তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য উপন্যাস হাওয়ার্ড ফাস্ট | মুক্তির পথ (পর্ব ৭) | ভাষান্তর : মোবাশ্বেরা খানম বুশরা | উপন্যাস
অনুবাদ উপন্যাস

হাওয়ার্ড ফাস্ট | মুক্তির পথ (পর্ব ৭) | ভাষান্তর : মোবাশ্বেরা খানম বুশরা | উপন্যাস

উপন্যাসের স্থান : আমেরিকা।
ঘটনাকাল : সিভিল ওয়ার (১৮৬১-১৮৬৫) পরবর্তীকাল
আমেরিকার সবচেয়ে জঘন্য প্রথাটি ছিল দাসপ্রথা। কালোদের ওপর যে নির্য়াতন চালানো হয়েছে, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল সেটি। এই দাসত্বপ্রথা আরও চলবে কি না, সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধটা ছিল তাই নিয়ে। কিন্তু একসময় এই যুদ্ধ শেষ হলো। কালোরা মুক্ত হলো। এরপর কালোরা কীভাবে তাদের অধিকার পেল, এই উপন্যাসের গল্পটি তাই নিয়ে।

ঔপন্যাসিকের উপক্রমণিকা

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘ রক্তঝরানো সেই যুদ্ধ। এ্যাতো বড় যুদ্ধ বোধহয় আর দেখে নি পৃথিবীর লোক। সে যুদ্ধ শেষ হলো শেষ পর্যন্ত। নীল পোশাক পরা লোকেরা ফিরে এল ঘরে। ধূসর পোশাক পরা লোকেরা হতবাক দৃষ্টি আর ক্ষরিত হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে রইল তাদের বিস্তীর্ণ ভূমির দিকে। দেখল যুদ্ধ কি করতে পারে।
এ্যপোম্যাটোক্স কোর্ট হাউজে জেনারেল লী তার অস্ত্র সমর্পন করলেন আর অবসান হল এই যুদ্ধের। উষ্ণ দক্ষিণ দেশে চব্বিশ লক্ষ কালো মানুষ মুক্ত হল। বড় কষ্টে পাওয়া এই স্বাধীনতা, বড় মূল্যে কেনা। একজন মুক্ত মানুষের কাছে তার গতকাল আর আগামীকাল দুটোই একান্ত নিজের। সে দুটোরই হিসাব রাখে। ক্ষিদেয় পেট জ্বলছে, কিন্তু কোনো প্রভু নেই তোমার মুখে খাবার তুলে দেবার, তবে দ্রুত পা ফেলে হেঁটে গেলেও তো কেউ নেই যে বলবে, আস্তে হাঁটো। এই কালোদের মধ্যে দু’শ হাজার ছিল প্রজাতন্ত্রের সৈন্য। তাই যখন যুদ্ধ শেষ হলো অনেকেই ঘরে ফিরে এল হাতের বন্দুক সাথে নিয়ে।
গিডিয়ন জ্যাকসন ছিল তাদেরই একজন। দীর্ঘ মজবুত দেহে ক্লান্তি, হাতে বন্দুক, গায়ে রংচটা নীল পোশাক, সে ফিরে এল ক্যারোলাইনার মাটিতে, কারওয়েল জমিদারিতে (প্ল্যান্টেশনে)। বিশাল সাদা বাড়িটা যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ওর মনে পড়ল। যুদ্ধে তার কিছুই হয় নি। কিন্তু মাঠে আর বাগানে আগাছা, জঙ্গল। কারওয়েলরা চলে গেছে, কেউ জানে না কোথায়। মুক্ত মানুষেরা ফিরে এসে তাদের পুরোনো দাস কোয়ার্টারগুলোতে আবার জীবন শুরু করল, যারা কোথাও যায় নি তাদের সাথে। যতই মাস যেতে লাগল কারওয়েল জমিদারিতে আরও আরও মুক্ত মানুষেরা ফিরে আসতে লাগল, উত্তরের ঠান্ডা ভূমি থেকে, যেখানে তারা স্বাধীনতা খুঁজতে গিয়েছিল, ইউনিয়ন সেনাবাহিনী থেকে যেখানে তারা লুকিয়ে ছিল, পাইনের বনে অথবা জলাভূমিতে। সব জায়গা থেকে মুক্ত মানুষের দল ফিরতে লাগল। পুরোনো জীবনে ফিরে গভীর বিস্ময়ের সাথে ওরা দেখল যে ওরা এখন স্বাধীন।

