তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য ছোটগল্প স্বপন বিশ্বাস | সং | ছোটগল্প
কথাসাহিত্য ছোটগল্প

স্বপন বিশ্বাস | সং | ছোটগল্প

মিশিগানের গ্র্যান্ড রাপিডসে তখন মধ্যরাত। স্ট্রিট লাইটের চুইয়ে পড়া আলোগুলো ঠান্ডায় তিরতির করে কাঁপছে। কারখানাগুলোর ভেতরে তখন উজ্জ্বল আলোর নিচে ঘড়ঘড় শব্দ করে ঘুরছে কনভেয়ার বেল্ট। তার কোনটা চিপস, কোনটা সিরিয়াল কিংবা সিরিয়াল বার বয়ে নিয়ে আসছে। বেল্টের পাশে দাঁড়ানো সারিবদ্ধ শ্রমিকের দল সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হাত চালাচ্ছে।

চেরিওস সিরিয়ালের ব্যাগ সাজাতে সাজাতে ক্যারোলিনার মনে পড়ে গুয়াতেমালায় তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ডুলস নামে এক নদীর কথা। সিরিয়ালের প্যাকেটের মতো যেখানে নানা রঙের ফুল ভেসে আসে স্বচ্ছ জলে। রঙিন পাথর গড়িয়ে চলে জলের তলে। সেই জলের স্মৃতির মাঝে ভেসে ওঠে বৃদ্ধা দাদীর তোবড়ানো মুখের হাসি। যে দাদী একদিন সর্বস্ব বিক্রি করে দালালের হাতে তুলে দিয়েছিল তাকে আমেরিকায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। সে এখন গুয়াতেমালায় বসে অপেক্ষা করে ক্যারোলিনার পাঠানো ডলারের জন্য। গৃহযুদ্ধে নিহত বাবা-মা’র স্মৃতিটা খুব আবছা। যেন ভারি কোন পাথরের নিচে চাপা পড়া বর্ণহীন ঘাস। ক্যারোলিনার পাশে দাঁড়ানো হন্ডুরাসের ছেলে কেভিন টমাস। তার মাথার ভেতরে তখন হন্ডুরাস থেকে আমেরিকা আসার স্মৃতি। বাবা-মা’র সাথে পায়ে হেঁটে যোগ দিয়েছিল আমেরিকামুখি মানুষের কাফেলায়। কারখানার কনভেয়ার বেল্টের মতো রাস্তা বেয়ে তারা শতশত মানুষ জড়ো হয় মেক্সিকোর সীমান্ত শহর সিউদাদ হিডালগোতে। স্থানীয় মানুষেরা সেখানে নেচেগেয়ে তাদের স্বাগত জানায়। জল, খাবার, কাপড়-চোপড় দিয়ে তাদের সহায়তা করে। তারপর আমেরিকা ঢোকার মুখে তারা বর্ডার পেট্রোলের বাধার মুখে পড়ে। মানুষের কাফেলা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কেভিন বাবা-মা’কে হারিয়ে ফেলে। তার সাথে সাত বছরের ছোট ভাই। কেভিনের বয়স তখন তেরো। পরে এক দালাল তাদেরকে বর্ডার পার করে দিলে তারা আশ্রয় পায় হেল্থ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসের আশ্রয় কেন্দ্রে। সেখানে তখন মানুষের এত ভীড় যে তাদের থাকতে হয় তাঁবুর ভেতরে। দালালরা স্পন্সর জোগাড় করে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মুক্ত করে। স্পন্সর হওয়া এক ধরনের ব্যবসা। কাগজপত্রে নিকটজন বলে প্রমাণ দেখায়। যে তাদেরকে খাওয়া-পরা বসবাসের ব্যবস্থা করবে। স্কুলে পড়াবে। যদিও সেসবের কোন কিছুই করে না। এখন কাজ করে কেভিনকে দালাল আর স্পন্সরের ঋণ শোধ করতে হয়। নিজেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়। স্পন্সরের সাথে ভিডিও কলে কথা হয়। ঋণ শোধের তাগাদা দেয়। বাবা-মা’র সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি।

