পোলান্ডের নোবেলজয়ী কথাসাহিত্যিকের গল্প। ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন গল্প, ভিন্ন অনুভব। পড়ুন গল্পটি।
‘আমাদের প্র্যাম নিয়ে আসা উচিত ছিল,’ একজন মহিলা আরেকজন মহিলাকে বললেন, যখন তারা রাস্তা দিয়ে বাস স্টপেজের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সেই রাস্তায় অনেক বছর কোনো তুষার জমেনি।
বয়সে বড় মহিলা শিশুটিকে কম্বল পেঁচিয়ে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন খুব দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসছিল এবং এমন ধূসর দেখাচ্ছিল যেন চারপাশে ময়লা জমে আছে। কম বয়সী তরুণী তার মায়ের পেছনে হাঁটছিল এবং বরফের ওপর তার পায়ের চিহ্ন থেকে যাচ্ছিল – যা খুব সহজ ছিল।
‘আমাদের দিনের আলোয় যাওয়া উচিত ছিল, রাতের বেলা নয়,’ পুনরায় বেশি বয়সী মহিলাটি বললেন।
‘যাওয়া উচিত ছিল, যাওয়া উচিত ছিল,’ কম বয়সী তরুণী বলল। ‘আমি তৈরি ছিলাম না।’
‘এ ধরনের পোশাক পরার কোনো প্রয়োজন ছিল না।’
‘আপনিও তো এরকমই পোশাক পরেছেন।’
‘না, আমি পরিনি। আমি আমার টুপি খুঁজে পাইনি।’
মা ও মেয়ে কেবল বাসের নাগাল পেয়েছে। বাসটি ধোঁয়াচ্ছন্ন এবং প্রায় ফাঁকা ছিল। বাসটি ধাতু দিয়ে তৈরি বাদামি ডিমের মতো দেখাচ্ছিল। একদল যুবক ও যুবতী বাসের পেছনের দিকে চাপাচাপি করে বসেছিল। নিশ্চয়ই ওরা ডিসকো দেখতে শহরে যাচ্ছিল। কম বয়সী মেয়েটি চোরা, কিন্তু লোভী দৃষ্টিতে বারবার যুবকদের দিকে তাকাচ্ছিল। সে যুবতীদের দেখছিল, বিশেষ করে যার পরনে ছিল চামড়ার জ্যাকেট এবং আঁটসাঁট জিন্স। তার মা কোমল স্বরে কিছু একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু জবাবে সে রুক্ষভাবে দাঁত কিড়মিড় করল। তারপর মেয়েটি জানালার কাঁচে জমে-থাকা বাষ্প পরিস্কার করে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন বাইরের দিকে তাকায়, যেখানে বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলছিল। যুবক ও যুবতীরা তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে, কিন্তু মা ও মেয়ে পরবর্তী স্টপেজে নেমে যায়। এখানে পাশের একটা সরু পথ দ্বিমুখী বড় রাস্তার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। সেই বড় রাস্তায় সাঁই সাঁই করে বিশাল আকৃতির লরি আসা-যাওয়া করে।
তারা উৎসবমুখর আলোয় সজ্জিত একটা মোটেল পেরিয়ে যায় এবং ভাজা মাছ ও চিপসের দোকানের সামনে গিয়ে পৌঁছায়। ‘সব সময় কোকা-কোলা’ – এই বিজ্ঞাপনের কাছে তারা অল্প সময়ের জন্য থামে। বিজ্ঞাপনটি বিশাল লাল চাঁদের মতো নতুন পুনর্নির্মিত কোনো বাড়ির সামনের দিকটা আলোকিত করে রেখেছিল।
‘আমরা কী তাকে এখানে ডেকে আনব? তা না হলে আমরা কীভাবে কী করব?’ মা জিজ্ঞেস করল।
‘আপনি যান, আমি বাচ্চাকে নিয়ে এখানে অপেক্ষা করি।’
বয়স্ক মহিলা ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং তাড়াতাড়ি ফিরেও এলেন ।
‘সে ভেতরে নেই। বাড়িতে আছে।’
মা ও মেয়ে খুব দ্রুত একজন আরেকজনের দিকে তাকাল এবং উঠানের দিকে হাঁটতে থাকলো।
গলায় রশি বাঁধা একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আলো জ্বলে ওঠে। তুষার সমস্ত নির্মাণ এলাকাটি করুণা করে এলোমেলোভাবে আচ্ছাদিত করে রেখেছে – সারিবদ্ধভাবে রাখা তক্তা, প্লাস্টিকে মোড়ানো স্টাইরোফোম এবং ফাঁপা ইটের স্তূপ। ভ্লাদিস্লভ গ্যারেজ নির্মাণ করছিল।
লোকটি বাইরে বেরিয়ে আসে এবং তাদের সঙ্গে দেখা করে। সুঠামদেহী পশমওয়ালা লোকটির গায়ে ছিল বোনা সোয়েটার, যার আস্তিন ঝুলছিল। সে অবাক দৃষ্টি মেলে তাদের দিকে তাকায়।
‘তোমরা এই অসময়ে এখানে কী করতে এসেছ?’ লোকটি হ্যালো না বলেই সরাসরি জিজ্ঞেস করে।
‘আমাদের আলোচনা করার কারণ আছে,’ বয়স্ক মহিলাটি বললেন।
‘সত্যি?’ লোকটি কায়দা করে কথাটা টেনে আরো বিস্মিত গলায় বলল।
‘আমরা কী ভেতরে আসতে পারি?’