পর্ব ৭

চার্লস্টনের মত তাড়া এখানে নেই, সেই সময়ের চাপ নেই যেটা গিডিয়ন ওখানে বোধ করত। সূর্য ওঠে, সুর্য অস্ত যায়। ওর ভাল কাপড়গুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে। পুরোনো জিনস আর ছেঁড়া শার্টটা আবার পরে নিয়েছে। একটা অসুস্থ সোমত্থ শূকর, ময়লার ঢিবির মধ্যে বাচ্চা বিয়োবে বলে ও সারা রাত জেগে রইল খোঁয়াড়ে। এখন বৈপরীত্যটা অত চমকে দেয় না, আর দাসদের খুপরিগুলো যেগুলোকে ফিরে আসার পর পর খুব ভয়ঙ্কর লাগত এখন ততটা লাগে না। এখন আবার খুব পুরোনো চেনা ছবিই মনে হয়।

রাতে ও বেশিরভাগ সময় মোমবাতির আলোয় জোরে জোরে পড়ে। মার্কাস, জেফ, জেনি আর র্যা শেল শোনে বসে বসে। মাঝে মাঝে অ্যালেনবি আসে, এলেন জোনস, কখনো ব্রাদার পিটার আসেন, আবার কখনো অন্য কেউ। ও তাদেরকে হুইটম্যান, এমারসন থেকে পড়ে শোনায়, কানে বাজতে থাকে বুড়ো জন ব্রাউনের শেষ কথাগুলো জন গ্রীনলিফ হুইটিয়ারের কবিতা। কবিতা ওদের কল্পনায় সাড়া ফেলে, ওরা ছন্দের তালে তালে দোলে, আস্তে আস্তে হাতে তালি দেয়। ও যখন পড়ে জেফ ওকে দেখে। গিডিয়ন ভাবে শিগগিরই ও ছেলের সাথে কথা বলবে, বের করতে হবে ওর কালো চোখ আর অবিচল শক্ত কালো মুখের পেছনে কি আছে। মার্কাস জীবনকে সহজ ভাবে নিয়েছে, অ্যালেনবিকে ওর শেখার ক্ষিপ্রতা দিয়ে অভিভুত করেছে। এই সব কিছু মিলিয়ে একটা যতি ছিল, একটি বিরতি যখন গিডিয়ন বুঝতে পারল যে ওকে একটি অস্থিরতা খুব ভোগাচ্ছে। ব্রাদার পিটার বললেন, ‘ফিরে তাকাও গিডিয়ন, আমি বলেছিলাম তুমি ভরে দেবে, যেভাবে কুয়ো থেকে ঠান্ডা পরিষ্কার পানি এনে ভরতে হয়।’
‘আমি মনে করতে পারি,’ গিডিয়ন বলল।
‘তুমি চার্লস্টনে গেছ যেখানে প্রভু তোমাকে উঁচুতে তুলে দিয়েছিলেন। তুমি ফিরে এসেছ, কিন্তু তোমার লোকদের সাথে কোনো বাঁধন অনুভব করছ না।’
‘সেটা ঠিক নয়,’ গিডিয়ন বলল।
‘তুমি যদি ঈশ্বরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তবে ঈশ্বরও তাঁর মুখ ফিরিয়ে নেবেন,’ ব্রাদার পিটার চিন্তিত ভাবে যোগ করলেন, কিছুটা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে, ‘তুমি তাই করেছ, গিডিয়ন।’
‘না না তা নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু। একমাত্র যে ভাবে আমি পারি ব্রাদার পিটার, সে ভাবেই আমি জিনিসগুলোকে দেখি, আমার বোঝার ক্ষমতা দিয়ে। আমি মানুষদেরকে দাসত্বের বন্ধনে বাঁধা দেখেছিলাম, ঈশ্বর কিন্তু সে শেকল ভেঙে দেন নি, ভেঙেছে মানুষ। আমি খারাপ লোক দেখেছি, দেখেছি উদাসীন লোককেও একটি ভাল কারণে বন্দুক তুলে নিতে। কারণ ভাল লোকেদের নিজেদের পথ আছে। এভাবে রক্ত আর দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়েই তো ভাল কিছু এসেছে। ’
‘আর আত্মার মুক্তি গিডিয়ন?’
