নিখোঁজের চারদিন পর গুদারাঘাট থেকে মাইল দু’য়েক পশ্চিমে মাছ ধরতে গিয়ে ঋষিদাস মালো যখন মিয়াদের ধান ক্ষেতের হাঁটু পানিতে নিখিলের মরা দ্যাহোডা দেখতে পেল তখন সে জানতো না, কে এই হতভাইগ্যা; একবারের জন্যও তখন সে ভাবেনি এ্ই লাশ নিয়ে এত থানা-পুলিশ, এত এত কাইজ্জা আর মিছিল-মিটিং-মাইকিং হইবো, আর লাশটা প্রথম দেখার অপরাধে তাকে মাছ ধরা ফেলে দৌড়াইতে হইবো এমন সব জায়গায় যেখানে সে কোনদিন পা রাখবে এমন স্বপন সাতজম্মেও দেখেনি।
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি, বর্ষার পানি নামতে শুরু করেছে। গাঙের কিনারে আমন ধানের জমিতে জাল ঠেললেই কুচো চিঙড়ি ভরে ওঠে।
দুপুরের পর ঋষিদাস ঠেলা জালটা নিয়ে বেরিয়েছিল। ভগবানের কৃপায় মরা গাঙ এখনও তার কীট দিয়া ঋষিদাসরে বাঁচাইয়া রাখছে। জলের দেবতা বরুণ আর মাছের দেবতা মাকাল ঠাকুর এই অধমরে খালি হাতে ফিরায় না, কিছু না কিছু দেয়ই। তাই এই জাগ্রত দুই দেওতারে প্রণাম না সাইরা কখনো জলেই নামে না ঋষিদাস।
মরা গাঙের উজানে ঋষিদাসের একটা ভেসাল আছে, সেখানে মাছ ধরে রাতে। কাল রাতে ঝড়-বৃষ্টি ছিল বিধায় বউ তারে ভেসাল বাইতে নিষেধ করেছিল; শইলডাও জুতে ছিল না। ভিজা থাকতে থাকতে পায়ের তালুতে খোদাই করা শিল-পাটার মতো ছিদ্রছিদ্র হয়ে গেছে, পা-টা মরিচ লাগানোর মতো জ্বলছিল; শুনে ছেলেমেয়ে দুটো ঘুমানোর পর, ননীবালা তার পায়ের তালুতে চিটাগুড় আর হুঁকার পানির মিশ্রণ লাগিয়ে দিয়েছে। এই টোটকায় কাজ হয়, ননীবালা জানে, ছোটবেলায় সে তার বাবাকেও দেখেছে। তাছাড়া বৃষ্টি হলি যে সব মাছ জলের নিচি ঘাপটি মাইরা থাহে, চলাচল করে না, জালেও আসে না, সে কি আর ঋষিদাস বা ননীবালা না জানে?
ঠেলা জালটা ধানের গোড়া বাঁচিয়ে ঠেলতে ঠেলতে মরা দ্যাহোডা যখন ঋষিদাসের নজরে পড়ল, তহন পরথমে সে ভেবেছিল ওটা একটা শুশুক, বর্ষার সময় নদী থেকে পথ ভুলে কম জলে হান্দাইছে আর বারাইবার পারে নেই, মইরা পইরা আছে কিন্তু কাছে গিয়ে বুঝলো তার ধারণা আস্তাই ভুল। দ্যাহোডা মুনিষ্যির, ফুইল্যা গেছে, একটু একটু গন্ধও ছড়াইছে। উবুত হয়্যা পইড়াছিল তাই চেহারাটা বুঝতে পারেনি। জালের বাঁশ দিয়ে বেশ কসরত করে দ্যাহোডা যখন উল্টালো, তখনও বুঝতে পারল না মুনিষ্যিডা কে? নাক-নকশা ফুলে ঢোল, মুখটাও কেমন থেতলানো, জলের কীটে খাইছে কি না কে জানে!
ঋষিদাস একবার ভাবলো, যে মরে মরুক, রোজ দিন তো কত কত মানুষ মরে, আইজকাল কি আর মানুষের পরানের কানা-কড়িও দাম আছে? আমি মাছ ধইরব্যার আইছি, মাছ ধরি, বিকালের বাজারে কুচাগুলান বেইচা চাল কিনতি হবি। যা হয় হউক, আমার কী? ভগবান যে কেন আমারেই এসব দেখায়! মাফ করো ঠাকুর।
সেই যে আগের বার, তার ভেসালে উঠলো বাচ্চার মরা দ্যাহো, শ্যাষে জানাজানতি জানা গেল শিকদার বাড়ির ছেলে ঢাহাত্থন বেড়াইবার আইছিল, তাগেরই অভাইগ্যা ছাওয়ালডা পানিতি পইড়ছিল।
আরো কিছুক্ষণ দ্যাহোডার দিকে না তাকিয়ে, দ্যাহোডার থেকে আরো একটু সরে, আরো গভীর মনোযোগ দিয়ে জাল ঠেলতে লাগল ঋষিদাস। পরের দুই তিন খ্যাপ ভালই চিঙড়ি উঠল, সঙ্গে কিছু পুঁটি আর মলনদি জালের মধ্যে ফালাফালিও করল। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ঋষিদাস কি যেন ভাবল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মুনিষ্যডাও কি মরার আগে ইমুন ফালাইছিল? কপালের কাছে দুই হাত এক করে মাকাল ঠাকুরের উ্দ্দেশে একটা প্রণাম ছুঁড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আমার দুষ নিও না ঠাকুর; এইগুলান তুমার কীট, তুমিই আমারে দিছো, এই গুলান মুনিষ্যি না।
ঋষিদাস আবার যত্ন করে জাল ঠেলতে লাগল কিন্তু মনের খচখচি থামে না। একবার ভাবলো দ্যাহোডা টেনে হুগনায় নিয়ে যাবে কিন্তু তিনকোনা জালের বাঁশের ধাক্কায় নাড়াতে না পেরে বুঝল একার পক্ষে দ্যাহোডা সরানো যাইতো না, পাঁচ মুনি ওজন। শেষে খলুইয়ের দিকে চায়্যা না দেখলাম শতখানেক টাহার মাছ হইছে, তাই জল থেইক্যা উড্যা , হুগনা ধুতি বদলাইয়া, গামছাডারে কোমরে না বাইন্ধ্যা বাজারের দিকে মেলা করলাম।
ঋষিদাস যখন ঠেলা জালের বাঁশ দিয়ে দেহটাকে উল্টা করতে চেষ্টা করছিল, বাতাসের ভেতর ঘুরঘুর করা এক অপঘাত আত্মা তখনও স্বপ্নটা দেখছিল। স্বপ্নটা এই রকম।
রাহেলাদের বাড়ির পেছনে বাঁধানো পুকুর ঘাট; ঘাটলার ওপর ফজলি আমের ডালগুলো ঝুলে ঘাটলার অন্ধকারকে মিশ কালো করে তুলেছে। রাহেলাদের ঘরের কোনায় একটা লাইট আছে, তা থেকে এক টুকরো আলো তীরের মতো ছুটে আসছে কিন্তু কিছুতেই অন্ধকার ভেদ করতে পারছে না।
–সারাদিন একটা ফোনও দিলা না, আছিলা কই?
-তুমিও তো দিতে পারতা।
–আমার তো কাজ নেই। স্কুলের চাকরিতে যে কি কষ্ট, তুমি কি বুঝবা। বাচ্চাগুলা মাথা খেয়ে ফেলে। আজ আবার হেড স্যার বলল, ট্রেনিংয়ে পাঠাবে। তবে এবার ঢাকা না, ফরিদপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে।
–তুমি না গত বছর ট্রেনিং করে এলে। বাঁধানো সিঁড়িতে পাশাপাশি বসতে বসতে নিখিল প্রশ্ন করল রাহেলাকে।
–আবারও পাঠাবে।
–ট্রেনিংতো খুবই ভাল জিনিস। হাজার হলেও কালিমোহন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তুমি। ভালই হলো, তোমার ট্রেনিংয়ের সুবাদে আমারও গতবারের ট্রেনিংটা ঝালাই হয়ে যাবে। আগের বার পরীক্ষা কেমন দিছিলাম, কও দেখি সোনা পাখি? মনে আছে…।
–থাক, থাক, আর বলতে হবে না। নিখিল আরো কিছু বলতে চাইল কিন্তু রাহেলা থামিয়ে দিল। সে জানে নিখিল কি বলতে চাইছে। আগের বার ঢাকায় ট্রেনিংয়ের সময় তারা তিন দিন একসঙ্গে হোটেলে ছিল। নিখিলকে সুযোগ দিলে সে তিনদিনের খুঁটিনাটি বর্ণনা দেবে; আর সে বর্ণনা শুনে রাহেলার কান গরম হয়ে যাবে। তাই বর্ণনা শুরুর আগেই ওকে থামিয়ে দিল।
–শোন, চ্যাটার্জির গদিতে আজ পুজোর মিটিং ছিল। এবার কিন্তু চারদিনই তুমি আমার। বাড়ি থেকে বের হবে একা, সারাদিন ঘুরবো দোকলা, আবার রাতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো। তবে কথা দিচ্ছি অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
–কি আমার সাহসী পুরুষরে, রাতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে; তাও আবার আগেই বলে দিচ্ছে, অক্ষত অবস্থায়। ক্ষত হতে আমার আপত্তি আছে কে কোনদিন তোমাকে বলেছে? রাহেলা নিখিলের কণ্ঠস্বর নকল করে আরও বলল, কোন দিন যে স্কুল থেকে সোজা তোমার বাড়ি চলে আসছি, সে তুমি জানো না পাগলা।
–চলে আসো, না করছে কে? তবে তোমার বাপ-চাচার দায়িত্ব তোমার। লাঠি নিয়ে আসলে তুমি ঠেকাবে।
–আর আমার দায়িত্ব?
