৩৭ ও ২৪
লোকটা ভাবছে এই জায়গাটার নাম বালুচর কেন? নামটা এত সহজ যে এই নামের পেছনের ইতিহাস খুব একটা ভাবার প্রয়োজন পড়ে না। হয়ত একসময় এখানে বালুর চর ছিল। হয়ত আশেপাশে একসময় মরা নদী ছিল।
নদী মরে যায় কেন ভাবতে ভাবতে লোকটা লেবু আড়াআড়ি কাটতে গেল। লেবু আড়াআড়ি কাটার কোন দরকার ছিল না, একভাবে কাটলেই হলো। সে কোন খাবার লেবু ছাড়া খেতে পারে না। লোকটার বন্ধুরা বলে সে মারা গেলে তার কবরের পাশে লেবুগাছ লাগিয়ে দেবে।
লোকটার ভাবনা মুহূর্তে টসটসে লেবুর সবুজ রং থেকে দূরে সরে যায়। আচ্ছা সে মরে গেলে তাকে কবর দিতে হবে কেন? সে জন্মসূত্রে মুসলমান বলে?
এই সব ভাবনার প্রকৌশলে লেবু কাটার সময় তার বাম হাতের তর্জনীর সামান্য একটু কেটে গেল। সে কবর ভাবনা বাদ দিয়ে আঙুলটার দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল। চিলতে রক্তের আভা দেখা যাচ্ছে। অল্প রক্তের একটা সৌন্দর্য আছে। তাকিয়েই রইল রক্তের দিকে। ক্রমশ রক্তের আকার বড় হচ্ছে। হোক।
সবজি খিচুড়ি খাবে সে লেবুর রস মাখিয়ে। খিদে জমেছে টনটন। রান্নাঘরের এক খণ্ড জানালা দিয়ে তেমন কিছু দেখা যায় না। এই মেস থেকে আরেকটা মেসের নোনাধরা দেয়াল দেখা যায় শুধু। তার রুমমেটরা কেউ নেই এখন। কাটা আঙুলে অল্প অল্প পানি ঢালছে। সময় যাচ্ছে একটু একটু। রক্ত পানিতে মিশে তরল হয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। যাক না।
লোকটার মাথায় তখনি ভাবনা এলো ডানায় ভর করে। জীবন তো এরকমই, সময় পার করে দেয়া। আচ্ছা তার নাম ইরফান কেন রেখেছে বাবা মা? ইরফান শব্দের অর্থ কি?
মানুষের নাম যদি সংখ্যায় হতো! যদি তার নাম বাবা মা রাখতেন ৩৭? স্কুল কলেজে সবাই তাকে ডাকত সাঁইত্রিইইইইইইইইইইশ..
কেউ নাম শুনেই তার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম বুঝতে পারত না।
সেই মেয়েটাকে ডাকত চব্বিইইইইই্ইই্শ..
লোকটা নিজেই নিজের এই আবিষ্কারে মুগ্ধ হয়..হাত কাটার এই জলচিকিৎসা থামিয়ে খিচুড়ির প্লেটে মনোযোগী হয়। লেবুটা ঠিকমতো কাটা হয়নি… লেবুর খণ্ডিত অংশে খানিক রক্ত লেগে আছে শার্টের পকেটে কলম উঁকি দেবার মতো করে।
৩৭ আর ২৪ সংখ্যাটা তার মাথায় এলো কেন চট করে? অন্য সংখ্যাও তো ভাবতে পারত সে। ক্লাসের সেই পুতুল মেয়েটা সব সময় সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ… ওর রোল ২৪ বলে?
একাকী খাবার খাওয়ার এই একটা প্লাস পয়েন্ট। প্লেটে অনেক খাবার নাও, খেতে থাকো আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ উত্তেজনার মতো ভাবতে থাকো।
মেসের জানালা দিয়ে রোদ পালিয়েছে অনেক আগেই। রাতের খাবারের আয়োজন করতে বুয়া এসেছে। বুয়া লোকটার এই ধীরগতির খাবারে বিরক্ত হয় না, অবাক হয় না। বুয়া জানে।
খিচুড়ি খেতে ভালো লাগছে না। আরেকটু লেবু মাখাবে কিনা..সবুজ-রঙা কাটা লেবুটার দিকে তাকিয়ে ভাবে কাটার সময় কি লেবুটা ব্যথা পেয়েছে?
লোকটা তন্ময় হয়ে বুয়াকে ডাক দিলো তখুনি : চব্বিইইইইইশ…
গল্পের ভাবনা বা গল্পের কৌশল
যে জিনিসটা সহজ সেটা আবার জটিল হয় কী করে!