‘হতে পারে আমি আমার আত্মার মুক্তি দেখছি আমার মত করে, কোনো কিছুর সত্যতায়, স্কুলে, ভাল আইনে, আমরা যে থাকি এই নড়বড়ে ঝুপরিগুলোর বদলে ভাল বাড়িতে…’
রাতে র্যা শেল মরিয়া হয়ে ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে ডাকল, ‘গিডিয়ন?’
‘কি হলো?’
‘আমাকে ভালবাস বল, গিডিয়ন।’
‘আর কাকেই বা ভালবাসব আমি?’
‘তাহলে কি হয়েছে গিডিয়ন, তুমি এত বদলে গেছ, অন্য কথা বল, অন্যভাবে চল। তাহলে তোমার আমার কি হবে?’
‘কিছুই হবে না সোনা, কিছুই না।’
‘শিগগিরই তুমি চলে যাবে গিডিয়ন তুমি চলে যাবে…’
‘না’
‘মুখ এককথা বলে কিন্তু মন অন্য কথা।’
‘না না,’ গিডিয়ন ওকে আশ্বস্ত করল।
কারডোজো থেকে ক্যাপ্টেন হলস্টেইন একটি চিঠি নিয়ে এল, যেটায় লেখা, ‘গিডিয়ন তুমি কি ঐ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছিলে? ওখানে তুমি নিরামিষের মত বসে থাকতে পার না যখন জগতটা কাঁপছে।’
এক বিকেলে ওরা পুরোনো দিনের মত যব আর ভুট্টার গোলাটার দিকে পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল, গিডিয়ন, ব্রাদার পিটার, হ্যানিবাল ওয়াশিংটন, অ্যালেনবি, এনড্রু আর ফার্দিনান্দ যারা দু’জনেই লিংকনের নাম নিয়েছে। ধুলোয় লাথি দিতে দিতে ওরা ঘাস চিবুচ্ছিল।
‘দেখে মনে হয় বৃষ্টি হবে।’
‘হয়ত আসবে তবে অল্প একটু।’
‘একটু বৃষ্টি হলে পুরোনো ধুলোটা চলে যাবে।’
‘পশ্চিম থেকে আসছে মনে হয়।’
‘খুব জোরেই আসছে মনে হয়।’
গিডিয়ন বলল, ‘আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমরা একটু তুলো কর।’
‘যদি আর কোনোদিন আমি তুলোর একটা গোল্লাও না ভাঙি, কী যে খুশি হব।’
‘একটা দুঃখের ফসল।’
‘এটাই এই মাটির ফসল,’ গিডিয়ন বলল, ‘এটা টাকা আনে। আমাদের টাকা দরকার।’
‘একথা তো তুমি বলেই যাচ্ছ,’ অ্যালেনবি বলল।
‘হ্যাঁ, কিছুই আমাদের নয়। এমনকি যে ঝুপরিগুলোতে আমরা থাকি সেগুলোও নয়। এর আগে পর্যন্ত সবকিছুই হেঁয়ালি ছিল, কেউ দলিলপত্র দেখায় নি, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি এখানে এই নিগাররা কি করছে? প্রথম নির্বাচন এল, আমরা এখন বেসামরিক সরকার পেতে যাচ্ছি। এরপর এক একর জায়গাও আর গোনার বাইরে থাকবে না।’
‘কারা আমাদেরকে জমি থেকে তুলে দেবে?’
‘যে বা যারা এটা কিনবে।’
‘কিন্তু সাদা লোক তো একা জমিতে কাজ করতে পারবে না, ওদের তো নিগারদেরকে লাগবেই। ’
‘হ্যাঁ, ওদের নিগারদেরকে লাগবে। ভাগে চাষ করবে যেমন সাদারা যুদ্ধের আগে করত। প্রতি একরে তুলো চাষ করত আর নিগারদেরকে তাদের বাচ্চাদের একটুকরো মাংস খাওয়ানোর জন্য ভিক্ষে চাইতে হত। যেমন ব্রাদার পিটার বলে এটা দুধ আর মধুর দেশ। কিন্তু কেন? কারণ আমরা এখানে ভুট্টা ফলাই, এভাবে খাই, কারণ আমরা নগদ টাকা ছাড়া চলি। কেবল একটা মোমবাতি, বই পড়বার জন্যে কিনি, বাচ্চাদের বই কিনতে একটু টাকা লাগে।’
