তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য ছোটগল্প তানিয়ার দিনযাপন | সুপ্তি জামান | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ২০২৪
ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

তানিয়ার দিনযাপন | সুপ্তি জামান | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ২০২৪

পৃথিবীর তাবৎ চাকুরিজীবীর মতো তানিয়াও চাকরিজীবী জীবনের গ্লানি বহন করে চলেছে, তথাপিও চাকরিটা তার জীবনযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তানিয়ার প্রায়ই মনে হয় একটা অনর্থক জীবনের ঘানি টেনে চলেছে সে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো! ছাড়াও যায়না, ধরে রাখার বিড়ম্বনাও কম না। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে অর্থের কাছে পরাস্ত হতেই হয় – এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এই দুর্মূল্যের বাজারে মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা একধরনের প্রশান্তি দেয় বটে।
তানিয়া বিবাহিত, এক সন্তানের জননী। এদেশে বিপুল সংখ্যক নারী চাকরি করে না, ঘর গৃহস্থালির কাজ করে, স্বামী-সন্তানের সেবাদাসী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়। তানিয়া চোখ বন্ধ করে সেই জীবনটা কল্পনা করে দেখেছে, ওরকম একটা জীবনের স্বপ্ন তানিয়া কখনো দেখেনি। তাছাড়া স্ত্রীর সেবা ভালবাসা শতভাগ চাইলেও সংসারে শতভাগ ব্যয়ভার বহন করতে হবে না এরকম একটা যোগ-বিয়োগ করেই না এদেশের ছেলেরা চাকরিজীবী মেয়ে বিয়ে করে। পুরুষ সম্পর্কে যার বিচার-বিবেচনা এই রকম সেই মেয়েকেতো চাকরি করেই জীবনধারণ করতে হবে। এ নিয়ে হাপিত্যেশ করবে আবার চাকরিটা ছাড়বেও না – হাপিত্যেশ করতে করতে একদিন চাকরি জীবন শেষ হবে। তানিয়া তার মাকে দেখেছে চাকরি ছাড়ার জন্য মায়ের কী ছটফটানি ছিল। অথচ মা শেষ পর্যন্তই চাকরিটা করেছেন এবং অবসরের পর আর বেশিদিন বাঁচেননি। যুদ্ধ শেষে যেন আর করার কিছু নেই বলে তিনি ওপারে যাওয়ার জন্য একরকম ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। শেষবার যখন মায়ের সাথে তানিয়ার দেখা হয়েছিল মা তখন তানিয়াকে বলেছিল তোমার সাথে আর দেখা নাও হতে পারে, দূর থেকে আমার মৃত্যু সংবাদ শুনবা, আমি হাঁটাচলার মধ্যেই চলে যাব। তানিয়া শুধু বলেছিল – এ তুমি কি বলছ? তুমি চলে গেলে আমরা কোথায় যাব? তুমি আমার সাথে ঢাকা চল। এখানে এই অজপাড়াগাঁয় তোমার থাকার দরকার নেই। এখানকার এই তীব্র একাকিত্বের মধ্যে তোমাকে রেখে যেতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু মায়ের এককথা, সে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। ফেরার সময় তানিয়া ঠিক করেছিল প্রতিমাসে একবার এসে মাকে দেখে যাবে। কিন্তু ডিসেম্বরের পর তানিয়া আর গ্রামে যেতে পারেনি বা যায়নি। মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছিল সামনের মাসে রোজায় বাড়ি যাবে, বাবার নামে মসজিদে ইফতার দেবে। মা তুমি বাজারটা করে রেখ, মা বলেছিল তুমি কিন্তু আসবা। র্মাচ মাসেই মা বনের পাখির মতো উড়াল দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। কী অদ্ভুত এই পৃথিবী থেকে মানুষের হারিয়ে যাওয়া। তানিয়া ভালভাবেই জানে চাকরি ছাড়ার চিন্তাটা একটা উচ্চাবিলাসী কল্পনা ছাড়া আর কিছুনা, তবুও তানিয়া প্রায়শই ভাবে একদিন সে চাকরি ছেড়ে দেবে, ধরাবাঁধা এই জীবনের গ্লানি ভুলে যাবে-একদিন নতুন দিন আসবে।

যতটা না প্রতিদিনের নয়টা-পাঁচটা অফিস বিরক্তিকর তার চেয়ে বেশি দুর্বিষহ দৈনিক দুবেলা পাবলিক যানবাহনে অফিসে যাতায়াতের ধকল। এই শহরে প্রতিটি সকালবেলা মধ্যবিত্ত নারী চাকুরিজীবীদের জন্য নিয়ে আসে নতুন করে আবার কোন অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে সেই দুর্ভাবনা। জ্যাম ঠেলে সময়মতো অফিসে পৌঁছানো এখন রীতিমতো যুদ্ধজয়ের মতো। বছরে তিনশ পয়ষট্টি দিন একই যুদ্ধ করতে করতে এই শহরের মানুষগুলো দিন দিন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শহরের সড়কের ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের মতো মানুষগুলো স্বপ্নহীন এখন।

