লেখালেখি

গল্পের আমরা, আমাদের গল্প | ইমতিয়ার শামীম | লেখালেখি

সমতলের আমরা সমুদ্র আর অরণ্যের স্বাদ পাই শ্রুতির অনুষঙ্গে। আমাদের প্রথম সাগর, অরণ্য কিংবা বরফপাত ও লু হাওয়া দেখা ও অনুভবের অভিজ্ঞতা হয় গল্প শোনার মধ্যে দিয়ে। সে গল্পের কোনওটা সাত সাগর আর তের নদীর ওপারে বন্দিনী রাজকন্যার, কোনওটা ধর্মসভায় ভাড়া করে নিয়ে আসা মওলানার বয়ান, যা শুনতে শুনতে শীতের রাতেও আমাদের শরীরে খেলে যেত লু হাওয়ার এলোমেলো ঝাপটা। খুব ভোরে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে মেঠো পথে চাষের জমি, রেলস্টেশনে কিংবা স্কুলে যেতে যেতে আমরা তুষারপাতের মধ্যে হাঁটার আস্বাদ নিতাম। এসব অভিজ্ঞতা লেখা আমার জন্যে তেমন অস্বস্তিকর না হলেও যাঁরা পড়বেন তাঁদের চোখের সামনে হয়ত বা আমার ‘আমিত্ব’ ঝকমক করে উঠবে। আর তাই পড়তে পড়তে গালিগালাজও করতে পারেন তাঁরা। তবু বলি, যতই আমিত্ব থাক প্রক্রিয়াটি শেষাবধি যৌথ। আমরাই নির্মাতা এসব আমিত্বের। পরিবারে আমাদের শেষের দিকের ভাইবোনেরা ছিলাম মায়ের থেকে বেশ কিছুটা দূরে মাকে আমরা পেতাম দিনের শেষে, শরীরের ক্লান্তি তার কণ্ঠেও ভর করত, তাকে দেখতাম কোনও মতে তাড়াতাড়ি জায়নামাজে বসে অমন দীর্ঘ কর্মব্যস্ততায় পাপাচার করার কোনও সুযোগ না থাকলেও খোদার কাছে পাপমোচন আর সংকটমুক্তির জন্যে অবনত হয়ে মাথা নোয়াতে। কণ্ঠ নয়, যেন তার ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ থেকে আমরা যে পারস্যের উপকথা শুনি তাও বোধহয় ওই কারণে, উপকথা বলার হলে সোলেমান পয়গম্বর কিংবা সোহরাব-রুস্তুম আর ইউসুফ-জোলেখার পাপপূণ্যবোধে আমাদের মনজগত গড়ে তুলতে।

গল্পের জগৎ খুঁজতে আমরা আরও যেতাম এদিকওদিক। হয়ত সেখানে কেবল বড়রাই বসে আছে, কিন্তু তাদের গল্প বলায় ছেদ পড়তে দেখি নি। হতে পারে, প্রাইভেসি শব্দের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সেসব দিনের আড্ডাকে তখনও আক্রান্ত করতে পারে নি। অথবা তারা ভালবাসতেন নিজেদের আড্ডার প্রসঙ্গ উপেক্ষা করে ছোটদের প্রশয় দিতে আমাদের বাড়িতে কামলার কাজ করতেন ফয়েজ জোয়াদ্দার, কুরমান আলীর মতো গল্পবলিয়ে মানুষ। সাত সমুদ্র আর তের নদী তাঁরা এনে দিতেন আমাদের একেবারে হাতের কাছে। এখনও মনে পড়ে, তাঁদের সেসব গল্প রূপকথা হলেও অনেকটা জুড়ে আদিরসাত্মক ঘটনাও থাকত। আমাদের মতো বালকেরা থাকলে গল্প বলতে হতো সম্পাদনা করে। বলতে বলতে তারা আমাকে তাগাদা দিতেন তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার। কেননা এমন অনেক রূপকথা আছে যার খানিক পরপরই আদিরসের বন্যা নেমে আসে। কতক্ষণ আর গল্প বলা যায় কিশোরোপযোগী সম্পাদনা করে?