লোকটি অনেকটা অস্পষ্টভাবে ইতস্তত করেছিল, তবে মাত্র একমুহূর্তের জন্য। তারপর সে সদ্য প্লাস্টার করা হলঘরে তাদের ঢুকতে দিয়েছিল। এখানে হাঁটার সময় তাদের জুতার নিচে সিমেন্টের নরম দানা চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল। তারা সন্তর্পনে রান্নাঘরে যায়। সে অবশ্য সিঙ্কের কিছু অংশ মেরামত করছিল। কারণ সে দেওয়াল থেকে তৈজসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী রাখার আলমারি খুলে ফেলেছিল এবং সেই ফাঁকা জায়গায় পানির পাইপ ও ইউ-বাঁকগুলো দেখা যাচ্ছিল।
‘আমরা কী বসতে পারি?’ অনুমতির ভঙ্গিতে বেশি বয়সী মহিলাটি জিজ্ঞেস করে।
ভ্লাদিস্লভ রান্নাঘরের প্রায় মাঝখানে মা ও মেয়ের জন্য দুটি চেয়ার এগিয়ে দেয়। তারপর সে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে এবং দেওয়াল থেকে খুলে ফেলা আলমারির গায়ে হেলান দিয়ে বসে। তখনই বাচ্চাটি তার চোখে পড়ে এবং সে হেসে ফেলে।
‘ছেলে, না মেয়ে?’
‘ছেলে,’ জবাবে অল্প বয়সী মেয়েটি বলল। তারপর সে বাচ্চাটির শরীর থেকে পেঁচানো কম্বল সরিয়ে ফেলে।
মেয়েটি বাচ্চার চোখের ওপর থেকে উলের নীল চাদর তুলে নেয়। বাচ্চাটি ঘুমাচ্ছিল। ওর কুঁচকানো ছোট্ট মুখটি ভ্লাদিস্লভের মনে সদ্য খোসা ছাড়ানো বাদামের কথা মনে করিয়ে দেয়। মুখটি কুৎসিৎ দেখাচ্ছিল।
‘সুন্দর,’ লোকটি বলল। ‘কী নাম?’
‘এখনো কোনো নাম রাখা হয়নি,’ চপল গলায় অল্প বয়সী মেয়েটি বলল।
‘ভ্লাদিস্লভ,’ তৎক্ষণাৎ বেশি বয়সী মহিলা বললেন।
‘ভ্লাদিস্লভ?’ লোকটি অবাক করা গলায় বলল। ‘আজকাল কোনো বাচ্চাকে ভ্লাদিস্লভ নামে কেউ কী ডাকে?’
লোকটি ভ্রুকুটি করে এবং জ্বলন্ত সিগারেটে টান দেয়।
‘তোমার নাম ভ্লাদিস্লভ এবং তাই ওর নাম…’ পুনরায় বেশি বয়স্ক মহিলাটি বললেন।
‘হয়তো বা – কে বলেছে হতে পারে না?’
চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। লোকটি সিগারেটের শেষাংশ টুসকি মেরে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে।
‘ঠিক আছে তাহলে?’
মহিলা দেওয়ালের গায়ে ঠেস দেওয়া পর্দার লম্বা লোহার দণ্ডের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন এবং সেই দিক লক্ষ করে বললেন, ‘বাচ্চাটি তোমার, ভ্লাদিস্লভ। ছুটির সময় আসছে। তাই আমরা ওর নাম রাখতে চাই।’
লোকটির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।
‘তুমি অবশ্যই পাগল হয়ে গেছ, হালিনা। কেমন করে বাচ্চাটি আমার সন্তান হয়? বলো, ইভোঙ্কা,’ লোকটি বলল। তারপর সে মেয়েটির দিকে ঘুরে বলল, ‘কেমন করে বাচ্চাটি আমার সন্তান হয়? তোমরা দুজনে মিলে কী চাও?’