বাসা থেকে বেড়িয়ে মূল সড়কে আসার রাস্তা কাটা গত ছমাস ধরে। দীর্ঘ বর্ষায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ শেষ করে শরৎ এসে গেলেও এখানকার মানুষের মনে কাশফুলের মতো শ্বেতশুভ্র মেঘের আনাগোনা শুরু হয়নি, দুর্ভাবনার কালো মেঘ এখনও কাটছে না। তানিয়া রোজই হন্তদন্ত হয়ে বের হয় বাসা থেকে। অফিসে যাওয়াটাওতো যাপন করার মতো করে করা যায়। চাকরির শুরুতে যখন তানিয়ার পোস্টিং উপজেলায় ছিল, উপজেলার ভেতরে কোয়ার্টারে থাকতো তখন অফিসে যাওয়ার আগে সকালে কত ফুরফুরে মেজাজে শাড়ির সাথে কাচের চুড়ি, কানের টপ, টিপ মিলিয়ে ধীর পায়ে কোয়ার্টার থেকে অফিসের পথটুকু হেঁটে যেত।

উপজেলা চত্বরটি ঘিরে ছিল সবুজ বন-বনানীর ছায়া। দুটো সুপরিসর পুকুর, অফিস অঞ্চল আর কোয়ার্টারের মাঝখানে খোলা মাঠ, ক্যাম্পাস জুড়ে অগুনতি আম কাঁঠালের গাছ, কাঠবিড়ালিদের চকিত দৌড়ঝাপ আর অমাবশ্যার রাতে ফুলের মতো ফুটে উঠতো জোনাকি। অন্ধকারেরও কত রূপ-রস-সুগন্ধ আছে তা কি শহুরে মানুষ জানতে পায়? পায় না। সেসব দিন মনে পড়লে আজো বুকের ভেতরে হু হু করে ওঠে। অথচ তানিয়ার জীবনে তখনও হয়রানি ছিল। একা একজন মানুষ কতটা বিপন্ন থাকে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তানিয়া। মা বলতেন একা আর বোকা সমান। বাবা চলে যাওয়ার পর মা সত্যি সত্যি বোকা হয়ে গিয়েছিল, তা না হলে মানুষ মৃত্যুর জন্য এত উতলা হয়ে ওঠে! খুব রাগ হয় মার উপর, কেন শেষবেলাটা আমার সাথে থাকতে চাইলো না মা, মা কি কোনদিনই বোঝেনি মায়ের জন্য কতটা হাহাকার তানিয়ার বুকের ভেতর। মা বলতেন মানুষ মরে গেলে ছেলেমেয়ে দুই দিন কান্নাকাটি করে ভুলে যায়। তানিয়া মন্ত্রপাঠের মতো উচ্চারণ করে- মা তুমি ভুল জেনেছো, মা দুই বছরে আমিতো একটি দিনের জন্য তোমাকে ভুলিনি। এমনকি আমি বুঝে গেছি অবশিষ্ট জীবনে প্রতিটি দিনই তোমরা দুজন আমার সাথে সাথে পথ চলবে। এমনকি বেঁচে থাকতেও তোমরা এতটা আমার সঙ্গে ছিলে না। তানিয়া মরিয়া হয়ে ঢাকায় বদলি হয়েছে, জোড়া বাঁধবার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করেছে। আজ তানিয়ার ঘর বর সংসার সন্তান সব আছে অথচ বিবাগী মনটা এখনও ছটফট করে। এই অস্থিরতা কী কোনদিন দূর হবে না? কেন এত অশান্ত থাকে পোড়া মন?

সকাল থেকেই মেজাজটা খিঁচতে শুরু করে। হাতে সময় থাকে না একদম অথচ ছেলেটা ঘুম থেকে উঠতেই চায় না, রান্নার বুয়াকে সব বুঝিয়ে দেয়ার পরও রান্নাটা ঠিকঠাক করতে পারে না। রান্না করার মেয়েটা উত্তরাঞ্চালের, তানিয়ার বাড়ি দক্ষিণাঞ্চলে। রান্নার ধরনে কোন মিল নাই। ছেলেটা এখনও নিজের হাতে ঠিকঠাক খেতে পারে না। স্কুলের টিফিন প্রায়ই ফিরিয়ে আনে। সকালে তানিয়া হাতে খাইয়ে দেয় আবার রাতে এসে খাইয়ে দেয়। তানিয়া সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয় ছেলেটার কাছে। ছেলেটা পড়ার টেবিলে বসতে চায় না, টিচার দিলে টিচারও ধৈর্য হারিয়ে ফেলে টুনুর দুষ্টমির কাছে। বড় মানুষের মতো তানিয়াকে নাজেহাল করার জন্য ছেলেটা সবসময় তৎপর থাকে। ছেলেটা কেবল শৈশবের খোলস ছেড়ে কৈশোরে পা রেখেছে, বাবাকে ফলো করে। মাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মধ্য দিয়ে নারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার হাতেখড়ি হচ্ছে। নারীতো তামাশারই জিনিস, মাকে নিয়ে প্রায়শই সন্তানদের তামাশা করতে কী তানিয়া দেখেনি?