এখনও আমার মনে পড়ে এমন এক রূপকথার সামান্য আদিরসাত্মক অংশ। তখন। বর্ষা ও শরতের পর এই সময়ে তেমন কাজ থাকে না। এ সময়ে তাই শুরু হয় বর্ষায় হয়ে যাওয়া গৃহস্থালী গুছিয়ে নেয়ার কাজ। হয়ত তৈরি করা হয় ঘরের বেড়া নতুন করে। অথবা উরুর ওপর টাইকরাশ নিয়ে রশি পাকানো হয়। সন্ধ্যায় নেমে আসা সামান্য শীত এড়াতে হালকা আগুনের আঁচে কামলারা পোড়াতে থাকে শোলার আটির ফেইশ্যা। এরকম এক সময়ে গোয়ালঘরের জন্যে শোলার বেড়া বুনতে বুনতে কুরমান আলী চাচা তার সঙ্গীদের এক গল্প শোনান, যাতে ছিল এই আদিরস : এক রাজকুমার খুবই উদ্বেলিত হয়ে তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী রাজকন্যাকে চুপে চুপে দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু রাজবাড়িতে ঢুকবে কেমন করে। তাই সে রাজবাড়ির প্রহরীর কাজ নেয়। একরাতে রাজকুমারী তার গোপন প্রেমিক এলে এমনে এক আশ্চর্য সঙ্গমে মেতে ওঠে যে খাটের একটি পায়া ভেঙে যায়। রাজকুমারী তখন ডেকে আনে প্রহরীবেশী হবু স্বামীকে। হুকুম দেয় পায়ার বিকল্প হিসাবে কাঁধ ঠেকিয়ে খাটটা সোজা করে রাখতে। বলে, খাটটা ঠিকমতো কাঁধে রাখতে পারলে পরদিন এক কুড়ি মোহর দেয়া হবে প্রহরীকে আর না রাখতে পারলে ঘরে ঢোকার অপবাদ দিয়ে গর্দান নেয়া হবে। ছন্দবেশী রাজকুমার খাটের কোণ কাঁধে নিয়ে একঠায় বসে থাকে আর দেখে হবু বধুর কামতাড়না। কিন্তু পরদিন রাজকুমারী ঠিকই ভুলে যায় কামোম্মত্ততার সময় দেয়া প্রতিশ্রুতি। অনেক অনেক ঘটনার মধ্যে দিয়ে, যা এখন আমার আর একদম মনে নেই, একসময় বিয়ে হয় রাজকুমার আর রাজকুমারীর। বাসর রাত পেরিয়ে দুপুর বেলা তারা বসে পাশা খেলছে। পাশায় যে হারবে সে দেবে কত শত হাজার মোহর। রাজকুমার হেরে যায় সেই পাশা খেলায়। বাজিতে জেতা মোহর গুণতে গিয়ে রাজকুমারী দেখে বিশটি মোহর কম। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই রাজকুমার স্মরণ করিয়ে দেয়, অতীতের সে রাতের কথা।

