তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য ছোটগল্প রাত দখল ও রঙের খেলা | সপ্তদ্বীপা অধিকারী | ছোটগল্প | রাত দখল
ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

রাত দখল ও রঙের খেলা | সপ্তদ্বীপা অধিকারী | ছোটগল্প | রাত দখল

Kanishka

প্রিয় পাঠক, আমাদের এই ভূখণ্ডে ‘জুলাই আন্দোলনে’র কিছুদিন পরেই সীমান্তের ওপারে শুরু হয় ‘রাত দখল’-এর আন্দোলন। জুলাই আন্দোলন নিয়ে তীরন্দাজ একটি বিশেষ সংখ্যা করেছে। এরপর ইচ্ছে ছিল ‘রাত দখল’ নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা করবার। সেইভাবে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা লেখাও দিলেন, অনেকের কাছ থেকে লেখা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও পেলাম। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ করে তীরন্দাজ-এর ওয়েব সাইটটিতে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিল। থমকে গেল প্রকাশনার কাজ। অবশেষে সেই সমস্যা কাটিয়ে সংখ্যাটি লেখকদের সামনে হাজির করতে পেরে আমরা আনন্দিত। সময় মতো প্রকাশের প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করতে পারিনি বলে সীমান্তের ওপারের লেখক বন্ধুদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি। সংখ্যাটি কেমন লাগল, আমাদের জানাতে ভুলবেন না। চিঠি লেখার ইমেইল অ্যাড্রেস : eteerandaz@gmail.com
সবার জন্যে শুভকামনা।

রাত দখল ও রঙের খেলা | সপ্তদ্বীপা অধিকারী | ছোটগল্প | রাত দখল

মহারাজা সিংহাসনে বসে ছিলেন। মনে মনে নক্সা আঁকছিলেন কেমন করে দুই নাম্বারের বদলে এক নাম্বার চেয়ারে বসবেন। খবরটা ঠিক তক্ষুনি এল।
এন কে ধর নামক বিখ্যাত সরকারি হাসপাতালে একটি নারী ধর্ষিতা হয়েছে। শোনার সাথে সাথে তিনি লাফিয়ে উঠলেন।
চিৎকার করে বললেন–“ওরে তৈরি হ। তৈরি হ। মাঠে নামতে হবে। রঙ পাল্টানোর খেলায়।”
তাদের নিজেদের আসল রঙ নীল। অন্যদিকে হলুদ, গোলাপী, সোনালী রঙের রাজা-মহারাজারাও মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেভাবেই হোক, সিংহাসনের দখল চাই। চাই মানে চাইই চাই।
পৃথিবীর সমস্ত মেয়েরা সমস্বরে গর্জে উঠল।
“রাত হলেই, অন্ধকার হলেই শ্বাপদের মতো বেড়ে ওঠে চিতার খাই। আমরা নারীরা আর এটা মেনে নেব না। আমরা রাত চাই। রাতের দখল চাই।”
রাত। মানে অন্ধকার। মানে কালো। সেই রাতের অন্ধকার চেয়ে গোটা পৃথিবীর নারীরা পথে নামবে।
পুরুষ নামক ধর্ষকরা প্রমাদ গুনল। তবে তো বিপদ! রঙ পালটানো কয়েকটি গিরগিটি ভিতরের খবর আনল–” সত্যি সত্যি মেয়েরা পথে নামছে। রাত দখলের জন্য! আর আরও মারাত্মক খবর আছে!”
রাজার আগ্রহ চরমে।
“কী খবর? কী খবর?”
সমস্ত রঙের কাছেই খবর আছে। গোপন খবর নয়। আসল খবর। এই খবর মেয়েরা নাকি প্রকাশ্যে বলেছে এবং সেইভাবেই চলছে।
দলপতি গর্জে ওঠে–“কী, সেটা কী?”
খবর জোগাড় করেছে যারা তারা বলে–“এই মেয়েদের কোনো রঙ নেই!”
