তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য ছোটগল্প জাহেদ মোতালেব | এই পৃথিবীর মরা ঘাসে তবুও মুক্তির ফুল ফোটে | ছোটগল্প
কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

জাহেদ মোতালেব | এই পৃথিবীর মরা ঘাসে তবুও মুক্তির ফুল ফোটে | ছোটগল্প

কোনো এক কালে গোপাল ভাঁড় বলেছিলেন, বলতে হবে সত্যি কথা, যতই হোক হৃদয়ে ব্যথা। কিংবা তিনি একথা বলেছিলেন কিনা জানি না। তাঁকে নিয়ে যে কার্টুন দেখানো হয়, সেখানে শুনেছি কথাটা।

গলি থেকে বের হওয়ার মুখে যুবকটাকে দেখলাম। প্রথম দেখায় মনে হলো পাগল।
কথার হাত ধরে হেঁটে আসছিলাম। মেয়েকে নিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ালাম।
যুবকের চেহারায় কান্না কান্না ভাব; তবে তা কান্না নয়। একটু অসহায়ত্ব মাখা। সেখানে আবার রাগের ছিটেফোঁটাও ছিল।
ঝাউতলার গলি থেকে রাস্তা অনেক উপরে। সে উপরে উঠে বাঁয়ে ঘুরল। হাঁটার সময় রাস্তা নয়, অন্য কোনো দিকে তাকিয়ে ছিল।
পাগলের গা থেকে গন্ধ বের হয়। যুবকের গা থেকে কিছু বের হলো না।
আমি একটু ভাবনায় পড়লাম। ওকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় চোখ কুঁচকে তাকালাম।
ফুল শার্ট। দুই হাতে নানা স্থানে কাটা। হাতার একটা অংশ দিয়ে দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। পরনে জিন্সের প্যান্ট। এখন হাঁটু পর্যন্ত অবশিষ্ট আছে। বাকিটুকু নেই। বোঝা যাচ্ছে কেটে নেওয়া হয়েছে।
দুই পা খালি। স্যান্ডেল দুটি গলিতে উল্টে পড়ে আছে হয়ত।
গলিতে মানুষের জটলা। সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করা সেলিম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
তিনি বললেন, জাল টাকাসহ ধরা পড়েছে। টাকা ছিঁড়তে কষ্ট হয়। এটা এক টানে ছিঁড়ে গেল। এই গলিতে জাল টাকা বেড়ে গেছে।
মোমিন রোড ঝাউতলায় কোনো ঝাউগাছ নেই। কোনো এক কালে ছিল কিনা জানি না। মেথরপট্টি বা সেবক কলোনিতে চমৎকার একটা নিমগাছ ছিল। এখন নেই। সেখানে এখন কোনো গাছ নেই। কেটে ফেলা হয়েছে। বারো তলা দালান উঠছে। দালান যে বৃক্ষের শত্রু তা বৃক্ষরা ভালোই জানে।
সামনে এগোলাম। একটা স্যান্ডেল উপুড় হয়ে বড় নালার পাশে কান্নার মতো পড়েছিল। সাথে সাথে যুবকের চেহারাটা মনে পড়ল।
এ সময় সাইকেলে যাওয়া এক তরুণ রাস্তায় দাঁড়ানো আরেক তরুণকে গালি দিয়ে তার ক্ষমতার কথা জানাল। মানে সে যদি ইয়ে করে তাহলে দিনে দিনে বাচ্চা হবে এবং বাচ্চাটা রাস্তায় এসে দাঁড়াবে।
পেছনে হাত বাঁধা যুবকটাকে মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। তার চেহারাটা যেন কেমন। এই চেহারার কথা ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। মোমিন রোড ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে? আর যার নামে এই রোড, সেই মোমিন এখন কোথায়? তার নিশ্বাস কি এই রোডে মিশে আছে! তিনি কি যুবকটাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন?
জাল টাকায় জর্জরিত যুবক কী ভাবছিল? তার ভাবনার কথা কেউ কি জানবে? হয়ত এই বাতাসে তার ভাবনার বুদ্বুদ ছড়িয়ে পড়ছিল ফাল্গুন মাসের হালকা কুয়াশার মতো।
