হিন্দি থেকে অনূদিত
আমি, সেই সমুদ্রে প্রথমবার ডুব দিলাম। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গগুলি আমাকে হাত তুলে তুলে বারবার নিজের কাছে ডাকছিল। ওদের সম্মোহনশক্তি ভয়ঙ্কর! আমি চারদিকে চোখ তুলে তাকালাম। কোথাও এমন কিছুই নেই, যা আমার পা দুটোকে শিকলে জড়িয়ে আমাকে আটকে রাখে। দূরে, বহু দূরে দুই চোখে তাকিয়ে দেখলাম। শুধু রোদেপোড়া পাষাণ, যাদের ফাঁক-ফোকরের নিচু জায়গাগুলোতে জল জমে জমে শাওলা হয়ে গেছে। মাটিতে যতদূর চোখ যায় শুধু মেঠো রঙ, এই পাথরগুলিতে জলের স্রোতের বেগে কোথাও কোথাও গর্ত তৈরি হয়ে গেছে আর সেই গর্তে ঘোলাজল জমে রয়েছে। আমি রোমাঞ্চ খোঁজার লোভেই চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। ভাবলাম, এই ধুসর পাথরগুলো যদি একসঙ্গে ফেটে যায়? গোটা সমুদ্রের জল যদি এই পাথরগুলো শুষে নেয়? আমরা কোনো দিন পাথরের তৃষ্ণার কথা ভাবিনি। আমরা কোনো দিন বালিদের পিপাসার কথাও ভাবিনি। কখনও জলের পিপাসার কথাও চিন্তা করিনি। আমরা সমুদ্রের তৃষ্ণার কথাও ভাবিনি। সমুদ্র হাত দুটো ছড়িয়ে নদীদের নিজের কাছে ডাকে। আমাদের সীমারেখা দেখিয়ে বলে দেয় এটা ভারতের সীমারেখা, অন্য জায়গায় যেসব দাগ দেয়া ওটা ভারতের নয়, অন্য কোনো দেশের সীমারেখা। এটা এই দেশের, ওটা ওই দেশের মানচিত্র। ওই দেশের সীমারেখা। সীমারেখার কাছে কিন্তু ভয় আছে। কিন্তু আমি কি করে বলি যে আমার মনটা সীমারেখাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আমি কিন্তু মান্য করা বা বাঁধন অখবা নিয়ম ভাঙায় বিশ্বাসী। আমি তাই পণ করেছি যে সীমারেখাকে ছোঁবই, ছোঁবই। সীমারেখার কাছে যদি না-ই বা যেতে পারি, তাহলে এই সীমারেখা কেন? জানি না কেন যে-বস্তুটি ধরা-ছোঁওয়া বারণ, আমার কিন্তু সেই বস্তুটিকে আরও বেশি করে ছুঁতে ইচ্ছে করে। মানুষের লালসার দ্বার কোথায় গিয়ে খোলে আর কোথায় গিয়ে বন্ধ হয়, আমি আজও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
তাই আমি সেই সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে নিজের দেহটাকে হাল্কা করে ভাসিয়ে দিলাম। তরঙ্গগুলি নিজের আক্রমণাত্মক রুপেই ছিল। ওরা আমাকে চারদিক থেকে জাপটে ধরল, আর নিজেদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে চলল অতল গভীরে, যেখানে সমুদ্রের সব জীব-জন্তু আমার দেহে নিজেদের নাম, গন্ধ ও আঁচড়ের দাগ ফেলার জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে এগিয়ে আসছে। বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাঁটাতারগুলি দিয়ে নিজেই নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করছিলাম। তারপর এখন আমি নিজের রক্ত নিজের জিভ দিয়ে নিজেই লেহন করতে করতে আসন্ন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। আমিও কিন্তু সেই জন্তুগুলিকে রেহাই দিলাম না, নিজের শরীরের সম্পূর্ণ জোর দিয়ে ওদের দেয়া আঁচড় হতে রক্ত ঝরাতে লাগলাম। আমি আমার শরীরের সব অঙ্গ দিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো জানিনা কত বছর ধরে অকেজো হয়ে আছে।
আমি লামার্ক ও ডার্ভিনের বিকাশের কথাও ভাবিনি, আমি কিন্তু এক্কেবারেই ওই রকম কিছু হতে দেব না। আমার শরীরের লোমগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল – এই সীমানা থেকে ওই সীমানায়।