অফিস টাইমে রিক্সা পাওয়াই যায় না, শেয়ারের সিএনজিতে এতদিন চলাচল করেছে। এখন কালীবাড়ি থেকে বৌদ্ধ মন্দির পর্যন্ত রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণে হেঁটেই বৌদ্ধ মন্দির পর্যন্ত যেতে হয়। বৌদ্ধ মন্দির বাসস্ট্যান্ড থেকে ঠিক সকাল আটটার মধ্যে বাসে উঠতে পারলে নয়টা দশ পনেরোর মধ্যে অফিসে পৌঁছান যায়। অফিস কলিগ প্রায় সকলের বাসাই অফিসের কাছাকাছি, সবাই নয়টার মধ্যেই অফিসে চলে আসে শুধু তানিয়াকেই কাচুঁমাচুঁ করে অফিসে প্রবেশ করতে হয় সময়মতো আসতে না পারার গ্লানি মাথায় করে। দিন শেষে একরাশ ভয় এসে ছায়া ফেলে মুখে, কতক্ষণে ফেরা যাবে বাসায়? টুনু ড্রয়িংরুমে বসে মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে টিভি দেখতে থাকবে। এমনও হয় কোন কোন দিন তিনঘণ্টা লেগে যায় বাসায় ফিরতে। টুনু বেঘোরে টিভি দেখতে থাকবে। অদ্ভুত ছেলে একটিবারের জন্য ফ্রিজটাও খুলে দেখবে না। টেবিলের উপর খাবার রেখে গেলেও খাবে না। তানিয়া ঘরে ঢুকেই ওভেনে ফ্রিজের খাবার গরম করে টুনুকে খাওয়াতে শুরু করবে। রান্নার মেয়েটি সকালে এসে রান্না করে খাবার ফ্রিজে রেখে যায়, হায়রে চাকরি একবেলা খাবারও তাজা জোটে না, ফ্রিজে রাখা খাবরাই বার বার গরম করে খেতে হয়। এভাবেই রাত যায়, দিন আসে, একইরকম বারো মাস।

তানিয়ার স্বামী দূর শহরে থাকে, মাঝেমধ্যে আসে। এক দুর্লঙ্ঘনীয় দূরত্ব বহন করেই চলছে দাম্পত্য জীবন। এ নিয়ে তানিয়ার এখন আর কোন অভিযোগ নেই। মানুষে মানুষে সীমাহীন দূরত্ব থাকবে – এটাই মানবচরিত্র। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে সাথে সে দূরত্ব ঘুচে যাবে – এমনটি বিলাসী কল্পনা ছাড়া আর কিছু না।