তার কাছে ছিল দুটি জোব্বা। জোব্বা মানে পাঁচশ টাকার নোট। দুটিই ওরা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে।
এই পৃথিবীতে আছে উদ্ভিদ ও প্রাণী। আছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক। প্রাণীদের মধ্যে আছে মানুষ। হ্যাঁ, মানুষের প্রতি তার খুব রাগ হচ্ছিল। রাগ হচ্ছিল নিজের ওপরও। একটা হাতুড়ি নিয়ে ইটের কণার মতো নিজেকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে পারলে বেশ হতো। গরিব হওয়াটা একটা অভিশাপ। ভাবছিল সে।
এ সময় একটা বুড়ি আসছিল তার দিকে। শরীরের উপরের অংশে কোনো কাপড় নেই। এক হাতে বুকটা ঢেকে আরেক হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা করছিল, বাবা, আল্লার ওয়াস্তে একটু সাহায্য করবেন?
ঝুলে পড়া স্তনের দিকে চোখ যায়। তার রাগ আরো চড়ে।
পাশ ঘেঁষে গেল সাদা কার। হাতুড়ি দিয়ে কাচগুলো ভেঙে ফেলতে পারলে ভালো হতো। এই পৃথিবী ধনী লোকদের। তারা পৃথিবীটাকে ছেঁড়া কাপড় বানিয়ে ফেলেছে। দুনিয়ার সব ধনী লোকের গলা টিপে ধরতে চায় সে। আনমনে বলে, তোরা সব শয়তান।
শার্ট দুইদিন পরলে কাঁধের ভেতরে ময়লা জমে। ধনীরা পৃথিবীটাকে তেমন ময়লা করে ফেলেছে। কাজের মেয়েকে দিয়ে বলছে, ধুয়ে দে। ওরা ইচ্ছেমতো আছাড় মারছে। পৃথিবীর গায়ে বড় ব্যথা। ব্যথা আসলে তার গায়ে। চড় কিল ঘুষি লাথি অনেক খেয়েছে।
ইচ্ছে করছিল ধনী লোকের পাছায় ইনজেকশন মারতে। পঞ্চাশ-একশটা মারবে। বসতে পারবে না, পাছা বিছানায় লাগাতেও পারবে না। ওরা হারামজাদা, মিথ্যুক। ওদের মনে দয়ামায়া নেই। ওরা দেশে বউয়ের পেটে বীজ রুয়ে খালাস করতে নিয়ে যায় বিদেশে। এসব বেহায়াকে ওর চেনা আছে। বেহায়াদের জন্য তার এই অবস্থা। না হলে তার কর্ম নেই কেন? কেন তাকে জাল টাকার কারবারির ফাঁদে পড়তে হলো? যে লোকটা তাকে ফাঁদে ফেলেছে তার যন্ত্রটা কেটে ফেলতে চায়।
এখনো দুই হাত পেছনে বাঁধা। বুকটা ফোলানো। সে হাঁটছে মরা মানুষের মতো। ডান চোখের পাশটা ফোলা। রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিল। এক সিএনজি ড্রাইভারের গালি খেয়ে অপর পাশে চলে যায়। সেও গালি দিতে ছাড়ে না। মুখে ড্রাকুলার ভঙ্গি করে, চোখ দুটি রাক্ষসের মতো হয় কয়েক মুহূর্ত।
ওর মেয়ের বয়স পাঁচ বছর। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে বাল্যশিক্ষা মানে প্রাক-প্রাথমিকে পড়ে। বাসার পাশে খেলছিল। পাশের বাসার ওর বয়সী এক মেয়ে সিরিঞ্জ দিয়ে চোখে পানি মেরেছে। প্রথমে চোখ লাল হয়ে যায়। পরে পুঁজ জমে। ডাক্তারের কাছে অনেক দৌড়াদৌড়ি হলো। ডাক্তার বললেন, সিরিঞ্জে জীবাণু ছিল। কোনো ওষুধ রয়ে গিয়েছিল। চোখটা নষ্ট হয়ে গেল। এখন নীল হয়ে গেছে।
মনে হয় এই দুনিয়ার সবকিছু নীল বেদনা; ঝরে পড়ছে বৃষ্টির মতো। তবে তাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে না, ডুবিয়ে রেখেছে। সে হাউমাউ করে কাঁদতে চায়। ফাতেমার নষ্ট চোখের মতো এই পৃথিবী। এখানে এখন হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাবে, কী করবে বুঝতে পারে না।