ইভোঙ্কা নিজের ঠোঁট কামড়ায় এবং দ্রুত বাচ্চাটিকে দোলাতে শুরু করে। বাচ্চাটি জেগে যায় এবং কিছুক্ষণ কাঁদে।
‘কে সেই বাবা?’ লোকটি জিজ্ঞেস করে।
‘তুমি। বাচ্চাটি তোমার সন্তান।’
লোকটি উঠে দাঁড়ায় এবং হতভম্ব হয়ে সে জুতা দিয়ে সিগারেটের শেষাংশ চেপে ধরে।
‘অনেক হয়েছে। এখান থেকে চলে যাও, দুজনেই।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা উঠে দাঁড়ায়। ইভোঙ্কা মাথা ঢেকে রাখার ছোট্ট নীল চাদর শিশুর চোখের ওপর টেনে দেয়।
‘জলদি, জলদি,’ লোকটি মহিলাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে।
‘ঠিক আছে, ভ্লাদিস্লভ। তাহলে ইয়াৎসেক তোমার ছেলে,’ বলেই তৎক্ষণাৎ মহিলা পেছন দিকে না ঘুরে দরজার দিকে রওনা হন।
‘সে ঈস্টারের জন্য এসেছে,’ ইভোঙ্কা প্রচণ্ড নিষ্ঠুর গলায় যোগ করে।
‘চলে যাও।’
তাদের বেরিয়ে যাওয়ার পরে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তারা জমাট বাঁধা অপরিস্কার বরফের ওপর এসে নিঃশব্দে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরে বাতি নিভে যায়।
‘এখন কী হবে?’ ইভোঙ্কা তার মাকে জিজ্ঞেস করে।
‘তুমি কী ভাবছ? কিছুই না।’
বাস আসতে এক ঘণ্টার মতো বাকি। তারা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।
‘আমি আপনাকে প্র্যাম নিয়ে আসার কথা বলেছিলাম। এখন আমাদের কম করে হলেও এক ঘণ্টা সময় লাগবে।’
‘বাস স্টপেজে অপেক্ষা করা এবং ঠান্ডায় জমে বরফ হওয়ার চেয়ে হাঁটতে শুরু করা শ্রেয়।’
সেই রাতে শিশুটি অস্থির ছিল। ইভোঙ্কা মরা মানুষের মতো ঘুমিয়েছে। তাই তার মা ন্যাপির এক কোণা গরম পানিতে ভিজিয়ে শিশুকে চুষতে দিয়েছিল। আর তাতেই শিশুর ছোট ঠোঁট দুটি নড়তে শুরু করে। রান্নাঘরের সীমানায় ঝনঝন শব্দের মধ্যে আগুনের আলো ঝলমল করছিল।
পরদিন সকালে দুই মহিলা দোকানে গিয়েছিল। ইভোঙ্কা নিজের জন্য একটা ম্যাগনাম আইস ক্রিম কিনেছিল। আইস ক্রিমের দাম ছিল খুব বেশি। তার মা তাকে তিরস্কার করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, দাম কোনো ব্যাপার নয়, তবে তিনি হয়তো ঠান্ডায় আক্রান্ত হবেন এবং তার বুকের দুধ শুকিয়ে যাবে। ইভোঙ্কা ধীরেসুস্থে আইস ক্রিম খায় এবং কাঁধ নেড়ে ঝাকুনি দিতে থাকে। শিশুটি উজ্জ্বল নীল রঙের প্র্যামে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল।
‘কী সুন্দর শিশুটি,’ দোকানের মহিলা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল। সে সিঁড়ি ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার গায়ে সোয়েটারের ওপর ইস্ত্রি ছাড়া সাদা লম্বা পোশাক। উফ’, কি ঠান্ডা!’