অথবা গল্পের প্রতিপক্ষে বাস্তবতা, – তাও তো আমাদের মনে হতো গল্প। সেখানে দুর্ভিক্ষ, গণবাহিনী আর স্বপ্ন, বুভুক্ষ আর অসহায়তা; এসব নিয়েই বাঁচি আমরা, বেড়ে উঠি। যে বাস্তবতা থেকে পিতামাতা তার সন্তানকে আড়ালে রাখতে চায়। অগ্রজ চায় তার অনুজকে দূরে রাখতে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও সে বাস্তবতা তো গল্পই মনে হয় কখনও হঠাৎ শুনে ফেললে। কিন্তু তারপরও মানুষের প্রাণ অত সহজলভ্য ছিল না সেই গল্পে। সেনাশাসনের সময় এক ঘটনা ঘটতে দেখি একেবারে দিনদুপুরে। পিস্তল হাতে দৌড়ে পালাচ্ছে কয়েকজন তরুণযুবা। এসে ঢুকলো একেবারে স্কুল কম্পাউন্ডে। আমাদের শিক্ষকেরা তাদের লুকিয়ে রাখলো লাইব্রেরির ভেতর। আমাদের শিখিয়ে দেয়া হলো, কেউ এসে জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে স্কুলের ভেতর কেউ ঢোকে নি। শীতের রাতে গ্রামের কোনও উঠানে বিরাট বাবরি চুলের সঙ্গে ঢেঁকি বেধে চড়কির মতো ঘুরাচ্ছে নওয়াব আলী নামের চল্লিশোর্ধ মানুষ, এখন মনে হয় রীতিমতো স্বপ্ন; লাঠিবারি খেলা হচ্ছে, ঢাকের শব্দ এখনও কানে বাজছে। বরফ কেনার টাকা নেই, কিন্তু কে কে বরফ কিনে খায় তা দেখার জন্যে আইসক্রিমওয়ালার পেছন পেছন হাঁটছি মাইলের পর মাইল। বড় চুল রাখব বলে নাপিতকে দেখামাত্র উধাও হয়ে গেছি গ্রাম থেকে গোটা বালকের দল, বয়োজ্যেষ্ঠদের কণ্ঠ পৌঁছাতে পারে নি আমাদের শ্রুতি অবধি। নৌকা বাইচ দেখতে রওনা হয়েছি ভর দুপুরে, যেতে হবে অনেক দূরে সেই বড়হরে, ফিরতে ফিরতে ক্ষুধা উঠে আসছে, চোখ খুঁজছে গাছের পাতার ফাঁকে ফল আছে কী না। কিংবা ফুঠবল খেলা আছে দূরের গ্রাম সরাতৈলে, খেলা দেখতে দেখতে মারামারি; অথবা মারামারি নয়, খেলা শেষে খেয়াঘাটে এসে আমরা দেখতে পেলাম কোনও নাও নেই, সাঁতরিয়ে পেরুতে হবে বিশাল নদী, ঝাঁপ দিয়ে খানিক দূরে গিয়েই দেখতে পেলাম হাবুডুবু খাচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছে ভাল খেলোয়াড় মতিন, বুটপরা ক্লান্ত পা পানির ভারে ওর শরীরকে টেনে নিচ্ছে পানির নিচে, এতদিন পরে আর মনে নেই কে কে তাকে তুলে নিয়েছিল পিঠের ওপর, কে তার বুটজোড়া খুলে ফেলেছিল ওই অবস্থাতেই আর ক্লান্তি কাটাতে আমরা মুখের মধ্যে পুরে নিয়েছিলাম শাপলার তাজা কাঁচা একাহারা ডাঁটা। কে যে গান গেয়েছিল গাছে চড়ে মৌলভী স্যারকে লক্ষ্য করে জোরে জোরে, প্রেম করেছে ওয়ারেস মৌলভী/ সকলে তাহা জানে না/ তার প্রেমেতে শাহিদা বিবি… । খুব সহজেই আমাদের কারও কাঁধে এসে চেপে বসে বন্ধুর কিশোর প্রেমের দায়। হেডস্যারের কাছে তার ছেলে সমেত আমরা সবাই স্যান্ডেল না কী জুতোর বাড়ি ভাগাভাগি করে নেই। তখন যে বন্ধু সত্যিই প্রেমে পড়েছিল, সেও বুঝতে পারে প্রেমট্রেম কোনও কিছুই গ্রাস করতে পারে নি তাকে। এরকম সব গল্পের দিনরাত