আধুনিক বিশ্বে খেলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বা নান্দনিক তাৎপর্য অনস্বীকর্য। ঐতিহাসিক ই. জে. হবস্বম খেলাকে উনিশ শতকের শেষভাগে ও বিশ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপের ‘একটি অন্যতম নতুন সামাজিক অধ্যাস’ বলে অভিহিত করেছিলেন, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ঐক্যমূলক ভাবধারা বা অনুভূতি গঠনে সাহায্য করেছিল। কারও মতে, দীর্ঘমেয়াদী কিংবা রক্ষণশীল ধারণার বশবর্তী হয়ে বৌদ্ধিক দূরদৃষ্টির অভাবেই ঐতিহাসিকদের এই ব্যর্থতা। জেমস্ ওয়ালভিন লিখেছিলেন নির্দিষ্ট একটি খেলা খেলার বিনোদনকে ছাড়িয়ে ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বর্তমানে বাংলাদেশের জনজীবনে খেলার বিশেষ করে ক্রিকেটের একটি তাৎপর্য্যমণ্ডিত ভূমিকা রয়েছে। খেলাধুলা, নৃত্য, সঙ্গীতের যেমন আচরণ ও প্রকাশগত সহজাত দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে দার্শনিক ভিত্তি।
কেননা, অন্যান্য অনেক সামাজিক অভ্যাসের মতো খেলাও মূলত সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচিত হয়। ওয়ালভিন লিখেছেন : “the sports historian and sociologist need to reach beneath the surface, behind the obvious facts of sporting history, if their studies are to be any more than yet another quasi-anti-quarianism masquerading as serious social history. ওয়ালভিনকে অনুসরণ করে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে বোরিয়া মজুমদার বলেছেন, শুধুমাত্র ভারতীয় খেলার ঐতিহ্যের বিবর্তন জানার জন্যই খেলার ইতিহাস চর্চা জরুরি নয়, আপেক্ষিকভাবে বিযুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কিংবা জাতীয়তাবাদ বা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলেও খেলার ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
ভারতীয় ক্রিকেটের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে লিখিত বোরিয়া মজুমদারের Twenty-Two Yards to Freedom: A Social History of Indian Cricket গ্রন্থে উপনিবেশিক বাংলায় ক্রিকেটের প্রবর্তন ও প্রসার সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। বাংলার ক্রিকেটের ইতিহাসকে ‘এক বিস্তৃত জাতীয়তাবাদের কাহিনী” বলে উল্লেখ করে তিনি সংক্ষেপে হলেও ঢাকাসহ পূর্ব বাংলায় ক্রিকেটের জনপ্রিয়করণের ইতিহাস বিবৃত করেছেন। একই সঙ্গে নাটোরের মহারাজার ক্রিকেটপ্রীতি কিভাবে এক জাতীয়তাবাদী প্রয়াসের রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
ভারতীয় সাংবাদিক সাম্য দাশগুপ্ত তাঁর লেখা Bangladesh Cricket Scoring on Passion, but Little Else শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভেদের মাঝে ক্রিকেটের ঐক্যমূলক শক্তির তাৎপর্য উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক স্তরে জাতীয় দলের সাফল্যলাভের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে।
ক্রিকেটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি। দু’ধরনের জাতীয়তাবাদী ধারণার বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে ঘটেছে জাতীয় ঐক্যমূলক আত্মপরিচয়ের প্রকাশ। একদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা যেখানে বাঙালি সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা ও ভূগোলের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বাঙালি জাতীয় সত্তার মূলগত বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন, অন্যদিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রচারকগণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের থেকে বাংলাদেশের জনগণের পার্থক্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ইসলামিকরণ করেছেন।
রাজনীতির বাইরে গিয়ে বলা চলে, জাতীয়তাবাদী চেতনার সচেতন অনুভূতি ও প্রকাশ বর্তমান বিশ্বে মূলত খেলা, গান, সিনেমা, উৎসব ইত্যাদির মতো কতকগুলি সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্যে দিয়ে জনমানসে প্রতিসারিত বা প্রতিফলিত হচ্ছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ঔপনিবেশিক বাংলার পূর্বাংশে (পূর্ববঙ্গে) দৈনন্দিন সাংস্কৃতিক অভ্যাস বা ক্রিয়াকলাপ রূপে ক্রিকেট খেলার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭-৭১ সময়কালে অনেকাংশেই তা ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্ভোগ ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানি শাসন ছিল এক ‘দ্বিতীয় উপনিবেশিক’ শাসনের মতো, এবং খেলার মতো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে তারা দেশের মধ্যে ও বাইরে ক্রমশ নিজেদের জাতি (ethnic) তথা জাতীয় (national) সত্তা প্রকাশের একটি সার্থক মাধ্যম রূপে দেখতে শুরু করেছিল। কেননা, পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৪৭-৭১ সময়কালে ক্রীড়াক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুত্ব ও বৈষম্যের ঘটনা ছিল সুবিদিত।
১৯৯০-এর দশকের শেষে ক্রমশ ক্রিকেটের উত্থান ও জনপ্রিয়তা বুদ্ধির প্রেক্ষিতে ক্রিকেটীয় আবেগে পরিণত হয়। দেশের সরকার ও জনগণ উভয়েই জাতিসত্তা প্রকাশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উপাদান রূপে এবং জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ক্রিকেটের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছিলেন।