–সে তো সব সময়ই আমার। আর আমার দায়িত্ব কিন্তু চিরকালই তোমার, ভুলে যেও না। নেবে তো দায়িত্ব?
–নেব বলেই তো রাত বিরাতে ডাকলেও ঘাটলায় এসে বসি।
–যদি বুঝি দায়িত্ব নিতে গড়মসি করছো, তাইলে কিন্তু নিখিল হারিয়ে যাবে।
–আর একবার কথাটা বলে দেখ, আজই তোমাকে হারানোর বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
–বাপ-চাচার মত তুমিও কি লাঠিয়াল হয়ে উঠছো নাকি দিন কে দিন?
–লাঠিয়াল নই, তবে সাহসী। না হলে রাহেলা ভালবাসে নিখিলকে, তাও কি হয়?
তারপর আত্মাটা, যেটা তিন দিন আগেও নিখিলের ভেতরে ছিল, আবার স্বপ্ন দেখে, রাহেলাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে আছে। রাহেলার চুল থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে, ওর ঘাড়ে নাক ডুবাতে গিয়ে জরির কাজ করা ওড়নায় একটা খোঁচা খায়, তবুও নাকটা ডুবিয়েই রাখে।
ঠিক তখনই আমের ডাল থেকে একটা কত্থক ডাকল, পুকুরের পানিতে একটা ব্যাঙ ছরছর শব্দে ছুটে গেল। আত্মাটা রাহেলার ঠোঁটে একটা ছোট্ট চুমু খেল। লম্বা করে। রাহেলাও পুরে দিল তার ঠোঁট লিখিলের স্বাদের ভেতর। সময় গড়াল, আকাশে আরো খানিকটা অন্ধকার জমা হল, পুকুরের পানিতে বাসার আলোর ঝলক নিস্তেজ হয়ে উঠল।
রাহেলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
–এখন বাড়ি যাই, রাত হল। শুভ বিজয়া।
নিখিল আশ্চর্য হয়ে বলল, বল কি? পুজোই তো শুরু হল না, তার আগেই বিসর্জন দিয়ে দিলে?
–মানে কি? রাহেলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল নিখিলকে। নিজের ভুলটা তখনও ধরতে পারে নি।
–মানে হল, পুজো শুরুর আগে শুভ বিজয়া বলতে নেই, অমঙ্গল হয়।
–দুঃখিত, আমি তো জানতাম না। তুমি পুজোর মিটিংয়ের কথা বললে তাই ভাবলাম শুভ বিজয়া হয়তো বলা যায়।
–শোন বরনারী, শিখতে হবে আরো আনেক খানি। তবে তুমি শিক্ষিকা, শিখে যাবে। আর আমিও তোমারটা শিখে যাব। রাজি?
–রাজি তো সেই কবে থেকেই। তুমিই তো কিছু করছো না।
–এই তো আর ক’টা দিন। কেবল রসুন বুনেছি।
–তোমার রসুন পাকতে পাকতে অন্য কেউ যেন ছোঁ মেরে নিয়ে না যায়। রাজপুত্র এলে কিন্তু ঠেকানো যাবে না।
–এমন কোন রাজপুত্রের এখনো জন্ম তো হয়ই নি, এমন কি কোটাল পুত্রেরও জন্ম হয় নি। নিখিলকো হারানা মুশকিলই নেহি না মুমকিন হ্যায়। শাহরুখ খানের গলা নকল করে কথাটা বলে নিখিল হাসতে থাকে।
–দেখা যাবে। বলে রাহেলা নিখিলকে থামিয়ে দেয়।
–ঠিক আছে দেখা যাবে। এখন ঘরে যাও। কেউ দেখে ফেলবে। সাবধানে থেকো।
–তুমিও।
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকাল। সমেদ মাঝির গুদারায় গাঙ পার হতে হতে মাঝিকে ধানের ক্ষেতের মরা মুনিষ্যির দ্যাহোডার কথা বলল ঋষিদাস মালো। শুনে মাঝির চোখেমুখে প্রথমে খানিকটা ভয়ের ভাব জাগল; সেটা কাটিয়ে উঠে, কোমর বাঁকা করে লগিতে চাপ দিয়ে গুদারাটা জলে ভাসিয়ে, একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বুঝছো ঋষিদা, আইজকাল আর মাইনসের জানের এক আনাও দাম নাই, যেহানে সেহানে মানুষ মরে, রাস্তায় মরে, বাড়িত মরে, হাটে মরে, বিষ খাইয়া মরে, না খাইয়াও মরে। খালি পয়দা অয় আর মরে। মানুষ আর মানুষ নেই, সব ইঁদুর বিড়ালের সুমান; জম্মাইতেও সুমায় লাগে না, মরতেও না। কি আর করবা কও। জমানাটাই ইমুন। আল্লা মাফ করো।
আমরা দেখি, সমেদ মাঝি আর ঋষিদাস মালো গাঙ পার হওয়ার ঐ ছোট সময়টুকুতে একে অন্যকে আরো কিছু মনের কথা বলে, কি মাছ পেয়েছে তার খবর নেয় মাঝি, নিজেদের জীবন নিয়ে দু’জনেই আক্ষেপ করে, এমন দিনও যে তাদেরকে দেখতে হচ্ছে তার জন্য কপালকে দোষে, তারপর গুদারা থেকে নেমে ঋষিদাস খলুইটা হাতে ঝুলাতে ঝুলাতে মাছ বাজারের দিকে চলে যায় আর সমেদ মাঝি নতুন চড়নদার নিয়ে নদী পারাপার করে।
নদীটা ছোট; এতটাই ছোট যে কেউ তারে নাম ধরে ডাকে না। নামটাই ভুলে গেছে সবাই। খুব জোর বলে মরা গাঙ, যদিও লোকমুখে শোনা যায় একসময় নদীটা খুব দীর্ঘ আর খরস্রোতা ছিল, বড় বড় পানসি আসতো পাবনা-রাজশাহী থেকে। তখন সারা বছরই গুদারা লাগত পারাপারের জন্য, এখন কেবল বর্ষার কয় মাসই লাগে। শুকনার সময় সমেদ মাঝির গুদারাঘাটের কাজ থাকে না, তখন নিজের সামান্য জমিতে সবজি ফলায়, নইলে লক্ষ্মীকোল গ্রামে অন্যদের বাড়িতে ঘরামির কাজ করে। গ্রামের লোকের বাড়িতে পুরানো ছনের চালে নতুন ছন দেয়, বাঁশের নড়বড়ে খুঁটি বদলায়, পুকুর ঘাটে গাছের গুড়ি কেটে সিঁড়ি বানায়, পাতকুয়োয় নেমে পরিস্কার করে, কেউ মারা গেলে কবর খোঁড়ে, কারো চেহলাম হলে রান্নার জুগালিতেও লেগে পড়ে হারান বাবুর্চির সাথে।
নদীর এপারে লক্ষ্মীকোল গ্রাম, ওপারে রাজবাড়ি বাজার। নদী পার না হয়েও লক্ষ্মীকোল যাওয়া যায় কিন্তু সেটা অনেকখানি ঘুর পথ, বাঁধের রাস্তা। সে রাস্তায় রিক্সা চলে এমনকি গাড়িও যেতে পরে। গ্রামে যাদের মোটর সাইকেল আছে তারা সবাই বাঁধের রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করে। তবে বেশিরভাগ মানুষই গুদারাঘাট দিয়ে আসে যায়।
রাজবাড়ি বাজার থেকে লক্ষ্মীকোল যেতে এ পথটাই সবচেয়ে সহজ।