বাংলাদেশের ছেলে হানিফ কনভেয়ার বেল্টের ওপরে আসা সবুজ আর বেগুনি রঙের চিপসের প্যাকেট দেখতে দেখতে ভাবে গড়াই নদীতে যেন বানের জল ঢুকেছে। থোকা থোকা সবুজ কচুরিপানা ভেসে আসছে। কচুরিপানার বেগুনি রঙের ফুলের ওপরে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। কনভেয়ার বেল্টের দিকে তাকালেই হানিফের মাথার ভেতরে এই স্মৃতিটা ঘুরতে থাকে। হানিফের বাবা সর্বহারা পার্টি করত। দলীয় কোন্দলে একদিন খুন হয়ে যায়। হানিফের মা ছিল খুব সুন্দরী। আমেরিকা প্রবাসী একজন তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে নিউ ইয়র্কে। নতুন বাবা হানিফকে সহ্য করতে পারত না। সেই দ্বন্দ্ব থেকে হানিফের মা অন্য একজনকে বিয়ে করে ফ্লোরিডা চলে যায়। সেখানেও হানিফের কোন গতি হয় না। সে কিছুদিন পাম বীচের একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে। সেখান থেকে হাওয়াই দ্বীপে এসে কাজ নেয় একটি অবকাশকালীন বাড়ির চারপাশে লাভা পাথরের দেয়াল তৈরির। তারপর সেই বাড়ির মালিকের সাথে চলে আসে মিশিগান। সেখানে প্রথমে কাজ নেয় গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির এক কারখানায়। কাজগুলো ছিল তার বয়সের তুলনায় অনেক কষ্টসাধ্য। তাই অন্য এক এজেন্সির মাধ্যমে তুলনামূলক ভাবে এই সহজ কাজটা পেয়ে যায়। এখানেও সব সময় পুলি গিয়ারে হাত আঁটকে যাওয়ার ভয়ে থাকতে হয়। ভারী ভারী বাক্স বহন করতে হয়। তার সমবয়সী অনেক ছেলে মেয়ে এখানে কাজ করে। ক্যারোলিনা কিংবা কেভিনের মতো নেরি কাটজাল, হোসে ভাসকুয়েজ, প্যাকো ক্যালভো সবাই এখন হানিফের বন্ধু। ওরা হানিফকে ডাকে হানি বলে। হানিফকে ওরা আরও একটা নাম দিয়েছে, গুডি বয়। কারণ হানিফ ওদের তুলনায় স্বভাবে শান্ত। জীবনযাপনে হিসেবী। নরম স্বরে কথা বলে। একটু ভাবুক প্রকৃতির।

শুরুতে হানিফকে কেউ ততটা পাত্তা দিত না। ঠান্ডা মাথার ছেলে হিসেবে এখন সবাই তার কাছ থেকে বুদ্ধি পরামর্শ নেয়। ওদের বেশির ভাগই মধ্য আমেরিকা কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার কোন দেশ থেকে অবৈধভাবে আসা। তবে তারা যে আমেরিকায় আছে সেটা সরকারের অজানা নয়। সরকার বর্ডারে আটকা পড়া অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদেরকে শেল্টার থেকে বাবা-মা কিংবা নিকটজনদের কাছে ছেড়ে দেয়। যাতে তারা একটা ভালো জীবন পেতে পারে। যেমন হানিফের আরেক বন্ধু লোপেজ থাকে তার দূরসম্পর্কের এক চাচার বাসায়। তার মা গুয়াতেমালা থেকে আমেরিকা সীমান্তে ঢুকতে পারেনি। হয়তো কোন একদিন ঢুকতে পারবে। তখন লোপেজ আবার তার মাকে ফিরে পাবে। এখন লোপেজ চাচার বাসায় বেসমেন্টে ফ্লোরম্যাটে ঘুমায়। সেখানে বেশির ভাগ সময় হিট থাকে না। অসুস্থ হয়ে এর আগের দুটো কাজ ছাড়তে হয়েছে। হানিফের পরামর্শে লোপেজ একদিন শেল্টার থেকে দেয়া হট লাইনে ফোন দিয়েছিল। কেউ কোনদিন খোঁজ নিতে আসেনি। তবে লোপেজ আশা ছাড়েনি। সে ঠিক করেছে আবার একদিন ফোন দেবে। তারপর চাচার ঋণ শোধ হলে বন্ধুদের সাথে মেসে উঠে যাবে।