বিশ্বায়নের উদারীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও পেশাদারিত্বের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলাটিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মাধ্যম রূপে এখন ব্যবহার করেছে। এর শুরু মূলত ২০০০ সালে। ‘টেস্ট খেলিয়ে’ দেশের শিরোপা লাভ বাংলাদেশের জনমানসে এক বিরাট প্রভাব ফেলে এবং ক্রিকেটীয় জাতি হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ঘোষণা করে। অর্থাৎ একুশ শতকের গোড়াতেই ক্রিকেট বাংলাদেশ জাতির ঐক্যমূলক আত্মপরিচয়ের প্রকাশক হয়ে ওঠে।
নতুন শতকে উপমহাদেশের তিন ক্রিকেটীয় মহাশক্তি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সাথে সাথে বাংলাদেশও এক সাধারণ দক্ষিণ এশীয় ক্রিকেট সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধিতে পরিণত হয়।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে ক্রিকেটকে একটি সাংস্কৃতিক আবেগ হতে এক জাতীয়তাবাদী আবেগে রূপান্তরিত করে। পরবর্তী কয়েক বছরে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটীয় জাতি রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং ক্রিকেট এক ‘সেক্যুলার’ ধর্মে বা চেতনায় রূপান্তরিত হয়। ২০১১ বিশ্বকাপের পরিপ্রেক্ষিতে ও পরবর্তী কালে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর সংস্কৃতি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ঢাকায় ক্রিকেট খেলার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৫৮ সালে। তবে পূর্ববাংলায় প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেট ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ সালে সিলেটে। ১৮৮০-র দশকের গোড়ার দিকে ঢাকা কলেজের কিছু উৎসাহী শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকা ক্রিকেট ক্লাব স্থাপিত হয়। কলেজের ইংরেজ অধ্যাপকগণ এসময় খেলাটির প্রসারে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কলেজ ক্রিকেট দলটি অনুশীলন ম্যাচে অংশ নিত। পূর্ব বাংলার কলেজ ও ক্লাব ক্রিকেট দলগুলি ১৮৮০-এর দশক হতেই পশ্চিম বাংলায় নিয়মিত খেলতে আসত। বিশ শতকের প্রথমভাগে পূর্ব বাংলায় খেলাধুলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়।
ক্রিকেটে যেন ছিল রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার অনুকরণ এবং জাতীয়তাবাদী প্রকল্প। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর নবগঠিত রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের খেলাধুলা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের প্রভাবে অনেকাংশেই ব্যাহত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব বিস্তারের কারণে খেলাধুলার ক্ষেত্রেও বাঙালিরা বঞ্চনার শিকার হতে শুরু করে। এই অঞ্চলে খেলাধুলোকে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে দেওয়া হয় নি এবং দক্ষ বাঙালি খেলোয়াড়দের অন্যায়ভাবে জাতীয় দলের বাইরে রাখা হয়েছিল। গণতন্ত্র তখন এক প্রহসনে পরিণত হয় এবং স্বভাবতই সেক্ষেত্রে সমাজে বিনোদন বাধাগ্রস্ত হয়।
ক্রিকেটীয় জাতিরূপে বাংলাদেশের উত্থান ঘটে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এবং এর পর। খেলা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় এক হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান শাসনে বাঙালি জাতীয়তার অন্তর্নিহিত স্বরূপটি স্পষ্ট হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হতে ১৯৭০ সালে পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের মধ্য দিয়ে। সেই ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির গঠনে গণভিত্তিক সিভিল সমাজের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা কখনই দৈনন্দিন ক্রীড়া সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। গণমাধ্যম, বিশেষ করে ১৯৮০-র দশক হতে মুদ্রিত ও দৃশ্যমান গণমাধ্যম জনগণের মধ্যে জাতীয় জনপ্রিয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে খেলাকে গুরুত্ব দিতে থাকে এবং এক উজ্জীবনী ভূমিকা গ্রহণ করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী আড়াই দশক অব্দি ফুটবলই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষর আবেগ ক্রমশ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। এইসময়েই ঘটে বাংলাদেশে ক্রিকেটের উত্থান। তবে তখনই খেলাটির পুনর্গঠিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
আইসিসির সদস্যপদ লাভের পর বেশ কিছু বিদেশি দল বাংলাদেশ সফরে আসে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয়ী হলে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব আলোড়ন দেখা দেয়। ১৯৯৯ সালের ৩১ মে গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ চুড়ান্ত অঘটন ঘটায় তারকাখচিত শক্তিশালী পাকিস্তানকে পরাজিত করে। এই জয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে এক ঐতিহাসিক জয় রূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। হাজার হাজার মানুষ হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর জাতীয় পতাকা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় শোভাযাত্রায় সামিল হয়। সেদিন বাংলাদেশ আবার জাতীয়তাবাদী চেতনায় নতুন করে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বলা যায়। কবি শামসুর রাহমান একে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় বলে উল্লেখ করেছিলেন। প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের টেলিফোনে অভিনন্দন জানান আর পরদিন ১ জুন অর্ধদিবস জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেন। অবশেষে স্বপ্নপূরণ হয় এবং ২০০০ সালর ২৬ জুন বাংলাদেশ আইসিসি টেস্ট খেলিয়ে দেশের মর্যাদা লাভ করে। জন্ম হয় একটি নতুন ক্রিকেটীয় জাতির। নতুন শতাব্দীতে ক্রিকেট বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়। সাহিত্য, কবিতা ও গানের মতই ক্রিকেট বাঙালি তথা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভাবনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। একুশ শতকে বাংলাদেশ সেক্যুলার সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। নতুনতর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। নতুন শতাব্দীতে ক্রিকেট বাংলাদেশে এক বিকল্প শক্তিশালী জাতীয় আত্মপ্রকাশের (national self-expression) সাংস্কৃতিক মাধ্যম হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি অভিবাসী সমাজ ক্রমে ইসলামীয় সত্তার প্রতি আগ্রহপ্রবণ হলেও ক্রিকেটের মতো ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক মাধ্যমের প্রতি তারা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হতে থাকে। এখন তো ক্রিকেট আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় বিনোদন। ক্রিকেট এখন সকল বিভেদের ঊর্ধ্বে এক নতুন ঐক্যের বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করেছে। পাকিস্তানের জয় নিয়ে কারো কারো সামান্য আবেগ কাজ করলেও বাংলাদেশের জাতীয় আবেগের কাছে তা একেবারেই তুচ্ছ বলা যায়।
বাংলাদেশের এই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় আবেগ গভীরতর হয় ২০১১ সালে বিশ্বকাপের অন্যতম আয়োজক দেশ হিসেবে। বাংলাদেশের জনমানসে ও গণমাধ্যমে ক্রিকেটের সর্বজনীন জনপ্রিয়তা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় সত্তার প্রতিভূ রূপে খেলাটির ক্রমবর্দ্ধমান গুরুত্ব বর্তমানে এটিকে যেন এক সেক্যুলার ধর্মে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশের জনসাধারণ এর বাইরেও বেশ কিছু সেক্যুলার মুহূর্ত বা অনুষ্ঠান, যেমন ভাষাদিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং পয়লা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে এই ধরনের ঐতিহ্যকে লালন করে এক সহনীয় জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি নির্মাণের প্রয়াসী হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপকে এক বিরাট সাংস্কৃতিক মহাদৃশ্য (Grand cultural spectacle) হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, যার দ্বারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের আদর্শ ধারণ করতে পেরেছে। নতুন শতকে বাঙালি আত্মপরিচয়-ভিত্তিক সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি সত্তাভিত্তিক ধর্মীয় মৌলবাদী জাতীয়তাবাদের দ্বান্দ্বিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি মাত্র সাংস্কৃতিক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে। আর এটি সম্ভব করেছে ক্রিকেট।
ফলে, নিঃসন্দেহে বলা যায়, আজকের একুশ শতকে বাংলাদেশের সমাজে ক্রিকেটীয় সত্তা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও পেশাদারী বিভিন্নতার ঊর্ধ্বে এক ঐক্যমূলক সূত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। নিম্নবর্গীয় (subaltern) থেকে উচ্চবর্গীয় (elite) – সকল স্তরের মানুষকে সম্মিলিত করার ক্ষমতা বর্তমানে একমাত্র ক্রিকেটেরই রয়েছে। দা ডেইলি স্টার (The Daily Star) পত্রিকার বিশেষ বিশ্বকাপ সংখ্যার সম্পাদক মাহফুজ আনম (Mahfuz Anam) একবার বলেছিলেন : There are few things with a greater capacity to unite than sport as a leveller that truly transcends all boundaries and commands unanimity across supporters irrespective of age, sex, race and religion. In sport, political boundaries are irrelevant, we are all united for the common good, which in this case is the success of the Bangladesh national cricket team।
সাংবাদিক রেজানুর রহমানের মতে, “ক্রিকেট বাংলাদেশে এখন আর শুধুমাত্র একটি খেলার নাম নয়, আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা ও অহংকারের প্রতীক। শত প্রতিকূলতার মাঝেও এই একটি মাত্র খেলা জাতিকে, গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে। তাইতো যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলে তখন সবার সমবেত প্রার্থনা শুরু হয়।” ২০১১ বিশ্বকাপের তাৎপর্য আরও বেশি ছিল কারণ বাংলাদেশ আয়োজক দেশ হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। বিশ্বক্রিকেটের সবচেয়ে বৃহৎ ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন এবং প্রতিযোগিতার আটটি খেলা আয়োজনের দায়িত্বলাভ সুযোগ এনে দিয়েছিল বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার। মাহফুজ আনাম তখন লিখেছিলেন,
For Bangladesh it will be debut in organising a sporting event of this magnitude. For any sport, the World Cup is the pinnacle of achievement and competition and for Bangladesh to be bestowed the honour of hosting such an event, it is imperative that we put our best possible faces forward to the watching world. Be it in terms of our hosting and hospitality, our game or the showcasing of our culture/national identity, the stage is ours to perform.