আগে সমেদ মাঝি একবার পার হলে আটআনা নিতো, এখন পোষায় না, তাই এক টাকা নেয়। তাও কতজন যে কত বাহানা করে; কারো কাছে ভাঙতি থাকে না, কারো এক টাকার জায়গায় লুঙ্গির খোঁটে মাত্র আট আনা থাকে, কারো বাজার করে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। তবুও সমেদ মাঝি কাউরে ফেরায় না, কটু কথাও বলে না, নদী পার করে দিয়ে বলে, আবার আসলে মনে করে নিজের থেইক্যা দিয়্যা যাইও। গাঙ কারো দেনা মনে রাহে না, আমি দাবি ছাইড়্যা দিলাম।
গাঙের ওপারে বলে বাজারের দিকের লোকেরা টিটকারি দিয়ে বলে, গ্রামটার নাম লক্ষ্মীকোল নয়, আসলে চর লক্ষ্মীকোল; চরের মানুষ মানে তো অশিক্ষিত, আনপড়, চাষাভুষা।
আদতে গ্রামের ছবিটা উল্টো। পুরো জেলার সবচেয়ে ভাল স্কুল অশ্বিনীকুমার উচ্চবিদ্যালয়, আর কালিমোহন স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দু’টোই ঐ গ্রামে। সরকারি না হয়েও স্কুল দুটোর খ্যাতি পুরো জেলা জুড়ে। প্রতি বছর শুধু জেলায় নয়, সারা দেশের মধ্যেই তাক লাগানো ফলাফল করে। শহরে নতুন আসা ডিসি এসপিদের ছেলেমেয়েরাও যায় ঐ স্কুলে। বেশ কয়েক ঘর সমর্থবান ব্যবসায়ী, যেমন সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি, হরিহর ঘোষাল, মাখন দত্ত, বাজারে যাদের বড়বড় গদি, তাদেরও বাস ঐ গ্রামে।
যদিও ভোটের সময় প্রতিবারই একটা ফুসফাস-ফিসফিস শোনা যায় যে এরা ভোটের পরেই ইন্ডিয়া চলে যাবে, সব ব্যবসা গুটিয়ে নিল বলে; কিন্তু তারা যায় না, বরং প্রতি বছর এই এলাকার সবচেয়ে বড় দুর্গাপুজো করে, কালিপুজোতেও ধুমধামের কমতি পড়ে না। দুই পুজোতেই সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির ঠাকুর দালানের সামনে মেলা বসে, গ্রামের বৌঝিরা সারা বছরের হাঁড়ি, কলস, মালসা, পিঠার ছাঁচ, ধামা, কুলা, টুকরি কেনে ঐ মেলা থেকেই।
চারদিন দিন আগের কথা।
সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির গদিতে এ বছরের দুর্গা পুজোর জন্য মিটিং বসেছে। এবার বারোয়ারি পুজোর কি হবে তাই নিয়ে মিটিং। সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জিই ডেকেছেন গ্রামের সবাইকে, প্রতি বছরই ডাকেন। হরিহর ঘোষাল আর মাখন দত্তকেও থাকতে বলেছিলেন কিন্তু বলার সময়ই সমীরেন্দ্র জানতেন, ওঁরা আসবেন না, বলার জন্য বলা আর কি; বারোয়ারি পুজো মানে তো অনেক টাকার ব্যাপার, ওঁদের না জানিয়ে করলে টাকায় টান পড়বে। সমীরেন্দ্র কাউকে রাগাতে চান না। বারোয়ারি পুজোয় তো বার রকমের মানুষ থাকবে, তাদের সবার মন জুগিয়েই কাজটা উঠিয়ে দিতে হবে দুগ্গা দুগ্গা বলে।
পুজো নিয়ে এসব আলোচনা সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির বাড়িতেও হতে পারে, তিনি ডাকলে তাঁর বাড়িতে যাবে না এমন লোক তামান লক্ষ্মীকোলে নেই কিন্তু প্রতি বছর গদি ঘরেই ডাকেন সবাইকে। মিটিংয়ে অনেক চ্যাঙড়া পোলাপান থাকে। ওগুলারে তিনি বাড়িতে ঢুকাতে চান না। কার মনে কি আছে কে জানে। সমীরেন্দ্রের স্ত্রী সরলাও চান না বাড়িতে এসব হুজ্জোত হোক। মেয়ে বড় হচ্ছে। এসব উটকো লোক ঢুকলে যদি কোন বিপদ ঘটে! সরলা দেবীর এককথা, বাইরের লোক বাইরেই থাকবে, বড়জোর ঠাকুর দালান পর্যন্ত আসবে, বৈঠকখানায় নয়।
সমীরেন্দ্র নিজের গলা খাঁকারি দিয়ে উপস্থিত সবাইকে বললেন, তাইলে আমরা মিটিং শুরু করি, কি বলেন আপনারা?
মিটিংয়ের শুরুতেই গ্রামের যুবকদের অবাক করে দিয়ে পুরুত মশাই বললেন, তোমরা জানো তো, এবার মহালয়ার ৩৫ দিন পরে দুর্গা পুজা হবে, অন্যবারের মতো ছয়দিন পরে নয়?
বয়স্কদের কেউ কেউ খুব অবাক হলেন না পুরুত মশায়ের কথায়, কারণ তাঁরা এমন ঘটনা আরো দু’একবার দেখেছেন, বিশেষ করে বাসুদেব ঠাকুর, যাঁর মাথা খুব ভাল, দিনক্ষণ খুব ভাল মনে রাখতে পারেন, অশ্বিনীকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন, নিঃসন্তান, বছর পাঁচেক আগে অবসর নিয়েছেন কিন্তু এখনও নিয়ম করে স্কুলে যান, কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তার ক্লাসে ঠেকা দেন। তিনি বললেন, এ আর নতুন কথা কি পুরুত মশাই, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে, এই ধরেন ১৯৮২ সালে আর ২০০১ সালেও এমন হয়েছিল।
পুরুত মশায়ের কথায় বিবেকানন্দ ক্লাবের ছেলেদের মধ্যে খানিকটা চোখ চাওয়াচাওয়ি হল, বিশেষ করে নিখিল একটু অবাক হল। সে ক্লাবের সভাপতি, বারোয়ারি পুজোর চাঁদা তোলা থেকে বিসর্জন সবই সে একা হাতে সামলায়। নিখিলই বাসুদেব ঠাকুরকে বলল, স্যার দুই হাজার এক সালে হলে তো আমার মনে থাকত কিন্তু আমার তো মনে নেই, আপনি ঠিক বলতেছেন তো?
বাসুদেব ঠাকুর একটু অপ্রস্তুত হলেন। এত বছর শিক্ষকতা করছেন, ইতিহাসের সব কিছু তার মাথায় তাজমহলের মার্বেলের মতো গাঁথা আর তাকেই কিনা এই ছোকরা বলে ঠিক বলছেন কি না? বাসুদেব ঠাকুরের মনে হল, কেউ যেন তার কর্তৃত্বকে, জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করছে। এটা তিনি কখনো নিতে পারেন না, এখনও পারলেন না। হাতের মুঠোটা শক্ত হয়ে গেল, যেন নিজের অজান্তেই মুঠোর ভেতর তাঁর পাকানো বেতের উপস্থিতি খুঁজলেন। ক্লাসের ভেতর হলে এতক্ষণ তিনি হামলে পড়তেন, তবে রে বাঁদর!
