রূপক চক্রবর্তীর কবিতার মেজাজকে পুরোপুরি তুলে ধরার জন্য শিরোনামটি বিশেষ অসফল নয়। বরং ,বলা যেতে পারে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। অন্তত বাংলা কবিতার ঘনিষ্ঠ পাঠকেরা এ ব্যাপারে সচেতন যে রাজনৈতিক ও প্রাতিবেশিক বিষাদ আর শ্লেষ সমান্তরালভাবে গতিধারণ করেছে অকাল প্রয়াত কবির কবিতায়। সঙ্গে যথাযোগ্যতায় ব্যবহৃত হয়েছে একটি স্বপ্রতিভ মার্জিত আরবান ভাষা, যা রূপকের কবিতাকে করে তুলেছিল স্পন্দমান এবং কয়েক দশকের বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানের প্রতিনিধি। এতো সব কবিরই অভিপ্সা। তবে রূপক চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে তা প্রভূত সফল হয়ে উঠেছে প্রধানত শব্দ ও শ্লেষের সুনিয়ন্ত্রিত নিপুণ ব্যবহার, বলে অনুমান করা যেতে পারে। আসলে শ্লেষকে তখনই ব্যবহার করা যায় যখন কবির কালচেতনা ও কালচেতনার অংশ হিসেবে আত্মবিনির্মাণ সম্পর্কে সচেতনতা সমানভাবে সক্রিয় থাকে। এ প্রক্রিয়া ভীষণ পিচ্ছিল। হাস্যরসকে করুণ কিংবা দাস্যে পরিণত করা যখন কাব্যিক অভিপ্রায় হয়ে দাঁড়ায়,তাকে নান্দনিক করে তোলা দুরূহ কাজ হিসেবেই অনুমিত হয়। শ্লেষাধিক্য ঘটলে অনায়াসে ফার্স জন্মাতে পারে, আবার করুণ বেশি প্রতিভাত হলে তাতে কাঙালের আর্তি শোনা যায়।
রূপক এই ভারসাম্য তাঁর কবিতায় বজায় রেখেছেন – বললে কিন্তু রূপক চক্রবর্তীর কবিতাকে সম্পূর্ণ বোঝাতে পারবে।তবে, আংশিক বোঝাবে তো নিশ্চয়ই। অন্তত যে পর্যন্ত তাঁর কবিতা সেই ধারার একাত্ম হয়েছে,যে ধারায় কবিতার শরীর থেকে লিরিককে, গীতলতাকে খুলে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কথা বলার স্পন্দে, প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া নির্মাণের কাজটি নিপুণভাবে করেছেন রূপক তাঁর কবিতায় তাঁর কবিতার একটি অংশ জুড়ে :
আমি এমন একটা মাইনে চাই
যারপর আমার দুঃখ কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যাবে
কিংবা,
প্রিয়া মমতাজকে বলছি
ঘরে রেঁধো না – আজ তরকা আনব
আমার দু’কোলে দারা সুজা আলমগীর নূরজাহান নিয়ে
মাখামাখি হয়ে বসে আছি আগ্রা ফোর্টে।
অথবা,
বাবা অন্ধ ছেলে হাবা
দু’জনে যুক্তি করে সারাদিন শহর ভরে খুঁজে বেড়ায়
এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো – বিয়েবাড়ি-শ্রাদ্ধবাড়ি
যেদিন কোন বাড়ি নেই, সেদিন রাতের দিকে
ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে যায় বেগুসরাইয়ের রিক্সাওয়ালা
হাতে দেয় তিন-চাট্টে টাকা
বাবা বলে, বেবুশ্যে কোথাকার, কিছু বুঝি না ভাবিস?