অল্প সময়ের মধ্যে দোকানের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়, যা সাধারণত মধ্য-দুপুরে দেখা যায়। সাধারণত এ সময়ে শুধু স্থানীয় খদ্দেররা সস্তা মদ আর সীমান্তের দিকে যাওয়ার চলন্ত গাড়ির লোকজন কোলা এবং বাদাম কেনার জন্য থামে। আজ গৃহবধূরা কেকের জন্য রুচিকর সুগন্ধি, ভ্যানিলা চিনি, কৃত্রিম মাখন এবং কিসমিস কিনতে এসেছে। ঔষধ বিক্রেতাদের মতো দোকানের মহিলা মার্শম্যালো২, চকোলেট মোড়ানো জেলি এবং বিশেষ ধরনের বড়দিনের মিষ্টি ওজন করছিল। তবে সেখানে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছিল, তা ছিল মোড়ানোর জন্য ঝলমলে সোনালি এবং বেগুনি রঙের কাগজ। এসব ছোটখাটো জিনিস ক্রিসমাস ট্রীতে ঝোলানো হয়। তাড়াতাড়ি অগ্রসর হওয়ার জন্য ক্রেতারা মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। যখনই তারা কাউন্টারের সামনে উপস্থিত হয়, তখন প্রত্যেকেই দোকানি মহিলার সঙ্গে খোশ আলাপে মগ্ন হয়। মহিলা কাউন্টারে বেকিং পাউডার দেওয়ার সময় ঝুকে ক্রেতাদের গল্প শোনে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল যে, তারা মূল্য পরিশোধ করার জন্য অর্থকড়ি ব্যবহার করছে না, বরং টাকা-পয়সা তাদের কাছে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মুদ্রা ছিল। কিসমিস, বেকিং পাউডার এবং সস্তা মদিরার জন্য ক্রেতারা অতি সংক্ষিপ্ত কোনো গল্প, সামান্য প্রশ্ন বা কিছু কৌতুকপূর্ণ সরল জবাবের সঙ্গে অর্থ প্রদান করছে। তার জন্যই এত দীর্ঘ সময় লাগছিল।
ফ্যাশনদুরস্ত গাঢ় সবুজ রঙের একটা গাড়ি এসে দোকানের সামনে থামে। অত্যাধুনিক যেসব গাড়ি উঁচু এবং পেছনের দিক বাক্স-আকৃতির, সেই গাড়িটি ওগুলোর মধ্যে একটি। গাড়ির ছাদে বরফের ওপর স্কি করার সরঞ্জাম রাখা আছে। একজন লোক গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। বরফের মধ্যে হাত গরম রাখার জন্য সে বিশেষ ধরনের গ্লাভস পড়েছে এবং তার মাথায় হাস্যকর টুপি। গাড়ির ভেতরে বসা মহিলাকে সে কিছু একটা বলল। মহিলার সঙ্গে গাড়িতে দুজন কিশোর ও কিশোরী বসা ছিল। লোকটি দোকানে প্রবেশ করে এবং অপেক্ষারত খদ্দেরের পেছনে, ঠিক ম্যাটুশেকের পরেই, গিয়ে দাঁড়ায়।
‘জুরেক স্যুপ* আছে?’ পশমের তৈরি পোশাক পরা লোকটি হাত ঘষতে ঘষতে বলল। তারপর সে অনিচ্ছাকৃতভাবে বললো, ‘উফ! কী ঠান্ডা।’
খানিকটা স্বগোক্তির মতো করে লোকটি বলল। জুরেক স্যুপের প্রশ্নটি গল্পগুজবে মশগুল পরিবেশকে তিক্ত করে তোলে। দোকানের মহিলা আগুন্তকের দিকে চোখ তুলে তাকায়।
‘বোতলে এবং বোয়ামে জুরেক স্যুপ আছে। আমি জানি না সাধারণত আপনি কোনটা কেনেন – বোতলের না বোয়ামের।’
‘জুরেক স্যুপ,’ দোকানের মহিলাকে খেই ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মিসেস ম্যাটজিউক প্লাস্টিকের থলিতে ক্রয় করা সামান্য জিনিসপত্র রাখার সময় বললেন।
সবাই আগুন্তকের দিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে তাকায়। তার পায়ের উজ্জ্বল রঙ্গিন ট্রেন্ডি স্নো বুট৩ জুতার ওপর তুষার গলে যাচ্ছিল। তার আকাশী-নীল রঙের জ্যাকেটের গায়ে ভিনদেশি ভাষায় চটকদার কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল। দোকানের মহিলা নিচের দিকে তাকালেন।
‘আছে,’ মহিলাটি বললেন। ‘সর্বশেষ বোতলটা।’