এখন তেমন কিছুই করলেন না।
এতক্ষণ মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে বসেছিলেন বাসুদেব ঠাকুর, বয়সের কারণেই হয়ত, বেশিক্ষণ ঘাড় সোজা রাখতে পারেন না কিন্তু আমরা দেখি এবার তিনি শিড়দাঁড়া খাড়া করে নিখিলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে, চোখের মোটা- কালো-গোলাকার চশমাটা নাকের ওপরের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, দেখ নিখিল ২০০৫ সালে তুমি সর্বশেষ স্কুলে পা রেখেছিলে; তার একশো ৮ বছর আগে আমাদের এক ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তারও একশো বছর আগে মানে ১৮১৩ সালে কোম্পানি বাহাদুর শিক্ষার উন্নয়নে বছরে এক লক্ষ টাকা খরচ করবেন বলে সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন কিন্তু আমাদের শিক্ষার কোন উন্নতি হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না! তোমার জানা উচিত বাসুদেব ঠাকুর না জেনে কথা বলে না। বয়স হয়েছে ঠিকই কিন্তু মাথায় তো জং পড়েনি, তাই যা বলি একটু মেনে নিও। তোমার বাবাও কিন্তু আমার ছাত্র ছিল, এখনো আমি কথা বললে, মাস্টার মশায় বলেছেন বলে সম্মান করে; ফেলে দেয় না।
নিখিল নিশ্চুপ। জবাব দিতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে সামলালো সে। সে জানে এর পর কিছু বললেই, মাস্টার মশাই স্কুলে তার হাতে কতগুলো বেত্রাঘাত করেছেন, কতবার নীল ডাউন করিয়েছেন, কতবার পড়া না পারার অপরাধে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন, তার একটা লম্বা-চওড়া হিসেব দেবেন, একেবারে দিন তারিখ সমেত। সে এক মহা অসম্মান। এর আগেও এমন ঘটনা দু’একবার হয়েছে, তাই নিখিল বাসুদেব স্যারকে ঘাঁটাতে চাইলো না, বিশেষ করে তার পার্টির অন্য ছেলেরা যেখানে আছে সেখানে তো এমন বোকামি সে করতেই পারে না।
সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি ঘাগু লোক, পা থেকে মাথা অব্দি ব্যবসায়ী, বাজার কমিটির সম্পাদক, পুজো কমিটিতে থাকবো না থাকবো না করেও প্রতি বছর সভাপতি পদে থাকেন; তার বাড়ির ঠাকুর দালানেই বারোয়ারি পুজোটা হয়।
বাসুদের ঠাকুর যেভাবে নিখিলকে আক্রমণ করলেন তা দেখে চ্যাটার্জি বুঝে ফেললেন বেখেয়াল হলেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবে। চ্যাংড়া পোলাপান, মাস্টার মশাইকে আপমান-টপমান করে বসতে পারে; তাই মিটিংয়ের রাশ নিজের হাতে নিয়ে বললেন, তোমরা সবাই শোন। আমি বলি কি, পুরুত মশায় একটু ছোট করে সবাইকে বুঝিয়ে বলুক এ বছর মহালয়ার ৩৫ দিন পরে কেন পুজো। তা ছাড়া এটাতো একটা জ্ঞানের কথাও, কি বলেন আপনারা সবাই। উপস্থিত বয়স্কদের দিকে তাকিয়ে যেন তাদের আনুমতি নিলেন, এমনভাবে সবাইকে বললেন সমীরেন্দ্র।
পুরুত মশায়ের দিকে আমাদের সবার চোখ। বাসুদেব ঠাকুরের মতো অত বয়স হয়নি তাঁর, তবে সব চুল সাদা, বসে যাওয়া চোয়াল, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, গায়ে একপ্রস্থ গাঢ় হলুদ রঙের নামাবলি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, ঘাড়ের কাছে কালচে হয়ে যাওয়া পৈতাটা গায়ের গেরুয়া রঙের ফতুয়ার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
পুরুত মশায় বার দুয়েক গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, পঞ্জিকা বলছে, মহালয়ার এক মাস বাদে দুর্গা পুজোর কারণ হলো, দুটি অমাবস্যাই একমাসে পড়েছে, আর তার জন্যই এবার পুজো একমাস পিছিয়ে আশ্বিনের জায়গায় কার্তিকে হবে; শাস্ত্রমতে একই মাসে দু’টো অমাবস্যা থাকলে তাকে মল মাস বলে।
ও পুরুত মশায়, বাসুদেব ঠাকুর পুরুত মশায়ের কথার মাঝখানে গলার স্বর উঁচু করে বললেন, এটাকে অধিকমাসও বলে, ছেলেদেরকে এ কথাটাও বলে দিন; আরও বলে দিন, পুজো এবার শরতে নয়, হবে হেমন্তে। তাই ‘শারদীয়া’ উৎসব হলেও তা আসলে হবে ‘হৈমন্তিক’৷ অবশ্য দুর্গা পুজো এক সময় বসন্তকালেও হতো, আশা করি এটা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না।
বাসুদেব ঠাকুর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি বাতাস বদলে যাওয়ার আগেই থামালেন। আহ হা বাসু দা, পুরুত মশায় বলছে বলুক না, উনি তো আর সব বলতে পারবেন না, যা বাদ পড়বে সেটা আপনি ওঁর পরে সবাইকে বলবেন, ঠিক আছে দাদা? বাসুদেব ঠাকুরকে থামিয়ে দিয়ে পুরুত মশায়ের দিকে তাকিয়ে চ্যাটার্জি বললেন, বাকিটা বলেন পুরুত মশায়।
বাসুদেব ঠাকুর সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির কথায় একটু আরাম পেলেন, আসলেই তো, পুরুত মশায় কি আর সব বলতে পারবে? আরাম পেয়ে ঘাড়টা আবার মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে যেমন সব কিছুর থেকে নিজেকে আড়াল করে কিন্তু সব কিছুর মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন, তেমনি আবার ঝুঁকে বসলেন।
সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির গদিঘরটা বেশ বড়। এটা আসলে তার অফিস ঘর। ব্যবসার মালপত্র শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো। এ শিক্ষাটা বাবার কাছে পেয়েছিলেন তিনি। বাবা বলতেন, মহাজনের সব ডিম কিন্তু এক জায়গায় রাখতে নেই। বিপদ আপদ তো বলা যায় না। এমন ভাবে সেগুলো রাখতে হয়, যেন একটা গেলেও আরেকটা থাকে। বাবার কথাটা সমীরেন্দ্র অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন। তাই স’মিল, তেলের কল, পাটের গুদাম, দু’টো ইলেকট্রনিক্সের দোকান করেছেন। শুধু চালের ব্যবসা নিয়েই পড়ে থাকেননি। সে সব ব্যবসা দেখাশুনার জন্য লোক আছে। চ্যাটার্জি তার গদিঘরের সাদা গদিতে বসে নরেন সরকারকে কাজে লাগিয়ে সব কিছুর নাড়ি ধরে থাকেন। বাবা নীরেন্দ্র চ্যাটার্জি তাকে শিখিয়েছিলেন, লোক দিয়ে ব্যবসা চালালে, লোকের নাড়ি ধরে থাকতে হয়, নাড়িতে পা দিয়ে রক্ত বন্ধ করে নয়; বাবার এ শিক্ষাটাও কোনদিন ভোলেননি সমীরেন্দ্র।
আমরা দেখি, সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ষাটোর্ধ্ব চ্যাটার্জি শাপলা ফুলের নকশা তোলা কাঠের বড় ক্যাশবাক্সের পেছনে বসে আছেন, আর নরেন সরকার তাঁর ডানপাশে। নরেনের সামনেও একটা সবেকি ক্যাশবাক্স, তবে আকারে চ্যাটার্জির বাক্সের থেকে ছোট। মেঝে থেকে তাদের দুজনের বসার জায়গা ফুট তিনেক উঁচুতে, অনেকটা নাটকের মঞ্চের মতো। সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির মাথার ঠিক পেছনে গণেশ আর লক্ষ্মী ঠাকুরের দুটো ছবি, ফ্রেমে বাঁধানো, কয়েকটা ফুল আর ধুপকাঠির পোড়া অংশ ফ্রেমের নিচের কাঠের ধুপদানিতে; নিজের হাতে চ্যাটার্জি সেগুলোতে প্রতিদিন ধুপকাঠি জ্বালেন। ঠাকুরের ছবিগুলো থেকে একটু দূরে তাঁর বাবা নীরেন্দ্র চ্যাটার্জির একটা বড় ছবি, তাতে ফুলের মালা পরানো, তবে ফুলটা আসল নয় প্লাস্টিক। এই গদি ঘরটা ওঁরই করা। সেই ছবিটার নিচে সমীরেন্দ্রের নিজের কয়েকটা ছবি, এমপি, মন্ত্রী বা বিশিষ্টজনের সঙ্গে তোলা, সেগুলোতে অবশ্য কোন ফুল বা ধুপকাঠি নেই।
উঁচু জায়গাটার সামনেই চেয়ারে সারি দিয়ে বসেছে বয়স্করা, আর ছেলে ছোকরারা পেছনে দাঁড়িয়ে। ওদের বসার জন্য কোন চেয়ার বা বেঞ্চ নেই। ওরা বসতেও চায় না। কারণ সামনে গিয়ে বসলে সিগারেটের নেশায় পেলে উঠে যাওয়া একটা ঝক্কি। তারে চেয়ে এই ভাল। কারো নজরে না পড়েও ঢোকা বা বেরুনে যায়।
নিখিলও বসার জন্য একটা চেয়ার পেয়েছিল কিন্তু বাসুদেব স্যারের সামনে চেয়ারে বসতে তার কেমন বাধো-বাধো লাগল, হাজার হলেও হাই-স্কুলে চার বছর পড়িয়েছেন, তা ছাড়া বিবেকানন্দ ক্লাবের বাকিরাও দাঁড়িয়ে আছে দেখে সেও দাঁড়িয়েই থাকলো।
আমরা দেখি পুরুত মশায় আবার বলতে শুরু করেন, তো মল মাস বা অধিকমাসে শুধু পুজোই নয় কোনও শুভ অনুষ্ঠানও করা যায় না। পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার পরই দুর্গাপুজো শুরু হবার নিয়ম কিন্তু এ বছর তা হচ্ছে না। কারণ, পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার পরই আশ্বিনে অধিকমাস বা মলমাস শুরু হচ্ছে। তাই মহালয়া থেকে মহাষষ্ঠী পর্যন্ত নিত্যপুজো চলিয়ে যেতে হবে, আর পঁয়ত্রিশ দিন পরে কার্তিকে হবে মা দুর্গার পুজো।
সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি আবার হাল ধরলেন। মিটিংয়ের এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ আর কারো হাতে চলে যাক তিনি তা চান না। বাসুদেব ঠাকুর বা বয়স্কগোত্রীয় কেউ, অথবা বিবেকানন্দ ক্লাবের চ্যাঙরা সদস্যরা কোন কিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই রচনা লেখার উপসংহারের মতো করে তিনি বললেন, সব তো শুনলে তোমরা, আপনারাও শুনলেন। এবার নিখিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তো কাল থেকেই তোমার বন্ধুদের নিয়ে চাঁদা তোলার কাজে লেগে পড়, রশিদ তো ছাপাই আছে, ওগুলোই শুরুতে কাজে লাগাও, লাগলে আবার ছাপিয়ে নেয়া যাবে। মহালয়া থেকে বোধন পর্যন্ত মাসখানেক সময় পাওয়ায় ভালই হল, কি বল, চাঁদা তোলার সময় বেশি পাওয়া যাবে। সনাতন পালকে আমিই বলে দেব ঠাকুর গড়ার কথা। তোমরা শুধু চাঁদার দিকটা দেখ, বাকি সব আমি দেখব।
রাতুল ধর এতক্ষণ কোন কথা বলেনি, আলোচনা শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, সামনের বছর সে নিখিলকে সরিয়ে পার্টির জেলা সভাপতির পদের জন্য লড়বে। নিখিলকে সরানোর জন্য সে সব কিছুই করতে তৈরি। তবে ওপরে ওপরে নিখিলকে দাদা দাদা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। যদিও তার বাড়ি লক্ষ্মীকোলে নয়, বিনোদপুরে, পুজো হয় লক্ষ্মীকোলে কিন্তু সেও তো পার্টিরই ছেলে। তারও তো কথা বলার অধিকার আছে। তা ছাড়া সব ফোরামেই তার উপস্থিতি জানান দরকার, বিশেষ করে সবাই যখন নিখিলকে পাত্তা দিচ্ছে, সেখানে তার মতামতটা অবশ্যই দেওয়া উচিত।
আমরা দেখি রাতুল গায়ের সবটা জোর গলায় ঢেলে বলল, পুরুত মশায়, আমাদের পার্টি ক্ষমতায়, এবার কিন্তু আমরা মহালয়ার দিনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দনীর রেকর্ডটা মন্দিরের মাইকে বাজাবো, আপনারা কি বলেন? এ বছর মহালয়ার তিথি শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টা ৩ মিনিট ৪১ সেকেন্ড থেকে। তখন থেকেই আমরা মাইকে চালাবো। দরকার পড়লে ওপরের দিকে আমিই যোগাযোগ করে রাখবো। কি বলেন?
