পৃথিবীর সব গল্পই নাকি লেখা হয়ে গেছে, তবু প্রতিদিন এত নতুন নতুন গল্প আসে কোথ থেকে? সেসব গল্প পড়ে পাঠক কখনো বিস্মিত হয়, কখনো নতুন ভাবনার উদ্রেক হয় মনে, কখনো বিষন্ন হয়, কখনো গল্প পড়তে পড়তে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে। গল্প আসলে কি? কেন গল্প পড়ি? নিজের মনের প্রশ্নের জন্য নিজেই উত্তর তৈরি করি। গল্প আসলে যাপিত জীবন। গল্প আসলে চলমান সময়। গল্প আসলে সামাজিক নানা অসঙ্গতি। একই গল্প ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন ভিন্ন বয়ানে, ভিন্ন ভিন্ন নির্মাণে হয়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন দর্পণ। তীরন্দাজ এর গল্প সংখ্যায় ১২টি নতুন গল্প পড়তে গিয়ে গল্পের নানা বাঁকের কথা ভাবছিলাম। ছোট ছোট কিছু শব্দে, কিছু বাক্যে একজন লেখক তার সৃজনশীল মনের কথা, ভাবনার কথা, কল্পনার কথা সাজিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন, সেই কথাগুলোই যখন পাঠকের ভেতরটাকে অদ্ভুত ভাবে নাড়া দেয়, ভালো লাগার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে, ক্ষোভের উদ্রেক করে, ক্রোধে অন্ধ করে, মনটাকে অবস্বাদগ্রস্ত করে, অর্থাৎ গল্পের সাথে পাঠক নিজেকে একাত্ম করতে পারে, এটাই বোধহয় একজন লেখকের সৃজনের সার্থকতা।
এই আয়োজনের ১২টি গল্প পড়তে পড়তে সেই সব অনুভবেই আচ্ছন্ন হলাম আমি। হুসাইন হানিফের “রাক্ষসের মতো সেই কবিকে” গল্পটা পড়তে গিয়ে দালাই লামার ছোট্ট শিশুটিকে আদর করার নামে এবিউজ করার সাথে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উপর যৌন হয়রানির যে চিত্রটা তুলে ধরেছে গল্পের বয়ানে, আমি সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠছিলাম চাচাতো ভাইয়ের মাদ্রাসা ছেড়ে দেওয়ার গল্প জানতে। এই যে আমার পাঠক মনকে উস্কে দিতে পেরেছে এটাই লেখকের গল্প বলার দারুণ কৌশল। কী সাবলীল ঢঙে বলে গেলেন লেখক! “হুজুরকে খুশি করাই হচ্ছে খেদমত।” সেই খেদমতে খুশি হয়ে হুজুরের করা কর্মের বর্ণনায় গা রি রি করে উঠছিল। কী বীভৎস! এই সময়ের গল্প হিসেবে দারুণ একটা গল্প, যদিও গল্পটার শেষটায় কিছুটা তাড়াহুড়ো মনে হলো।
আজাদ মন্ডলের লেখা “কদম ফুলের কান্না” গল্পে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার গৃহ প্রবেশের অংশটুকুর রহস্যময়তা এবং তার পরিচয় জেনে জহির সাহেবের অস্থিরতা, সবজি বিক্রেতা কাশেম আলীর সবজি বিক্রির আড়ালে মাদক ব্যবসা, সব ছাপিয়ে গল্পটায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠে কাশেম আলীর ছোট মেয়েটা। মাদক ব্যবসায়ী কাশেম আলী দেশের জন্য, সমাজের জন্য খলনায়ক হতে পারে, কিন্তু তার স্কুল-পড়ুয়া কন্যাটির কাছেও নিঃসন্দেহে তার বাবা পৃথিবীর সেরা বাবা। জহির সাহেবের মতো আমারও কেন জানি কাশেম আলীর মেয়েটার জন্য মায়া হয়।
