিদের মতোই পুল থেকে উপরে উঠে বসে তার পা ডলছে। কিছু কালো ছাতা চই পিঠার মতো লম্বা লম্বা হয়ে ঝড়ে পড়ছে ভেজা ফ্লোরে। জয়া নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
উঁহু, প্রেম একটা উড়ন্ত বট গাছ, শেকড় নেই শুধু ঝুড়ি নিয়ে উড়তে থাকে কিংবা মানিপ্লান্ট, ফুল ফল কিচ্ছু হয় না শুধু পাতার বাহাদুরি কিংবা ধরো, প্রেম আসলে কেবল একটা মস, মিহি আর দুর্বল।
তোমার স্বামী ফরেস্ট অফিসার, ললিতা সানগ্লাসটা ওপরে তুলে হাসে।
ললিতা, তোমার স্বামী বীমা কোম্পানিতে চাকরি করে তো, তুমিও প্রেমের উপমা দিতে গিয়ে এবার ইনস্যুরেন্স জাতীয় ব্যাপার আনবে।
জয়াকে ভুল প্রমাণ করে ললিতা বলল, প্রেম বীজের মতো বেঁচে থাকে একটা গোপন কবরে, লাল চপ্পলের মতো উলটো হয়ে পড়ে থাকে সেই কবরের পাশে, প্রেম ঘটে যাওয়ার পর থেকেই কবরে যাওয়া শুরু করে।
জয়া সন্তুষ্ট হয় না, নাহ! কেমন যেন গুপ্ত সংজ্ঞা।
শম্পা ঠোঁট উল্টায়, চেপে রাখা, নিজস্ব, খুব ব্যক্তিগত।
নিজের বক্তব্য নিয়ে ললিতার মনেও সন্দেহ জাগে। সবার আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা থাকে কিন্তু একটা সামষ্টিক সম্মতিতেই কেবল একটা সংজ্ঞা দাঁড় করানো যায়। তাছাড়া দুজন বিবাহিত মেয়ের মতামত ফেলে দেওয়া বোকামি। কেবল বিবাহিত মানুষরাই একটা ভিন্ন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রেমকে দেখতে পারে। একটু ভেবে ললিতা তাদের আবার বলে,
প্রেম গাছপালার মতো অচল দর্শক হতে পারে না।
শম্পা : প্রেম বীজও না, প্রেমের পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই। একটা প্রেমের একটাই সমাপ্তি।
জয়া : তবে প্রেম কি করে কুকুর হয়? সব সময় কি পায়ে পায়ে ঘোরে?
ললিতা : না না, সব সময় না, প্রেমের ঠিক নেই, মাথা মোটা।
গরু।
গরু।
গরু।
প্রেম একটা গরু একথাটা মেনে নিয়েই সবাই নিশ্চুপ হয়ে যায়। জয়ার পায়ের ছাতা ওঠানো শেষ, সে শব্দ করে ঝাঁপ দেয়। শম্পার হাতের গ্লাসে জুস শেষের দিকে, গড়গড় শব্দ হয় স্ট্রতে। একটা গরু ঘাস খাচ্ছে, এমন একটা দৃশ্য ললিতাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।