সমুদ্রের সমস্ত জল এখন লাল। আমার ভাবনাচিন্তার কণাগুলি গভীর জলে মিলেমিশে যেতে লাগল, নিঃশব্দে আমি নিজের বুকে একটি গান লিখলাম। তারপর সবাইকে আহ্বান জানালাম। যারা আমায় ক্ষত-বিক্ষত করছিল, আর সেই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাওয়ার চরম আনন্দকে উপভোগ করছিল অতি আনন্দে – এসো, আমার সঙ্গে গাও সেই হিংসাত্মক গান, যে-গানটি গাওয়ার পর যে কোনো মানুষ যে কোনো কিছু করার জন্যে প্রস্তুত হতে পারে। এসো, এসো, দেখ আমার ভেতরের হিংস্র জানোয়ারটা চীৎকার করে কাঁদছে, ওকে সান্ত্বনা দিও না, ও এই ভাষাও বোঝে না। ওকে চাবুক দিয়ে কষে মারো, ওকে আরও হিংস্র করে দাও। যতক্ষণ ওর ভেতরে সামান্য রক্তের কণা বাকি থাকবে ও চুপ করে থাকবে না। কিন্তু ওকে মরতেও দিও না। ওরই ক্ষতস্থানে পা রেখে মানুষ আজ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এসব ছাড়া তো কোনো মানবের কল্পনাও করা যায় না। আমি ওটাকে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে লালন করেছি। সর্বক্ষণ ওকে আশ্রয় দিয়েছি এবং ওর কাছে আশ্রয়ও চেয়েছি। আজ আমি ওকে বেশ ভালো করে দেখতে চাই। ওর ধারালো নখে রক্ত আর ঠোঁটে মাংসের টুকরো। ও নিজের লম্বা জিভ দিয়ে নিজের গায়ে মাখানো রক্ত চাটছে। রক্তের গন্ধটা ওর বেশ ভাল লাগে। কখনো কখনো কোনো এক বিশেষ গন্ধের খোঁজ ওকে বহুকাল ধরে তাড়া করে বেড়ায়। যদি ওর খোঁজাটা কখনও পূর্ণ হয়, তাহলে সে ফুসলে-ফাসলে ওকে এমন আদিম যুগের রীতিতে কাটাছেঁড়া করবে যে, নিজের গন্ধ বাতাসে ছড়ানোর জন্যে ওর ভেতরে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। যদি চোখ না ফেরাই তাহলে সে জোর করে বেশ ভয়ঙ্করভাবে নিজের কাছে টানবে, ওর চোখ দুটো যেন যাদুকরের চোখ। জ্বলজ্বল করছে। যদি একবার ওর ফাঁদে পড়লে আর রক্ষা নেই। মোহজাল আমাদের ঘিরে ধরবে। আমি সেটাও দেখেছি। কিছু দিনের ক্লান্তির সুখ আর সন্তুষ্টি। আবার কোনো নতুন গন্ধের খোঁজ।
আমার গান এখন শেষের পর্যায়ে। আমি এখন সমুদ্রের অতল গভীরে, ওরা আমায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, কিন্তু আমার নিঃশ্বাস নয় আস্ফালন চাই। আমাকে আমার জখমগুলি নিজের দেহ থেকে আলাদা মনে হচ্ছে। সমুদ্রের তীব্র তরঙ্গে ওরা এদিক-ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি ওদের ধরার চেষ্টায় মত্ত, কিন্তু ওরা আমার হাত থেকে ফসকে দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি দেখছি ওরা সমুদ্রতটের বালিতে ছড়িয়ে আছে। ছোট-বড় জখমগুলো পুরানো শামুক ও শঙ্খের মতো সাগরের কিনারার বালিতে তীব্র রোদে ঝলসাচ্ছে। সন্ধে হয়ে এলে রোদ পড়ে যাবে আর এরাও কালো হয়ে যাবে। হঠাৎ আবার কোনো বিকেলে আমি সাগরের কিনারায় একলা বসে ওদের ছাল ছাড়াব নিজের নখের আঁচড়ে, আর ওদের উপর জমা দুঃখগুলোকে পরিস্কার করব।
