তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য ছোটগল্প আস্তেরিয়নের বাড়ি | হোরহে লুইস বোরহেস | আনিসুজ জামান অনূদিত
অনুবাদ ছোটগল্প

আস্তেরিয়নের বাড়ি | হোরহে লুইস বোরহেস | আনিসুজ জামান অনূদিত

স্প্যানিশ ভাষা থেকে অনুবাদ করলেও গল্পটি আমি প্রথম স্প্যানিশ ভাষায় পড়িনি, পড়েছি বন্ধুবর অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনের বাসায়, ওঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত নির্বাচিত বোর্হেস (কাগজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত) গ্রন্থ থেকে। গল্পটি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন কবি ও অনুবাদক জুয়েল মাযহার। পাঠশেষে গল্পটি মূল থেকে পড়ার আগ্রহ তৈরি হলেও পড়া হয়ে ওঠেনি। কাকতালীয় ভাবে মেক্সিকান ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন আমেতলি পরিচালিত অনুবাদ বিষয়ে দুই বছরের মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হওয়ার শুরুর দিকেই এই গল্পটি আমাকে বাংলায় অনুবাদ করতে বলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওরা বাংলা না বুঝলেও আমাকে ক্লাসে বাংলায় পড়তে হয়। ওরা ধ্বনিগত অথবা মেলোডিগত বা গল্পের মিউজিক্যালিটি মূলের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। এত বিখ্যাত একটা গল্প অনুবাদ শেষ করার পর বাংলাভাষার পাঠকের সামনে তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। বোরহেস-এর অন্য সব গল্পের মতো এটারও পাঠোদ্ধার করা খুব দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। গ্রিক পুরাণে অ্যালোপোডোর খণ্ডে মিনোতা বা মিনোতাউরোর আখ্যানটা জানা না থাকলে গল্পটি বোঝা অসম্ভব। তার সঙ্গে কুঠার-মন্দিরের (Temple of Hachas) বিষয়টি জানাও জরুরি। তবে বোরহেস যেহেতু সুফিবাদের অনুরক্ত ছিলেন, পাঠক হিসেবে আমরা চৌদ্দ সংখ্যাকে সুফিবাদের দুইবার পরিশোধন এবং নয় সংখ্যাকে দেহতত্ত্বের নয় দরজার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। বোরহেস তার লেখায় একটিও শব্দও বাড়তি ব্যবহার করেন না। তাই এই গল্পের প্রথম থেকে শেষ শব্দ পাঠকের সম্পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে।

…আর রানী আস্তেরিয়ন নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন।
Apolodor: Bibliotece, III, I.

জানি আমাকে অভিযুক্ত করা হয় অহংকারী, হয়তোবা মানববিদ্বেষী বা পাগল বলে। ওইসব অভিযোগ (এ কারণে ঠিক সময়মত ওদের শাস্তি দেব) হাস্যকর। সত্যি সত্যিই আমি বাড়ি থেকে বের হই না, কিন্তু এটাও সত্য বাড়ির দরজাগুলো (অসীম সংখ্যক) মানুষের জন্য এমনকি জন্তু জানোয়ারের জন্যও দিনরাত খোলা থাকে। যার ইচ্ছে সেই ঢুকুক না…। এখানে ওরা রমণীসুলভ আড়ম্বর বা রাজসিক আনুষ্ঠানিকতা না পেলেও পাবে নৈশব্দ ও নিঃসঙ্গতা। পাবে দুনিয়ার আর কোথাও নেই এমন এক বাড়ি। (কেউ কেউ মিশরে এরকম আরেকটি আছে বললেও তা মিথ্যে)। এমনকি আমার অপবাদকারীরাও মানে, বাড়িতে একটি আসবাবও নেই। আরেকটি হাস্যকর কথা বলে, আমি আস্তেরিয়ন নাকি কয়েদী! পুনরায় বলছি বাড়িতে একটি দরজাও বন্ধ নেই, একটি দরজাতেও তালা নেই। তাছাড়া, এক বিকেলে রাস্তায় নামলে নিম্নস্তরের লোকদের অচেনা, চ্যাপ্টা, খোলা হাতের মত মুখ দেখে আতঙ্কে রাত নামার আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। এরই মধ্যে সূর্য ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু এক অসহায় শিশুর কান্না ও মানুষের পালের আনাড়ি প্রার্থনা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম ওরা আমাকে চিনতে পেরেছে। লোকগুলো প্রার্থনা করছিল, পালাচ্ছিল, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাচ্ছিল; কেউ কেউ কুঠার-মন্দিরের (Temple of Hachas) সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল কেউ আবার পাথর জড়ো করছিল। খুব সম্ভবত ওদের একজন সাগরতলে লুকালো। এমনি এমনি আমার মা রানি নয়, শালীন হলেও আমজনতায় আমি বিভ্রান্ত হতে পারি না।

মোদ্দা কথা হচ্ছে আমি অনন্য। একজন মানুষ অন্যজনকে কোনো অনুভূতি ট্রান্সমিট করতে পারে কি-না, এই প্রশ্নে আমার কোন আগ্রহ নেই; দার্শনিকের মত, আমারও মনে হয় লেখনীকলা দিয়ে কোনো যোগাযোগই সম্ভব নয়। বিরক্তিকর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুচ্ছকে আমার আত্মা টানে না, কারণ সেটা তৈরিই হয়েছে বিশালত্বকে ধারণের জন্য; কখনই এক বর্ণ থেকে আরেক বর্ণের পার্থক্য মনে রাখিনি। কিছু উদার অধৈর্যতা আমাকে পড়তে শিখতে দেয়নি। মাঝে মাঝে খারাপ লাগে, রাত্রি ও দিনগুলো বড্ড লম্বা বলে।

