তীরন্দাজ Blog গদ্য টিপু সুলতানের প্রাসাদে ফাতিমা জাহান ভ্রমণ উৎসব সংখ্যা ১৪৩০
গদ্য বিশেষ সংখ্যা

টিপু সুলতানের প্রাসাদে ফাতিমা জাহান ভ্রমণ উৎসব সংখ্যা ১৪৩০

ফাতিমা জাহান

টিপু সুলতান মনস্থির করলেন আব্বা হুজুরের করে যাওয়া অসমাপ্ত প্রাসাদকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবেন। টিপুর জীবনে ঝক্কিরও অন্ত নেই। রাজ্যশাসন, ইংরেজ দমন, অন্য রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক বা মনোমালিন্য ইত্যাদিতে নতুন প্রাসাদ গড়ার সময় মেলা ভার।
ইতিমধ্যে তৃতীয় অ্যংলো মাইসোর যুদ্ধ লেগে গিয়েছে। কোডাগু, বেদেনুর, কারনাটিক প্রতিবেশীরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না। মারাঠাদের সাথেও বেশ কয়েক বছর ধরে ঝঞ্ছাট চলছে, পাশের রাজ্য হায়দ্রাবাদের নিজামগণও দোস্তি করছেন না। কোথায় যাবে টিপু একা একা! এত শত্রু ভারত উপমহাদেশের অন্য কোন রাজা বা শাসকের ছিলো না। রাজ্য টিকিয়ে রাখার অবিরত এই যুদ্ধ শুরু করেছিল টিপু কিশোর বয়স থেকে, আব্বা হুজুরের পাশে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে।
এত টালমাটাল অবস্থার মধ্যে টিপুর প্রাসাদ গড়ার সেই সময় কোথায়। তারপরও আব্বার করে যাওয়া প্রাসাদকে বাগবাগিচায় হরাভরা দেখার খোয়াহিশ মনে মনে পালন করেন টিপু। আব্বা হায়দার আলী খান টিপুর যেমন প্রিয় ছিলেন তেমনি আব্বার প্রিয় ছিলেন টিপু।
টিপু সুলতান গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করলেন নিজ রাজধানী শ্রীরাঙ্গাপাটনা থেকে খানিক দূরে ব্যাঙ্গালোরে। তখন ব্যাঙ্গালোরকে আলাদাভাবে কেউ চিনতো না। এ তল্লাটের রাজধানী শ্রীরাঙ্গাপাটনা কিন্তু রাজা বাদশাহগণ গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ গড়তেন একটু দূরে। তাই পিতা হায়দার আলী শুরুও করেছিলেন কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি।
বাদশাহ নাসিব উদ দৌলাহ সুলতান মীর ফতেহ আলী বাহাদুর সাহেব টিপু তাই অসমাপ্ত প্রাসাদের কাজ শুরু করলেন নিজ রাজধানী থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরে নির্জন ব্যাঙ্গালোরে, কাজ শেষ হল ১৭৯১ সালে। এই প্রাসাদ পুরোটাই নির্মাণ করলেন সেগুনকাঠ আর ছাউনি পাথর দিয়ে। চারিদিকে গাছগাছালিতে আবৃত জনমানবহীন উদ্যানের মাঝে এক কাঠের প্রাসাদ। আজকের ঝাঁ-চকচকে ব্যাঙ্গালোরের সাথে কোনই মিল নেই। কুড়ি বছর আগেও যদি টিপু এ শহরে আসতেন তাহলেও খানিকটা মিল হয়তোবা পেতেন। কিন্তু এখন আউটসোর্সিং কোম্পানি, মেট্রোরেল, হাই রাইজ বিল্ডিং, শপিং মলের ভীড়ে আর খুঁজে পাওয়া যায় না হযরত টিপু সুলতানের ব্যাঙ্গালোর, হ্যাঁ ব্যাঙ্গালোরের মুসলমান জনগোষ্ঠী টিপুকে মহব্বত করে এই নামেই ডাকে।