‘তাহলে বোতলে আছে। আমরা দক্ষিণাঞ্চলের যে জায়গায় থাকি, সেখানে বোয়ামে জুরেক স্যুপ পাওয়া যায়,’ লোকটি আশেপাশের অন্য সব খদ্দেরের মুখের দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলল। ‘আমরা ছুটির সময় স্কি করার জন্য অষ্ট্রিয়া যাচ্ছি। আমার স্ত্রী জোর গলায় বলেছে যে, আমরা যেন সঙ্গে করে জুরেক স্যুপ নিয়ে যাই এবং সীমান্ত অতিক্রম করার আগে এটাই শেষ দোকান,’ লোকটি আস্তে করে বলল এবং অজানা কোনো কারণে ম্যাটজিউকের কাছে সে নিজের পরিচয় দেয়।
লোকটি তার মাথা ঘুরিয়ে কাঁচ দিয়ে ঘেরা বাক্সের ভেতর প্রদর্শনের জন্য রাখা বিভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেটের প্যাকেটের দিকে শীতল চোখে তাকায়। ম্যাটজিউক দরজার কাছে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে খুচরা গোণার সময় অপেক্ষারত লোকজন নিঃশব্দে এক কদম সামনের দিকে এগোয়।
‘জুরেক স্যুপ ছাড়া কিসের বড়দিন?’ লোকটি পুনরায় বলল। তার গম্ভীর এবং আত্মপ্রত্যয়ী গলার স্বর অন্যদের কানে বাজে। ‘এটা আমাদের পোলিশ বিশেষত্ব। আমি ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে গিয়েছি, কিন্তু সেসব দেশে কোথাও জুরেক স্যুপ পাইনি। তাই আমি ভেবেছি যে, গাড়ি চালানোর সময় আমি যদি এখান থেকে না কিনি, তাহলে আমি কোথাও থেকে কিনতে পারব না। চেক প্রজাতন্ত্রের কোথাও জুরেক স্যুপ পাওয়া যায় না।’
কেউ জবাব দিল না। লোকটি পা দিয়ে মেঝেতে দুপদাপ শব্দ করতে শুরু করে এবং হাতের তালুতে ফুঁ দেয়। যদিও অপরিচিত লোকটিকে দেখে দোকানের বেশি কথা বলা মহিলাটি রীতিমত বিভ্রান্ত, তবুও তিনি দক্ষতার সঙ্গে এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন । অপেক্ষারত লোকজন খুব দ্রুত এগোচ্ছিল, তবে কেউ তাড়াহুড়া করছিল না।
‘ঠান্ডা,’ ম্যাটজিউককে উদ্দেশ্য করে অপরিচিত লোকটি পুনরায় দু’হাত ঘষতে ঘষতে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল।
ম্যাটজিউক চোখ তুলে লোকটির দিকে তাকালেন। লোকটি ভদ্রতার সঙ্গে ঠোঁটের ফাঁকে হাসির অস্পষ্ট ঝলকানি ছড়িয়ে দেয়। তারপর সে মুখ ঘুরিয়ে পুনরায় সিগারেট প্যাকেটের দিকে তাকায়।
‘আলপসে আমাদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট নির্ধারন করা আছে। হে ঈশ্বর, ওখানে অনেক ভালো স্কি করার জন্য লিফট রয়েছে – কী সুন্দর জায়গা। ওপর থেকে নিচে নেমে আসতে এক ঘণ্টা কিংবা তার চেয়ে কম সময় লাগে। নিচে হোটেলে পানশালা এবং সাঁতার কাটার জন্য কৃত্রিম পুকুর আছে। আমাদের খাবার আমরা নিজেরাই তৈরি করব। প্রত্যেক অ্যাপার্টমেন্টে রান্নাঘর রয়েছে। তাই আমার স্ত্রী জুরেক স্যুপ গরম করতে পারবে। আমি এর সঙ্গে সসেজ নেব। মনে রাখবেন, খুবই উৎকৃষ্ট ধরনের সসেজ। এখানে কী ভালো সসেজ পাওয়া যায়?’ সে জিজ্ঞেস করে। তার কণ্ঠস্বর উদ্বিগ্ন শোনায়।
পরবর্তী মহিলা অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউন্টার থেকে সরে যায়। দোকানের মহিলা সোয়েটারের গলা আলগা করেন।
‘আমি কিছু সসেজ দেখতে পাচ্ছি। মূল্য মাত্র ছয় জোয়তে৪ । আমার মনে হয়, ভালো হবে না,’ লোকটি বলল।
গাড়ির ভেতর থেকে ভেঁপুর শব্দ ভেসে আসে। লোকটি দরজা খুলে বেরিয়ে যায় এবং সেই ফাঁকে ঘূর্ণায়মান হিমশীতল বাতাস হুড়মুড় করে দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ে। গাড়ির দিকে তাকিয়ে সে চিৎকারের সুরে জিজ্ঞেস করে এবং তারপর যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই নির্দিষ্ট স্থানে সে ফিরে যায়।