অবশ্যই আমার বিনোদনের প্রয়োজন পড়ে। আক্রমণোদ্যত ভেড়ার মত গ্যালারির মধ্য দিয়ে ছুটে চলি যতক্ষণ না মাথা ঘুরে গড়িয়ে পড়ি মেঝেতে। এক পুলের ছায়ায় বা বারান্দার মোড়ে গুঁড়ি মেরে বসে ভান করি যেন কেউ আমাকে খুঁজছে। ছাদের ওপর থেকে নিজেকে গড়িয়ে দিই যতক্ষণ না রক্তে একাকার হই। যে কোন সময় চোখ বুঁজে বড় বড় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ঘুমানোর খেলা খেলতে পারি। (মাঝে মাঝে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে যাই, একেকবার চোখ খুলে দেখি দিনের রং বদলে গিয়েছে।) কিন্তু এত এত খেলার মধ্যে সব থেকে ভাল লাগে অন্য এক আস্তেরিয়নের সাথে খেলতে। ভান করি যেন সে বেড়াতে এসেছে আর তাঁকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাই। লম্বা কুর্নিশ করে বলি : ‘এবার আমরা আগেকার পথসন্ধিতে ফিরে যাব’ বা ‘এবার আমরা অন্য উঠানে গিয়ে পড়ব’ বা ‘বলেছি না, তোমার নালাটা ভাল লাগবে’ বা ‘এবার এক চৌবাচ্চা দেখতে পাবে, এখন সেটা বালু দিয়ে ভরে গিয়েছে’ বা ‘এবার দেখবে তলকুঠুরি কিভাবে শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়েছে’। মাঝে মাঝে ভুল করে ফেলি আর দুজনেই ফেটে পড়ি অনাবিল হাসিতে।
শুধু এই খেলাগুলোই কল্পনা করিনি; এছাড়াও বাড়িটা নিয়ে ধ্যান করেছি। বাড়ির প্রত্যেকটা অংশই পুনরাবৃত্ত, দেখতে একই রকম, একই আদলে, একইভাবে গড়া, আবার যে কোন জায়গাই অন্য এক জায়গা।

একটি করে চৌবাচ্চা, একটি উঠান, নান্দা, একটি করে জাবলা কোথাও নেই, আছে চৌদ্দটি (অসীম সংখ্যক) করে চৌবাচ্চা, উঠান, নান্দা, জাবলা। বাড়িটা আকারে গোটা দুনিয়ার সমান; ভালো করে বলতে গেলে এটাই এক দুনিয়া। তা সত্ত্বেও, চৌবাচ্চাসহ উঠানগুলো এবং ধূলি-ধুসর পাথুরে গ্যালারিগুলোকে অবসন্ন করে পৌঁছে গিয়েছি এক রাস্তায় আর চোখে পড়েছে কুঠারের মন্দির ও সাগর। তখনও বুঝতে পারিনি, যতক্ষণ না এক রাত্তিরে আমার সামনে উদ্ঘাটিত হয়েছিল মন্দির ও সাগরের সংখ্যাও চোদ্দটি (অসীম সংখ্যক) করেই আছে। সবই পুনরাবৃত্ত, চৌদ্দবার, কিন্তু মনে হয় এ দুনিয়াতে শুধুমাত্র দুটো জিনিসই একবার করে আছে : ওপরে জটিল সূর্য; নীচে আস্তেরিয়ন। হয়তবা আমিই তৈরি করেছি নক্ষত্র, সূর্য আর এই বিশাল বাড়ি, কিন্তু এখন আর সেসব মনে পড়ে না।

প্রতি নয় বছরে নয়জন করে পুরুষ বাড়িতে ঢোকে যেন আমি ওদের অশুভ সবকিছু থেকে মুক্তি দেই। ওদের পদশব্দ, গলা শোনা যায় পাথুরে গ্যালারিগুলোর গভীরে। আনন্দের সাথে দৌড়ে যাই খুঁজতে। আচার অনুষ্ঠানটা খুব কম সময় ধরে স্থায়ী হয়। আমার হাত রক্তে রাঙিয়ে ওঠার আগেই একের পর এক লুটিয়ে পড়ে। যেখানে পড়ে সেখানেই থেকে যায়, আর ওগুলোই এক গ্যালারি থেকে অন্যটির পার্থক্য গড়ে তোলে। জানি না ওরা কারা তবে মৃত্যুর সময় ওদের একজন ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছে, কোন একদিন আমার ত্রাণকর্তা আসবে। আর তখন থেকেই এই নিঃসঙ্গতা আমাকে আর ব্যথিত করে না, কেননা জানি আমার ত্রাণকর্তা বেঁচে আছে আর উদয় হবে ধুলোর উপরে। যদি পৃথিবীর সব গুঞ্জন ধরা দেয় আমার কানে, শুনতে পাবো ওর পদধ্বনি। আশা থাকবে, নিয়ে যাবে আমাকে, আরও অল্প সংখ্যক গ্যালারি, অল্প সংখ্যক দরজার ভুবনে। আমার উদ্ধারকর্তা কেমন হবে? মনে প্রশ্ন জাগে। সে কি ষাঁড় হবে নাকি মানুষ হবে? নাকি হবে মানব মাথাঅলা এক ষাঁড়? নাকি হবে ঠিক আমারই মত?

ভোরের কিরণ ঝিকমিকিয়ে ওঠে ব্রোঞ্জের অসির ফলায়। রক্তের কোন চিহ্নই আর পড়ে থাকে না।

– জানো, আরিইয়াদনা?—বলে তেসেও— মিনোতাউর খুব সামান্যই প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে।

আনিসুজ জামান আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশের লেখক। কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।

Exit mobile version