নিত্যদিনের মতো সেদিনও তানিয়া বৌদ্ধ মন্দির থেকে গুলিস্তানগামী বাসে উঠে বসেছে। ভাগ্য ভালো ইঞ্জিন কাভারে একটি সিট পাওয়া গেছে। তানিয়া ইঞ্জিন কাভারের শেষ মাথায় চেপে বসেছে, মতিঝিলগামী প্রচুর নারী এপথে যাতায়াত করে, আসন বলতে ইঞ্জিন কাভার আর ইঞ্জিনের পাশের চারটি সিট মেয়েদের। সিট পূর্ণ হয়ে গেলে বাসের হেলপার আর কোন নারীকে তুলবে না বলে ঘোষণা দিতে থাকবে। অফিস টাইমে মেয়েদের বাসে ওঠা একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে বেপরোয়া ও দুর্বিনীত কিছু নারী ঠেলেঠুলে উঠে যায়, যা পুরুষ যাত্রীদের চরম বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব কিছু থেকে মনোযোগ সরাতে তানিয়া ব্যাগ থেকে একটা কবিতার বই নিয়ে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে দিল। পনের মিনিটের রাস্তা মিনিমাম এক ঘণ্টা লাগবে। বাসটি কেবল মুগদা বাস স্টান্ডে এসে পৌঁছেছে , বাসে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, এরই মধ্যে দুইজন নারী জোড় করে বাসে উঠে পড়েছে। দরজার কাছে আগে থেকেই যাঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের জন্য এই নারীকে জায়গা করে দেয়াটা অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়ে। এক যুবক প্রায় হাঁক ছেড়ে তানিয়াকে আরো চেপে বসতে বলল, তানিয়ার কানে কথাটি নির্দেশের মতো শুনাল, তানিয়া হাঁকডাক শুনে বই থেকে মুখ উঠিয়ে যুবকটিকে বললেন – আমি আগে থেকেই চেপে বসেছি। আমরাতো মানুষ, গরু ছাগল না, একটা মেয়ে বসতে পারলেতো আমারই ভালো লাগবে। যুবকের কথাটি ভালো লাগলো না, হয়তো ভিড়ের মধ্যে একজন নারীকে বই পড়তে দেখা তার কাছে অসহ্য বোধ হচ্ছিল! সে তানিয়ার দিকে শ্লেষের সুরে বলল আমি কী আপনাকে গরু-ছাগল বলেছি। আপনি আরেকটু চেপে বসলেইতো এই মহিলাটি বসতে পারে। তানিয়া ঝাঁঝের সাথেই বলল – এখানে আরেকজন বসার মতো জায়গা নেই আপনি কী সেটা দেখতে পাচ্ছেন না? আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, দাঁড়িয়ে থাকুন – হেলপারি করার দরকার নেই। অমনি পাশ থেকে এক চিকনামতো লোক খেঁকিয়ে উঠল খেঁকশিয়ালের মতো। আপনি ওনাকে হেলপার বললেন কেন? আপনাকে চেপে বসতে বলেছে আপনি চেপে বসবেন। তানিয়া অবাক হয়ে গেল লোকটির আস্পর্ধা দেখে। আরে আপনি আমাকে আদেশ করছেন কেন? আপনি কী আমার কথা বুঝতে পারছেন না এখানে বসার আর কোন জায়গা নেই। মুহূর্তেই পুরুষটির পক্ষালম্বন করে চার পাঁচজন পুরুষ তানিয়াকে কটুক্তি করতে শুরু করলো। তানিয়ার চারপাশে বসা নারী যাত্রীরা তাদের নম্রতা এবং ভদ্রতা যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এজন্য মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন। নীরব দর্শক হয়ে তানিয়া ভার্সেস কয়েকজন উগ্র পুরুষের ঝগড়াটা গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন। তানিয়ার মনে হলো নারীগুলো মনে মনে তানিয়ার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করছে আর মুখে বলছে আপা আপনে চুপ করেন। তানিয়ার রাগ এবার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে – ভেতরের গোঁয়ার ভাবটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তীব্রভাবে বলে উঠল – কেন চুপ করবো। আমি চুপ করবো না। খেঁকিয়ে ওঠা পুরুষটির মনুষ্য অবয়ব এবার পুরোই খসে পড়ল, দানব হয়ে উঠল মানুষটি। বলে উঠল বেয়াদব মেয়ে মানুষ, ওর মনে হয় স্বামী সংসার নাই। তানিয়া এবার মারমুখী হয়ে বলে উঠল আর একটা বাজে কথা বললে আমি পায়ের কেডস ছুঁড়ে মারবো তোর মুখের উপর। লোকটির সাথে এবার বাসের অর্ধেক পুরুষযাত্রী একজোট হয়ে তানিয়ার দিকে বৃষ্টির মতো কটূক্তি নিক্ষেপ করছে এবং পুরুষটি বলে উঠল ড্রাইভার বাস থামাও এই বেয়াদব মহিলাকে বাস থেকে টেনে নামাবো। তানিয় এক নাগারে বলে যাচ্ছে আয় দেখি কার বুকের পাটা কত, কে আমাকে টেনে নামাবি? আয় আমার সামনে আর প্রত্যেকটাকে জুতা পেটা করে পুলিশে দেব। এদেশে বসবাস করে এতবড় আস্পর্ধা একজন নারীকে বাস থেকে টেনে নামাবি, আর আমি বসে থাকবো। এতক্ষণ যারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন তারা খেঁকশিয়ালটিকে থামাতে এবার উদ্যত হলেন এবং উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় স্তিমিত হলো। খেঁকশিয়ালটি এবার বিড়বিড় করে বলছে – অফিস টাইম না হলে ওকে আমি চুলের মুঠি ধইরা বাস থেকে টাইন্না নামাইতাম, উচিত শিক্ষা দিতাম, কিছু না বলতে বলতে এদের বড় বাড় বেড়েছে। তানিয়ার এবার হাসি পেল – লোকটির মনে নারীর বিরুদ্ধে কত কালের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমা আছে কে জানে। এ ক্ষোভ চাকরিজীবী নারীর প্রতি ক্ষোভ। তানিয়া ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিল, এত জোরে চ্যাঁচামেচি করেছে যে তার গলার রগগুলো টনটন করছে। সে আবার বইয়ে ডুব দিল। বাস গুলিস্তান এসে থামলো। বাস থেকে নামার সাথে সাথে তানিয়া ভেঙে পড়তে লাগলো। এতক্ষণ একাই লড়ে গেল অথচ এখন হাঁটছে আর অবিরাম তাঁর চোখ থেকে পানি ঝরছে। কার প্রতি এত অভিমান তানিয়ার? রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি? কূপমণ্ডুক পুরুষের প্রতি? নাকি তার নিজের প্রতি?

