মুখোশ
মেঘার আজ ২১তম জন্মদিন। কথা ছিল এবারের জন্মদিনে অরুপ তাকে খুব স্পেশাল এক চমক দেবে। কিন্তু কী সে স্পেশাল চমক, মেঘা জানে না। জানতেও চায়নি মেঘা। দারিদ্র্যের পেষণে পিষ্ট মেঘার যাপিত জীবন। তবুও অগাধ বিশ্বাস নিয়ে স্বপ্ন দেখে মেঘা। একদিন সে দেবদারু গাছ হবে। বাবাকে সম্মান আর সম্পদের জীবন তুলে দেবে।
অরুপ মেঘাকে পছন্দ করে আর মেঘা হৃদয় উজার করে ভালোবাসে রুপমকে। রুপম বড়োলোক বাবার একমাত্র সন্তান। বিনয়ী এবং বিশ্বাসী। কলেজে একসাথে পড়তো ওরা তিনজন। অরুপ মেধাবী। মেধাবীরা নাকি অহংকারী হয়, ধারণা মেঘার। তবে অহংকার অরুপ কোনোদিন দেখায়নি। তাতে কী!
ভালোই চলছিল সব, কিন্তু বিধি বাম।
ডিমেনশিয়ায় ভুগছিল রুপম। কলেজের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিল, কিন্তু কলেজে আসেনি। সে হারিয়ে গিয়েছিল ভুল রাস্তায় ভুল কোনো বাস অথবা ট্রেনে। অপেক্ষায় দুপুর কেটেছে, এসেছে সন্ধ্যা, এসেছে রাত। রুপম আর আসেনি। শহর তন্নতন্ন করেও কোথাও পাওয়া যায়নি রুপমকে। নিখোঁজ শিরোনামে সংবাদ হয়েছে রুপম। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ফুরিয়েছে। রুপমের জন্য অপেক্ষা ফুরায়নি কারোর, না পিতার, না বন্ধুর, না মেঘার।
জন্মদিনের দিন সকালবেলা মেঘাকে নিয়ে অরুপ একটি হাসপাতালে যায়। জন্মদিনে হাসপাতালে আসার বিষয়টি বুঝতে পারে না মেঘা। ওরা গিয়ে দাঁড়ায় করিডোরে। মেঘা তাকায়। চারপাশে অসুস্থ মানুষ। মেঘার চোখ ভিজে আসে। হৃৎপিণ্ডের মত অনবরত লাল সিগনালে ওঠানামা করছে মেডিকেলের বিকলাঙ্গ লিফট।
হঠাৎ মেঘা দেখতে পায় রুপমের মতো একজনকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওটিতে। দিকভ্রান্তের মতো দৌঁড়ায় মেঘা। পা পিছলে পড়ে যায় সে। রক্তপাত হয়। অনেক লোক জড়ো হয় সেখানে। মেঘা মাথা তুলে তাকায়, সে অরুপের মাঝে দেখতে পায় রুপমকে। রুপমকে ভেবে মেঘা জড়িয়ে ধরে অরুপকে। অরুপ আর অপেক্ষা করে না। অরুপের অপেক্ষা ফুরায়। মুখোশের অরুপ রুপমের মেঘাকে জয় করে।
আমার গল্প লেখা
ছোটগল্প আমার প্রথম পছন্দ। শৈশব থেকে ছোটগল্পের ঝোঁক অনুভব করি। ছোটগল্প নিয়ে প্রিয় গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই মহান উক্তিকে আমি শ্রদ্ধা করি। ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ আহা! ছোটগল্প পাঠকচিত্তকে ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। বনফুলের ‘নিমগাছ’ গল্পটি পড়ে কতবার যে ভেবেছি। কত সহজ করে কঠিন কথা বলা যায় ছোটগল্পে, যা আর কোনো কিছুতে সম্ভব নয়। আমি মনে করি, ছোটগল্প একজন পাঠককে নদীর হাত ধরে সমুদ্রে পৌঁছে দেয়। তারপর পাঠক শব্দের সৌন্দর্য খোঁজে, খুঁজে না পেলে আহত হয়, কিন্তু ক্লান্ত হয় না। ছোটগল্প পাঠককে তাড়িত করে, আর লেখকের থাকে তাড়না। ছোটগল্পে কল্পনার আশ্রয় কম, কিন্তু জীবননির্ভর। বৈশিষ্ট্য অনুসারে পরিচিত জীবন নিয়ে, জীবনের কাহিনি নিয়ে ছোটগল্প আমাদের জীবনকে গতি দেয়। এর ভাষা দুর্বোধ্য না হওয়াই ভালো। প্রেম- বিরহ, আনন্দ- বেদনা, ন্যায়-অন্যায় ছোটগল্পের বিষয়বস্তু, ছোটগল্পের শব্দ সমাজকে আঘাত করে, রাষ্ট্রকে দীক্ষা দেয়, বিবেককে জাগ্রত করে। বর্ণনার বাড়াবাড়ি নেই সত্যি, কিন্তু চরিত্রের দাপট রয়েছে, চরিত্রকে ভালোবাসার রসদ রয়েছে। লেখক গল্পের সমাপ্তিতে আকাঙ্ক্ষা নামক রস ছিটিয়ে দেন, যা পাঠককে ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। পাঠের তালিকায় ছোটগল্পের স্থান শীর্ষে। একটি গাছের যেমন অনেকগুলো শাখা রয়েছে সাহিত্যেরও তেমন অনেকগুলো শাখা রয়েছে। মূলত গাছ একটি। আমি মনে করি ছোটগল্প হলো সাহিত্যের গাছ। একটি বিষয়কে একটি চরিত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করাই এর বড় সার্থকতা। উপমার মুক্ত উচ্চারণ ছোটগল্পের সৌন্দর্য, আর বিষয়বস্তু হলো প্রাণ, তা হতে পারে পাঠককে হাসিয়ে অথবা কাঁদিয়ে। আর তাই ছোটগল্প আমার প্রথম পছন্দ, বিশেষ আগ্রহের জায়গা, মুক্তির পথ।