‘গাড়ির ভেতরে বসা মহিলা অস্থির হয়ে পড়েছে, কেননা আমাদের সন্ধ্যার মধ্যে আলপসে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু আমি জুরেক স্যুপের অভাব অনুভব করছি।’
ম্যাটজিউক সিগারেট, কমলার সুগন্ধি, আধা লিটার ভদকা এবং রুটি কিনেছেন। দোকানের মহিলা দক্ষতার সঙ্গে সব জিনিসের দাম যোগ করেন এবং হিসেবের কাগজের সঙ্গে বোতলটি পেঁচিয়ে দেন।
‘আর জুরেক স্যুপ,’ লোকটি বলল। ‘এক বোতল জুরেক স্যুপ।’
পুরো দোকান জুড়ে ভীষণ নিস্তব্ধতা। দোকানের মহিলা লোকটির হাতে বোতল তুলে দেয়। ম্যাটজিউক তাড়াতাড়ি মূল্য পরিশোধ করে।
‘এই যে, জনাব…’ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে লোকটি শুরু করে। তার পরনে ঢিলেঢালা সার্ট। চোখের পলকে ম্যাটজিউক তার জিনিসপত্র তুলে নিয়ে দোকান থেকে চলে যায়।
সে দোকানের বাইরে হালিনা ও তার মেয়েকে দেখতে পেল। বাইরে এসে হালিনার হাতে বোতল ধরিয়ে দেয়।
‘এটা ধরো । আমরা জুরেক স্যুপ খাই না –বিটরুট পছন্দ করি,’ লোকটি বলল।
ইভোঙ্কা ভেতরে যেতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল। সে বেড়ার পাশে দাঁড়ায়। তার দাঁত ঠকঠক করে কাঁপছিল। ঈশ্বরই ভালো জানেন তা ঠান্ডার জন্য, নাকি ভয়ে।
‘তুমি কিসের ভয় পাচ্ছো, নিনি৫? ওরা তোমাকে খেয়ে ফেলবে না। তখনই তোমার ভয় পাওয়ার কথা ছিল, এখন নয়,’ তার মা তাকে বলল ।
‘ওখানে কয়েকজন লোক আছে । আপনি যান । শিশুকে নিয়ে আমি এখানে অপেক্ষা করি।’
‘এটা ভালো যে ওরা ওখানে আছে – এখন হয়তো আমরা সমাধান করতে পারব। সাক্ষীদের সামনে। এসো!’
মেয়েটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাকে অনুসরণ করে।
চারজন লোক রান্নাঘরে টেবিলের পাশে বসে আছে। ম্যাটজিউক সবেমাত্র শেষ বারের মতো গ্লাসে ঢেলেছে। বিশালদেহী এবং শক্তসমর্থ্য তার স্ত্রী সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করছিল। পাশের টেবিলের উপরে রাখা টপিং দেওয়া খামিরের কেক ঠান্ডা হচ্ছিল। কেকটি সুন্দর এবং গরম ছিল।
‘মা, মেয়েরা নরম পালকের কম্বল নিতে এসেছে,’ ম্যাটজিউক বলল।
সেখানে একটি মাত্র খালি চেয়ার ছিল। লোকটি ওদের জন্য চেয়ারটি এগিয়ে দেয়। হালিনা চেয়ারের এক পাশে বসে। ইভোঙ্কা বাচ্চাকে নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ঠিক আছে, চিয়ার্স,’ গোরাল বলল এবং গ্লাসের তলানি ঠুকে শব্দ করে। কোনো কথা না বলে অন্য সবাই একই কাজ করে। তারা হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে এবং খানিকটা কমলার রস পান করে।
মিসেস ম্যাটজিউক ঘর থেকে বেরিয়ে যান এবং সরাসরি প্লাস্টিকে মোড়ানো ও সুতা দিয়ে বাঁধা একটা পুঁটলি নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি শিশুটির দিকে তাকালেন।
‘ওর নাম কী?’
‘এখনো ওর নাম রাখা হয়নি,’ হালিনা চটজলদি জবাব দেয়।
ইভোঙ্কা ঘটনাস্থলেই ঘাবড়ে গিয়ে রীতিমত কাঁপতে শুরু করে।
‘কখন নামকরণের অনুষ্ঠান হবে?’
হালিনা কাঁধ ঝাকিয়ে শ্রাগ করে।
‘কম্বলটা খুবই সুন্দর,’ মিসেস ম্যাটজিউক বললেন। ‘পুরো গ্রীষ্মকাল চিলেকোঠার খোলামেলা ঘরে ছিল। ঢেকে রাখার মতো কোনো কিছু আছে?’
