সন্ধ্যায় জানতে চেয়েছিলে এখানে শীত কেমন? বলেছিলাম ঢাকার মতোই অনেকটা। কিন্তু এখন প্রায় মাঝরাতে জেঁকে বসেছে শীত। খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছিল। মাত্র বন্ধ করে দিলাম জানালাটা। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামদায়ক উষ্ণতার ভেতর আছি। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম একটা সুন্দর কবিতা লেখার। পড়ে যেন মনের অজান্তেই তুমি বলে ওঠ, বাহ! কিন্তু আমি পারিনি রাই। কোনো ছন্দিত শব্দ ধরা দেয়নি মগজে। আমি খুব করে জানি, ইদানীং কবিতার নামে যেসব ছাইপাশ লিখছি, সেগুলো তোমাকে মুগ্ধ করছে না মোটেই। বরং বিরক্তি তৈরি করে থাকতে পারে তোমার মনে। আদতে কবিত্বের যন্ত্রণা অনেক বেশি। কবিজীবন মানে নিস্তারহীন দহনযাত্রা। জানো রাই, একবার এক ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো – কেন লিখেন আপনি? উত্তরে হরবর অনেক কথা বলেছিলাম। তবে মনে মনে বলেছিলাম – রাইকে মুগ্ধ করার জন্য লিখি!
*
বলছিলাম, শীতের জন্য একটু আগে জানালা বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি কি জানো রাই, ছোটবেলায় এই ঘরে আমি একা থাকতাম। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা – সবসময় জানালা খোলা রেখে ঘুমাতাম। এমন কত হয়েছে – গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অসম্ভব ভয় পেয়েছি। তারপরও জানালা বন্ধ করার কথা ভাবিনি। আবার এমনও হয়েছে – হঠাৎ শেষরাতের জোছনা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বললে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, শেষরাতের দিকে জোছনার আলোয় মুগ্ধ হয়ে কতদিন ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেছি! ভেবেছি একটু পরেই ভোরের আলো আসবে। কিন্তু অনেক হাঁটাহাটিঁর পরেও সূর্যের দেখা না পেয়ে আবার ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন আমি মাত্র ক্লাস এইট পড়ুয়া। নিতান্তই বালক ছেলে। আমাদের বাড়ির সামনে বিশাল এক মাঠ। বিস্তৃত ফসলের জমি। দেখতাম জোছনায় ভেসে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত। চারদিক যেন দিনের আলোর মতো ধবধবে শাদা। আর কী ভীষণ বাতাস বইতো তখন!
*
আমার পাশের রুমে দাদাজান ঘুমাতেন। রাত বিরেতে হুঁটহাট আমার ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া দেখে মাকে ডেকে দাদাজান বলেছিলেন – পাভেলকে একটা তাবিজ এনে দাও বউ মা! ওর মনেহয় খারাপ কিছুর আছর লেগেছে!
*
আহা আমার দাদাজান। কতদিন পর তার কথা মনে পড়লো! আমার দাদাজান ছিলেন রহস্যময় এক মানুষ। বিরাট পরহেজগার। মাগরিবের নামাজ শেষে তসবি জপতে বসতেন। একেবারে এশা পর্যন্ত টানা তসবি জপে যেতেন। ভোরে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে আবার চলতো দোয়াদরুদ পড়া। ফজর শেষ করে হাঁটতে বের হতেন। অনেক সময় আমি দাদাজানের হাঁটার সঙ্গী হতাম। তিনি কিন্তু আমার আপন দাদা ছিলেন না। আমার দাদার ছোট ভাই। চিরকুমার ছিলেন। আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। ছিলেন আমৃত্যু। আমরা ডাকতাম মিয়াদাদা বলে। তখন আমি ছিলাম হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের পোকা। সারাক্ষণ তার বই নিয়ে পড়ে থাকতাম। মিয়াদাদা বলতেন, হুমায়ূনের বই পড়ে কি হবে? শরৎ পড়, বঙ্কিম পড়। সকালে হাঁটতে হাঁটতে অনর্গল বলে যেতেন শরৎচন্দ্রের লেখা বইয়ের লাইন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। বঙ্কিমচন্দ্রের কুপালকুণ্ডলার রোহিনীর কথা আমি মিয়াদাদার কাছ থেকেই জেনেছি। তিনি আমাকে আ ন ম বজলুর রশীদের বই পড়তে বলতেন। তার মুখেই আমি প্রথম কাজী ইমদাদুল হকের কথা শুনি। পরে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর কাজী ইমদাদুল হকের বিখ্যাত বই – আব্দুল্লাহ আমাদের সহপাঠ্য বই হিসেবে পেয়েছিলাম। আহা, আমার মিয়াদাদা! এমন এক শীতের সন্ধ্যায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। সেদিন ছিলো ফেব্রুয়ারির চার তারিখ। আমি তখন কলেজে পড়ি। মিয়াদাদা অসুস্থ্য – কলেজ হোস্টেল থেকে এমন খবর পেয়ে বাড়ি পৌঁছে দেখি তিনি আর নেই।
রাই,
জানি না তোমাকে এতো কথা কেন বলছি। হয়তো বিরক্ত হচ্ছ। হয়তো বোর লাগছে আমার কথা শুনে। তবুও আজ অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। জানো তো, ছোটবেলা থেকেই আমার হোস্টেলজীবন। ক্লাস নাইনে থাকতে উঠে গেলাম হোস্টেলে। তারপর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সব বাড়ির বাইরে বাইরে। স্কুলে থাকতে কত যে হোস্টেল ছেড়ে পালিয়েছি! আমাকে স্কুল হোস্টেলে রেখে বাবা বাড়িতে আসার আগেই আমি বাড়ি এসে বসে থেকেছি। স্কুল ফাইনালের আগে আগে একবার হোস্টেল ছেড়ে পালালাম। গিয়ে উঠলাম এক বন্ধুর বাসায়। সেখানে একরাত থেকে ভোরবেলা বের হয়ে যাই। বাড়ির পাশের বড় রাস্তায় ব্রিজের ওপর বসে থাকি সারাটা সকাল। কে যেন বাড়িতে গিয়ে খবর দেয়। মিয়াদাদা এসে আমাকে বাড়ি নিয়ে যান। সেদিন দাদাজান ভীষণ মন খারাপ করেছিলেন। নিজে নিজেই বলছিলেন – ছেলেটা কি তবে পরীক্ষা দেবে না? পড়াশোনা না করলে খাবে কি করে? এরপর আমি আর হোস্টেল পালাইনি। এসএসসির রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছিল। দাদাজান যে কি খুশি হয়েছিলেন – বলে বোঝাতে পারবো না রাই।
একবার কি হয়েছিলো জানো? আমাদের বাড়ির সামনে বিস্তীর্ণ ফসলিজমি। একমাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না এতো বড় মাঠ। আমরা গ্রামের মানুষেরা বলি মাঠের বন্দ। বর্ষাকালে সেই মাঠের বন্দ পানিতে ভরে যায়। বিপুল জলরাশিতে হাওড়ের রূপ নেয় মাঠ। বড় বড় ঢেউ দেখে মনে হয় বিশাল দরিয়া। সেই নতুন বর্ষাজলের পানিতে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে সাঁতার কাটে। কলায় ভেলায় করে শাপলা শালুক তুলে বেড়ায়। মায়ের কড়া নিষেধ পানিতে নামা নিয়ে। আমি যে তখন সাঁতার জানি না। একবর্ষায় সবার অলখে আমি নেমে গিয়েছিলাম মাঠের বন্দে। ভাবনা ছিল কিনারের হাঁটুজলে একটুক্ষণ থেকে উঠে আসবো। কিন্তু পানিতে নামার পর বিশাল ঢেউ আমাকে টেনে নিয়ে যায় অথই জলে। আমি হাবুডুবু খেতে থাকি। আমি ডুবতে থাকি। আমি ভাসতে থাকি। আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। আমার প্রবল