“সেকি কথা! সেকি কথা? এমন হওয়ার তো কথা নয়! রঙ না থাকলে তো ওদেরকে এই সভ্য সমাজ থেকে বার করে দেওয়া হবে!”
সবাই বলে–“তাই করুন। নইলে আমরা কোনোদিন মসনদ পাবো না!”
পরের দিনই আরো চমক। বেগুনি রঙের দলনেতা খবর দিলেন–“পথে নামা রাত দখলের নারীদের সাথে পুরুষরাও থাকছে! থাকছে অটোওয়ালা। টোটোওয়ালারা! মায়ের সাথে থাকছে তার পুরুষ সন্তান…, স্ত্রীর সাথে পুরুষ স্বামী…!”
দলনেতা বললেন–‘বাহ! এই তো চাই। কাল ওই রঙহীন প্রতিবাদের মিছিলে সব্বাই নেমে পড়বে। মেয়েদের রঙ না থাকতেও পারে। কিন্তু রঙহীন পুরুষ তো নেই। সুতরাং আমরাও নামব। আর এন কে ধর হাসপাতাল এই সুযোগে ভেঙে দিতে হবে। গুঁড়িয়ে দিতে হবে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে। এমন পর্যায়ে নিতে হবে সন্ত্রাস যে মসনদ ছাড়তে বাধ্য হয় বর্তমান বেগুনি রঙের রাজা।”
একজন নিরীহ সমর্থক বলে ওঠে–“কিন্তু হাসপাতালে সন্ত্রাস সৃষ্টি করলে তো সাধারণ রুগিদের সমস্যা হবে। তাছাড়া রাজা এবং তার দলের লোক সেটা সহজেই বুঝতেও পারবে যে!”
দলনেতা হো হো হাসেন। যেন এমন মজার কথা তিনি জীবনেও শোনেন নি।অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলেন–” এই মালটাকে আর সিক্ষিত করতে পারলাম না। বলে সাধারণ মানুস মরবে। আরে বালটা এই মানুসগুলোই তো আমাদের তুরুপের তাসরে! এরাই যদি না মরে, না রেপ হয়, তাইলে সালা আমাদের সারা জীবন আঙুল চুসতে হত! বুইলি!”
বলতে বলতে দলনেতা
খইনি মেশানো থুতু ফেলে পচাৎ করে।
দেশে ছিল যত রঙ সবাই নিল খোলা চ্যালেঞ্জ। নামো, নামো তো বাছাধনরা। এই তো চাই! হা হা হা।
হলুদ রঙ ছিল বেশ বুদ্ধিমতীদের নিয়ে। কয়েকজন ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার তাঁদের মধ্যে আছেন।
ইতিমধ্যে কিছু “শিক্ষিত” “নারীর” সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা সোনালী আর নীল রঙের সমর্থক এবং তারা উচ্চ শিক্ষিত। তারা জানে এবং মানে যে, যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে, সেটি তার সাথে কখনো হবে না! কারণ তাদের সাথে নির্দিষ্ট রঙ আছে। তারা জানে এই ডামাডোলের বাজারে প্রতিবাদ করে-টরে যদি একবার লাইম-লাইটে আসা যায় তো রঙ পাল্টালে সেও ওই নির্দিষ্ট রঙেদের নজরে পড়ে একজন কেউকেটা হতেই পারে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি। তারা জানে একবার কোনো দলনেতার কৃপাপ্রার্থী হতে পারলে সে আর কখনো ধর্ষিতা হবে না। আর নাম, যশ, খ্যাতি সবই পুরুষদের মতো হবে এবং তারাও ভোগ করবে।
ফলে নারীদেরকেও রঙের খেলায় সামিল করা গেল। আন্দোলন চলল সারারাত ধরে। যে সমস্ত মেয়েরা সত্যের জন্য, ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়তে চাইল, তারা সব কী অদ্ভুত ভাবে ভূত হয়ে গেল। কে না জানে দশের চক্রে ভগবান ভূত! আর ভূতেদের তো শরীরই নেই! তার আবার প্রতিবাদ!