বিকেলে তানিয়ার আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠতে ইচ্ছে করলো না। এত বিরক্তি পেয়ে বসল যে, সে দুশো টাকা দিয়ে একটা রিক্সা ভাড়া করল ঘরে ফেরার জন্য। তানিয়া জানে এ বিলাসিতা বেশি দিন সে করতে পারবে না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সে পয়তাল্লিশ পয়তাল্লিশ নব্বই টাকায় যাতায়াত করতে পারে। রিক্সায় তাকে গুনতে হবে চারশো টাকা। দিন কয়েক রিক্সায় যাতায়াত করে রাগটা প্রশমিত হলে আবার বাসে যাতায়াত করার চেষ্টা করবে। প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করে সে তিনশ টাকার মতো বাঁচায়। এই টাকাটা দিয়ে সে টুনুর জন্য এটা-সেটা খাবার কিনে নিয়ে যায়। ফল কেনে, সিপি ফাইভ স্টার থেকে চিকেনের আইটেম কেনে। টুনুর পছন্দের খাবার কিনতে খুব ভাল লাগে তানিয়ার। তানিয়া রিক্সায় চড়ার বিলাসিতা বাদ দিয়ে ছেলের জন্য আনন্দ কিনে ঘরে ফেরে রোজ।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের নামে মূলত বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে। ডলার সংকটের কবলে পড়েছে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ। জ্বালানি তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে রিজার্ভ ভেঙে খাচ্ছে দেশ। দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে দেশ এমন একটা আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব দুর্ভাবনা তানিয়াকেও তাড়িত করে, কপালে ভাঁজ পড়ে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কিছু না কিছু বাড়তি পণ্য দ্রব্য কিনে আনে ঘরে। কোনদিন দু-কেজির আটার প্যাকেট, কোনদিন এক কেজি লবণ, কোনদিন এক বোতল শ্যাম্পু কিংবা হুইলের গুড়া হাতে নিয়ে ঘরে ফেরে। তানিয়া জানে দেশে দুর্দিন এভাবে মোকাবেলা করা যাবে না। তবুও সে এসব করছে। ব্যাংকে এসে লোকজন আমানতের টাকা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা দিতে পারবে না এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।

এখন তানিয়া প্রতিদিনই চকবাজার থেকে রিক্সায় কমলাপুর স্টেশন অব্দি রিক্সায় আসে। রিক্সা চকবাজার থেকে উর্দু রোড দিয়ে বকসিবাজার মোড় দিয়ে সোজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে শহিদ মিনার, এনএক্স বিল্ডিং, খেলার মাঠের সামনে দিয়ে কার্জন হল হয়ে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে। মোড়ে মোড়ে জ্যামের কবলে পড়তে হয়। অন্যান্য উৎপাতের সাথে এখন মোড়ে মোড়ে হিজড়াদের চাঁদা দিতে হয়। এমনিতেই রিক্সা এখন শৌখিন মধ্যবিত্তের বাহন, অত্যধিক ভাড়ার কারণে অনেকেই রিক্সায় চড়া ছেড়ে দিয়েছে। তার উপর মোড়ে মোড়ে হিজড়াদের কবলে পড়ে দশ-বিশ টাকা চাঁদা গুনতে হয়। ফেরার পথে তানিয়া তাড়াহুড়াকে এখন একপাশে সরিয়ে রাখে। বাচ্চাটা স্কুল থেকে ফিরে একনাগাড়ে রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত টিভি দেখবে। তানিয়া ফিরলেও গা করবে না। অথচ মাত্র কিছু দিন আগেও টুনু তানিয়ার ফিরতে দেরি দেখলে দরজার কাছে চেয়ার নিয়ে বসে থাকতো। ঘরে ফেরার সাথে সাথে তানিয়ার উপর একরকম ঝাপিয়ে পড়তো। এখন টুনু অনেকটা নির্বিকার থাকে। পছন্দের খাবার কিনে আনলে খুশি হয়, অন্যথায় টিভিতে ইউটিউবে নানারকম ভিডিও দেখে। তানিয়ার বুকে শূন্যতা বাড়ে। কেমন একা একা লাগে। সন্তান জন্ম হওয়ার সাথে সাথে এক মায়েরও জন্ম হয়। সন্তানের বয়স বাড়ার সাথে বন্ধন আলগা হতে থাকে – এ নির্মম সত্য প্রতিদিন যেন একটু একটু করে টের পাচ্ছে তানিয়া। তানিয়ার মায়ের কথা মনে পড়ে। শেষের দিকে মায়ের চারপাশে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু ছিল না। গ্রামে খালের পাড়ে একলা এক বাড়িতে মা কেমন একলা ঘরে মরে পড়ে ছিল। মা আমার দুখিনি মা।