যেখানে আছে সেখানে কাছাকাছি সমুদ্র বা অরণ্য না থাকলেও কোনও কিছু আসে যায় না। আমাদের কখনও মনে হয় না কত বেশি প্রাকৃতিক দৈন্যে আকীর্ণ আমরা সমতলের মানুষেরা। চোখের মণিতে আটকে যাওয়া বিশাল ধানী প্রান্তর, বর্ষণমুখর দিনরাত্রি, বর্ষা ও বন্যার অকুল পাথার, শীতের সূর্যতৃষা কিংবা খরায় পুড়ে যাওয়া স্কুলের মাঠের ঘাস আর কখনও ফাটতে থাকা বিস্তীর্ণ ফসলী জমি, অনেক দূরে সেই ভূমির কাছে নত হয়ে সংলগ্নতা নেয়া আকাশ আমাদের কেবলই সান্ত্বনা দেয়, অপেক্ষা করতে শেখায়। তারপর অক্ষরজ্ঞানের ধকল সামলে উঠলে আমরা আরও নিকটবর্তী হই সমুদ্র, অরণ্য, তুষারপাত, এস্কিমোর বরফের ঘর আর রবিনসন ক্রুশো ও জেমস স্কটের মতো মানুষের। ধীরে ধীরে বড় সন্তানের অকাল মৃত্যুর স্মৃতিদিন ধরে রাখা বাবার হাতের লেখায় জ্বলজ্বল দেব সাহিত্য কুটিরের পুরানো বইয়ের পাতায় লেখা ‘হামিদুল হক চৌধুরীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে—বিয়োগকাতর বাবামা’ পেরুতে গিয়ে হঠাৎ আনমনাও হতে শিখি, এই বই তো কোনও দিন আমাদের সেই জন্মের পরেই মরে যাওয়া বড় ভাই ছুঁয়েও দেখবে না, তবু কেন তাঁর স্মৃতিতেই কেনা হয়েছে এ ‘সোনার কাঠি রূপার কাঠি’? বইয়ের ভেতর থেকে উঁকি দেয় কলকাতার বিখ্যাত দাঁতের চিকিৎসক বিক্রমপুরের ছেলে আর আহমেদের অনেক বড় হয়ে উঠবার গল্প। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি মাত্র পঞ্চাশ টাকা পকেটে নিয়ে প্রথমে গিয়েছিলেন বোম্বাইতে। তারপর এক জাহাজে আলু ছুলতে ছুলতে তিনি না কি গিয়েছিলেন সেই দূর বিলেতে; কিন্তু সেখানে থেকে ভাল দাঁতের ডাক্তার হওয়া যাবে না জেনে আবার ইটালির এক জাহাজে ঘোড়ার সহিসের কাজ নিয়ে চলে যান আমেরিকাতে। কিন্তু সেসব দেশও তাঁকে আটকে রাখতে পারে নি, তিনি ফের চলে এসেছেন ভারতে, কলকাতার চৌরঙ্গী লেনে। আবার আশালতার গল্পে বিলেত থেকে ফিরে আসা ব্যারিস্টার সোমেনবাবু ছেড়া মোজাপরা মিনুর সাবলীল আবৃত্তি ‘বিলেত দেশটা মাটির—সেটা সোনা রূপার নয়/ তার আকাশেতে সুর্যি ওঠে, মেঘে বৃষ্টি হয়। সেথা পুঁটি মাছে বিয়োয় নাক টিয়ে পাখির ছা আর চতুষ্পদ সব জন্তুগুলোর চারটে চারটে পা’ শুনতে শুনতে অনায়াসে দেশেই থিতু হয়ে বসে। তখন রূপকথা ধীরে ধীর দূরে চলে যায়, যদিও আমাদের মাথার চিলেকোঠার কোনও এক কোণে পড়ে থাকে গল্পের সমুদ্র, অরণ্য, মরুভূমি, বনবনানী কিংবা বরফকুচি। আর যুদ্ধদিনও ফিরে ফিরে আসতে থাকে এসবের ফাঁক গলিয়ে। কত অনায়াসে আমাদের দৃষ্টির সীমানায় পড়ে থাকে অস্ত্র, বেয়নেট, বোমা, গুলি। তারপর একদিন সেসব জমা দিতে নিয়ে যায় বড়রা। যুদ্ধ শেষ হলেও যুদ্ধ আসলে শেষ হয় না। যুদ্ধ যেমন পর্দার আড়ালে চলে যায়, অস্ত্রও তেমনি চলে যায় অন্তরালে। কিন্তু সময়ে তারা ঠিকই নিজেদের চেহারা দেখায়।