মাঝরাত গড়িয়ে গেলে ওদের ছুটি হয়। পেছনের ফ্লোর থেকে সরু একটা রাস্তা পার হয়ে ছোট একটা গেট। এই গেট পার হলে কারখানার অফিস এলাকা। সেখানে সব বড় সাহেবদের কাঁচের ঘর। সরু রাস্তাটা পার হওয়ার সময় সবাই লাইন দিয়ে হাঁটতে থাকে। একজন আরেকজনের কাঁধে হাত দিয়ে যেন কু-ঝিকঝিক রেলগাড়ি। ছোট গেটটার দুপাশে দুজন দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। ওদের মাঝ দিয়ে হাঁটার সময় হানিফ মনে মনে ছড়া কাটে :

ওপেনটি বাইস্কোপ
নাইন টেন টেইস্কোপ
চুলটানা বিবিয়ানা
সায়েব বাবুর বৈঠকখানা
কাল বলেছেন যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচ বাঁটা
ইস্প্রিংএর চাবি আঁটা
যার নাম রেনুবালা
গলায় দিলাম মুক্তার মালা।

আজ সেই ছোট গেটটা পার হওয়ার পর দারোয়ান দুটো সেই খেলার মতো রেনুবালা বেছে বেছে মুক্তার মালা পরানো শুরু করল। মানে লাইন থেকে বেছে বেছে আলাদা করা শুরু করল। তারা হাতের লিস্ট মিলিয়ে যাদের বয়স আঠারো বছরের নিচে তাদের একটা অফিস ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে সবার হাতে একটা করে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলা হল কাল থেকে আর তোমাদের কাজ নেই। নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের কোম্পানির নাম উল্লেখ করে শিশুশ্রম বিষয়ে একটা রিপোর্ট ছাপিয়েছে। এখন সরকারি সংস্থাগুলো তদন্তের নামে অনেক ঝামেলা শুরু করবে তাই তাদেরকে কাজ থেকে বাদ দিতে হচ্ছে।

কাজ হারানোর খবর শুনে একেক জন একেক রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করল। কেউ বেশ খুশি, কালকে আর কাজে আসতে হবে না। ক্যারোলিনা আর হানিফের মতো কারো কারো বেশ মন খারাপ, আবার একটা কাজ খুঁজে বের করতে হবে। কেউ কেউ খুব উত্তেজিত। কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে কিছু অশ্লিল শব্দগুচ্ছ ছুঁড়ে দিল, যা তারা সব সময়ই করে থাকে। কর্মকর্তাদের টেবিলে একটা নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা পড়েছিল। কেভিন ছুটে গিয়ে টেবিল থেকে পত্রিকাটা তুলে নিল। তারপর লম্বা করে পেঁচিয়ে অশ্লিল একটা অঙ্গভঙ্গি করে গালি দিল, ফাক ইউ। টেবিলের ওপর দুটো পেপার ওয়েট আর একটা ছুরি ছিল। একজন কর্মকর্তা তাড়াতাড়ি সেগুলোকে একটা ড্রয়ারের ভেতর ফেলে দিল। সিকিউরিটির লোকগুলো তেড়ে আসল কেভিনের দিকে। তারপর কর্তাদের নির্দেশে সবাইকে কারখানা থেকে বের করে দেয়া হল।

কারখানার পার্কিংলটের পাশ দিয়ে লম্বা রাস্তা পার হয়ে কারখানার মূল ফটক। তারপর বড় রাস্তা। ছুটি হওয়া লোকজন সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে গেছে। কেউ কেউ রাস্তার ওপারে কয়েকটা বারে ভীড় জমিয়েছে। নেরি আর লোপেজ বলল চল লিকার স্টোর থেকে এক কেস লিকার নিয়ে পার্কে গিয়ে বসি। আজ কাজ হারানোর রাতটা সবাই মিলে এনজয় করি। কেভিন খুব উত্তেজিত। সে বলল, চল তার আগে আরেকটা কাজ করে নেই। তারপর রাস্তা পার হওয়া বাদ দিয়ে আবার কারখানার গেটের দিকে এগিয়ে গেল। কেভিন তার হাতের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাটা ক্যারোলিনার হাতে দিয়ে প্যান্টের চেইন খুলে কারখানার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। তার দেখাদেখি বাকি ছেলেরাও প্যান্টের চেইন খুলে প্রস্রাব করা শুরু করল। হানিফ দৃশ্যটা দেখে খুব মজা পেল। কাজ হারানোর দুঃখটা যেন ক্ষণিকের জন্য উবে গেল। মনে পড়ল বহুদিন আগে বাংলাদেশে স্কুল থেকে ফেরার পথে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে ঠিক এইভাবে পাল্লা দিত, কে কত দূরে দিতে পারে। তবে আজ সে ওদের লাইনে দাঁড়াল না। দলে দুজন মেয়ে আছে তাদের সামনে সে একাজ কিছুতেই করতে পারবে না। ক্যারোলিনা চিৎকার দিল, ‘হেই হানি, তুই দাঁড়িয়ে থাকলি কেন। তোর চেইনটাও খোল।’ হানিফ খুব লজ্জা পেয়ে নো নো করে একটু দুরে সরে গেল। ক্যারোলিনার বান্ধবী অ্যাঞ্জেলিনা বলল, ওকে দিয়ে হবে না। ওর লজ্জা ছাড়া আর কিছু নেই।