ওদিকে Artificial Inteligence ব্যবহার করে মৃত মেয়েটিকে কেমন চূড়ান্তভাবে ধর্ষণ করা হতে থাকল দিনে-দুপুরে।
মেয়েটি প্রচণ্ড পরিশ্রমী ছিল। পড়াশুনায় অসম্ভব ভালো ছিল। খেতে ভুলে যেত পড়ার নেশায়। মা সহ্য করতে পারতেন না। ভাত মেখে মেখে গালে তুলে দিতেন। এক এক গাল ভাত খেত মেয়ে আর মায়ের বুক ভরে যেত। একবার আঙুল কেটে গেছিল তার। সে সারাদিন কেঁদেছে। মাকে দেখিয়েছিল। বাবাকে দেখিয়েছিল। সেই মেয়ে! সেই মেয়ের মুখে রক্ত। ঠোঁটে রক্ত! ঠোঁটটা থ্যাতলানো। পা দুটো দুই দিকে ছড়ানো। পক্ষের লোক বললেন–“রেপ-টেপ নয়। ও মেয়ে আত্মহত্যা করেছে!” বিরোধী পক্ষ মানলেন না। তাঁরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। জোর প্রতিবাদ চলছে। পক্ষের লোক বাধ্য হয়ে মেয়ের পোস্ট মর্টেম মায়ের সামনে করতে বললেন।মেয়ের উলঙ্গ শরীরটা মা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। বুক দুটোতে কালশিটে। কালো আর লালের মিশেলে চাক বেঁধে শক্ত হয়ে আছে বুকে, ঘাড়ে, গলায়, কব্জিতে, থাইতে। যোনিদ্বার দিয়ে তখনো ক্ষীণ রক্তধারা!
যোনিদ্বার দেখে মনেহচ্ছে একসঙ্গে অনেক পুরুষ অত্যাচার করেছে। যেন কোদাল দিয়ে কোপানো হয়েছে কবরের মাটি। যোনি এমনই ক্ষতবিক্ষত!
এই মেয়ে এক বেলা পেট ভরে না খেলে মা সহ্য করতে পারতেন না! আজ মা দুই চোখ মেলে দেখছেন। দেখছেন সেই পেটটা ডোম ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল। ডাক্তার মেয়ের পেটের ভিতর চেয়ে চেয়ে দেখছেন। মায়ের মেয়ে খিদে পেটে ছিল না। সে রাতে সে খেয়েছিল। মায়ের বুকে একটু জ্বালা কমে! আহা! মেয়ে খেয়েছিল! ডাক্তার লেখেন। ধর্ষিতা রাতে খেয়েছিল। সারা শরীরে একশত তিনটি গভীর কামড়ের দাগ! মায়ের বুক ফেটে যায়! একটু লাগলে তার মায়ের বুকে বাজত যে! কতো কষ্ট পেয়েছিস রে মা আমার! ডাক্তার দেখান যোনি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন! কমপক্ষে আঠারো থেকে কুড়ি জন মেয়ের শরীরটা খুবলে খেয়েছে! মা দেখেন। দুই চোখ মেলে। আহা!
” মাগো!”
মা চমকে তাকান!
‘কে ডাকল? মৌ, মা আমার? মৌ? ও মৌ?’
মা মেয়ের ছিন্ন-ভিন্ন শরীর থেকে চোখ সরান!
‘না, না! এ শরীর তাঁর মেয়ের নয়। এই শরীর আদতে কোনো নারীর নয়! কোনো নারী কিছুতেই এভাবে মরতে পারে না! আমরা সভ্য জগতে বাস করি! কোনো পুরুষ কোনো নারী-শরীর এভাবে ছিন্ন-ভিন্ন করতে পারে না! তাঁর মেয়ে তাঁকে ডাকছে তো! ওই তো ডাকল তো সে!’
“মা, ওমা!”
‘আবার ডাকল। আবার ডাকল যে!’
মা বলেন–“ওমা, মৌ, মা আমার কোথায় তুই? আমার কাছে আয় মা! আয় না!”