কথার শেষের দিকে ‘ওপরের দিকে’ শব্দটায় রাতুল এমন কায়দা করে জোর দিল, যাতে সবাই বুঝলো ওপরে তার যোগাযোগটা কত শক্ত, কত লম্বা।
আমরা দেখি, রাতুলের প্রস্তাব শুনে পুরুত মশায় বাসুদেব ঠাকুরের দিকে তাকান, আর বাসুদেব ঠাকুর তাকান সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির দিকে, সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি তাকান নিখিলের দিকে; নিখিল মাথা নেড়ে বা মুখে হ্যাঁ-না কিছুই বলল না দেখে, চ্যাটার্জি আবার একটা চালাকিমাখা উত্তর দিলেন রাতুলকে, সে তো করাই যাবে রাতুল, তুমি ওপরে কথা বলে রেখো, আর রেকর্ডটাও রেডি রেখো।
–রেকর্ড না পেলেও সমস্যা নেই। এখন পুরোটাই ইউটিউবে পাওয়া যায়। ওখান থেকেই বাজাতে পারি।
–তা তো বাজানোই যাবে। তবে তোমাদের এই ইউটিউব-মিউব আমি বুঝি না, রেকর্ডটা পাওয়া গেলে ভাল। আর এখনও তো সময় আছে, তুমি খুঁজে দেখ, আর ওপরে কথা বলতে ভুলো না কিন্তু।
আলোচনা আরো কিছুক্ষণ চলল। তারপর ভাদু সাহার দোকানের চপ আর চা খেয়ে সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির গদিঘর থেকে বেরিয়ে নিখিল তার বন্ধুদের নিয়ে যখন বাড়ির দিকে রওনা দিল, তখন রাত দশটা প্রায়।
ভোর রাতে ঋষিদাস মালোকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ননীবালা খুব ভয় পায়, ভগবানকে ডাকে, ছেলেমেয়ে দু’টোকে আগলে ধরে ডাক ছেড়ে কাঁদে, যদিও পুলিশ বলে, থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেবে কিন্তু ননীবালার মন মানে না, মুখে যাই বলুক, পুলিশ তো, মেরেটেরে ফেলে যদি।
পুলিশ ঋষিদাসকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলে ননীবালার ডাক-কান্নাটা আরো বাড়ে। ছেলেমেয়ে দুটো কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ননীবালার গা ঘেঁষে থাকে।
অতো সকালে কি করবে কার কাছে যাবে ভেবে না পেয়ে শেষমেষ ছেলেমেয়ে দু’টোকে নিয়ে দৌড়ে যায় সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির বাড়ি।
সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জির দেখা পেতে অবশ্য প্রায় দশটা বেজে গেল। অতোক্ষণ ননীবালা বাবুদের বসার ঘরের বারান্দায় নীরবে কেঁদে গেল।
চ্যাটার্জি বাড়ির কাজের মেয়ে পদ্মা সকাল সকাল উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিল। গোবর লেপা চকচকে উঠোনে সতসত শব্দে ঝাড়ু দিতে দিতে বসার ঘরের বারান্দার কাছে আসতেই ননীবালাকে কাঁদতে দেখল। শলার ঝাড়ুটা হাতে নিয়েই কাছে এসে কি হয়েছে জানতে চাইল পদ্মা।
ননীবালা তাকে ঘটনাটা যতনা বলে তার চেয়ে বেশি ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। পদ্মা কি বুঝলো কে জানে, শুধু ননীবালার ছেলেমেয়ে দু’টোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কিন্তুক কাইন্দো না, মায়ের কাছেই থাইকো, আর কিছু লাগলি আমারে ডাইকো। খাইছো কিছু? খাড়াও আমার ঝাড়ু শেষ হইলে দিমুনি।
ননীবালার কাছে সব শুনে সমীরেন্দ্র বললেন, তুমি চিন্তা করো না ননী। ঋষিদাস তো খালি দেহটা দেখছে, আর তো কিছু না, তবে সে সমেদ মাঝিরে ঘটনাটা না বলে, আমারে গদিতে গিয়ে জানাইতে পারতো। সমেদ মাঝি কারে কি বলেছে কে জানে। তারপর গলায় আশ্বাসের সুর তুলে বললেন, শোন ননী, আমি গদিতে গিয়ে খোঁজ করি। তারপর তোমার বৌদিরে ফোন করে জানাবো, তুমি এখানেই থাকো।
সমীরেন্দ্রের কথার উত্তরে ননীবালা কিছুই বলল না, শুধু তার নীরব কান্নাটা নাকি কান্নায় পরিণত হল আর কাঁদতে কাঁদতেই সে বার কয়েক চ্যাটার্জির পা জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করল কিন্তু সমীরেন্দ্র সকাল সকাল ননীবালার ছোঁয়া বাঁচানোর জন্য দ্রুত পা সরিয়ে নিলেন।
ননীবালার সাথে কথা শেষ করে উঠে যেতে যেতে খানিকটা উঁচু গলায় পদ্মাকে ডেকে এই জেলে বউ আর তার ছেলেমেয়ে দুটোকে খাবার দিতে বললেন।
দুপুর গড়িয়ে গেলে সমীরেন্দ্রের স্ত্রী সরলা এসে ননীবালাকে খবরটা দিল। ঋষিদাস থানা থেকে সমীরেন্দ্রের গদিতে ফিরে এসেছে। তার বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। কোন ভয় নেই। পুলিশ খালি তারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এক নিশ্বাসে সব খবর ননীবালাকে দিয়ে সরলা বলল, বাড়ি ফিরে যাও ননীবালা। এখানে থাইক্যা কি করবা। চিন্তা কইরো না। তারপর একটু থেমে বলল, বাড়িতে কি খাবার দাবার কিছু আছে?