সেটাই ভাবছি, ভাবনাটা আবার শব্দে সাজাচ্ছি। ভাবনাটা যত সহজ, সেটাই আবার গুছিয়ে লেখা তত জটিল। দিন শেষে তো সব শব্দের শব মিছিল। আবার অদ্ভুত বিষয় হলো এই ‘শব শব্দ’ই তীব্র জীবিত। নিজের সাথে তো কথা বলে আবার যিনি পড়ছেন তার সাথে সাথে যাত্রা করে। পাঠককে ভাবায়, হাসায়, কাঁদায়, স্বপ্ন দেখায়।
সব গল্পই পাঠকের।
আমার সব গল্পেই চেনা মানুষের মুখ আছে। খুব কম গল্পই আছে যার চরিত্রগুলো আমার চেনাশোনার বাইরে। হয়ত এ কারণে আমি খানিকটা নির্বিকার মানে শৈল্পিক বিচ্ছিন্ন থাকি আর চরিত্রানুসন্ধান করে বেড়াই। মানুষের মুখ আমার প্রিয় বলেই গল্পের চরিত্র খুঁজি। তবে এটা কখনই পূর্ব নির্ধারিত নয়।
বিচিত্র কিছু অভ্যাস আছে আমার। কী করে একটা ‘সাবজেক্ট’ চুলকায়, নাক টানে, কথা বলার সময় কোন অঞ্চলের ডায়লেক্ট ব্যবহার করে, পুরুষ হলে সে অন্য একজন অপরিচিত নারীর দিকে বা কিশোরীর দিকে তাকায়; আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন তার চোখ আমি মুখস্থ করি। যেন চরিত্রটি আমি হয়ে যাই। যখনই ল্যাপটপের ডালা খুলি, টাইপ করতে শুরু করি, সেই দেখা চরিত্রটা আমার স্ক্রিনে ভর করে, অন্য রকম ভাবনার শরীর নির্মাণ হতে থাকে।
কখনও লেখার জাদুর জন্য বা চরিত্রটাকে পরম মমতায় ধারণ করবার জন্য আমি প্রথম পুরুষে লিখতে শুরু করি। এমন সব চরিত্র আছে যার সাথে আমার জীবন যাপনের বিন্দু মাত্র সাযুজ্য নেই, তবুও আমি হয়ে যাই সেই সব চরিত্রের চরিত্র শরীর।
এটা তো ঠিক যে আমি আমার গল্পের প্রথম পাঠক। শব্দের পর শব্দ সাদা স্ক্রিনে টাইপ হতে থাকে, আমি পুলক অনুভব করতে থাকি।
এই পুলকই হয়ত আমার নির্মাণের কৌশল। চেষ্টা করি নতুন উপমা ব্যবহার করতে, একটা কিছু নতুন দিতে। প্রায়শই ব্যর্থ হই। লেখাটা প্রকাশিত হলে আর ভালো লাগে না। গল্পের কৌশলে, ফর্মে, শব্দে নিজেই বিরক্ত হই।
তখনই দ্বিতীয় গল্প লিখতে শুরু করি।
এ রকম একটা গল্প লেখার গল্প বলি :
লালমনিরহাট ডিসি অফিস থেকে ঢাকায় ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ত্রাণ অধিদপ্তরে বদলি হয়ে এলাম। নিজের বসার কোন জায়গা নেই, কোন কাজ নেই।
ত্রাণ অধিদপ্তরের অফিস বায়তুল মোকাররমের উল্টো দিকে, হাউজ বিল্ডিংয়ের ৫/৬ তলায়। বাসায় বলা যাচ্ছে না যে অফিসে আমার মতো সহকারী পরিচালকের কোন কাজ নাই। তবুও সকাল বেলা গম্ভীর মুখে বেশ সুদর্শন একটা ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠি।
তো খলিল নামে এক ভাই, আমার বড় ভাইয়ের সহপাঠী, ঢাকায় আমেরিকান লাইফ ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে জীবন বীমার পলিসি বিক্রি করতেন। এরকম একদিন দুপুরে এসে হাজির। আমার যেহেতু তেমন কাজ কর্ম নেই, খলিল ভাইয়ের সাথে গল্প হতো। ওনার মলিন মুখ, পলিসি বিক্রি করবার আকুলতা আমাকে দুর্বল করে দিলো।
খলিল ভাই, সেই নতমুখী মলিন ভদ্র মানুষটা। ছবিটার দিকে তাকাতে তাকাতে আমি যেন খলিল ভাইয়ে রূপান্তরিত হতে থাকি। বিসিএস ভাইভা দিতে আমি এর আগে একবার ঢাকায় এসে কাঁঠালবাগান দারোগার মেসে আমার বন্ধু ফুজু’র ওখানে উঠি।
খলিল ভাই, সেই কাঁঠালবাগান মেস আর আমি সমান্তরালে হাঁটতে থাকি তুষার খলবল মন্ট্রিয়লে। ও হ্যাঁ আমি সাঁতার জানি বলে ডুব দিতে জানি।
দিলাম ডুব। হাহাকার ডুব।
লিখে ফেলি ‘একলা চাতক’ গল্পটি।