সকালে ঘুম থেকে হুড়মুড় করে উঠে বসল তানিয়া। এই যাহ্, ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে অথচ আলো ফোটেনি। রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত তানিয়া যত্ন করে ফ্রিজে তুলে রাখে। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলে দ্রুত ওভেনে ভাতটা গরম করে নিয়ে একটা ডিম ভেজে টুনুকে খাওয়ানো যায়। আজও তাই করল। দুপুরে ক্যান্টিন থেকে কিছু কিনে খাওয়ার জন্য টুনুকে কিছু টাকা দিয়ে দৌড়ে নেমে এলো রাস্তায়। বাইরে এসে দেখে বাইরে বেশ ঝড়ো হাওয়া বইছে, বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টিও হচ্ছে। তানিয়া ছুটে চলছে অফিস পানে। বহুদূরের পথ। কুসুমবাগ থেকে বৌদ্ধ মন্দির যাওয়াই সবচেয়ে ভয়াবহ। রাস্তা কাটা। বছর ঘুরে গেল তবুও রাস্তার মেরামত আর শেষ হলো না। রিক্সা অথবা শেয়ারের সিএনজিই ভরসা। কিন্তু এখন এ দুটো যানবাহনই এ রাস্তায় চলাচল বন্ধ আছে। রিক্সা নিয়ে ঘুরে যেতে হয়। যেমন সময় বেশি লাগে তেমনি ভাড়াও গুনতে হয় বেশি। ভাগ্য ভালো আজ এই ঝড় বাদলের দিনে একটা রিক্সা পাওয়া গেল। বৌদ্ধ মন্দির না গিয়ে এখন বাসাবো বাস স্ট্যান্ড গিয়ে বাসে উঠে বসল তানিয়া। গুলিস্তান হলের সামনে আসতে আসতে বৃষ্টি মুষলধারে নামতে শুরু করেছে। তানিয়া একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ল। তানিয়াও ভিজে চুপচুপা, রিক্সার প্লাস্টিকের পর্দাও ভেজা, তবুও সাইড ব্যাগ আর খাবারের ব্যাগটি সামলানোর চেষ্ট করছে তানিয়া। ব্যাগে চেক বই সহ কত জরুরি কাগজপত্র রয়েছে। আল্লা জানে সেগুলোর কি অবস্থা হয়েছে এতক্ষণে। হঠাৎ তানিয়ার চোখ পড়ল রিক্সাওয়ালার দিকে । মধ্যবয়সি সুঠাম পুরুষ। বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে তার কোন বিকার নেই। যেন সে অনন্তকাল এমন বৃষ্টি মাথায় করে রিক্সা চালিয়ে আসছে। আজ বরং বৃষ্টি না হলেই সেটা বেমানান হতো। রিক্সাওয়ালাকে মনে হচ্ছে একটা ঘোড়ার মতো যে তানিয়ার রিক্সা টেনে নেয়ার জন্যই জন্মেছে। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, নিতান্ত নিরুপায় না হলে আজ আর কেউ রাস্তায় নামেনি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ, বেশ শীত অনুভূত হচ্ছে। রিক্সাওয়ালাকে বলতে ইচ্ছে করছে – বৃষ্টির মধ্যে রিক্সা নিয়ে কেন নেমেছেন? আপনারতো ঠান্ডা লেগে যাবে। কিন্তু তানিয়া রিক্সাওয়ালাকে কিছুই বলে না। নিতান্ত বাধ্য না হলে কে নামে এই বৃষ্টিতে। তাছাড়া রিক্সাওয়ালা বৃষ্টির দিনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমালে যাত্রীদের কী উপায় হবে – হতেওতো পারে এই কথা ভেবেই রিক্সাওয়ালা বেড়িয়ে পড়েছে।