তুই জানলি কীভাবে? ক্যারোলিনা তার বান্ধবীকে কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই ছুটে যাচ্ছিল হানিফের দিকে। যেন জোর করেই তার চেইন খুলে দেবে। কিন্তু তখন কারখানা গেটের সিকিউরিটিরা বাঁশি বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে তাদের দিকে। ক্যারোলিনা তার হাতের লম্বা করে মুড়ানো নিউইয়র্ক টাইমসটা নিয়ে একটা অশ্লিল ভঙ্গিসহ চিৎকার করে গালি দিল, সাক মাই ডিক। যারা প্রস্রাব করছিল তারা ক্যারোলিনার গালি শুনে হো হো করে হেসে উঠল। তারপর সমস্বরে চিৎকার করে একই গালির পুনরাবৃত্তি করল। সিকিউরিটিগুলো আর এগোল না। ঝামেলা না বাড়িয়ে ফিরে গেল।

কেভিন বলল, চল এবার লিকার স্টোরে যাওয়া যাক।

সবাই মিলে হই হই করে রাস্তা পার হয়। তারপর লিকার স্টোরে ঢুকে দেখে স্টোর একেবার জমজমাট। আজ পে ডে ছিল তাই ছুটির পরে অনেকেই এসে বারে আর লিকার স্টোরে ভীড় জমিয়েছে। সমস্যা দেখা দিল ওরা যার কাছ থেকে লিকার কেনে সেই মার্কো আজ নেই। মার্কো গুয়াতেমালার মানুষ। অনেক বছর আগে আমেরিকা এসেছে। জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। এই স্টোরে অনেকদিন যাবত কাজ করছে। মালিক মারা যাওয়ার পর ওরা কয়েকজন মিলে স্টোরটা কিনে নিয়েছে। কেভিনদের বয়স কম হলেও মার্কো গোপনে একটু খাতির করে। আজ তাই বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

বিকল্পটা যে কী তা ওরা সবাই জানে। কেভিন ইশারা করে অ্যাঞ্জেলিনা আর ক্যারোলিনাকে বলল, তোরা রেডি থাকিস। আমরা ওদিকটা সামলাচ্ছি। কেভিন, নেরি আর লোপেজ এগিয়ে গেল সামনে রেজিস্টারের দিকে। রেজিস্টারে দাঁড়ানো লোকটা আইডি দেখাতে বলল। ওরা প্রথমে মার্কোর নাম করে একটু সুবিধা নিতে চেষ্টা করল। তাতে কাজ না হওয়ায় বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ল। রেজিস্টারের লোকটা বলছে, ইন্সপেক্টররা ছদ্মবেশে ওঁত পেতে বসে থাকে। আন্ডার এজ ছেলেমেয়েদের কাছে লিকার বিক্রি করে আইনি ঝামেলায় পড়তে চাই না। বলছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশ কল করবে। ওরাও চিৎকার করছে, ‘কল ইওর পুলিশ, কল ইওর পুলিশ।’ কারণ ওরা জানে লোকটা পুলিশ কল করবে না। সে ওদেরকে মার্কোর বিশেষ পরিচিত বলে জানে। তাছাড়া পুলিশ এলেও আন্ডার এজ এসব ছেলেমেয়েদের অ্যারেস্ট করে না। এদের অ্যারেস্ট করলে পুলিশকে অযথা বাড়তি কাজের ঝামেলায় পড়তে হয়। পুলিশের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তাই পুলিশ আসলে বড় জোর ওদের নাম ঠিকানা লিখে রেখে স্টোর থেকে বের করে দেবে। তাতে যে লোকটা পুলিশ কল করে তাকেই পরবর্তীতে রাস্তাঘাটে ঝামেলায় পড়তে হয়।