ডোম বলে ওঠে–“এই দেখুন মাসিমা, আপনার মৌএর গলার হাড্ডি। ভাঙা। “
ডাক্তার বলেন–” খুব জোরে গলা টিপে ধরেছিল।”
বোকার মতো মৌএর মা উচ্চারণ করেন–“কেন ডাক্তারবাবু? ওর গলা কী দোষ করেছিল?”
নির্লিপ্ত ডাক্তার বলেন–“বুঝতে পারছেন না কেন? ওর মৃত্যু সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিল ওরা!”
কেউ বলে অলক্ষ্য থেকে আবার–“মা গো! আমার শরীরটা আর দেখিও না কাউকে! আর পারছি না মা!”
মা বলেন–“আমার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে! ঢেকে দিন ওর পেট! ওকে ঢেকে দিন! ওর যোনি ঢেকে দিন ডাক্তার!”
সোনালী রঙ, গোলাপী বা হলুদ অথবা নীল কিংবা যেখানে আছে যতো রঙ সব্বাই সেই পোস্ট মর্টেম দেখছে। বিরোধী পক্ষের দাবি মানতে বাধ্য সব্বাই! তাই ক্যামেরার সামনে হচ্ছে মেয়ের পোস্টমর্টেম! সমস্ত দুনিয়ার মানুষ তা দেখছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। গণতন্ত্র বলে কথা! এখানে ধর্ষিতার লজ্জা থাকতে পারেনা। ধর্ষিতার মান-সম্মান? হাসাবেন না তো মশায়! সব্বাই কেমন প্রতিবাদী বুঝতে পারছেন না? মসনদে আসীন রঙের বিরুদ্ধে এমন অকাট্য প্রমাণ আর পাওয়া যাবে না! সুতরাং আওয়াজ তোলো। আওয়াজ তোলো।
” উই ওয়াণ্ট জাস্টিস!”
মৌএর মা শোনেন–
“উই ওয়াণ্ট মসনদ!”
সমবেত আওয়াজ ওঠে আবার–
“দাবি এক, দাবি এক
পদত্যাগ, পদত্যাগ!”
মৌএর মা শোনেন–
“পেলাম সুযোগ ভাইরে!
মসনদ এবার চাইরে!”
দাবি চলতে থাকে। আই এ ভুয়ো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে ব্যস্ত থাকে।
আর ভিতরে ভিতরে যত ছিল রঙ তারা বাহারি স্বপ্ন দেখে। মৌদের তারা কেমন করে ধর্ষণ করবে তার প্ল্যান ছকতে থাকে! তারা সিংহাসনে বসে প্রথমেই কিছু স্তন আর যোনি ভোগ করতে চায়। আরও হিংস্র ভাবে! আরও কামড়ে, আঁচড়ে শরীরের খিদে মেটাতে চায়!
নইলে আর কীসের রাজা? ধর্ষকরা মনে মনে উৎফুল্ল হয়। এই যে রঙের খেলা, এই খেলাতেই তারা সারা জীবন মেয়েদের এভাবেই মেরে ফেলবে! তারা শুধু রঙ পাল্টাবে। আর কিচ্ছু না! রঙ পাল্টাতে পারলেই ইচ্ছেমতো যোনি আর স্তন ভোগ করা যাবে!
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!
সৃষ্টির শুরু থেকেই নারীকে ভোগ করা হচ্ছে। পুরুষেরাই এই অপকর্ম করছে!
আবার পুরুষেরাই তো রক্ষা করেছেন!
“ওগো বিদ্যাসাগর, দয়ার সাগর আমার! আর একবারটি এসো! আমাদের বাঁচাও! আমাদের সমাজ ভরে গেছে লিঙ্গ-প্রধান কাপুরুষতায়!”
কে বলল? কে বলল এ কথা? মা মেয়ের ছিন্নভিন্ন যোনির থেকে মুখ তুলে তাকান!
“মৌ, মা আমার! কোথায় তুই? মাগো!”
হাহাকার করে মাটিতে লুটিয়ে কাঁদতে থাকেন ধর্ষিতার মা।

Exit mobile version