একেক দিন সাদা হয়ে বর্ষা আসে
শহরের রাস্তায় নামে আদ্যিকালের পানসি-বজরা
সেদিন কোন বাড়ি নেই – রিক্সাওয়ালা নেই,
অন্ধকার কোন গাড়িবারান্দার নীচে
হাবা ছেলেকে গুম্ গুম্ করে কিলোতে কিলোতে বলে :
শুয়োরের বাচ্চা মেয়েছেলে হলেও তো পারতিস, শীতটা কমত অন্তত।
তন্নিষ্ঠ পাঠে এ উদাহরণগুলিতে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে ফুটে ওঠে,
১. কালগত অর্থনৈতিক রোমান্স।
২. প্রেম সোচ্চার কিংবা শৃঙ্গার হওয়ার চাইতে বেশি অসহায় ও আর্ত।
৩. চলিত ব্যবহৃত হলেও রূপক চক্রবর্তীর কবিতায় চলতি শব্দের অকুলান হয়নি কখনও।
৪. মুখের ভাষায় এসেছে অক্ষরবৃত্তধর্মী গদ্য ছন্দ।
এই শেষ বৈশিষ্ট্যটির সঙ্গে রূপক মিশিয়েছেন তীব্র, কখনও অনুচ্চ শ্লেষ। এই গদ্য ভঙ্গিমার মতো হয়তো এই গুণটিও তাঁর কবিতায় সঞ্জাত হয়েছে সম্ভবত বাংলা আখ্যানের ইতিহাস থেকেই। এটাই হয়তো রূপক চক্রবর্তীকে সমসময়ের কবিতায় নতুন বর্ণ যুক্ত করার জন্য প্ররোচিত করেছে।
একথা ভীষণভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, বাংলা আখ্যানের একটা অংশ শ্লেষ ও ব্যঙ্গকে আশ্রয় করে যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনই এই রসিকতাপ্রবণ রচনাগুলিই সাধারণ বাঙালির রুচিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেছে। অর্থাৎ যখনই আখ্যানে আরবান শব্দ ও শ্লেষ প্রবেশ করেছে, তখনই তা যুগরুচির ওপর খুব বড় প্রভাব ফেলেছে। যদিও এই পরিস্থিতিকে নান্দনিক ও সংযত করা খুবই দুরূহ, যা পেরেছেন নবারুণ ভট্টাচার্য। কিন্তু,রূপকের শ্লেষ অতি তীব্র তো কখনই নয়। শ্লেষ সংস্কৃত হয়েছে কবিত্বে। রূপকের শ্লেষ অনেকাংশে আত্মপীড়ন, যা সিংহভাগ পরিস্থিতেই পাঠষ্ক্রিয়ায় করুণার সঞ্চার করে। তৈরি করে পরিশুদ্ধি। একে কী ক্যাথারসিস বলা যেতে পারে – সে তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে নিষ্কৃতি নিয়ে এই করুণা’ও রূপক চক্রবর্তীর কবিতা সম্পর্কে ক’টি প্রস্তাবের অবকাশ তৈরি করা যাক।
এই আত্মপীড়ন ও করুণা নির্মাণের ক্ষেত্রে রূপকের মধ্যে কাজ করেছে সচেতন মৃত্যুচেতনা। লিরিক অথবা লিরিক ব্যাতিরেকেই রূপক চক্রবর্তীর কবিতায় সন্নিবদ্ধ হয়েছে, মৃত্যু ও সংক্রান্ত বেদনা। না, মৃত্যুকে যুক্তি দিয়ে দেখতেন বলেই ততোধিক রোমান্টিক হতে পারেননি সম্ভবত। এই জগত জন্ম শেষ হয়ে গেলে আর কিছু থাকে না। আর কোনও অস্তিত্বের সম্ভাবনাও তৈরি হয় না। বস্তুপুঞ্জের অযুত লক্ষণের মধ্যে মিশে যেতে হয়। কবি খুব ভালভাবে সেটা মেনে নিয়েছিলেন এবং এ কারণেই বারবার বেঁচে থাকার আর্তি ধ্বনি পেয়েছে তাঁর কবিতায় :
ও নদী কত দীন হয়ে যাচ্ছ
ও জঙ্গল কত উজাড় হয়ে যাচ্ছ
ও মেরু কত গলে যাচ্ছ
ও প্রাণ ও প্রাণী কত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছ নিঃশব্দে
ও বাতাস কত উষ্ণ হয়ে উঠছ
ও বন্ধু কত দূরে চলে যাচ্ছ
ও দুঃখ কত বড় হয়ে উঠছ
ও বুড়ি পৃথিবী,মা অনন্ত ছায়াপথে একা হয়ে রয়েছ
হাত ধর আমার
তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না
বুঝতে পারছিলেন কবি, এই গতি, এই জীবনের তীব্র উদ্বোধনের পাশাপাশি আছে একটা ক্রম ক্ষয়িষ্ণুর একক। অমোঘ এই এককের দায়ে কবির শৃঙ্গার থেকে ক্রোধ শেষতক হাহাকার হয়ে যায় :
বাসস্থান আর বাসস্ট্যান্ড শব্দ দুটোকে আমার সব সময় এক রকম মনে হয়। মনে হয় বাসস্থানে যেমন মানুষ ফিরে যায়, বাসস্ট্যান্ডে তেমনই চলে আসে বাস। সারাদিনের সকলের শেষে বিশ্রাম নেয়। এসব লিখতে লিখতে বুঝি, না কবিতা হচ্ছে না, এর মধ্যে কোনও রকমের অবচেতনা নেই। অথচ বন্ধুরা কত গূঢ়তম কবিতা লিখে চলেছে। আশ্চর্য আশ্চর্য ইমেজারি। একই শব্দের করো না। অথচ খবরের কাগজের মতো হয়ে যাচ্ছে আমার লেখাগুলো। এসব ভাবি, ভাবতে ভাবতে দেখি কালান্তরের প্রথম পাতা রঙিন হয়ে গেল। এখন কোথায় কোনও সূর্যান্ত হচ্ছে না, মেঘ হচ্ছে না। সমস্ত আকাশ মটরশুঁটি ফুলের মতো নীল। কিছুই করা হলো না। শুধু অবসাদ ঘিরে রাখল, অবসাদ। ডানহাতের অসহ্য ব্যাথা। লেখা বেঁকে গেল। নূপুর হয়ে গেল এখনও একটা বড় লেখার হাত দেওয়া হল না। দায়িত্ব বেড়ে গেল অর্থ কেউ গেল না। দিন শেষে দেখি ছাই? সত্যিই ছাই?