‘তিনি হলেন বাবা,’ ইভোঙ্কা ইতস্তত করে হঠাৎ থেমে যায় এবং গোরালের দিকে তাকিয়ে মাথা অবনত করে।
চারপাশে অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে।
‘ঠিক আছে, ইভোঙ্কা?’ তার মা তাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন।
‘আপনিই বাবা,’ এবার সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল।
‘আমি আমার চারটা পেয়েছি,’ অবশেষে গোরাল বলল। ‘আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও । তোমার কোনো ধারণাই নেই যে, তুমি কার সঙ্গে ঘুমিয়েছিলে।’
‘ঠিক আছে,’ হালিনা তিক্ত স্বরে বলল।
‘আমি তার সঙ্গে ঘুমিয়েছি,’ কাফকা চিৎকার করে বলল।
তার কথা অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল এবং অতি মাত্রায় মদ্যপান করার জন্য চোখ ঝাপসা দেখাচ্ছিল। পাকস্থলীতে আরো পানীয়ের জন্য কোনো জায়গা ছিল না।
‘হ্যাঁ, আমি তার সঙ্গে ঘুমিয়েছি,’ সে ধীরে পুনরায় বলল। কিন্তু আমি ঘু-মি-য়ে-ছি; এত বেশি মাতাল ছিলাম যে, আমি আলোর গতিতে গিয়েছিলাম। সুতরাং আমি না।’
‘ইতোমধ্যে সে ভ্লাদিস্লভের কাছে গিয়েছিল এবং দোষ তার ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছিল। কে জানে কার সন্তান …’
‘একটা শিশু কিন্তু শিশুই,’ মিসেস ম্যাটজিউক বললেন।
‘তিনি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের একজন সৈনিকের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। সবাই তাদের দেখেছে,’ গোরাল যোগ করে। ‘অনেকটা খড়ের স্তূপে সূঁচ খোঁজার মতো।’
সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আংটা দিয়ে আটকানো টুপি খুলে নেয় এবং দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
‘হে ঈশ্বর,’ মিসেস ম্যাটজিউক আর্তনাদ করে ওঠেন। ‘কেন তুমি তার দিকে নজর রাখোনি? হালিনা, এটা তোমার দোষ, এটা তোমার অক্ষমতা।’
‘আপনি কী তাই ভাবছেন? আমার করণীয় কী ছিল? তার পা বেঁধে রাখা? আমি জানতে চাই, আপনি কীভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। মেয়েটি একজন পরিপক্ক মহিলার দেহ নিয়ে একটি শিশু।’
‘ইয়েরজিক?’ সন্দেহ করে হঠাৎ মিসেস ম্যাটজিউক বললেন। তিনি সবচেয়ে কমবয়সী লোকটির দিকে তাকালেন। সে হল তার ভাতিজা।
গোরাল দরজার কাছে গিয়ে থামে। ইয়েরজিকের কানের লতি রক্তিম হয়ে ওঠে। তার সূঁচালো চোখের নীল মনি যেন জ্বলে উঠল।
‘আমি না, আন্টি, আমি সতর্ক ছিলাম।’
কাফকার মুখ দিয়ে অদ্ভূত শব্দ বেরিয়ে আসে।
‘বিষয়টি নিস্পত্তি করতে কম করে হলেও অর্ধ লিটার লাগবে। ঠিক আছে, মিসেস ম্যাটজিউক। অধিক পরিমানে পানীয় পান করার এই তো সময়।’
মিসেস ম্যাটজিউক অসহায়ভাবে রান্নাঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দৃষ্টি একবার ইয়েরজিকের দিকে, আরেকবার গোরালের দিকে এবং অন্যবার তার স্বামীর দিকে। তাকে দেখে মনে হয় তিনি ফুলে আছেন, যেন একখণ্ড আসবাবপত্রের মতো ভারী। তিনি কিছু বলবেন, সেই আশায় সবাই অপেক্ষা করছিল। তার ঠোঁট গুলিয়ে যাচ্ছিল, যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে সবকিছু আড়াল করার জন্য একটি বিশেষ শব্দের আকৃতি নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্পষ্টতই তিনি তা করতে পারলেন না। কেননা তিনি টেবিলের কাছে যান এবং টেবিলে বিছানো চাদরের ওপর সজোরে থাপ্পর মেরে বললেন, ‘যথেষ্ট মদ্যপান হয়েছে। সবাই এখন চলে যান। আগামিকাল ক্রিষ্টমাস ঈভ। বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে।’
তিনি পুঁটলি ধরেন এবং হালিনার হাতে তুলে দেন। হালিনার মুখের সঙ্গে প্লাস্টিকে মোড়ানো পুঁটলি গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে, যেন সেটি দৈত্য আকৃতির কোনো শিশুর বাসা। তারপর সে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। মিসেস ম্যাটজিউক অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে টেবিল গোছাতে শুরু করে। কোনো কথা না বলে অতিথিরা উঠে দাঁড়ায় এবং তারা দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার স্বামী মুখ খোলে।
‘এক মুহূর্ত অপেক্ষা করো, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করো,’ সে বলল। ‘দাঁড়াও।’