এরকম সময়ের মধ্যে দিয়ে একেবারে প্রাণান্তকর চেষ্টার মধ্যে দিয়ে কোনও কিছু লেখার আকুতি সত্যি কথা বলতে গেলে শৈশব, কৈশোর এমনকি ভার্সিটির বয়সেও আমার তেমন ছিল বলে মনে হয় না। তবে এও সত্য, লেখালেখির আবহ আমার চারপাশে সবসময়েই ছিল। কিন্তু সেই আবহ এত তীব্রও ছিল না যে কোনও প্রসন্নতায় অথবা ট্রমা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আমাকে লেখার খাতা খুলে বসতে হবে। ট্রমা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে লেখার খাতা খুলতে শিখি অনেক পরে, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে এসে; কিন্তু আমার জন্যে সত্যিই বেদনার ব্যাপারে যে আমাকে লিখতে হয় কম্পিউটারে, লিখতে লিখতে এখন অস্বস্তি না লাগলেও এটা একান্তই ব্যক্তিগত দুঃখ কাগজের ওপর কলম দিয়ে লেখা আমার জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি আসলে পড়তে ভালবাসতাম, এখনও ভালবাসি। বইয়ের প্রতি এই ভালবাসার ধরন হয়ত বয়স আর অনুভূতির সঙ্গে পাল্টাতে থাকে, কিন্তু কোথাও তবু একটা সঙ্গতি রয়েই যায় শেষাবধি। এখনও তাই ছোটবেলার মতো শিশুকিশোরদের বই পড়তে আমার আগ্রহে একটুও ঘাটতি নেই। বরাবরই পড়াই বরং আমার ট্রমা থেকে উত্তরণের প্রধানতম পথ। স্কুল পেরুনোর আগেই একবার বড়সড় আমাশয়ের ধকল, দু’বার প্যারাটাইফয়েডের ধকল একবার টাইফয়েডের ধকল আর আরেকবার রিউম্যাটিক ফিভারের সঙ্গে লড়াই করতে হয় আমাকে। জানি না এসবের প্রভাবেই টিউবারকুলোসিসের টিকা নেয়ার পরও তা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল কী না। তবে এ তো সত্যি, তারুণ্যে আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এ রোগের সঙ্গে। ভাল খেলতে না পারার আকুতি নিয়ে আমি আমাদের সমবয়সী এমনকি অগ্রজদের সঙ্গে মিলে অনেক অনেক দূরে চলে গেছি খেলা দেখতে। শীতের দিনে রাতে যাত্রা দেখাও ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের মা-বাবাকে এ নিয়ে কখনও কোনও সন্তানকে শাসন করতে দেখি নি। বোধহয় এ জন্যেই আমরা কোনও ভাইবোন কাউকে শাসন করতে শিখি নি, কারও শাসন মেনে নিতেও শিখি নি, হুকুম করতে শিখি নি, হুকুম মানতেও শিখি নি। এমনকি ধর্মসভাও ছিল আমাদের কাছে বন্ধুবান্ধবদের একত্রে মেলার উপলক্ষ্য । কিন্তু এসবের মধ্যেও তো মানুষ নিঃসঙ্গ হতে শেখে কিংবা কখনও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন বই সঙ্গ দেয়, সঙ্গে দেয় বিবিধ স্মৃতি। আবার এসবই যে লেখার আবহ তৈরি করে। তাই বা বলি কি করে। যে কোনওভাবেই হোক, হাইস্কুলের শেষ দিক থেকে আমার প্রধান পাঠ্য হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সাহিত্য। আসলে আমাদের তখন এত দ্রুত, এত ঘন ঘন স্বপ্ন তৈরির ক্ষমতা ছিল যে শেষ পর্যন্ত কী করব তা ঠিক ছিল না। চোখের সামনে দেখা চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, ছিয়াত্তরের খরা, রক্ষীবাহিনীর তাণ্ডব আবার গণবাহিনীর কারও পিস্তল হাতে দিনেদুপুরে দৌড়ে যাওয়া দেখার আতঙ্কও আমাদের সেসব স্বপ্নকে ভেঙে দিতে পারে নি। এ বয়সে সেসব দেখলে কী হবে জানি না, কিন্তু শৈশব আর কৈশোর এতই শক্তিমান যে নিরন্ন থেকেও আমরা পার হতে পারি নি। আমরা বরং দুর্ভিক্ষ আর খরার ধকল কাটিয়ে উঠে দল বেধে সিনেমা দেখতে যেতে শিখি। বিচিত্র সব উপায়ে সিনেমার টিকেট কেনার টাকা সংগ্রহ করা হতো। আমার একমাত্র উপায় ছিল খবরের কাগজ, ক্লাসের পুরানো খাতা অথবা বাড়ির পুরানো অপ্রয়োজনীয় পত্রিকা সের দরে বিক্রি করা। জানি না আমি যে পত্রিকাকে তখন অপ্রয়োজনীয় ভাবতাম, কালের বিচারে এখন তা প্রয়োজনীয় কি না। তবে পুরানো সওগাত আর মোহাম্মদীর আগে পিছের বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো ছিঁড়ে বিক্রি করায় এখন মাঝে মাঝে হাসি ও দুঃখ পায়। পলিথিন তো ছিল না তখন, তাই পুরানো কাগজ দামীই ছিল। গ্রাম থেকে দুপুরের ট্রেনে আমরা বন্ধুরা মিলে জেলা শহরে যেতাম, সেখানে যতগুলো সিনেমা হল ছিল সবগুলোতে একটানা বিভিন্ন শো দেখে আবার শেষরাতের ট্রেনে চলে আসতাম গ্রামে । কিংবা তিন মাইল হেঁটে ইচ্ছা হলে চলে যেতাম থানা শহরে। তখন একবার মনে হয়েছিল চলচ্চিত্রকার হব, পুনায় যাব লেখাপড়া শিখতে।