আঙুর গাছের নিচে বসে আছে দু’জন। বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে না আজ ললিতা। কেউ দেখবে না। সদর দরজায় তালা দেওয়া। বাচ্চারা স্কুলে, বোয়ালির মা আসবে দুপুরে কিন্তু ইলিয়াদ একটু গম্ভীর, হু হা করছে। কবর থেকে উঠে তার সহজ হতে সময় লাগে।
আগে ইলিয়াদ অবশ্য অনেক কথা বলত, হাসত, হাসাত। এখন শব্দ না, ইলিয়াদ শুধু সান্নিধ্যই চায়। একজন রাজ্য সংরক্ষক বা পলাতক আসামীর মতো সাবধানী হয়ে থাকে, বার বার কথা বলতে গিয়ে নিজেকে শুধরে নিতে হয় ললিতার। ললিতা স্পষ্ট বুঝতে পারে এই কবর খোঁড়াখুঁড়ি আর গোপনে দেখা করাটা একটি মেলে রাখা রঙিন কাগজ থেকে, দলা পাকানো আবর্জনা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
দুপুর দ্রুত নেমে আসছে আর একটা গুরুত্বহীন দৃশ্যের মতো ললিতা-ইলিয়াদ বসে আছে আঙুর গাছের নিচে, এই গুরুত্বহীন দৃশ্যই নাকি প্রেম! প্রেমের চেহারা এতই সাধারণ ও নিয়মিত!
ইলিয়াদের গলার হাড়টা উঁচু হয়ে আছে, ললিতার রোমকূপ ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসা কিছু পশম হাতের কবজি পর্যন্ত লেপে পুছে আছে। দুজনের মুখে কিছু তিল, কিছু ব্রণ কয়েক জায়গায় জোট বাধা মেলানিন এইসব বার বার চোখ টেনে প্রেমের সৌন্দর্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ললিতা ভেবেছিল আজ নতুন কিছু কথা হবে, মহামারীর মতো মিলন হবে। প্রতিবারই দেখা হবার আগে এমন কিছু মনে হয় তার, প্রতিবারই একটা গিঁট দেওয়া গোল দড়ির মধ্যে ব্যাপারটা ঘুরপাক খায়। ইলিয়াদ বিশেষ কথা খুঁজে পায় না বা কথা লুকায়। ললিতা বার বার নিজেকে সংযত করে।
একই দেয়ালে বার বার মাথা ঠুকতে আসাকে প্রেম বলে! আসলেই দুটো বোকা, নির্বোধ গরুর অস্তিত্ব অনুভব করল ললিতা যেগুলোর ঘাস খাওয়া শেষ, শুধু জাবর কেটে যায়।
প্রেম একটা গরু, ইলিয়াদ?
ইলিয়াদ যান্ত্রিক স্বরে বলল, প্রেম একটা যন্ত্র, সারভাইভিং টুলস।
ইলিয়াদ কথা না বাড়াতে চেয়ে ললিতাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে তার চুলের গন্ধ নেয়, তারপর বলে, প্রেম একটা যন্ত্রই আর এই যন্ত্র দিয়ে আমরা সচল হই।
নাহ, প্রেম গরুর মতোই…
ইলিয়াদ যেন কথা বন্ধ করতেই ললিতার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। ইলিয়াদকে বেশ স্বার্থপর মনে হয় ললিতার, সে বিরক্ত হয়। নিজেকে ছাড়িয়ে ললিতা খোঁড়া কবরটার দিকে তাকায়। ইলিয়াদ বাইরে বলে কবরটা এখন ফাঁকা, মাটিগুলো চারপাশে জড়ো হয়ে আছে। এগুলো আবার পরিপাটি করতে হবে। এত ঝুঁকি নেওয়ার যোগ্যতা কি এই প্রেম নামক বোকা যন্ত্রটার আছে? গত কয়েকবারের মতো এবারও ললিতা সরিয়ে দেয় ইলিয়াদকে।
সকল যন্ত্রের একটা মেয়াদ থাকে ইলিয়াদ।
ইলিয়াদ মেনে নেয়। স্পষ্ট গলায় বলে, হ্যাঁ।
তুমি চাও একটা নষ্ট যন্ত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে চলে যাবে, আমি চাই না।
ইলিয়াদ গম্ভীর গলায় বলে, আচ্ছা।
কোনো সত্যই ইলিয়াদ অস্বীকার করে না, তার এই ঝুপ করে মেনে নেওয়াটা বেশ অস্বস্তিকর, ললিতা পালাতে চায়, ইলিয়াদকে ঠেলে কবরে নামাতে শুরু করে।
এই ব্যাপারটা বিগত এক দু’বছর ধরেই নিয়মিত ঘটছে, ললিতা খুব আয়োজন করে কবর খোঁড়ে, ইলিয়াদ বেশ অপেক্ষা করে আছে, এভাবে বের হয়, তারপর এভাবেই ললিতা আবার ইলিয়াদকে কবরে নামিয়ে দেয়। পুরো ব্যাপারটা ললিতার সিদ্ধান্তে ঘটে বলে তাকে বেশ স্বার্থপর মনে হয় ইলিয়াদের, সে-ও বিরক্ত হয়। ইলিয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাটি ছুড়তে থাকে ললিতা। ললিতাকে অস্বস্তিতে ফেলার সূক্ষ্ণ প্রতিশোধ নিতেই তখন ইলিয়াদ হাসে।
এবার দ্রুত কবর দেওয়া শেষ করে ললিতা হাত ধোয়, নখ থেকে মাটি সরায়। তবে আজ লাল চপ্পলটাও ময়লার বাক্সে ফেলে দেয়।