ননীবালা সেকথার কোন জবাব দিল না।
ননীবালা যখন বাড়ি ফিরল তখন তার কোঁচড়ে সেরখানেক চাল, কয়েকটা আলু আর দুটো কচুরমুখী। বাড়ি ফেরার সময় ননীবালা নিখিলদের বাড়ির পাশের খাল থেকে কতকগুলো কলমি শাক তুলে নিল, তারপর নিখিলদের বাড়িটা পেছনে ফেলে বাঁধের রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে ছুটলো।
আমরা দেখি, বাঁধের রাস্তা ধরে ছুটছে ননীবালা, পেছনে পেছনে ছুটছে ভয়ার্ত ছেলেমেয়ে দু’টো। পায়ের গতির সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে ননীবালার ডুরে শাড়িটা হাঁটু অব্দি উঠে আসছে বারবার, বুকের দিকে জড়ানো আঁচলটাও বাতাসে সরে সরে যাচ্ছিল। ছুটন্ত ননীবালা ঘুণাক্ষরেও জানল না, চারদিন আগের অন্ধকার রাতে এই পথটা ধরেই নিখিল একইভাবে ছুটে রাহেলাদের বাড়ির দিকে গিয়েছিল।
নিখিলের বন্ধু শফিক আর রমজানও ছিল পুজোর মিটিংয়ে, তবে তারা কোন কথা বলেনি, শুধু শুনেছে। পুজোর মিটিংয়ে তারা কথা বললে উপস্থিত অন্যেরা সেটা ভালভাবে নাও নিতে পারে। তাই চুপ করে ছিল, যদিও নিখিল আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, তারাও কথা বলতে পারে। বারোয়ারি পুজো, ওরাও তো অংশীদার।
নিখিলের কথাটা মিথ্যে নয়। লক্ষ্মীকোলের বারোয়ারি পুজোতে গ্রামের দু’ই একঘর ছাড়া সবাই আসে, প্রসাদ খায়, মেলা থেকে বাতাসা, গজা, মুরালি কেনে। মাটির পুতুল কেনে। বাঁশ বেতের জিনিস, মালসা, ঘড়া, কলস কেনে, রাতের বেলা ধুনুচি নাচ দেখে।
গদিঘর থেকে বেরিয়ে গুদারাঘাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শফিক নিখিলকে বলল, তোদের এত হুজ্জোত কিসের রে? পাল বাড়ি থেকে প্রতিমাগুলো তুলে এনে পুরুত মশায়কে বলবি, নমনম করতে, তা না, মহালয়া, অকালবোধন, মহিষাসুরমর্দিনী, যত সব হুজ্জোতি।
–তোদের রোজা নামাজ কি খালি খাড়াইয়া গেলেই হয়? হয় না, আমাদেরও হয় না।
–শালা সব কিছুতেই মোল্লা লাগে, পুরুত লাগে। রমজান পাশ থেকে বলে, বিয়েতে মোল্লা লাগে, মরলে লাগে, বাঁচলেও বার মাসে তের পার্বণে লাগে। মোল্লা আর পুরুতরা কি চালাক দেখ, এমন সিস্টেম করে রেখেছে যে তাদেরকে ছাড়া বাঁচা যাবে না, মরলেও মুক্তি নেই, তাদেরকে লাগবেই।
গুদারাঘাটের কাছে এসে তিন বন্ধু দেখল ঘাটে সমেদ মাঝির গুদারাটা নেই, তিনজনই একসঙ্গে খিচিয়ে উঠল। ধুস শাল। শফিক বলল, নে হইলো, খাড়া হয়্যা থাক এখন।
–কতক্ষণ যে আন্ধার ঘাটে খাড়াইয়া থাকতে হবে কে জানে। ঐ নিখিল তোর কাছে সিগারেট আছে? দে তো। রমজান সিগারেটের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
–আমার কাছে নেই, কাল রাত থেকে আজ সারাদিন একটাও খাই নাই। গত পরশু মা কালির দিব্যি কাটছি, আর খাবো না।
–কার কাছে দিব্যি কাটলি? রমজান জানতে চায়।
–জানোস তো, আবার জিগাস কেন?
–রাহেলার কাছে?
শফিকেরও বিশ্বাস হয় না। গলায় একটা অবিশ্বাস মিশিয়ে বলল, ভং করোস, নাকি সত্যিই খাস নেই সারাদিন?
–তুই যে সিগারেটখোর আতকা একটা দিন না খায়া পারলি? রমজান জিজ্ঞেস করল।
–মা কালির দিব্যি। সারাদিনে একটাও খাই নাই। চ্যাটার্জির গদিতে চায়ের পরে খুব মন চাইছিল কিন্তু তহনও খাই নাই; আসলে পকেটে নিয়াই বাইর হই নাই, খাবো কি?
নিখিলের উত্তরে রমজানের গলার স্বরটা মুহূর্তেই বদলে গেল। গলায় একটা তরলতা ফুটিয়ে সে বলল, তাইলে তো এখন একটা কাঠি খাইতেই হয় বন্ধু, আর কতক্ষণ সতী থাকবা।
–তোরাই আমারে নষ্ট করলি, আমি কত ভাল ছেলে ছিলাম, সেই ক্লাস এইটেই সিগ্রেট ধরাইয়া দিলি। তোরা কি আমার বন্ধু, নাকি শত্রুরে, সেকথা জাতি এই আন্ধার রাতে মরা গাঙের পারেও জানতে চায়। বক্তৃতার ঢঙে বলল নিখিল।
–তাইলে তো তোমার সতীপনা এখনই শেষ করতে হয়। শফিক খিকখিক করে হেসে বলল, আসো বন্ধু, এইখানে এই আন্ধারেই তোমার সতীচ্ছদ করি।
শফিক পকেট থেকে সিগারেট বের করে। তিনজনে একসঙ্গে সিগারেট ধরায়, লাইটারের আলোয় একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায় আর দুই ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে বেদম টানতে থাকে। তিনটা সিগারেটের কুণ্ডলিপাকানো সাদা ধোঁয়া কালো অন্ধকারের পেটের ভেতর হারিয়ে যায়।
সিগারেটে সুখ টান দিয়ে শফিক আবার খিস্তি ঝারে সমেদ মাঝির উদ্দেশে। ঐ পারে গুদারার বাতিটা হালকা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এখনো কেন আসছে না, বুড়াডা অকম্মা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ঠোঁটের সিগারেটটা আঙুলের ভেতরে রেখে মুখের দুই পাশে দুই হাত দিয়ে মাইকের মতো বানিয়ে শফিক চিৎকার করল, সমেদ চাচা গুদারাটা আনেন।
–ধুস শালা, বলে নিখিল পানির কাছে এগিয়ে গেল, তারপর জিপার খুলতে শুরু করল। তার দেখাদেখি শফিক আর রমজানও আসে। হিসু এমন এক জিনিস, দেখাদেখিতেও চাপে।
তিনজনে মরা গাঙের পানিতে হিসু করতে সারি দিয়ে দাঁড়ানোর পরই রমজানের মাথায় বুদ্ধিটা আসে, কি রে খেলবি নাকি, কাটাকাটি?
–আয়। নিখিল রমজানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে।
তিনজনে দাঁড়িয়ে হিসু দিয়ে কাটাকাটি খেলে, তারপর পাল্লা দেয় কারটা কতদূর যায়। সেই ছোট বেলার খেলা, এখনও ভোলেনি কেউ।
এ রকম অন্ধকার রাতে মরা গাঙের পারে গুদারার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেদের ভেতরকার ছেলেমানুষি বেরিয়ে এলো দেখে তারা তিনজনই খে খে করে হাসে।
–তোর তো শালা কাটা নাই, তোরটা যাবে না বেশি দূর, চামড়ায় আটকে যাবে। রমজান নিখিলকে খোঁচা দিল। নিখিল খোঁচাটা গায়ে না মেখে বলল,
–তোরা তো আগা কেটেই জোর কমিয়ে ফেলেছিস, আমারটা এখনো ইনট্যাক্ট। আয় দেখি, কার জোর কত।
শফিক অন্ধকারে সিগারেটটা জোরে একটা টান দিয়ে নিখিলকে লক্ষ করে বলল, ইনট্যাক্ট থাকলে জোর বেশি থাকে এই পরম সত্য তোমাকে কে বলল চান্দু? রাহেলা? নাকি অন্য কেউ? কিরে কথা কস না যে? নতুন কোন কাহিনি নাকি?