শেষমেষ এই যতটুকু লেখালেখির চেষ্টা বা অপচেষ্টা তার কারণ খানিকটা পারিবারিক, খানিকটা পারিপার্শ্বিক। গদ্য আমি লিখতে শুরু করি আমার স্কুলের সহপাঠীর দেখাদেখি, রিশিত খান নামে ও এখনও বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করে। ওই সময়ে আমরা ছিলাম হরিহর আত্মা। আমি স্কুলক্যাপ্টেন পদে ইলেকশনে দাঁড়ালে ও সুযোগসন্ধানী ভোটারদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে রাগে গরগর করতে করতে প্যাকেটের পর প্যাকেট জুলমাত আর বাঁশী বিড়ি আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠেছিল, খা, খা। সত্যি কথা হলো এই, সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমি পড়াই শুরু করি অনেক পারে। শিশুকিশোরদের বই, মার্কস-এঙ্গেলস কিংবা লেনিনের রচনাবলী, বিপ্লব ও রাজনীতির ইতিহাসকে আমাদের পাঠকরা এখনও ঠিক সাহিত্য বলে মেনে নিতে শেখেন নি। অথচ আমি সেসব পড়তেই বেশি ভালবাসতাম।

একঅর্থে আমার গল্প তাই আমার অগ্রজ গল্পকারদের গল্প পড়ার ফসল নয়। এটা বলা সত্যিই বিব্রতকর, প্রথমদিকে আমার গল্প লেখার শুরু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেমন রিশিত খানের দেখাদেখি। কিংবা প্রচলিত অর্থে যাকে বলে বড়দের গল্প সেরকম গল্প আমি প্রথম লিখি আমাদের এক ভাবীর ছোটভাইয়ের প্রেমের ঘটনা শোনার পরে। প্রেমিকার বেরসিক তাই মাস্তানদল নিয়ে তার কান কেটে দিয়েছিল। কলেজে অসম্ভব সুন্দর দেয়াল পত্রিকা বের করত আমাদেরই সংগঠনের সুব্রত বসাক, তাতেও লেখালেখি করি আমরা, খানিকটা উৎসাহে, খানিকটা নাম কুড়াতে, খানিকটা আবার সংগঠনের ব্যপ্তি স্বার্থে। একেবারে গল্প লেখার মন নিয়ে আমি বোধহয় বড়দের জন্যে প্রথম গল্প লিখি ‘আইনকানুন’ নামে। সেটাও আমার এক বন্ধুর গল্প। স্কুলের পড়া অনেক চেষ্টা করেও ও শেষ করতে পারে নি। শরৎচন্দ্রের বই থেকে লাগসই বাক্য তুলে প্রেমিকার কাছে চিঠি লিখে পাঠানোর কায়দা অবশ্য ঠিকই রপ্ত করেছিল। আমার চেয়ে দ্বিগুণ শরীর, স্কুলে পড়ার সময়েই মাটিতে রাখা পাঁচনম্বরী ফুঠবল ও অনায়াসে পাঁচ আঙুলে আঁকড়ে ওপরে তুলে ধরত, ওর হাত এত বড় ছিল! শেষ পর্যন্ত ও হয় ট্রাক ড্রাইভার (এখন ও আছে সৌদি আরব)। ওকে নিয়ে লেখা এই গল্পটি সাপ্তাহিক সন্ধানীতে ছাপেন সুশান্ত মজুমদার। একটা পোস্টকার্ডে চিঠিও লিখেছিলেন তখন আমার কাছে, মনে পড়ে। ততদিনে আমি রাজনীতিতে আরও ভয়ানকরকম জড়িয়ে গেছি। আমার এই লেখালেখিটা যতটা না আমার তারও চেয়ে আমার বন্ধুদের প্রাণান্ত চেষ্টার ফল।