জোরে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারি না আমি। আমার পেটে পানি ঢুকে যেতে থাকে। আমি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। ঠিক তখন কোত্থেকে জানি হাজির হন মিয়াদাদা। কাঠের খড়ম পায়ে দিতেন তিনি। সেই খড়ম পায়ে তিনি নেমে পড়েন পানিতে। এটেল মাটির কাঁদায় আটকে যায় কাঠের খড়ম। তারপরেও আছাড়ি পিছাড়ি করে কোনমতে আমার কাছে পৌঁছান তিনি। আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। তখন আমার বয়স কতো? ছয় কি সাত? বেশ নাদুস নুদুস ছিলাম। সেই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে কোলে নিয়ে পানি থেকে ডাঙায় তুলে আনার মতো শক্তি তার শরীরে ছিলো না। পরে কিভাবে সেখান আমরা দাদা-নাতি উদ্ধার পেয়েছিলাম সে গল্প না হয় আরেক দিন করবো। সেই ঘটনার অনেক বছর পর মিয়াদাদোকে আমি বলেছিলাম – আপনি তো আমার জীবনদাতা। শুনে দাদা বলেছিলেন – তওতা কর। এখনই তওবা কর। জীবনদাতা একমাত্র আল্লাহ। আমি শুধু উসিলা মাত্র।
এখানে এই গ্রামে, আজকেই আমার শেষরাত। ভোর সকালে গাড়ি আসবে। আবার শুরু হবে ভীষণ কর্মব্যস্ত গতির জীবন। বিশ্বাস করো রাই – আমি এতো গতি খ্যাতি যশ কিছুই চাইনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম এই শান্ত জনপদে একটা নিরাপদ শান্তির জীবন।
সব মিলিয়ে তোমাকে একান্তে কতদিন পেয়েছি বলো তো? মাত্র একদিন। অথবা ঠিকঠাক করে বলে দেড় দিন! অখচ সারাক্ষণ তুমি চোখের সামনেই থাকো। যেই বিকেলে তোমাকে আধঘণ্টা কি পৌনে একঘণ্টার মতো একা পেয়েছিলাম, তার প্রতিটি মুহূর্ত আমার মনে আছে। এমনকি সেদিন তুমি কী রঙের জামা পরেছিলে, সেটাও মনে আছে। তোমার হাতে ছিলো রুপালি চেইনের ছোট্ট একটা ঘড়ি। তাও মনে আছে আমার। এছাড়া মেলায় কাটানো সেই আধখানা বিকেল – সেটাও মনের মাঝে রেখে দিয়েছি সযতনে। জানি তোমার কাছে ওসবের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু দুটো বিকেলকেই আমি মূল্যবান মণিমুক্তোর মতো হৃদয়ে রেখে দিয়েছি।
*
আমার কথাগুলো নিশ্চয় খুব এলোমেলো লাগছে তোমার কাছে। লাগারই কথা। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। কথার খেই হারিয়ে ফেলছি।
*
আচ্ছা সেদিনের কথা একটু বলি। ওইদিন যখন তোমাকে দূর দেখি – আমি ভেবেছিলাম তুমি কাছে আসবে। পরে যখন একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেলে, তখন মনে হলো আমার আরো অনেক চাওয়ার মতো এটাও অপূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু না, ঘণ্টাখানেক বাদে তুমি আবার এলে। আমরা দাঁড়িয়ে গল্প করলাম কিছুটা সময়। কফি খেলাম। এরপরই যথারীতি চলে যাওয়ার তাড়া দেখাতে শুরু করলে তুমি, যেমনটা সব সময় দেখাও। তারপর আমার অনেক অনুরোধে কিছুটা সময় থাকলে। তুমি কি জানো, আমি নিজের জন্য কখনো কাউকে অনুরোধ করি না। শুধু তোমাকে কেন যেন করি। সেদিন সেই বিকেলে, তোমার হাত ধরতে খুব ইচ্ছে করছিলো। চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু তোমার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে খারাপ লেগেছে খুব। তবুও মেনে নিয়েছি। ভালোবাসার জন্য কাউকে তো আর জোর করা যায় না! তাই না?