নিখিল সিগারেটের আলোতে আবছাভাবে শফিকের মুখটা দেখতে পেল কিন্তু তার প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। মনের সুখে হিসু করতে করতে একটা গানের কলি গুনগুন করে, ‘মন চাঙ্গা তো কাটরামে গঙ্গা’।
আমরা দেখি, অন্ধকারে তিনটা আগুনের বিন্দু। মাঝে মাঝে কোন একটা বিন্দু একটু বড় হচ্ছে, আবার কোনটা ছোট হয়ে যাচ্ছে, যখন আগুনের বিন্দুটা বড় হয়ে মুখের ওপর পড়ছে, তখন একটা মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে কিন্তু সে মুখটা কার তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
কাটাকাটি শেষ করে জিপার লাগাতে লাগাতে নিখিল বলল, শালা গত দশ বছর ধরে শুনছি এখানে ব্রিজ হবে; চুতিয়ার এমপি খালি টাকা মারে; ব্রিজটাই বানাতে পারল না। শুনছিলাম গত বছর টাকা আসবে কিন্তু ব্রিজের টাকা এলো না, আসলো বাজারের ড্রেনেজ মেরামতের টাকা।
–শোন নিখিল, এমপি-রে গালি দেস যা করস, সাবধানে দিস। রমজান নিখিলকে সাবধান করে দিয়ে বলল, তোর পোস্টের দিকে কিন্তু রাতুল ধরের নজর পড়ছে। সিস্টেম করে লিংক রাখিস সবখানে। পেছনে যাই কস, সামনে কিন্তু জি হুজুর কইতে ভুলিস না।
–তয় দোস্ত, শফিক দু’জনের কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, এই ব্রিজের টেন্ডার হলে আমাদের কিন্তু কামডা ধরতে হবে। বসন্তপুরের কামডা থেকে তিন পারসেন্ট দিছি এলজিইডি’র ইঞ্জিনিয়াররে, পাঁচ পার্সেন্ট এমপিরে, লাভের গুড় সব পিঁপড়ায় খাইছে। চোখ রাখিস, এই ব্রিজের টাকা আসলে কিন্তুক এক পয়সাও কাউরে দেব না। শালা পার্টির জন্য খাইটা মরি আমরা, আর ডিম খায় দারোগা বাবু। এই ব্রিজের বিল তুলে তিনজনে তিনটা মোটর সাইকেল কিনবো। এই চুতিয়ার মতো আন্ধার রাইতে খাড়াইয়া থাকতে হইবো না গুদারাঘাটে। বাঁধের রাস্তা দিয়ে একটানে বাড়ি।
ঘাটে দাঁড়িয়ে তিন বন্ধু সিগারেট ফোঁকে, এমপিকে গালাগাল দেয়, হাঁক ছেড়ে সমেদ মাঝিকে ডাকে, আর ভবিষ্যত উন্নতির স্বপ্ন দেখে।
নিখিল, শফিক আর রমজান তিনজনই কালিমোহন স্কুলে পড়েছে, তবে রমজান এক ক্লাস ওপরে ছিল, এখন অবশ্য আর এক বছরের ফারাকে কিছু এসে যায় না। নিখিল ক্লাস টেনের পরে আর স্কুলমুখো হয়নি, শফিক আইএ শেষ করে কিছুদিন এদিক সেদিক করেছে, সুবিধা করতে না পেরে নিখিল আর রমজানকে নিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসায় থিতু হয়েছে। রাতুলকেও রাখতে চেয়েছিল কিন্তু নিখিল আপত্তি করায় তাকে শেষ পর্যন্ত রাখেনি। যদিও পার্টির ছেলে কিন্তু রাতুলের স্বভাব ভাল না, নিখিল বলেছে, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চায়, এই অভ্যাসটা আমার মোটেও পছন্দ না।
রাজনীতিটা তাদের ঠিকাদারি ব্যবসার পুঁজি। এমপিকে যতই গালাগাল করুক, কাজতো সেই-ই দেয়। তার কাছেই তো সব তদবির নিয়ে যায় নিখিল। পার্টির কাজে কখনও পিছপা হয় না, জান দিয়ে খাটে, ভোটের রাজনীতিতে যা যা দরকার, সবই করে তিন বন্ধু মিলে; তারাই তো দেশের উন্নয়নের প্রকৃত অংশীদার, সাধারণ মানুষকে সেবা করতে পারে, চুরিচুট্টামি হলেও কিছু কাজ তো হয়।
ক’দিন আগেই তো এমপি’কে ধরে সুরবালা রাজবংশীকে একটা বয়স্কভাতা কার্ড করে দিয়েছে নিখিল। বেচারি একলা এক বাড়িতে থাকে, তিনকুলে তার কেউ নেই। তিন বিঘার ওপর বাড়ি, আম কাঁঠালের বাগানে ঘেরা। অনেকের কুনজর আছে বাড়িটার ওপর। কামরুজ্জামান, সমীরেন্দ্র, মাখন দত্ত ছাড়াও আরো কয়েকজনের নাম জানে নিখিল, কোন রকম বুড়ি চিতায় উঠলে বাড়ির ওপর হামলে পড়বে।
সুরবালাকে কাল একবার দেখে আসব, মনে মনে ভাবল নিখিল। দেখতে গেলে বুড়ি গাছের কলা, আম, যখন যা থাকে নিখিলকে দেয় আর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে, রাধে-মোহন তোমার মঙ্গল করবেন। আমি মরলি এই জায়গাখান তোমারে দিয়্যা যাব। তুমি দেইহ্যা রাইখপ্যার পারবা না?
–আমারে দেওয়া লাগবি না। তুমি বাঁইচা থাহো।
–আর বাঁচা, ঠাকুর তুইল্যা নিলিই বাঁচি।
সুরবালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে প্রতিবারই নিখিলের মন খারাপ হয়। সবাই একে একে চলে গেছে, বুড়িটাই কেবল সব আগলে আছে। কেউ নেই, তবু গাছগুলোর জন্য, উঠোনের তুলসি তলাটার জন্য, বাঁশঝাড়ের নতুন গজানো বাঁশটার জন্য বুড়ির এখনো কত যে মায়া!
সুরবালার বয়স্কভাতা কার্ড ছাড়াও, কালিমোহন প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠের জন্য এমপি’কে ধরে কিছু গম এনে দিয়েছে। সে গমের টাকায় স্কুলের মাঠটা এখন বেশ সবুজ; রোদের নিচে যখন বুক চিতিয়ে মাঠটা শুয়ে থাকে আর স্কুলের ছেলেমেয়েরা তার ওপরে হাসিমুখে দৌড়াদৌড়ি করে, তখন নিখিলের খুব ভাল লাগে। পড়াশুনা করেনি বলে মনে একটা কষ্ট ছিল নিখিলের, কিন্তু স্কুলের নতুন মাঠটা দেখলে তার খুব আনন্দ হয়, লেখাপড়া না করার কষ্টটা খানিকটা কমে।
সমেদ মাঝির গুদারাটা ঘাটে ভিড়তেই নিখিলের দেখাদেখি রমজান আর শফিকও লাফিয়ে পাটায় ওঠে। সমেদ মাঝি শক্ত করে লগিটা ধরে ছিল, তাই কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না। ঘোড়ার মতো লাফিয়ে ওঠা দেখে মাঝি বলল, বাবা নিখিল, গুদারাটা ভাইঙ্গো না, আমার আর কিছু নাই, ইডা দিয়্যাই আমার প্যাট চলে। গুদারার খোলডা পুরান হয়্যা গিছে। তোমাগের মতো জুয়্যানমর্দ পোলা লাফ দিলি তো নতুন গুদারাও ভাইঙ্গা যাবি।
নিখিল সমেদ মাঝিকে আশ্বস্ত করে বলে, সমেদ চাচা আপনারে আগামী ভোটের আগে আমি একটা নতুন গুদারা বানায়া দেব, চিন্তা কইরেন না। খালি ভোটটা আমার দলে দিয়েন।
–কবে ভুট? আইয়া পইড়ল নাহি?
–এইতো আইলো আইলো বইলা। যখন আসবি আমি আপনারে মনে করা দিবানি।
–চাচা সারাদিনে কয় খ্যাপ মারলেন, আইজক্যা পোষাইবো? রমজান সিগারেটে শেষ টান দিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মেরে মাঝিরে জিজ্ঞেস করে।
–এই কোন রহম আর কি? তয় বাবা এটা কতা হুনলাম। গুদারাঘাট নাহি বোশ্যাখ মাসে নিলামে উঠপি? তাইলে তো আমার প্যাটে লাত্থি।
সমেদ মাঝির কথায় তিনজনেই অবাক হয়। এটা তাদের কাছে নতুন সংবাদ। এই ঘাটও নিলামে উঠবে? কই কিছুই তো তারা শোনেনি। এমপি সাহেবও তো কিছু বলেনি।
–কে কইলো আপনারে চাচা? নিখিল জানতে চাইল।
–কামরুজ্জামান সাহেব কইল।
নৌকার টিমটিমে হারিকেনের আলোয় তিন বন্ধু একে অন্যের দিকে তাকায়। কামরুজ্জামান মানে রাহেলার চাচা। লোকটা সুবিধার না সেটা লক্ষ্মীকোলের সবাই জানে। অন্য দল করে, সুযোগ পেলেই হিন্দুদের জমি দখলের মতলব করে। সুরবালার বাড়ির দিকে শকুনের মতো ওঁত পেতে আছে, বুড়ি মরলেই নখ ঢুকিয়ে দেবে।
শুধু জমিই না, প্রতি বছর পুজার সময় একটা না একটা হুজ্জোত বাধায়ই। রাহেলার চাচা না হলে এর মধ্যেই একটা ডলা দিয়ে দিত সবাই মিলে। গত বছরও পুজোর সময় মাইক বাজানো নিয়ে, আরতির সময় ঢাক বাজানো নিয়ে, মহা ঝামেলা করেছিল। বলে কি না, সন্ধ্যা আরতি করতে দেবে না, সেটা নামাজের সময়। আরে তোর নামাজ তুই পড়। শেষ পর্যন্ত এমপি’কে বলে মন্দিরে অতিরিক্ত পুলিশ বসাতে হয়েছিল।
–নে নিখিল, তোর চাচা শ্বশুর, তুই সামলা। রমজানের খোঁচাটা বোঝে নিখিল। রমজানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সমেদ মাঝিকে আশ্বস্ত করে নিখিল বলল,