ওদের বাকবিতণ্ডা যখন চরমে তখন অ্যাঞ্জেলিনা আর ক্যারোলিনা এক কেস ট্যাকিলা নিয়ে স্টোর থেকে বেরিয়ে গেল। হানিফ হাত ধরে টান দিয়ে কেভিন আর নেরিকে বলল, চল যাই। আর ঝামেলা করার দরকার নেই। তারপর চোখ টিপে ইশারা করল, আমাদের কাজ শেষ।

ওরা দুই ব্লক দূরে একটা পার্কে গিয়ে ঢুকল। পার্কে তখন নিশুতি রাত। একটা ছাউনির নীচে কয়েকজন হোমলেস নারী-পুরুষ জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। ওরা একটা হরিণের মূর্তির সামনে গিয়ে বসল। সেখানে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। হানিফ সেই আলোয় নিউইয়র্ক টাইমেসের প্রতিবেদনটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলল, এটা একটা গবেষণা প্রতিবেদন। বিশটা রাজ্যের একশ’ জনের বেশি কম-বয়সী শ্রমিকের সাথে কথা বলে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কেভিন সব সময়ই উত্তেজিত। প্রতিবেদকের নামে একগুচ্ছ অশ্লীল বিশেষণ যোগ করে বলল, তাতে কার কী লাভ হল? মাঝখান থেকে আমরা কাজ হারালাম। হানিফ বলল, আমরা কয়েকজন কাজ হারালেও সত্যটা তো সামনে উঠে এসেছে। আমেরিকার মতো দেশে এটা একটা জটিল সমস্যা। কেউ না কেউ এটাকে সামনে তুলে না ধরলে সমাধান হবে কীভাবে? কেভিন হানিফের কথা শুনে এবার ক্ষোভে ফেটে পড়ল। সারা জীবনে যত ইংরেজি গালি শিখেছিল সবগুলো উগরে দিল। তার নিজের ভাগ্য আর জন্ম থেকে শুরু করে ঈশ্বর পর্যন্ত কেউ সে গালি থেকে রেহাই পেল না। কেভিনের গালির জোসে সবাই বোতল খুলে হই হুল্লোড় করে গলায় ঢালা শুরু করল। হানিফ বলল, ‘কাজ তো নেই, এখন তোরা কী করবি?’ রামিরেজ বলল, কাজ নেই মানে? কাজের কি অভাব নাকি? কয়েকদিন আরাম করব। তারপর আগের কাজটাতে ফিরে যাব। রামিরেজ এসেছে মেক্সিকো থেকে তেরো বছর বয়সে। এখন সতেরো। আগে একটা মিট প্রসেসিং প্লান্টে কাজ করত। সেখানে তিনটা আঙুল হারিয়ে কাজ ছেড়েছে। এখন সে মিট প্রসেসিং প্লান্টটা বন্ধ। লোপেজ বলল, আমি এবার স্কুলে ভর্তি হব। ইংরেজি শিখব। হোজে একটু জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ইংরেজি শিখে কী করবি? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবি? লোপেজ উত্তর দেয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই নেরি বলল, কেন ইংরেজি শিখলে ভিক্ষে করে খাওয়া যাবে। বয়সের ঝামেলা থাকবে না। দেখিস না, ট্রেনে যারা ভিক্ষে করে তারা কেমন সুন্দর ইংরেজি বলে। অ্যাঞ্জেলিনার গলায় হয়তো একটু বেশি পড়েছিল। বলল, তোরা কিন্তু সবাই এবার আমাকে ভোট দিবি। আমি প্রেসিডেন্ট হয়ে তোদের সবাইকে চাকরি দিয়ে দেব। বল, তোরা সবাই আমাকে ভোট দিবি তো? হানিফ বলল, যারা ভোটার না তাদের কাছে তুই ভোট চাচ্ছিস! ভোটার হওয়ার বয়স হলে তো কাজের কোন অভাব নেই। ক্যারোলিনা যেন ওদের কথা শুনে খুব মজা পেল। অ্যাঞ্জেলিনার দিকে মিডল ফিঙ্গার তুলে বলল, তোর তো এটাই নেই, তোকে ভোট দেবে কে? আমেরিকানরা ওটা না থাকলে ভোট দেবে না, দেবে না। তারপর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতেই থাকল, দেবে না, দেবে না…। বলতে বলতে হড়হড় করে বমি করে দিল। কেভিন অভিযোগের সুরে বলল, খাওয়ার সময় হুস ছিলনা? এখন বমি করছিস কেন? ক্যারোলিনার ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল। তারপর আবার মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলা শুরু করল, আমিতো প্রেগনেন্ট। বেশি খাওয়া একদম ঠিক হয়নি। আমার পেটে একটা ছেলে হবে। সে আমেরিকায় জন্মাবে। সে হবে আমেরিকার প্রেসিডন্ট। বেশি খা-ও-য়া একদম ঠি-ক হয়-নি। অ্যাঞ্জেলিনা জিজ্ঞেস করল, তোর ছেলের বাবা কে রে? কে করল এই কাজ? ক্যারোলিনা বলল, তুই জানিস না কে করেছে? এরা সবাই করেছে? আমি ডি এন এ টেস্ট করাব। দেখবি সবার সাথে আমার ছেলের ডিএনএ মিলে যাবে। স-বা-র সা-থে।