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী একই ভাবনার শরিক ছিলেন :
For the first time in our history, we will be hosting a global sporting event that will have millions round the world glued to their sets, laptops and monitors.
Not only will we be welcoming the world to Bangladesh, the world will be embracing us in a manner it has not had an occasion to do thus far. Bangladesh will be seen through new lenses and a very different perspective as modern technology beams us into the living rooms and private time and space of cricket enthusiasts and faithful all over the world.
What an incredible and wonderful opportunity to showcase the best of the best with regard to our country, our people, our culture and also our knowledge, appreciation, love and respect for the game of cricket and its values.
উপসংহার
ব্যক্তির মতই নেশন বা জাতিও বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তি গঠন ও প্রকাশ করতে চায়। আন্তর্জাতিক জনসমাজে বাংলাদেশ তার কোন ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণে বরাবরই পিছিয়ে থেকেছে। এ দেশের সমস্যার ক্ষেত্রগুলি বহুবিধ : রাজনৈতিক উত্তেজনা, জঙ্গি সন্ত্রাস হানা, ধর্মীয় মৌলবাদ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সামাজিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ – যা কিনা এখনও দেশটির বিকাশের পথে বড় বাধা হয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজকে অনেকে একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, অন্যদিকে ডানপন্থী ও মৌলবাদী শক্তি – এ দুয়ের মধ্যে বিভাজিতরূপে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট মাঠে সফল হোক বা ব্যর্থ, ক্রিকেটীয় জাতীয়তাবাদ কিন্তু অন্যরূপ জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা দোষে দুষ্ট নয়। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী বা তাদের অনুগামীরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সেক্যুলার ভাবনার বিরোধী হলেও ক্রিকেটীয় জাতীয়তাবাদের আবেগে উদ্দীপ্ত। বিশ্বায়ন, বাণিজ্যায়ন ও বহুজাতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরও স্থিতিশীল করে তুলেছে ক্রিকেট। বিশ্বায়ন ও বহুজাতিক চলনের দ্রুত পরিবর্তনশীল যুগে ক্রিকেটই সম্ভবত একমাত্র স্বর বা মাধ্যম যা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তার জাতীয় আত্মপরিচয় ঘোষণার সুযোগ এনে দিয়েছে। ক্রিকেট এমন এক বহুজাতীয় (transnational) ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যা প্রচলিত জাতীয়তাবাদী বা ইসলামি প্রকরণের সীমাকে অতিক্রম এবং তাকে পুনর্গঠিত করতে পারে। ক্রিকেট তাই বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পুনঃসংজ্ঞাত, পুনর্ব্যাখ্যা ও পুনরুজ্জীবিত করেছে বলা যায়।
খেলার ইতিহাস মানুষের ইতিহাস (Peoples’ history) চর্চার অন্যতম অঙ্গ। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ঔপনিবেশিক ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ যে নতুন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়বাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, ক্রিকেট থেকেই আমরা সেটা বুঝতে পারি। বর্তমানে নারী ফুটবলার ও ক্রিকেটাররাও এই জাতীয়তাবাদ নির্মাণে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। সেই ভূমিকাটা হলো নারীর গৃহের বাইরে, এমনকি দেশের বাইরে গিয়ে সামাজিক সাংস্কৃতিক অচলায়তন ভেঙে খেলাধুলা করা। বাংলাদেশের মতো একটি রক্ষণশীল দেশ, যার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের মতো মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী, তারা নারীকে এখন গৃহের বাইরে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অচলায়তন ভেঙে ফেলার এ এক অনন্য জেন্ডার নিরপেক্ষ নিদর্শন।
আসিফ হাসান ঢাকায় থাকেন। পেশায় শিক্ষক। অনুবাদ করেন এবং মননশীল প্রবন্ধ লেখেন।