আমি প্রথম টিপুর সামার প্যালেস বা গ্রীষ্ম অবকাশকালীন প্রাসাদে এসেছিলাম বাইশ বছর আগে মা-বাবার সাথে৷ সবে ব্যাঙ্গালোরের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হয়েছি। আমাদের ঢাকার তুলনায় ব্যাঙ্গালোর একেবারেই আলাদা। পথে পথে অগুনতি গাছ ছায়া দিচ্ছে। বেশিরভাগই শিরিশ বা রেইনট্রি। এমনও পথ আছে যেখানে গাছের শাখাপ্রশাখা ভেদ করে সূয্যিমামা পিচঢালা পথে এসে আছড়ে পড়তে পারে না৷ এমনও পথ ছিল যা এতই নীরব যে দিনের বেলায়ও গা-ছমছম করবে। রাত আটটার মধ্যে চারিদিক নিঝুম, রাস্তাঘাট ফাঁকা। শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। এই ছিল আগের ব্যাঙ্গালোর শহর। এখন গাছ আছে ঠিকই কিন্তু সেই নীরবতা ভেঙে খান খান করে দিয়েছে অন্য দেশ থেকে আসা বড় বড় কোম্পানি, অন্য শহর থেকে কাজ করতে আসা মানুষজন, হাজার হাজার যানবাহন।
টিপু সুলতানের সামার প্যালেসের সামনে দেখি অজস্র হলুদ ট্যাবেবুইয়া ফুল ফুটে আছে এখন৷ টিপুর প্রাসাদে এসেছি আগেও কিন্তু এমন ফুলেল অভ্যর্থনা আগে পাইনি। দেখে মনে হচ্ছে আকাশ ছাপিয়ে আকাশকে লুকিয়ে কে যেন ফুলের আরেকটি আকাশ গড়ে দিয়েছে। ট্যাবেবুইয়া ফুলের নাম রবিঠাকুর ভালোবেসে দিয়েছিলেন ফাগুন বউ। কে জানে কবে কার বউ ছিলো সে। কে জানে ভালোবেসে রঙ ছড়িয়ে ঝরে যাওয়ার মাঝেই হয়তো তার আনন্দ।
টিপুর প্রাসাদ দেখার অনেক বাকি এখনও। সদর দরজা পার হয়ে একটি বাগান। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের ফুল ফোটায় মালী। এখন ফুটে আছে গোলাপ। গোলাপের খুশবুতে চারিদিক মাতোয়ারা, দুলছে ভ্রমর এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। আর এই খুশবুদার সময়ে টিপুর প্রাসাদ আমার সামনে। জনমানুষের হৃদয়ের রাজা ছিলেন টিপু। তার অবকাশ যাপনের প্রাসাদ তাই আড়ম্বরপূর্ণ নয়। সাধারণ দোতলা ভবন। তবে এমনি এমনি ভবন গড়া হয়নি। একতলা, দোতলা পূব থেকে পশ্চিমে পুরোটাই খোলা। কোন দেয়াল নেই, দাঁড়িয়ে আছে ১৬০টি কাঠের স্তম্ভের উপরে। স্তম্ভগুলো কারুকাজ খচিত। স্তম্ভের নীচের দিকে আর উপরে অসংখ্য কারুকাজ। স্তম্ভের রঙ গাঢ় বাদামি, সাথে ছাদের দিকে সোনালি রঙের বর্ডার দেয়া। স্বর্ণাভা ছড়াচ্ছে সেগুন কাঠের প্রতিটি স্তম্ভ দু’শো বত্রিশ বছর ধরে। স্তম্ভের ছাদের দিকে মিহরাবের আকার দেয়া। অতি সাধারণ প্রাসাদ কিন্তু তাকে অনন্য করেছে এই আভরণ। পূব থেকে পশ্চিমে হাওয়া বয়ে যায় খোলা দরবার হল দিয়ে। পূব আর পশ্চিমে উভয় দিকেই দোতলায় রয়েছে ঝুল বারান্দা। বারান্দার নীচের দিকে কাঠে কারুকাজ। সেখান থেকে টিপু সুলতান দর্শনার্থীদের দেখা দিতেন। নীচতলার উত্তর আর দক্ষিণে যে ঘর আছে তা ছিল পুরুষদের শয়নকক্ষ। দোতলায় উত্তর দক্ষিণের ঘর ছিল জেনানাদের মহল।
আমি খোলা দরবার হলে খানিক্ষণ ঘুরে ফিরে চলে গেলাম নীচের আরামগাহ দেখতে। ভেতরের দেয়াল আর ছাদের চিত্রকর্ম অবিকল রাখা হয়েছে। একটুও বদলে দেয়া বা রঙের হেরফের হয়নি আদি কাল থেকে। তাই এখানে আলোর ছটাও কম। দেয়ালে সবুজের আধিক্যে নানা নকশা, ফুল, লতাপাতা আঁকা। ছাদের রঙ লাল, বিদ্রোহের রঙও লাল। যেন টিপুর মতোই সমস্ত জগতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে আছে। লালের উপর ফুল ফুল নকশা। সিলিংয়ের চারিদিকে সাদা বর্ডার, সেখানে রঙিন ফুল, লতাপাতা খেলে যায়। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় কুলুঙ্গি। এই যে ধর্ম নিয়ে এত মাতামাতি, বাড়াবাড়ি; কুলুঙ্গি কিন্তু সব ধর্মের মানুষের ঘরে একই আকারের, আর এই যে মিহরাবের আকারে দরজা দেখা যায় ভারতের সব প্রাসাদে সেও কি জাত ধর্ম মেনে করা হয়েছে! আসলে শিল্পের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই, শিল্পে নেই কোন বিভেদ।
দোতলায় জেনানা মহল তো নয় যেন রঙমহল। যদিও টিপুর পনেরো বছর বয়স থেকে শুরু করে শেষ দিন অবধি বেশিরভাগ সময় কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে, নিজে আরাম করার সময় পাননি, তবুও রাজ্যের এবং পরিবারের জেনানাদের জন্য ছিলেন বিশেষ যত্নশীল।
জেনানাদের কোঠিতে আগে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিলো না৷ আমি মা বাবার সাথে যখন এসেছিলাম তখন দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রজাপতি হয়ে গিয়েছিলাম। কখনো এক ঝুল বারান্দায় তো আরেক মুহূর্তে অন্য বারান্দায় উড়ে উড়ে গিয়েছি। আসলে দোতলা থেকে বাইরের নাজারা দেখতে খুবসুরাত বেশি, হাওয়াও বেশি বয়ে যায়। জেনানা মহলের ছাদও লাল রঙে রঞ্জিত, এর উপরে ছোট ছোট ফুলের নকশা করা। দেয়ালে নীচতলার মতো সবুজ চিত্রকর্ম, জেনানা মহলের জৌলুস এবার দেখার সুযোগ হলো না। শুধু সিঁড়ির সামনে থেকে যতখানি দেখা যায়।
গ্রীষ্মকালীন এই প্রাসাদের পেছনের দিকেও একইরকম নকশা করা। পেছনের অংশে একটি পানির ফোয়ারা আছে। যদিও সেটি এখন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এখন এই গ্রীষ্মকালে এই প্রাসাদের মনের ভাব বোঝার মতো কেউ নেই। রাজা-বাদশাহরা পছন্দ করতেন বাগবাগিচা আর পানির নহর কিন্তু এত অযত্ন অবহেলা এই প্রাসাদকে মানায় না।
খুব বেশি বড় নয় বলে প্রাসাদটি ঘুরে দেখতে তেমন সময়ের প্রয়োজন হয় না। নীচতলার দরবার হলের দেয়ালে ফারসিতে কিছু শব্দ লেখা আছে যার ভাবানুবাদ এরকম,
‘যে মুহূর্তে এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হল তখনই আনন্দে প্রসাদের শির বেহেশতের কাছাকাছি চলে যেতে চাইল।
যারা এই প্রাসাদ দেখবে তারা বিস্ময়ে স্থির থাকবে।
কী অত্যাশ্চর্য এই প্রাসাদ, আনন্দের আলয়, গ্রীষ্মকালে স্বর্গীয় সুখের স্বাদ।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সামার প্যালেস গড়ার পর আরও আট বছর টিপু সুলতান তখতে আসীন ছিলেন। তারপর চলে গেলেন অন্যলোকে। এরপর কেটে গেছে বহু বছর। টিপু ঘুমায় আব্বা, আম্মির সাথে শ্রীরাঙ্গাপাটনায়, প্রিয়তমা বেগম আর বংশধরেরা ঘুমায় কলকাতায়। এ প্রাসাদের কাছে কেউ নেই তবুও মাথা উঁচু করে টিপুর প্রাসাদ বলে যায় এক অদম্য রাজার কিসসা, যে-রাজা মাথা নত করতে শেখেনি, কখনো দেশের কোন শত্রুর সাথে আপোস করেনি। বীরের জীবন নিয়ে এসে, বীরের তাজ মাথায় নিয়ে চলে গিয়েছেন অন্য দুনিয়ায়।

Exit mobile version