এমনতো হতে পারে সকাল বেলা রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া ভদ্রলোকটির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনেকসময় মানুষ কাজ করে কাজ করার উপর এক ধরনের মোহগ্রস্ততা সৃষ্টি হয় বলে। দেখা যায় পরিশ্রমী মানুষ বার্ধক্যেও বসে থাকতে পারে না, টুকটুক করে কাজ করে। তানিয়ার মনে হলো রিক্সাওয়ালা চার পাঁচ ঘণ্টা রিক্সা চালিয়ে ঘরে ফিরে যাবে হয়তো তার বউ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, সেবা যত্ন করবে, প্লেটে ভাত তুলে দেবে। তানিয়া যখন দিন শেষে ঘরে ফেরে প্লেটে ভাত বেড়ে কেউ তানিয়াকে ডেকে খাওয়াবে না। এসব নয়-ছয় ভাবতে ভাবতে তানিয়া পৌঁছে যায় অফিসে। ভেজা বৃষ্টি, ভেজা বাতাস আরা ভেজা ভাবনা সব মিলে চারপাশে হঠাৎ ঠান্ডা ভর করেছে। কাস্টমারশূন্য কাউন্টার, অফিস কলিগরা গল্প করছে। আজ টুনুর স্কুল বন্ধ, ঠান্ডার মধ্যে বাচ্চাটা একা একা টিভি দেখে কাটিয়ে দেবে সারাদিন। টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার ঢাকাই পড়ে থাকবে। বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে – এরকম হাজারো ইচ্ছা চিরদিন জলাঞ্জলি দিয়ে টিকে থাকার নামই মধ্যবিত্তের জীবন। বর্ষার বৃষ্টির দিনগুলো একরকম কিন্তু অসময়ের বৃষ্টি বড় বিমষর্তা বাড়ায়। চৌদ্দ বছরের সংসার জীবনে টুনু ছাড়া আর কোন প্রাপ্তি বা তৃপ্তি জোটেনি তানিয়ার জীবনে। খালেদের সাথে শুরু থেকেই খটমট লেগেই ছিল। তিক্ততা বাড়তে বাড়তে এখন সম্পর্কটা শুধু খোলসের মতো টিকে আছে। ভেতরে প্রচণ্ড ফাঁপা। অনেক ভেবেছে সম্পর্কের দায়বদ্ধতা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য। কিন্তু ভাবা পর্যন্তই শেষ। মধ্যবিত্ত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের যাঁতাকলে পড়ে আছে তানিয়া ও খালেদ। এ-জনমে আর মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে ডানা ঝাপটাবার সাধ মিটবে না ওদের দুজনের। শুধুমাত্র টুনুর জন্যই টিকে আছে সংসারটি। খালেদ বছরের পর বছর ঢাকার বাইরে চাকরি করে আসছে। বদলি যদিও সহজ নয় তবুও খালেদ কিংবা তানিয়া কেউই বদলির কোন প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না। মাসে এক আধবার খালেদ ঢাকা আসে মূলত টুনুর টানে। দুদিন থেকেই চলে যায়। এই দুটো দিনও নির্বিরোধ থাকে না। স্বামী ঘরে ঢোকা মাত্রই তানিয়ার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। এই না জানি কোন দোষ ধরবে। তটস্থ থাকতে থাকতে এখন ভীষণ অনীহাবোধ করে খালেদের বিষয়ে। তবুও এ জনপদে বেশির ভাগ সংসার যেমন টিকে থাকে তানিয়ার সংসারও সেভাবে টিকে আছে।

টুনুর জন্য আজ মনটা বেশি আনচান করছে, আহা বাচ্চাটা একলা একলা কী করছে? রাস্তায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। বাড়ি ফিরতে আজ খবর হয়ে যাবে। অফিস আরো এক ঘণ্টা বাকি থাকতেই তানিয়া বসের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিল। বস প্রায় সমবয়সী। এককথায় ভদ্রলোকের যেমন বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয় বস ঠিক সে রকম। বেশিরভাগ সময়েই তানিয়ার সাথে বসদের সম্পর্কটি মধুর হয়ে ওঠে না। খটমট টাইপের থাকে। বর্তমান বসের সাথে তুলনামূলক ভালো যাচ্ছে।

অফিসের ভেতরে থাকতে যা কল্পনা করেছিল বাইরে এসে তানিয়া রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছে বৃষ্টির তাণ্ডব দেখে। দমকা হাওয়ার তালে তালে বৃষ্টি ফুলে ফুলে উঠছে। ছাতা মেলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কোন রিক্সাই অতদূরের পথে যেতে রাজি না। খানিক দাঁড়িয়ে থেকে তানিয়া টেম্পু স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ঠান্ডা কামড় বসাচ্ছে গায়ে। গুলিস্তান এসে অনেক্ষণ অপেক্ষার পর একটা বিআরটিসি দোতলা বাসে ওঠা গেল। বৃষ্টির দিন হাতে গোণা সাত আট জন যাত্রী আছে বাসে। ড্রাইভার ঠায় বসে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। একজন মধ্য বয়সী নারী ক্রমাগত বাসের হেলপারকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন বাস ছাড়ার জন্য। জুতা জামা সব ভেজা, নিম্নচাপের কবলে পড়েছে দেশ। বাসের সব যাত্রীরা এক হয়ে ড্রাইভারকে অনুরোধ করতে লাগলো বাস ছাড়ার জন্য, দু একজন কটুক্তি করতে লাগলো। এক পর্যায়ে বাসের হেলপারের সাথে লাগলো সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের হাতাহাতি।