“অশ্রুর স্পর্শ পেয়ে মাটির কান ঝাঁ ঝাঁ করে। মাটি ভাবে, এই পৃথিবী নিশ্চিত উলটপালট হবে। মিশে যাবে মিছরির দানার মতো।” বাক্যের গাঁথুনি কেমন কবিতার মতো লাগে। বলছিলাম জাহেদ মোতালেব এর গল্প ‘এই পৃথিবীর মরা ঘাসে তবুও মুক্তির ফুল ফোটে’র কথা। জাল টাকার ব্যবসা করে ধরা পড়া মানিকের রাগের কথা, ক্ষোভের কথা, তার কন্যার চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা নিয়েই এগিয়ে যায় গল্প। জাহেদ মোতালেবের গল্প বরাবরের মতোই কোথাও কিছু মায়া রহিয়া যায় এর মতো মায়াবী বুননের চাদর।
নিঃসঙ্গতার চরাচরে ডুবে থাকা মানুষের ভেতরের ডুকরে ওঠা গোপন বেদনার ছবিই যেন আঁকা হয়েছে সুবন্ত যায়েদের ‘নিঃসঙ্গ করতলে’ গল্পে। সুবন্ত’র গল্পকথন আকর্ষণীয়। জিকো মাস্টরের নিঃসঙ্গতার গল্প, ঢোলকলমি ফুল, সবুজ পাহাড়, তুমুল বর্ষণ সব মিলিয়ে দারুণ এক আবহ রয়েছে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে।
সাদিয়া সুলতানার গল্পের ভেতরের গল্পটা বরাবরই চমকে দেয়। ‘একচোখা নিরঞ্জন’ গল্পেও সাদিয়া সুলতানা সেই মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। ধুমেরকুটি গ্রামের একচোখা নিরঞ্জনের দুই চোখ নিয়ে মৃতবৎ শুয়ে থাকার পাশাপাশি মগা তালুকদারের মৃত্যুরহস্যও পাঠককে নাড়া দেয়।
পাঁচ যুবকের ব্যাচেলর জীবন, মেসে থাকার নিত্যদিনের জীবন যাপন নিয়ে লেখা গল্প ইলিয়াস বাবরের ‘তালতল আবাসিকের স্বপ্ন-বৃত্তান্ত’। রেদু মামাকে নিয়ে বাকি চার তরুণের নানারকম হাস্যরসের আড়ালে হারিয়ে যায় জীবনযুদ্ধের গল্প। লেখকের ভাষায়, “পাঁচজনের ব্যাচেলর বাসায় গাইগুই নেই, কাজিয়া-ফ্যাসাদ নেই। তুই তোকারি কিছু আছে তবে সে অর্থে না; সবাই প্রায় বন্ধুর মতো, অনায়াসে শেয়ার করা যায় সময়ের যত কালিমা।” তালতল আবাসিকের নামকরণটাও বেশ মজার লাগলো।
মুয়িন পারভেজকে কবি হিসেবে চিনতাম। এবার প্রথম গল্পকার মুয়িন পারভেজকে পেলাম। অবশ্য এখানে আরও কয়েকজনকে পেলাম যারা মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত। এবার তারা গল্পের ডালি নিয়ে হাজির। পাঠক হিসেবে এবারই প্রথম তাদের গল্প পাঠের সুযোগ হলো আমার। যেমন খালিদ হামিদী, সাইদুল ইসলাম।
মুয়িন পারভেজের গল্প ‘বেশটমেটো’। নামটাই প্রথমে খটমট লাগছিল। উচ্চারণ ঠিক আছে কি না পরখ করার জন্য বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে হলো। গল্প পড়া শুরু করার পর ছালামতউল্লা যে কিভাবে ‘বেশটমেটো’ হয়ে গেল সেই গল্প জেনে গল্পের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি কাটলো। কবিতার মতো গদ্যেও মুয়িন পারভেজ বেশ স্বতঃস্ফূর্ত বলা যায়। সন্দ্বীপের অধিবাসী বেশটমেটোকে নিয়ে হাস্যরসের নানা গল্পের মাঝেও কেমন করে যেন গল্পের ভেতরের সূক্ষ্ম ব্যথাটা এড়ানো গেলো না। “কোথাও নাই বেশটমেটো – শিমুলতুলার মতো মিলাইয়া গেছে বাতাসে! কেবল একটা হট্টিটি টি-টি করতে করতে উড়ে চলল পিনপিন্যাছড়া পেরিয়ে, মাতবরের বিল পেরিয়ে, হয়তো বা দূরের সেই মাজারখোলার দিকে।”