কথা বলা থামিয়ে দিল, যেন সে কিছু ভাবছে এবং কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে ঢোল বাজানোর মতো শব্দ করে।
‘আমিই শিশুর পিতা।’
চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সে সেখানে বসল; তার স্ত্রী রান্নাঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখন অন্য সবাই গলে যাওয়া বরফের মধ্যে দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। তারপর মিসেস ম্যাটজিউক তার কণ্ঠস্বর শীর্ষে তুলে চিৎকার করল। ‘তুমি কী পাগল হয়ে গেছ? তুমি সন্তান নিতে পারবে না। গত বিশ বছর ধরে আমাদের কোন সন্তান হয়নি এবং সবাই জানে তুমি সন্তানের পিতা হতে পার না। কেননা তুমি দুর্ঘটনায় পড়েছিলে।’
‘চুপ থাকো। একদম মুখ বন্ধ। সে আমার সন্তান।’
কাফকা একটা চেয়ারে বসল।
‘তাহলে ঠিক আছে। যদি ঘটনা তাই হয়, তবে আরো পানীয় পরিবেশন করা তোমার উচিত…’
এক পা থেকে অন্য পায়ে স্থানান্তরিত করে ইভোঙ্কা নির্বিকারভাবে শিশুটিকে দোলাতে থাকে।
‘কিন্তু তুমি পারো না…’ পুনরায় মিসেস ম্যাটজিউক শুরু করেন। তখন তার মোটা হাত পরনের অ্যাপ্রোনে সেলাই খুঁজে পান এবং তা তিনি তার চোখের কাছে চেপে ধরেন। তারপর তিনি ভীষণ জোড়ে দরজার পাল্লা বন্ধ করে দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে যান।
ম্যাটজিউক পাশের ড্রয়ার থেকে একটা বোতল বের করে। সে সিঙ্ক থেকে গ্লাস তুলে আনে এবং ছয় আউন্স ভদকা ঢালে।
‘সে করেনি,’ ইভোঙ্কার দিকে আঙুল উঁচিয়ে হালিনা বলল। ‘এখনো তার বয়স আঠারো হয়নি। আর সে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে।’
তারা গম্ভীর নীরবতার মধ্যে মদ্য পান করেছিল।
‘সুতরাং কখন নাম রাখার অনুষ্ঠান হবে?’ ম্যাটজিউক জিজ্ঞেস করে।
‘পাদ্রী বলেছেন নতুন বছরের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে।’
‘তাহলে নতুন বছরে নামকরণ অনুষ্ঠান হবে,’ কাফকা বিড়বিড় করে এবং সে সবার আগে গ্লাস খালি করে।
তারপর ম্যাটজিউক সবাইকে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে বলল। সে আরো বলল, আগামীকাল বড়দিনের আগের দিন এবং তাদের কিছু কাজ করতে হবে। হালিনা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জামার আস্তিনে চোখের পানি মোছে। তারপর একসময় সে ম্যাটজিউকের দিকে তাকিয়ে হাসে।
‘জুরেক স্যুপের জন্য ধন্যবাদ,’ হালিনা বলল।
তারা মফস্বল শহরের বিশুদ্ধ এবং অদূষিত তুষারের ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়ির পথে ফিরে যায়। ইভোঙ্কা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
[মূল গল্পে নেই, কিন্তু পাঠকের সুবিধার্থে কয়েকটি অপরিচিত শব্দের টীকা জুড়ে দেওয়া হলো]
১জুরেক স্যুপ পোল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় স্যুপ, যা সাধারণত টক স্বাদের হয়। স্যুপের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত মাংস, সেদ্ধ ডিম, আলু এবং মাশরুম জাতীয় শাকসবজি থাকে। খাবারটি পোলিশ সংস্কৃতির এক শক্তিশালী অংশ এবং কমপক্ষে মধ্যযুগ (৫০০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে পোল্যান্ডে খাদ্য হিসেবে চালু আছে। জুরেক স্যুপ সম্পর্কে প্রাচীন সিলেসিয়ান উক্তি, ‘এই স্যুপ পুরুষকে প্রাচীরের মতো শক্তিশালী করে তোলে।’
২মার্শম্যালো এক ধরনের কনফেকশনারি। সাধারণত চিনি, পানি ও জেলটিনের সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।
৩ট্রেন্ডি স্নো বুট বরফের ওপর চলাচল করার জন্য বিশেষ ধরনের পশমী জুতা।
৪জোয়তে পোল্যান্ডের সরকারি মুদ্রা, যা এক শ’ গ্রোশে বিভক্ত।
৫ নিনি হচ্ছে লোকভাষায় বোকা ও দুর্বল মানুষ।
গল্পসূত্র : ‘জুরেক স্যুপ’ গল্পটি ওলগা তোকারজুকের ইংরেজিতে একই শিরোনামের গল্পের অনুবাদ। পোলিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যান্টোনিয়া লয়েড-জোনস্। গল্পটি ২০০৭ সালে মারিয়া ক্রোস্যান সম্পাদিত ‘এলসহ্যয়্যার : স্টোরিজ ফ্রম স্মল টাউন ইউরোপ’ শীর্ষক ছোটগল্পের সংকলনে প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অনুবাদকের জানা মতে গল্পটি এর আগে বাংলায় অনূদিত হয়নি।