সব বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নিচে। সেখানে একটুখানি মাটি ছিল। অশ্রুর স্পর্শ পেয়ে মাটির কান ঝাঁ ঝাঁ করে। মাটি ভাবে, এই পৃথিবী নিশ্চিত উলটপালট হবে। মিশে যাবে মিছরির দানার মতো।
মাটির উপর দাঁড়ানো যুবক, যার নাম মানিক, সে তখন বৃষ্টির মতো গালি দিচ্ছিল। তার গালি ডিসি হিলের গাছে, পাতায়, ফুলে মিশে যাচ্ছিল। গালিতে যদি এইসব জঞ্জাল আর তাকে দূষিত করা সবকিছু ভেসে যেত, তাহলে বেশ একটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার হতো। কিন্তু তার জীবনটা স্বপ্নের মতো নয়।
মানিক গুয়ের গন্ধ পায়। একদিনের বাসি গু। যা পা দিয়ে সে মাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়াক থু! নিজেকে তার ওই বাসি গুয়ের মতো মনে হয়।
তখন গিটার হাতে কয়েকজন যুবক রাস্তার পাশে ডিসি হিলে বড় রেইনট্রির শিকড়ে বসে গাইছিল, এই পৃথিবীর মরা ঘাসে তবুও মুক্তির ফুল ফোটে। একজন গিটার, অন্যরা তালি বাজায়।
গানটা শুনে মানিকের মুখে একচিলতে বাঁকা হাসি ফোটে। সে বলে, কুত্তার বাচ্চা। কাকে বলে বোঝা যায় না। মুখে ক্রোধ, রোদ পড়ে চিকচিক করছিল।
নন্দনকাননে বড় বটগাছটার ঝুড়ি বেরিয়েছে। সেখানে টং দোকান। লোকজন চায়ের দোকানদারকে ঘিরে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। চায়ের ঘ্রাণ পায়। হাত এখনো পেছনে বাঁধা, তাই চা খেতে ইচ্ছে করলেও কাউকে খুলে দিতে কিংবা দোকানদারকে চা দিতে বলে না।
তারপর সে হরিশ দত্ত লেইনে ঢোকে। চোখ বন্ধ করে হাঁটছিল। মনে হচ্ছিল, সামনে কিছুই নেই। শুধু একটা মেয়ে, যার একটি চোখের মণি পচে যাওয়া নীল রঙের। পৃথিবীর সবকিছু সামনে থেকে সরিয়ে দেয়; কিন্তু ছোট্ট মেয়ে ফাতেমাকে সরাতে পারে না। ওর নষ্ট চোখের মতো এই পৃথিবী; এখন ফাতেমার জন্য খুব কান্না আসে। ভেতরে ভেতরে সে ঝরঝর করে কাঁদে। তার কান্নায় ক্রোধ।
রাগ-রাগ মানিক তারপর কেসিদে রোডে ওঠে। রাইফেল ক্লাব, টিআইসি সরিয়ে শহীদ মিনারের দিকে যায়। শহীদ মিনারের দিকে তাকায় কি তাকায় না; কবিরাজের ঘৃতকুমারী ছুঁয়ে আরেকটু সামনে দাঁড়ায়। এ সময় দীর্ঘশ্বাসের মতো হরিশচন্দ্র দত্ত বা হরিশ দত্ত এবং কেসিদে বা কিরণ চন্দ্র দে যে উঠে এসেছেন, সে তো টের পায়নি।
হঠাৎ মানিকের ইচ্ছে হয়, বাঘের নখ ও ধারালো দাঁতের মতো যে রাগ, ক্ষোভ তা মিনারের পাথর ও সিমেন্টে মিশিয়ে দেবে। সেও ধীরে ধীরে ওখানে মিশে যাবে। কোথাও দীর্ঘশ্বাসের মতো আর থাকবে না।
কোনো একদিন ফাতেমা হয়ত তাকে খুঁজতে আসবে। কান্না কান্না একটি চোখ আর পচে যাওয়া নীল রঙের একটি চোখ, দুই চোখে জ্বালা। সে দেখবে, কিন্তু সাড়া দিতে পারবে না। যেখানে সে পাথর হয়ে থাকবে, সেই পাথর হয়ত একটু একটু ঘামবে। ঘাম নয়, ও যে মানিকের কান্না!
সেই ঘামের উপর দাঁড়িয়ে ফাতেমা ভাববে বাবার কথা। মনে মনে বলবে, বাবা! তবে এই হাওয়ায়, এই নগরে বাবাকে সে আর দেখবে না।


জাহেদ মোতালেব
জন্ম ১৯৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ধলই গ্রামে। নিজ গ্রাম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার নাজিরহাট পৌরসভার পূর্ব ফরহাদাবাদ। পেশা : সাংবাদিকতা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৪, উপন্যাস ৩, গদ্য ২, শিশুতোষ গ্রন্থ ৫।

Exit mobile version