ললিতা আর শম্পা যে যার মোবাইলের দিকে ঝুঁকে আছে। কুকারটা পুকুরের পাড়ে। ধোঁয়া উঠছে, চারদিকে মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে গেছে।
এটা পিকনিক হলো? জয়া বাকি দুজনের মোবাইল দুটো কেড়ে নিয়ে প্রশ্ন করল।
উত্তর না দিয়ে ললিতা চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। কেউ উঠছে না বলে জয়া উঠে টার্নারটা দিয়ে মাংসের টুকরাটা উলটে দিল। ফিরে এসে বলল, একটা সময় পর পর মাংসকে উলটে নিতে হয়।
ললিতা : স্টিমিংয়ে এই ঝামেলা নেই।
শম্পা : সেদ্ধ করলে নির্যাস গিয়ে জমা হয় গ্রেভিতে, টেস্ট লেস।
জয়া : আরামটাই আসল কথা না, বিষয় হচ্ছে টেস্ট উইথ ডিজায়ার উইথ রিস্ক। প্রেমের মতো।
শম্পা : পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকিটাই তাহলে প্রেম?
জয়া নেতার মতো মাথা নাড়ে। কথাটা ললিতার ভালো লাগে। শম্পারও ভালো লাগে। তারা যে যার মতো পোড়া মাংস আর প্রেম নিয়ে ভাবতে থাকে, আর অনেকক্ষণ না ওলটানোতে মাংসের টুকরাগুলো কালচে হতে থাকে। সেগুলো ললিতা প্লেটে করে নিয়ে এসে চাদরের ওপর রাখে আর বলে, এটা প্রেম না চিতা?
জয়া নিচু স্বরে বলে, হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়/ চিতা তার পড়ে থাকে শুধু।


মানুষের মন বদলে যায় সাত দিন পর পর। তিন সাতে একুশ দিন পর পর্যন্ত যদি একটা স্থির অবস্থা ধরে রাখা যায়, তবে না অভ্যাস ছোটে, সুভাস তার অ্যালকোহলের বোতলের সারির দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।
সুভাসের কোঁকড়া চুল বিচ্ছিরি রকম বড় হয়ে আছে, তার আচরণ এখন ভালো না। একটুতেই খিঁচিয়ে ওঠে, বিরক্ত হয়। তবে সে চেষ্টা করছে জিনিসটা ছেড়ে দেওয়ার, আজ চৌদ্দ দিন হলো। ললিতাও কবর খোঁড়েনি চৌদ্দ দিনই হলো। তবে দুজনের মাথার ওপর এখনো বাকি সাতটা দিন বছর হয়ে ঝুলে আছে।
ললিতা জানালা দিয়ে কবরটা খুঁজল। চপ্পলটা নেই। আগাছাগুলো বড় হয়ে আছে। একটা বালতি পড়ে আছে, পুরনো। দেয়াল নেই বলে বাগানটা পাশের পতিত জমির সাথে মিশে বিশাল দেখাচ্ছে।
ঘরে বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছে বলে ললিতা বাগানের দিকে গেল। চার পাঁচ দিন ধরে বৃষ্টি হয়। এখানে ওখানে নতুন আগাছা। ঝিঁঝিঁ পোকারা বাগানটাকে একটা হৃৎপিণ্ড বানিয়ে ছেড়েছে, ললিতার মনে হচ্ছে সে কারো বুকের ওপর দিয়ে হাঁটছে। আঙুরলতার কাছে গিয়েই জায়গাটা চিনতে পারল সে। আহারে! একটা বাজপাখির মতো সঙ্গী হারানোর বেদনা হঠাৎ তাকে বিলাপ করিয়ে ছাড়ল।
জানালায় সুভাস দাঁড়িয়ে আছে, সে চৌদ্দ দিন হয় মদ স্পর্শ করেনি, ললিতাকেও আরো সাত দিন কবর খোঁড়া থেকে বিরত থাকবে হবে। সুভাস জানালায় দাঁড়িয়ে চেঁচাল, এই সন্ধ্যায় কি করছ ওখানে?
ললিতা বিড়বিড় করল,
প্রেম একটা যন্ত্র যার মেয়াদ আছে।
প্রেম কখনো পোড়া মাংস, কখনো চিতা।
প্রেম মাঠে চড়ে, ঘাস খায়।

রাবেয়া রব্বানী

জন্ম নারায়ণগঞ্জে। ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেছেন। ছোটগল্প লেখেন, অনুবাদ করেন। তাঁর প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন : নিহত সূর্যের দেশ (সময় প্রকাশন), ইহা হয় ঢাকা (বিদ্যাপ্রকাশ), ইস্তাম্বুল সিটি অব ফ্রাগ্রান্স (ভ্রমণ উপন্যাস)। প্রকাশিত অনুবাদসমূহ : কিচেন (সময় প্রকাশন), প্রেম পূজা ভোগ (সন্দেশ প্রকাশন), আমি এখানে বক্তৃতা দিতে আসি নি (সন্দেশ প্রকাশন), ফেইট অব দা নেশন (অংকুর প্রকাশন), আরো দুটো অনুবাদের কাজ করছেন তিনি। সাহিত্যে ছোটগল্পই তার প্রিয়।

গল্পটি সম্পাদনা করেছেন আর পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন কথাসাহিত্যিক শিল্পী নাজনীন। নিচের লিংকে ক্লিক করে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়ুন।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field