জানি না,শেষ পর্যন্ত কবি বুঝতে পারেন কিনা দেহগত সমাপ্তির সংস্পর্শ, তবে, এটা তো সত্যিই আক্ষেপানুরাগে ভরা থাকে কবির ইতিবৃত্ত। রূপক চক্রবর্তীর কবিতার আক্ষেপ আবহমান সময়ের কাব্যিক আক্ষেপে পরিণত হয়। কিছুতেই তা আর আত্মবিশ্বাসী থাকতে পারে না। আসলে নিজেকে,নিজের প্রতিবেশকে, চালচিত্রকে ক্রমাগত নস্যাৎ ও সন্দেহ করতে করতেই তো কবিকে কাল চেতনা পেরিয়ে যেতে হয়। সেই পেরনর কাজটায় রূপক চক্রবর্তীর মতো অবলীলায় করে ফেলতে পারলেন বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর কেই বা!
আবার রূপক চক্রবর্তীর কবিতার নিয়মিত পাঠক হলে অবশ্যই আপনি এ বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন, শেষ পর্যন্ত বাংলা গীতিকবিতার মূল স্পন্দের সঙ্গে একাকার হয়ে যেতে চাইছিলেন। ত্রিপদী, বৈষ্ণব অনুসঙ্গ আর তৎসম শব্দের প্রাবল্য দেখা যাচ্ছিল রূপক চক্রবর্তীর কবিতায় :
শ্রীখোল খঞ্জনি নাই, বেলা যায় সাঁঝের গলিতে।
দীপ জ্বালো কলিকাতা, সুতানুটিগুছির পলিতে
ঊরুতে পাকাও বসি, দেখ দীন গোবিন্দপুরের
গৌর ধূলির পথে নিত্যানন্দে হাওয়া ওঠে ফের…
জ্যৈষ্ঠে করো কথকতা, দশকুশী তালের গুরুগুরু
তাউটি তাখিনা বোল, আখরে আষাঢ় হল শুরু
উত্তরে সঘন শ্যামপুকুরে সিনান শেষে রাধা—
বাজারে নিঙাড়ি শাড়ি বারিধার নাহি মানে বাধা
ঝরো ঝরো জানালার একা ঘর বিরহবিধুর
বেতের কেদারা দুটি পাশাপাশি… মাঝে ঝাপসা দূর
আমাদের জোড়াসাঁকো পার হয়ে কুমোরটুলিতে
কলস ভাসিয়া যায় অবিরল রবীন্দ্র সঙ্গীতে
শ্রীখোল খঞ্জনি নাই, গোবিন্দপুরের দীন দুখী
কীর্তনীয়া কতিপয়। বরষা জমায় জীবনমুখী।
এ কবিতায় আপনি অনায়াসে দেখতে পাবেন ,আততির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কবির সময় সংবেদনা কিন্তু সমানভাবে জায়মান। প্রচ্ছন্ন হয়েছে, প্রশমন পেয়েছে সে। পূর্ববর্তী উচ্চারণের থেকে মৃদু ও নিবিড় হয়েছে সে। কিন্তু, রয়ে গেছে। একেই সম্ভবত কবির নিজস্ব স্বভাব বলে। সে বিবর্তিত হবে কিন্তু চিহ্নকে ধারণ করে অব্যহত থাকবে।
রূপক চক্রবর্তী অকাল প্রয়াত। তাঁর কবিতার সম্পূর্ণ রূপ আমরা হয়তো দেখতে পেলাম না। ইন্টারন্যাশনাল গাইতে গাইতে চলে গেলেন যখন রেখে গেলেন একটি অসমাপ্ত অথচ পরিবর্ধমান কবিতার বিশ্বকে, যে বিশ্বের অসংখ্য সলমা জরিতে রয়ে গেল বিচিত্র ছন্দ প্রয়োগ আর ভাষা চেতনা। বাংলা লিরিক ও প্রতিকবিতার দু’টি ধারাকেই রূপক সমৃদ্ধ করেছেন। এটা আক্ষরিক অর্থেই বিস্ময়ের। এতটা সাবলীল বহুমাত্রিক কবিতা, পর্ব থেকে পর্বান্তরে গতায়াত সহজ দৃষ্ট নয়। ঠিক একারণেই রূপক চক্রবর্তী স্বতন্ত্র। আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই আপনাকে – রূপক চক্রবর্তী।