‘গিডিয়ন, সরকার কি নিগারদের জন্য জমি কিনে দেবে না?’ হ্যানিবাল ওয়াশিংটন জিজ্ঞেস করল।
‘হয়ত, কিন্তু মনে কর সরকার দিল। সরকারের হাজার হাজার লোক ধীরে ধীরে কাজ করে। হয়ত এক বছর, দু বছর বা হবেই না হয়ত। সরকার হয়ত বলবে এখানে জর্জিয়ায় এক টুকরো জমি আছে, সেখানে চলে যাও। তাতে তো লাভ হবে না। আমরা এখানে থাকি, এটাই আমার জায়গা, ঠিক এইখানটায়। এই জায়গাটাই আমাদেরকে পেতে হবে।’
‘কিভাবে পাব?’
‘কিনে নেব,’ গিডিয়ন বলল, ‘কাজ করে টাকা রোজগার করব, তারপর জায়গাটা কিনে নেব।’
অ্যালেনবি বলল, ‘কিন্তু তাতে তো অনেক টাকা লাগবে, গিডিয়ন।’
‘নিশ্চয়ই, তবু শুরু করা তো যায়। ব্যাঙ্ক টাকা ধার দেয়… এমনকি নিগারদেরকেও, যদি ওরা ঠিক কথাটা বলে। ওরা আমাদের উদ্দেশ্য দেখবে, দেখবে আমাদের কিছু নগদ টাকা আছে কি না। রেল রাস্তার জন্য জলাভূমির ওপর দিয়ে পথ বানানো হচ্ছে, লোকেদের দিনে এক ডলার হিসেবে কাজ করতে ডাকছে, সাদা কালো সবাইকে। ধর আমরাও সেখানে গেলাম, রেলরোডে ছ’সাত সপ্তাহ কাজ করলাম…’
‘আর ফসল?’
‘ফিরে এসে ওগুলো তুলব।’
দীর্ঘ নীরবতা ঘিরে থাকল যতক্ষণ না ব্রাদার পিটার বললেন, ‘গিডিয়ন এটা একটা কষ্টের ব্যাপার, এই যে পুরুষ মানুষগুলোকে তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া।’
কিন্তু হ্যানিবল ওয়াশিংটন বলল, ‘গিডিয়নই ঠিক।’
‘আমরা সবাই মিলে সভা ডাকব,’ গিডিয়ন ওদেরকে বলল।
তবে মহিলদের জন্যে এটা কষ্টের ব্যাপারই ছিল। খালের পানিতে কাপড় ধুতে ধুতে ওরা র্যা শেলের দিকে তাকাচ্ছিল, যে কিনা নীরবে কাপড় ঘষছিল আর থপ থপ করে সেগুলো ধুচ্ছিল। বদল খুব কষ্টের ব্যাপার কিন্তু এখন থেকে বদল হতেই থাকবে, যদিও এটা মুক্তির একটা অংশ, তবুও কষ্টের। বাচ্চাদের মত হওয়াই ভাল, যারা ন্যাংটো হয়ে পানিতে ছপছপ করে নাচছে, লাফাচ্ছে, হাসছে চিৎকার করছে, কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু ওরা তো বাচ্চাদের মত নয়। জলাভূমিটা ম্যালেরিয়ায় ভরা, লোকেরা সেখানে অসুস্থ হয়ে মারা যাবে, ওটা ডাইনিদের জায়গা। র্যা শেল থপথপ করে কাপড় ধুয়ে চুপচাপ চিপে নিচ্ছিল, দেখতে পেল জেনি পড়ে গিয়ে কাঁদছে। ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘জেনি জেনি ওঠো, বেরিয়ে আস।’ অন্য মহিলারা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালেও কোনো কথা বলল না…।
অ্যালেনবি গিডিয়নকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি জেফকে সাথে নেবে?’
‘হ্যাঁ নেব, ও তো শক্তপোক্ত আছে।’
‘আমি হলে নিতাম না গিডিয়ন।’
‘কেন?’

(চলবে)

মোবাশ্বেরা খানম বুশরা : অনুবাদক, গল্পকার ও নাট্যকার।

পূর্ববর্তী পর্বের লিংক (পর্ব ৬)

Exit mobile version