বাস চলতে শুরু করেছে। মতিঝিল বিমান অফিসের কাছে এসে বাসটি সিটি সেন্টারের দিকে না গিয়ে চিনিশিল্পের সামনে দিয়ে অগ্রসর হতে লাগল। ওখানে ব্যাংকের স্টাফ বাসগুলো থেমে আছে, পাঁচটায় অফিস শেষ হলে ব্যাংক কর্মীদের নিয়ে ফিরবে। উল্টোপথে বিআরটিসির বাসটি যাওয়ার কোন পথ নেই। ড্রাইভার নাছোরবান্দা সামনে তেলের পাম্প থেকে তেল নিয়ে ঘুরে আবার এপথ হয়ে তবেই বাসটি কমলাপুর বাস ডিপোতে গাড়ি নিয়ে যাবে। অনেক ধ্বস্তাধস্তি শেষে অবশেষে এক সময় বাসটি কমলাপুর এলো। তানিয়া বাস থেকে নেমেই জোড়ে হাঁটা শুরু করলো। ওভারব্রিজ পার হয়ে ওপাশে গিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরবে। কিন্তু বৌদ্ধ মন্দির পর্যন্ত এসেও না পাওয়া গেল কোন রিক্সা, না পাওয়া গেল শেয়ারের সিএনজি। এরপর হাঁটার গতিও কমে আসতে লাগলো। পায়ের কেডস ভিজে ভারি হয়ে গেছে। কাপড় চোপড় ভিজে ভারি হয়ে গেছে। রাস্তায় হাতেগোণা কয়েকজন পথচারীর সাথে তানিয়াও ভিজে ভিজে হাঁটছে। চারপাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সকলেরই চলার গতি শ্লথ, একজন পুলিশ বুকেরপাটা টান করে হেঁটে চলে গেল সামনে। তানিয়া ভাবছে পায়ে ওরকম বুট জুতা আর গায়ে রেইনকোট থাকলে সকলেই ওরকম হাঁটতে পারে। বাসার গলির মোড়ে মোবারক সাহেবের সাথে দেখা। মোবারক সাহেব একজন বাড়িওয়ালা, একই মহল্লায় থাকতে থাকতে পরিচিত হয়ে ওঠা আরকি। মোবারক সাহেব তানিয়ার দিকে চেয়ে হাসল। মোবারক সাহেবও অফিস থেকে ফিরেছেন কিন্তু তিনি মোটর সাইকেলে চেপে আছেন, গায়ে রেইনকোট। তানিয়া ভাবল একটি মোটর সাইকেল আর একটি রেইনকোট থাকা কতটা ব্যবধান গড়ে তুলতে পারে মানুষে মানুষে। তানিয়া কতটা নাজেহাল হয়ে ঘরে ফিরছে। মোবারক সাহেবও বাসা থেকে দূরে গিয়ে প্রতিদিন অফিস করেন। অথচ যাতায়াতের এত ধকল তাকে সইতে হয় না। মোড় ঘুরে গলির ভেতরের বাঁক ঘুরতেই তানিয়ার চোখের সামনে এক দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ লুঙ্গি কাছা মেরে বৃষ্টির মধ্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। উচ্চতার জন্য লোকটির পা দুটো তানিয়ার প্রায় চোখ বরাবর, লোকটি দ্রুত পায়ে কাছের গলির ভেতরে হাওয়া হয়ে গেল। বৃষ্টিমেদুর ঘনায়মান ভেজা শীতার্ত সন্ধ্যায় তানিয়ার চোখে অনেকক্ষণ লোকটির অনাবৃত দুটো পা একটা বিভ্রম সৃষ্টি করে গেল। তানিয়ার বার বার মনে হতে লাগলো লোকটির পা দুটো ঠিক যেন আবলুস কাঠের মতো! না, উপমাটা ঠিক যাচ্ছে না লোকটির পা দুটো ঠিক ভেজা গাবগাছের গুড়ির মতো মিশমিশে কালো, যেন সন্ধ্যার ম্রিয়মান অবশিষ্ট আলো প্রতিফলিত হয়ে তানিয়ার চোখে ঝলসে দিয়েছে। তবু সন্ধ্যাটা আঁধারে ডুবে আছে। বাসাটা একটু সামনেই, কিন্তু দূরত্ব যেন অনন্তকালের, ফুরায় না।

Exit mobile version