তীরন্দাজ Blog কবিতা আবুল হাসান | অগ্রন্থিত তিনটি কবিতা
কবিতা বিশেষ সংখ্যা

আবুল হাসান | অগ্রন্থিত তিনটি কবিতা

দুঃখের ভাঙন

সমস্ত কিছুই ভাঙছে নদীতীর নির্জন কোমল কাঁচ, হীরের শরীর
ভেঙে যাচ্ছে মাটির কলস, গাছ ভাঙছে
গাছের শরীরে কারো কুঠারের শব্দ শুনে আঁতকে উঠছে কান
এইভাবে বহু কিছু, ভেঙে যাচ্ছে, সংসারের সবুজ গেলাস,
চিনেমাটি, বাসন কোসন, সময়ের হাতঘড়ি, তাও ভাঙছে,
কতকিছু, ভেঙে যাচ্ছে, কোমল সবুজ অই আমলকী গাছের ডাল,
ভেঙে যাচ্ছে পুকুরের পাড় থেকে খুচরো কাজল মাটি অসতর্কতায়
আর এক আঘাত লেগে ভেঙে যাচ্ছে তোমার সোনালি হাসি
হয়তোবা আঁচলের আসন্ন গোলাপ!

সমস্ত কিছুই ভাঙছে, ঝরাপাতা, কাঁচের গেলাস, তোমার কাচের চুড়ি –
সমস্ত ভাঙার শব্দ কেউ না কেউ শুনে ফেলেছে,
কখনও এমনও হয়, তুমি খুব গোপনে গোপনে ভাঙ্ছো
তোমার অর্জিত সুখ, সোনারূপো সঞ্চিত শরীর!

সমস্ত কিছুই ভাঙছে, সমস্ত ভাঙার দুঃখে আর তাই
একটু, একটু, ভাঙছে কপাল!

নিঃসঙ্গ ভাষণ

আকাশে মেঘের মতো অলস ভাসছো তুমি অন্ধকারে
আর তোমার বন্ধুরা যায় তোমাকে পিছনে ফেলে নতুন মেলায়;
তাদের হাঁটার শব্দ বাতাসে ওড়ায় রূপা আধুলি ও সিকির সৌরভ
মেলায় চলেছে তারা, ভালুক নাচবে সখী নট নটী আসবে সেখানে
ঘুঙুর পড়বে ঝরে শেষরাতে যেন শিউলিফুল

বন্ধুরা মেলায় যায়, ঘুঙুরের শব্দে ঘুমায়, কেউ কেউ জেগে থাকে,
একজন তীব্র নটী বাঁশির মতোন সরু গলা থেকে
গান খুলে বাতাসে ভাসায়;

গান, নীলিমার মতো নীল রুমালের মতো মিহি ব্যথা দিয়ে বোনা
গান, বনভূমি থেকে আসা প্রথম ফাল্গুন হাওয়া, বসন্ত বাতাস,
গান, নদীর মতো, জলে থৈ থৈ শব্দ দিয়ে ভরা;
গান, অসুখে জ্বরের ঘোরে মাথার উপরে কারো হাতের পরশ,
গান, নার্সের ধবল হাসি, বোনের শিয়রে এসে মৃদ্ কথা বলা,
শিরাতন্ত্রী ছুঁয়ে দিয়ে মহাকাল মতো মৃদু, একাকী দাঁড়ানো।
কে তুমি গানের জন্য বাঁশিকে ব্যথার মতো তুলে ধরো ঠোঁটে
কে তুমি মেলায় এসে ম্লান হও? মনে পড়ে আমাকে তোমার?
মনে পড়ে আমিও ছিলাম, উঠানে রোদের ছায়া তার পাশে গোধূলি বেলায়
কে তুমি মেলায় যাও, বন্ধু তোমার কাছে আমার ভাষণ,
আমি কি মেলার সঙ্গী কোনোদিন কখনো হবো না?
গানের প্রাণের সঙ্গী কোনোদিন কখনো হবো না?

ক্ষণিক

দুঃখগুলি উল্টে দিয়ে দীর্ঘ একটি পুষ্প কর না,
প্রহর যায়, প্রহর যাক, এখন তুই হসনে ঝরণা।
রক্তগুলি রাঙিয়ে দিয়ে রঙিন একটি আয়না কর, না,
প্রহর যায়, প্রহর যাক, এখন তুই হসনে ঝরনা।

উৎস : রংধনু, ঢাকা, ১৯৭৩

Exit mobile version