জলের স্রোতগুলি আমাকে বেশ জোরে জোরে পাথরে আঁছড়ে মারছিল। আমার হাতে যে-ই কোনো শামুক আসতো, আমি জোর করে ওর মুখ খুলে দিতাম! আমি সেই নিঃসঙ্গ শামুকের খোঁজে ছিলাম যার ভেতর সত্যিকারের মোতি আছে। আমার শরীরকে জানিনা কত রকমের সমুদ্রের জীবেরা ঠোক্কর দিচ্ছিল আর আমাকে চেটে খাচ্ছিল। “আমি কিন্তু তোমাদেরই মতো একজন”, আমি ওদের বললাম। কিন্তু ওরা ভ্রূক্ষেপও করল না। পাথরগুলো আহত হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগল। পাথরের বালি আমার ধাক্কায় ধাক্কায় ছড়িয়ে পড়ছিল। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। বহু বছর ধরে নিজেকে ওরা সংযত করে রেখেছিল, আজ সমস্ত সংযমের বাঁধ ভেঙে চূরমার করে এমন একটি আকৃতি তৈরি হলো যা সেই পাথরের বালিকে চালুনি দিয়ে চেলে চেলে আমার দেহের মার খেয়ে খেয়ে তৈরি। এখন আমার দেহ বলতে আর কিছু নেই, না রূপ, না রং, না স্বাদ, না গন্ধ, শুধু ইচ্ছার, লালসার একটি মাত্র শুকনো কাঠি।
জল আমার দেহের সঙ্গে খেলা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল, তরঙ্গেরা আমাকে ছেড়ে দিল। বলল, “তুমি একা নও”, তারপর ওরা অন্য কারও সন্ধানে এগিয়ে গেল। কোনো ব্যাপারই না, শুধু আমিই তোমাকে খুঁজছিলাম তাই নয়, তুমিও তো আমাকে খুঁজছিলে, তাই না? এখন আমাদের দুজনেরই অন্য আর একজনকে খুঁজতে হচ্ছে। এখন আমরা বুঝতে পারছি, নিজেদের জখমগুলো যদি নিজেরাই জিভ দিয়ে চাটি, তাহলে এর ভেতরের মারাত্মক ব্যাপারটা যে কী, বোঝা যাবে! মজাটা পাওয়া যাবে তখনই যখন অন্য কেউ আমাদের জখমগুলোকে চাটবে আর আমরা আমাদের পা দুটোকে আরামে ছড়িয়ে দিয়ে সারা দুপুর আলতো তাপে রোদ পোহাবো। এবার শুয়ে শুয়ে দেখব নিজের ভেতরের বিষের প্রভাব কতটা!
আমি জল থেকে নিজের মাথা তুললাম আর চাঁদের কিরণগুলোকে গিলতে লাগলাম। ডাকলাম, এসো, এসো, আমার ভেতরে একাকার হয়ে যাও। আমি সৃষ্টির একক রূপ, একাকীত্বের রহস্যের সন্ধান আমি পেয়ে গেছি। বুঝে গেছি। আমি যা, তুমিও তাই। যা তুমি, তা-ই আমিও হতে পারি। আমাকে রূপ দাও, রহস্য দাও, গন্ধ দাও। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নামো। আমি দেখলাম, আমার ভেতরে শুধু চাঁদের কিরণই নয় তারারাও ঝরে পড়ছে। আকাশ থেকে টুকরো টুকরো হয়ে। তারপর দেখলাম আমার গোটা দেহটা তারায় তারায় খচিত হয়ে উঠলো। একটা সুন্দর ঝলমল করা দেহ, আমি আহ্লাদে নেচে উঠলাম।
“দেখো, আমাকে দেখো”, আমি দশ-দিশাকে ইঙ্গিত করে বললাম, আছ কেউ আমার মতো? শুধু আমিই হতে পেরেছি, শুধু আমাকেই হতে হবে। আমাকেই ভেঙে টুকরো টুকরো হতে হবে, আবার আমাকেই আমার টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে তৈরি হতে হবে। সৃষ্টির শেষেও সৃষ্টির অভ্যুদয় হবে, আমাকে ঘিরেই। বার বার, বার বার।
আমি আমার মানচিত্রের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি আমার সীমারেখাকে দূর থেকে দেখলাম, দেখলাম কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। চারিদিক অন্ধকার, কিছু তারা মিটমিট করে জ্বলছে আর নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। এমন আলোর জন্যেই আমরা লক্ষ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। যখন তারাদের টুকরোগুলো ঝরে পড়বে, আমরা সবাই ক্ষুধার্ত শৃগালের মতো ঝাপিয়ে পড়ে খামচে খামচে মাংসের টুকরোগুলোকে বাতাসে ছড়িয়ে দেব। তারপর অন্ধকারে মিশে যাব।
আমি বেরিয়ে এসে সেই পাথরটাকে দেখলাম, যে পাথরটি আমার দেহ তৈরি করেছিল। তারপর আমি নিজের দেহকে দেখলাম। আমার দেহটা নক্ষত্র-খচিত। ঝলমল করছে। আমি একটা তারা তুলে নিলাম আর সেটা আকৃতির মাথায় সেঁটে দিলাম।
“এখন তুমি সত্যি খুব সুন্দর হয়ে উঠেছ, আমারই প্রতিরূপ তুমি।” আমি ওকে আলতো করে একটা চুমু খেলাম।