লেখার জন্যে দিনের পর দিন লেগে থাকার অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে, নতুন নতুন পড়া বই নিয়ে কথা তুলে আমাকে লেখালেখি আর পড়ায় শেষাবধি আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে ওরা। আমাদের সামনে লিটল ম্যাগ প্রকাশের দুর্দান্ত তেজ নিয়ে তখন ঘোরাফেরা করেছে নূরুল কবির, তারিক-উল ইসলাম, আবু মুসা বিশ্বাস, তপন সাহা, দীপক চৌধুরী, মামুন হুসাইন, রাজা হাসান, স্বদেশ বন্ধু সরকার, শাওন সৈয়দ, রাশেদ উন নবী, সুব্রত বসাক, পিন্টু ভৌমিকরা। রাজনীতি থেকে সাহিত্যে চলে যেতে আমাদের একটুও দ্বিধা হয় নি, কিংবা সাহিত্য থেকে রাজনীতিমুখী হতেও সংশয় জাগে নি কোনও সময় । আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়তেন (এখনও বেশি পড়েন) রাজা হাসান; যা পড়তেন তা আমাদের পড়া আছে কী না জানতেও চাইতেন। আর এটাই একসময় বিব্রতকর হয়ে ওঠে, আমাদের আরেক বন্ধু লিখন রহমানের কথায় বলতে গেলে, ‘কতদিন আর সত্যি কথা বলা যায়, এক সময় বলতে শুরু করলাম, পড়েছি বোধহয়’। রাজা ভাই এত পড়তেন আর সেসব ফের বলতেনও এত আবেগ নিয়ে যে আমরা শুনতাম মুগ্ধ হয়ে। প্রচণ্ড বাজে বই পড়েও আমরা কোনও না কোনও ইতিবাচক, বিশ্লেষণাত্মক, বিস্ময়ের দিক ঠিকই তুলে আনতাম, তখন আমাদের হজম করার শক্তি এতই প্রবল ছিল! প্রশংসা করার শক্তি ছিল, শক্তি ছিল সমালোচনা করার। সেই মন আর শক্তি ধীরে ধীরে হয়ত বা হারিয়ে ফেলছি প্রত্যেকেই, নিজেদের জান্তে-অজান্তে এখন, এতদিনে আমি বলতে পারি, হোক বা না হোক, গল্প উঠে আসে আচ্ছন্নতার মধ্যে দিয়ে, মুক্তির আস্বাদ নিয়ে। আর সেই আচ্ছন্নতার বোধই তার প্রকরণ ঠিক করে দেয়। কিন্তু একজন মানুষের ব্যক্তিগত আচ্ছন্নতা কিংবা মুক্তির আস্বাদের সঙ্গে একজন পাঠকের যোগ কতটুকুই বা থাকতে পারে। হয়ত আমাদের গল্প সে কারণেই কোনও গল্প হয়ে ওঠে না, কেননা আমাদের বিন্দু বিন্দু অভিজ্ঞতা যখন ব্যক্তিগত আমার আচ্ছন্নতা ও আস্বাদের মধ্যে দিয়ে তারস্বরে বেরিয়ে আসে তখন তা তো আর আমাদের থাকে না। আবার কতদিন পরে সেটা আমার থেকে আমাদের হয়ে উঠবে কেইবা তা বলতে পারে? আসলে আমাদের আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে শৈশব কৈশোরের সেসব গল্প শোনার দিন, তারুণ্যের আবিষ্কার ও মুগ্ধ হওয়ার কিংবা ক্ষেপে উঠে হাসান আজিজুল হককে লক্ষ্য করেও অনায়াসে ‘ডেড হর্স’ বলবার দিন; প্রাত্যহিকতায় স্নান ও বিবর্ণ হতে হতে কখন যে সেসব দিন ফের ঝলসে উঠবে তার প্রতীক্ষায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতেও প্রত্যাশা নিয়ে বেঁচে থাকব আমরা সবাই।

তার কাছে এই গল্প লেখার দিন খুবই তুচ্ছ, ম্লান আর যন্ত্রণাকর।

২২ ডিসেম্বর ২০০২

উৎস : অমিত্রাক্ষর, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০০৩

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field