ছোটবেলায় একাবার স্টুডিওতে গিয়ে মা পরীর মতো সেজে একটা ছবি তুলেছিল। চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। ছিয়ানব্বইয়ের কথা। একটা পা টুলের উপর তুলে দিয়ে বেশ স্টাইলিশ ভঙ্গিতে ছবিটা তুলেছিল। পরনে যে-শাড়িটা ছিল, শুনেছি সেটা বড়মামা দেশের বাইরে থেকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। কোন দেশের তা জানা নেই। একটু বড় হয়ে শাড়িটা আমি বহুবার গায়ে জড়িয়েছি। তারপর কোন এক রাতে শাড়িটা আমি কেটেকুটে ফালি ফালি করে ফেলেছিলাম। কেন তাও জানিনা।
শাড়িটা ছিল সফট সিল্কের আর কালচে কফি রঙের। মায়ের হাতে যে-ঘড়িটা ছিল ওটা মেজমামা স্পেন থেকে পাঠিয়েছিলেন। মায়ের এই দুই ভাই মূলত আমার নানুর প্রথম স্বামীর সন্তান। শুনেছি নানা আর্মিতে ছিলেন। তার মৃত্যুর পরেই তার ছোট ভাইয়ের সাথেই বিয়ে হয়েছিল নানুর। সম্পত্তি বেহাত যেন না হয়ে যায় তাই এ বিয়ে। আমার নানা আর নানু চাচাতো ভাইবোন ছিলেন আর নানু ছিলেন তার বাবার একমাত্র কন্যা এবং বেশ ভালো সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার। সে-বিয়েতে নানুর সম্মতি জানার প্রয়োজন কেউ করেনি। আমার নানাভাইয়ের প্রথম সন্তান আমার মা।
নানাভাইয়ের কাঁধে ছিল এই তিন সন্তানের দায়িত্ব। সেই দায়িত্বের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একদিন আমার মাকে আমার মামারা বিয়ে দিলেন মাত্র এগারো বছর বয়সে আর তার প্রতিদান স্বরূপ এসব উপহার।
স্টুডিওতে ফেরা যাক। আর এসবের বাইরে মায়ের চোখে ছিল বড় ফ্রেমের চশমা। চশমাটা স্টুডিওর, তাও আবার চশমায় গ্লাস ছিল না। গ্লাসে রিফ্লেক্ট হয় তাই ফটোগ্রাফার বুদ্ধি করে ওটা খুলে রেখেছিল। ছবিতে যদিও একটুও বোঝা যায়নি যে চশমায় গ্লাস নেই।। আমি স্টুডিও’র এককোণে চুপ হয়ে বসেছিলাম। শান্ত হয়ে একদম চুপ, হয়ত বা চুপ হয়ে ভাবছিলাম ভবিষ্যতের কোন এক গল্পে মাকে কিভাবে দেখবো তাই কিংবা বাসায় গিয়েই আমার নতুন স্কার্ট পরার আনন্দে বিভোর ছিলাম। এই স্কার্টটা মা লুকিয়ে কিনে দিয়েছিলেন। বাবা স্কার্ট পরা একদম পছন্দ করতেন না। কেন তা আমার জানা ছিলনা। তবে বাবা যে খুব ধার্মিক মনোভাবাপন্ন তা নয় এটা তার পছন্দের বাইরের তাই আমাদেরও পছন্দ করা চলবেনা।
আমাকে বাবা বেশিবেশি ছেলেদের জামাজুতো কিনে দিতেন আর আমি পরতে চাইতাম স্কার্ট আর চকমকি লাল উঁচু জুতো। অবশেষে মা একটা মখমলের লাল স্কার্টটা আর একজোড়া লাল জুতো কিনে দিয়েছিলে সেদিন। সেইটি পরবো আনন্দে বিভোর ছিলাম হয়তো। স্টুডিওতে তোলা সেই একটি মাত্র ছবিই ছিল আমার কাছে, যেবার আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম।
৫০ টাকা আর মায়ের একমাত্র ফাটোগ্রাফ, যা বহুদিন পরে খুঁজতে গিয়ে আর খুঁজে পাইনি। ফটোগ্রাফটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। কোথায় কবে হারালো জানিনা। হারিয়ে ফেলে আমার প্রচণ্ড আফসোস হয়। মা এখন বুড়িয়ে যাচ্ছে অথচ মা কী সুন্দর ছিলেন তার যৌবনে। আমি প্রায়ই বলতাম তোমার আরেকটা বিয়ে করা উচিত মা। কেন বলতাম জানিনা। হয়তো মনে মনে বাবাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম কিংবা বাবা ছাড়া পরিবার হয়না এই ভাবনা আমার ছোট মগজে সেঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে।
মাকে বলতাম বাবাকে ছেড়ে আমরা একটা নতুন বাবা খুঁজি চল।
-মা একগাল হাসতেন শুধু।
মায়ের এই হাসিটা কখনো মিলিয়ে যেতে দেখিনি। অনেক বেশি তার ধৈর্য। এমনকি মদের নেশায় বুঁদ হয়ে বাবা যখন মায়ের পায়ে সিগারেটের আগুন চেপে ধরতেন তখনো মায়ের এই হাসিটা দেখতাম। আমি তখন স্টুডিওতে তোলা মায়ের সেই হাসিমুখটা মনে করার চেষ্টা করতাম। মা কেমন হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে ফটোগ্রাফার বারবার বলছেন না হচ্ছে না আপা। আরেকটু ন্যাচারাল করেন মেকি মেকি লাগছে।
ফটোগ্রাফার এগিয়ে গিয়ে মায়ের মুখটা হালকা বাদিকে সরিয়ে দিচ্ছে। মায়ের হাসিটা আরেকটু চওড়া হয়ে গেলে ফটোগ্রাফার মাকে ধমকে দিয়ে মায়ের গালে সিগারেট চেপে ধরছেন। মা তবুও হাসছেন। ফটোগ্রাফার রেগে গিয়ে আরো জোড়ে সিগারেট চেপে দিচ্ছেন। মা আরো জোড়ে হাসছেন। মা কে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। মা কী সুন্দর। মা হাত বাড়িয়ে আমায় ডাকছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে মায়ের কোলে বসে পড়লাম। ফটোগ্রাফার আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এক কোণায় ছিটকে গিয়ে দেখলাম মায়ের সমস্ত মুখে জলন্ত সিগারেটের লাল আভা অথচ মাকে কি সুন্দর লাগছে। মা জোরে জোরে হাসছেন। ফটোগ্রাফার চিৎকার করে বলছেন হাসিটা ন্যাচারাল করেন, হচ্ছে না। মা আরো জোরে হাসছেন।
মায়ের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে আমরা ভেসে যাচ্ছি, আমরা চলে যাচ্ছি , আমরা চলে যেতাম নানুবাড়ির জোৎস্না রাতে। উঠোনে পাটি বিছিয়ে নানু গল্প শোনাচ্ছেন। পরীরা নেমে আসতো চারিদিকে থেকে। জোৎস্নায় পরীদের কী মিষ্টি লাগতো, ধবধবে, সুন্দর। দেখতাম মা পরী হয়ে গেছে। কী সুন্দর শাদা ডানা, কিন্তু মা ধবধবে নয়, মা মায়ের তো সুন্দর। মা আমাকে কোলে নিয়ে উড়াল দিলেন। আমি মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গেলাম। অনেক শান্তির সে ঘুম।