হানিফ বলল, তোদের সবার জন্য আমার একটা পরামর্শ আছে। চল, সবাই মিলে নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাই। টাইমস স্কোয়ারে স্ট্রিট পারফর্মেন্স করব। কার্টুন ক্যারেক্টার সেজে ট্যুরিস্টদের সাথে ছবি তুলব। কেউ আমাদের বয়স নিয়ে প্রশ্ন করবে না। মানুষকে আনন্দ দিয়ে ডলার আয় করব। কথা শেষ না হতেই ক্যারোলিনা আবার বমি করা শুরু করল। বমি করতে করতে বলল, আমার খুব শীত করছে। আমাকে তোরা একটু জড়িয়ে ধরবি? কেভিন তার একটা জ্যাকেট খুলে ক্যারোলিনাকে পরিয়ে দিল। হানিফ পার্কে খোঁজাখুঁজি করে আগুন জ্বালানোর মতো কিছু না পেয়ে একটা গার্বেজ ক্যান থেকে কিছু কাগজের প্যাকেট নিয়ে এলো। কেভিন বলল, আগুন জ্বালাস না। পুলিশের ঝামেলা হবে। নেরি বলল, হলে হবে। জ্বালিয়ে দে হানি। হানিফ আগুন জ্বালিয়ে দিল। লোপেজ নিউইয়র্ক টাইস পত্রিকাটা আগুনে ফেলে দিয়ে বলল, এটা রেখে দিয়ে কী হবে। পুড়লে তো তবু শরীর গরম হবে। ক্যালভো ছেলেটা কথা কম বলে কিন্তু বেশ বুদ্ধিমান। সে বোতলে পড়ে থাকা অবশিষ্ট ট্যাকিলা আগুনে ঢেলে দিল। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। কিছু সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি, ইমারজেন্সি মেডিকেল সার্ভিস আর ফায়ার ডিপার্টমেন্টের গাড়ি এসে হাজির। পুলিশরা চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে এসে অস্ত্র তাক করে ওদেরকে ঘিরে ধরল। ওরা এতক্ষণ সবাই বেশ মজা দেখছিল। এবার পুলিশ হুঙ্কার দিল, হ্যান্ডস আপ। টার্ন অ্যারাউন্ড। ওরা সবাই হাত উপরে তুলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল ক্যারোলিনা আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের আভায় সোনালি রঙের হরিণের মূর্তিটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ধরতে গেলে এখনি দৌড়ে পালিয়ে যাবে। পরক্ষণেই হানিফের মনে হল, এ যেন আমেরিকার কেন্দ্রবিন্দু – নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার। চারিদিকে আলোর ঝলকানি। মাঝখানে ওরা কয়েকজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ সং সেজে কার্টুন চরিত্রে অভিনয় করে চলেছে।

(গল্পটি নিউইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা)

Exit mobile version