পরের দিন আবার তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে – আমি কল্পনায়ও ভাবিনি। অথচ দেখা হয়ে গেলো! খুব অদ্ভূত আমাদের জীবন, তাই না! অনেক সাধ্য-সাধনা করেও তোমার দেখা পাওয়া যায় না। আবার দেখো কখনো কখনো খুব অনায়াসে কেমন দেখা হয়ে যায়। জানো রাই, সেদিন তোমাকে একান্তে পেয়ে খুব নার্ভাস লাগছিলো। চারপাশে এতো এতো মানুষ। তবুও খুব নির্জন লাগছিলো। তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে চলা, আড়চোখে তোমাকে দেখা – সব মিলে এক অন্যরকম ভালো লাগা। হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম এক জায়গায়। এদিকটায় মানুষের ভিড় কিছুটা কম। আবার ভিড় কম বলেই তোমার শঙ্কা। কেউ যদি দেখে ফেলে?
*
আমি তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম। কী নিষ্পাপ মায়াময় মুখ তোমার। শান্ত গভীর চোখ। ইচ্ছে করে সারাজীবন চেয়ে থাকি। মনে আছে এভাবে আমার তাকানোকে একদিন ঘাতক চাউনি বলেছিলে? জানো, আমি কেন এতো গভীর আবেশে তোমার চোখের দিকে, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি? আমি তোমার চোখের ভাষা পড়তে চাই। মুখের প্রতিটি রেখা পড়তে চাই। বুঝতে চাই, জানতে চাই তোমার মনের কোথাও আমার জন্য একটুখানি অনুভব আছে কি নেই!
*
হঠাৎ খুব শান্ত গলায় তুমি বললে, ‘পেছনে তাকাও।‘ আগেই দেখেছিলাম মাথার উপর পূর্ণ পূর্ণিমার চাঁদ। লেকের জলে চাদেঁর বিশাল ছায়া। এবং সোডিয়াম লাইটে ছপিয়েও কেমন ফিনিক ছোটা জোছনা উঠেছে। কিন্তু আমার তো তখন তোমাকে দেখার সাধ। তোমাতে বিলীন হওয়ার ইচ্ছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও পতঙ্গ যেমন আগুনে ঝাপ দেয়, আমিও তেমন স্বেচ্ছামৃত্যু খুঁজছি তোমার চোখে।
তখন আমার কি মনে হয়োছিলো জানো? তুমি আমার প্রেমে পড়েছো। না হলে তো একথা বলতে না।
*
আচমকা তুমি বললে, ‘প্রেম করেই ছাড়বে? আমি তো চাই না প্রেম করতে!’
বলেছিলাম, ‘প্রেম তো করা যায় না। হয়ে যায়।’
শুনে তুমি কি একটু হেসেছিলে? ঠিক মনে পড়ছে না এতদিন পর! তবে এটা মনে আছে এরপর তুমি চলে যাওয়ার জন্য খুব তাড়া দেখাচ্ছিলে। কেন এমনটা করছিলে তার কিছুটা হয়তো বুঝি। বুঝি না অনেকটাই।
সেই সেদিনের পর কত করে খুঁজেছি তোমায়। কত শীতের রাতে ভীষণ রকম কুয়াশা নেমেছে। শীতের তীব্রতায় রাস্তাঘাট সব দ্রুত খালি হেয়ে গেছে। আর আমার অনেক বেশি ইচ্ছে করেছে, রাস্তার ধারের কোনো দোকানে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে তোমার সঙ্গে এক কাপ চা খাই। ভীষণ শীতের রাতে তোমার সঙ্গে হাত জড়াজড়ি করে হাঁটি। অথবা এমন কতো দিন হয়েছে তীব্র জোছনায় ভেসে গেছে শহর। সোডিয়াম আলো ছাপিয়ে চাদেঁর আলো জ্বলে উঠেছে অনেক উজ্জ্বল হয়ে। আকাশে বসেছে লক্ষ তারার মেলা। আমার মনে হয়েছে তুমি যদি পাশে থাকতে! যদি তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটতে পারতাম? তোমাকে অনেক করে খুজেঁছি! কত দিন ডেকেছি তোমাকে। কিন্তু তুমি আসোনি। কেন আসোনি? জিজ্ঞেস করবো আজ? না থাক জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সব কথার উত্তর কি জানতে হবে? জেনে কি লাভ? কিছু কথা অজানা থাকা ভালো। অথবা জানলেও না বোঝা ভালো। সব বুঝতে গেলে গেলে বিপদ বাড়ে। কষ্ট বাড়ে। আক্ষেপ বাড়ে। এমনিতেই অনন্ত আক্ষেপের সমষ্টি আমাদের জীবন।