সাইদুল ইসলামের “সাদা ফ্রক” ছোট্ট একটা গল্প। কিন্তু এই গল্পটা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অনেকক্ষণ। ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড় নিয়ে যে এমন সুন্দর গল্প লেখা যায়, সেটাই ভাবছিলাম কিছুক্ষণ। ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবির বুক পকেটের কালো দাগ দেখে এই পাঞ্জাবির মালিক স্কুল শিক্ষক কি না সেই ভাবনাটুকু কৌতূহল জাগালো। শাড়ি, শার্ট, জিন্সের প্যান্ট সব পেরিয়ে পাঁচ ছয় মাস বয়সী বাচ্চার ফ্রকটার দিকেই দৃষ্টিটা যেন স্থির হয়ে গেলো আমার। বাতাসের ধাক্কায় একটু একটু করে যখন ফ্রকটা ক্লিপ থেকে ছুটে যাচ্ছিল এবং একসময় যখন ক্লিপ থেকে ছুটেই গেলো ধুপ করে নিভে যাওয়া আগুনের মতো যেন কিছু একটা নিভে গেলো। স্তব্ধ হয়ে থাকা ছাড়া যেন আর কিছু করার নেই।
খালেদ হামিদীর গল্প ‘খোকা ও শোশা খালা’। খোকার বয়ানে তার শোশা খালার জীবনে সব পেয়েও কিছুই না পাওয়ার গল্পটা বেদনা বিধুরই ছিল। শোশা খালার জন্য প্রবাসী খোকার মায়া, ভালোবাসা, অনুভবের উপস্থাপন পাঠককে স্পর্শ করবে।
আব্দুল আজিজের ‘কুকুর চুরির রাত’ গল্পের প্রথম লাইনটাই হচ্ছে, চলুন অলৌকিক এক রাতের গল্প শুনে আসি। পুরো গল্প পাঠে লেখকের প্রথম বাক্যের সত্যতা পাওয়া যায়। গভীর রাতে এই গল্পের কথা মনে হলে গা ছমছম করে উঠবে। বিদঘুটে আকৃতির বাঁকানো বাঁশির কথা যেমন আশ্চর্যজনক। ঠিক তেমনি অন্ধ বৃদ্ধার ছাগলের কুকুর হয়ে যাওয়া এবং কুকুর চুরির রাত বলে বড়ই আজীব এক রাত নামে, সেই রাতে কুকুরের পরিবর্তে চুরি হয়ে যায় অন্ধ বৃদ্ধা। বৃদ্ধার বাঁকানো পা, শাদা চোখ খুলে নিয়ে যায় ছিদ্রযুক্ত বাঁশির বাহক। পরাবাস্তব এই গল্পের বয়ান দারুণ।
শুকতারা, শাহেদ আর রেজার সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প শোয়ায়েব মুহামদের ‘রুয়েলিয়া, রুয়েলিয়া’। গল্পে চন্দ্রনাথ পাহাড়, সয়ম্ভুনাথ মন্দির, গাছ-গাছালি, প্রকৃতির রূপ, প্রকৃতির মায়া সব মিলেমিশে কেমন একাকার হয়ে ধরা দেয়, মানবজীবনের দিবা-রাত্রির গল্প। সেই গল্পে যেমন প্রেম থাকে, তেমনি থাকে টানাপোড়েন। ‘রুয়েলিয়া, রুয়েলিয়া’ গল্পে সেই টানাপোড়েনের চিত্রই উঠে এসেছে কোন রূপ আড়াল ছাড়া।
তাইবা তুলবির গল্প ‘জন্ম থেকে মৃত’। নামকরণ সাদামাটা হলেও গল্পটা নিছক সাদামাটা নয়। “একটা বাতাস এলে আমি থমকে দাঁড়াই। আমাকে ঘিরে একটা ঘূর্ণি তৈরি হলে বুঝলাম এমন এক ঘূর্ণিপাকে আমি একদা পড়েছিলাম। স্মৃতি জেগে উঠলো – এমন ঘূর্ণিতেই আমি ঘুরতে ঘুরতে একদা উপরের দিকে উঠেছিলাম, অনেক উপরে। আবার ঘূর্ণি আচমকা বন্ধ হলে, তলিয়ে পড়লাম। হ্যাঁ, মনে পড়ছে – কিন্তু আমি মরিনি, কারণ আমাদের ধর্মই মৃত।” গল্পের এই অংশটা কী দারুণ! মৃতরা আর কি মরবে!
১২ জন লেখকের ভিন্ন মাত্রার গল্পগুলো পড়ে মনে হলো প্রতিদিনই গল্পের বাঁকবদল ঘটছে। নতুন রূপে গল্প ধরা দিচ্ছে লেখকের ভাবনায়। সেই গল্প সমকাল ছোঁবে না মহাকালে ঠাঁই পাবে, সেটা না হয় পাঠকের জন্যই অবশিষ্ট থাকুক। ১২ জন গল্পকারের জন্যই আমার শুভকামনা রইলো। আগামীতে তাদের আরও গল্পপাঠের প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখলাম মনে।
মোহছেনা ঝর্ণা
জন্ম ১৯৮২ সালের ৩১ ডিসেম্বর লক্ষীপুর জেলার ছবিলপুর গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নৈঃশব্দ্যের ভেতর’। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘ইলিনের বাবার চশমা’।