রাই,
তোমাকে ঘিরে কত কথা যে মাথার ভেতর ঘোরে! কতো স্বপ্ন আঁকি – কোনো হিসেব নেই। একদিন কি হয়েছে জানো, ঘুমের মধ্যে তোমাকে স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম রিকশা করে আমরা কোথায় যেন যাচ্ছি। আর কবিতা লেখা নিয়ে খুব ঝাড়ি দিচ্ছ তুমি। রাগী রাগী গলায় বলছো – কী সব ছাইপাশ কবিতা লেখো আজকাল। হয় না কিছুই। একই লাইনে একই শব্দ দুইবার ব্যবহার করেছো।
তোমার কথা শুনে আমি মিনমিন করে কী যেন কৈফিয়ত দিচ্ছিলাম। আমার কথা শুনে তুমি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলে! এরপরই আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নটা এতো জীবন্ত ছিলো, প্রতিটা কথা, তোমার মুখের প্রতিটা ভঙ্গি, প্রতিটি মুহূর্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেকেই বলে স্বপ্নের নাকি কোনো রং থাকে না। স্বপ্ন হয় সাদা কালো এবং গন্ধহীন। কিন্তু বিশ্বাস করো রাই, আমার স্বপ্নে তুমি পরেছিলে একটা নীল রঙের জামা আর সাদা ওড়না। তোমার শরীরের সৌরভ টের পাচ্ছিলাম আমি। এমনকি যে-কবিতার লাইনটা তুমি বলছিলে, সেটিও গেঁথে গিয়েছিল আমার মাথায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আর মাথা থেকে হারিয়ে গেল কবিতার লাইনটা! কিন্তু তোমার সৌরভ তখনও নাকে লেগে আছে! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ভোর হচ্ছে ধীরে ধীরে, চারপাশে লেগে আছে ফিকে অন্ধকার। আমার প্রচণ্ড মন খারাপ লাগতে থাকে। কেন মাথা থেকে কবিতার লাইনটা হারিয়ে গেল? মনে হয় গলা ছেড়ে কাঁদি। অন্য সময় এমন ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। বারান্দার জুঁই গাছটার পাশঘেঁষে বসি। অথবা দাঁড়িয়ে থাকি বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে। রাত কেটে ভোর হওয়ার দৃশ্যটা সবসময় আমার কাছে খুব অপরূপ লাগে। অন্ধকার কেটে কেটে একটা নতুন দিনের জন্ম দৃশ্য আমার কাছে পৃথিবীর মধুরতম দৃশ্য বলে মনে হয়। কিন্তু এদিন এতটাই মন খারাপ হয় আমার, বারান্দায় যেতেও ইচ্ছে করে না। একেবারেই না। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি।
কেন এমন হয় রাই? তুমি আমার কে? কি হও আমার? আগের জন্মে আমরা কি একান্ত স্বজন ছিলাম? নাকি কখনোই আমরা কেউ কারো ছিলাম না। তোমার জন্য অকারণেই দুঃখ পুষি? এ কি আমার মিছেমিছি দুঃখবিলাস? অনেক ভেবেছি আমি। উপরের প্রশ্নগুলো নিজেকেই জিজ্ঞেস করেছি বারবার। কোনো উত্তর পাইনি। এখন আর তাই ভাবি না এসব নিয়ে। শুধূ তোমার জন্য অনন্ত বেদনা ধরি মনের গহীন কোণে!
অনেক কথা বললাম। তোমার অনেকটা সময় নিয়েছি। শেষবেলায় আরো কিছু কথা বলি – কবিতার খাতা গল্পের বই সব তছনছ হয়ে গেলে আমি কোথায় দাঁড়াই!
তুমি আমার কবিতার খাতা। তুমি আমার গল্পের বই। তুমি আমার কিছু না হয়েও অস্তিত্বের সবটা জুড়ে মিশে থাকা একান্ত এক স্বজন। তুমি আমার গোপন এক ব্যথা। সুখের মতো ব্যথা।
ভালো থেকো রাই।