–আপনি কোন চিন্তা কইরেন না চাচা, এই ঘাটে আপনি ছাড়া আর কেউ গুদারা ভিড়াইতে পারব না। আমরা আছি, মইরা তো যাই নাই। আপনারে নতুন একখান ছইওয়ালা গুদারা না বানাইয়া দিয়া আমি কোথাও যাইতাছি না।
গুদারাঘাট থেকে পাড়ে উঠতেই যে রাস্তাটা পূর্ব-পশ্চিম বরাবর লম্বালম্বি চলে গেছে, গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িই ঐ রাস্তার দুই পাশে। রাস্তায় উঠে বাম দিকে প্রথমে নিখিলদের বাড়ি, তার পরে একটা খাল, খালটা নিখিলদেরই; খাল পার হলে রমজানদের বাড়ি, সেটা ডান দিকে রেখে দু’টো বাড়ি পরই শফিকদের বাড়ি। পুব দিকে মাইল খানেক হেঁটে গেলে গ্রামের শেষ মাথায় অশ্বিনীকুমার হাইস্কুল, আর পশ্চিম দিকে কালিমোহন স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অশ্বিনীকুমারের সামনে দিয়ে রাস্তাটা বাঁক খেয়েই সোজা রাজবাড়ি সদরের দিকে চলে গেছে।
বর্ষার সময় মাঝে মাঝে জল উঠে পড়ে বলে রাস্তাটা বেশ উঁচু, বাড়িগুলোও। সবগুলো বাড়িতেই রাস্তা থেকে নেমে বেশ খানিকটা হেঁটে তবে ভিতরে ঢুকতে হয়।
মরা গাঙটা যখন জীবিত ছিল তখন এই রাস্তাটা ছিল বাঁধ। নদী মরে গেলে খোয়া ফেলে রাস্তা তৈরি হয়েছে। এ জন্য লক্ষ্মীকোলের সবাই বলে বাঁধের রাস্তা।
গুদারাঘাট থেকে বাঁধের রাস্তায় উঠে নিখিল রমজানকে বলল, আমি একটু হয়ে আসি তোরা যা। বাড়ি ঢুকার আগে মা’কে একটু বলে যাইস, আমি আসতেছি। আমার ঘরে খাবার রেখে দিতে বলিস।
–পেট ভইরা খাইয়া আসিস। তাইলে তো আর বাড়িত গিয়া খাইতে অয় না।
কথাটার ইঙ্গিত তিনজনেই বোঝে, তবে নিখিল কোন জবাব দেয় না। শফিক আর রমজান খিকখিক করে হাসে। যদিও সে হাসি নিখিলের কান অব্দি পৌঁছায় না কারণ ততক্ষণে সে পশ্চিম দিকের অন্ধকার রাস্তা ধরে প্রায় ছুটতে শুরু করেছে।
মিছিলের সামনে এমপি সাহেবের পাশেই ঋষিদাস মালো; ঠিক পেছনে শফিক আর রমজান। সামনের সারির সবাই হাতে হাত রেখে শিকল তৈরি করেছে।
রাজবাড়ি বাজারের প্রধান সড়ক কেঁপে কেঁপে উঠছে শ্লোগানে।
‘নিখিলের রক্ত বৃথা যেতে যেতে দেব না।’ ‘আমার ভাই মরলো কেন, জবাব চাই, জবাব চাই।’
এত শব্দ ঋষিদাস কখনো শোনে না, এত লোকও সচরাচর সে দেখে না। ঋষিদাস শব্দ শোনে জলের, বাতাসের, মাছের লাফানির। সে রাত জেগে মাছ ধরে, একা একা। রাত গভীর হলে মাথার ওপর দিয়ে ডানায় শব্দ তুলে গেছো বাদুর উড়ে যায় পাকা ফলের খোঁজে। একটা দুটো মাছ ছপাত ছপাত শব্দ করে ভেঁসালের ভেতর থেকে ছুটে পালাবার চেষ্টা করে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাঝে মাঝে তার হুঁকা থেকে গুড়গুড় শব্দ ওঠে।
ঋষিদাস জেগে থাকে মাছের আশায় আর ভারায় বাঁধা বাঁশটায় ঝুলে থাকে টিমটিমে হারিকেনটা।
ঋষিদাস নীরবতাকে অনুবাদ করতে পারে। কখন ভেসালের ভেতর মাছ এসে কুটকুট করে জালটা কাটতে চেষ্টা করে, কখন একটা বড় মাছ একটা ছোট মাছকে কপাত করে গিলে খায়।
সেই ঋষিদাসের কাছে এই রাজনীতিক মিছিলের শব্দ বড় বেশি কড়া, কানে লাগে তার, কানে ধাপা লেগে যাবার উপক্রম হয়।
ঋষিদাসই আজকের মিছিলের মধ্যমণি। সে-ই নিখিলের মৃতদেহ প্রথম দেখেছে। সন্দেহভাজন হত্যাকারী কে হতে পারে, তারও একমাত্র সাক্ষী সে। সুতরাং এমপি সাহেব তাকে বাড়ি যেতে না দিয়ে মিছিলে নিয়ে এসেছেন। সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। হেনা চত্বর থেকে মিছিল শুরুর আগে একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিয়েছেন, সেখানে ঋষিদাসকে নিয়ে অনেক কিছুই বলেছেন এমপি সাহেব। তবে এমপি সাহেবের বক্তৃতার বেশিরভাগই সে বোঝেনি। যতবারই তার নাম বলেছেন এমপি সাহেব ততবারই সে কান খাড়া করে বুঝতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু মাইকের তীব্র শব্দে তার মাথা কেমন গোলমাল হয়ে যায়, তাতেই নিজের নাম ছাড়া এমপি সাহেবের বক্তৃতার কিছুই ঋষিদাস মালো শুনতে ও বুঝতে পারল না।
আবার মিছিল থেকে শব্দ, তীব্র শ্লোগান ওঠে, ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো, ‘নিখিলের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ ‘আমার ভাই মরলো কেন, জবাব চাই, জবাব চাই।’
ঋষিদাসের কানে এবার সত্যি সত্যি তালা লেগে যায়। এমপি সাহেব এতক্ষণ তার হাত ধরে ছিলেন। মিছিলের সামনে থেকে যেন তাকে শহরের সবাই দেখতে পায়, এমনভাবে।
মিছিলের সামনের সারিতে হাঁটতে গিয়ে ঋষিদাসের কেমন বেখাপ্পা লাগে। সবার কেমন ধোপদুরস্ত পোশাক। তারই কেবল হাঁটুর ওপরে ওঠা লুঙ্গি, আর ঘাড়ে ঝালকাঠির ঘাম জবজবে লাল গামছা।
মিছিলের তোড় খানিকটা বাড়ল। সবাই পেছন থেকে আরো জোরে শ্লোগান দিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। এমপি সাহেবের সঙ্গে কিছুতেই আর তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারল না ঋষিদাস। নিজের হাতটা এমপি সাহেবের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল।
এমপি সাহেব তার হাত ছেড়ে দেবার পর মিছিলের অনেকগুলো দাপানো পা গলে, এক ঝাঁক উচ্চৈস্বরে চিৎকাররত মানুষের কণ্ঠস্বর এড়িয়ে, কনুইয়ের ধাক্কা সহ্য করে মিছিলের পেছনে চলে এল ঋষিদাস।
ঋষিদাস এখন সবার পেছনে। মিছিল তাকে পেছনে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কাপড় বাজারের দিকে। ওখানেই কামরুজ্জামানের দোকান। উত্তেজিত মিছিলটা সেদিকেই যাচ্ছে।
মিছিলের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ঋষিদাস ভাবে এই হুজ্জোতের মধ্যে সে কি করছে? সে জানে না খুনি। সে শুধু জানে, তার বাড়ি ফেরা দরকার। দিনটা গেছে, সন্ধ্যা থেকে ভেসাল না বাইলে কাল তার বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না।
ঋষিদাস মিছিলের পেছনে হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর তাকে ছাড়িয়ে, পেছনে ফেলে, ধাক্কা দিয়ে পেছনের মানুষগুলো পড়িমরি করে এগিয়ে গেল।
স্থানীয় সাংবাদিকরা সামনের দিক থেকে মিছিলের ছবি তুলছে, তাই এই পড়িমরি অবস্থা।
থানা থেকে দুপুরের পরই ঋষিদাস মালোকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি। তারপর গদিতে ঘণ্টাখানেক বসিয়ে রাখল। হোটেল থেকে খাবারও আনিয়ে দিল। ঋষিদাস গায়ের গামছাটা গদিঘরের মেঝেতে বিছিয়ে সাদা ভাতের সাথে বেগুন ভাজি আর ছোলার ডাল মেখে আরাম করে খেতে বসল। তবে খেতে খেতে পোলা মাইয়াডার জুন্যি তার একটু বাধো বাধো লাগছিল। কত্তারে সে একবার বলেই ফেলল, খাবারটা সে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কত্তা তাকে বলল, তুমি পেট ভইরা খাও ঋষি। আইজ সারাদিন তোমার অনেক কাম। তোমার পোলা মাইয়ারা আমাগের বাড়িতে খাইছে। চিন্তা কইরো না। তুমি খাও।
জে কত্তা। বলেই মুখের ভেতর ভাতের দলা পুরে চোখটা আধো বন্ধ করে চাবাতে চাবাতে একটু হাসল। ডাইলড্যা বড় স্বাদ। ভাতডাও। বাড়িতে তো মোটা চাইলের ভাত। আর এইডা সরু চাইল। ভাতের ঘ্রাণডাও আলাদা।
ঋষিদাসকে গদিঘরে বসিয়ে রেখে কোথায় কোথায় ফোন করল সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি। থানায় কি কি জিজ্ঞেস করল পুলিশ, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানল। ঋষিদাস আবার তার কাহিনিটা পুলিশকে যেভাবে বলেছিল, একইভাবে সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে বলে। ‘বাড়িতি চাইল ছিল না। আমি মিয়াগরে ধানের ক্ষেতে কুইচ্যা চিংড়ি ধরব্যার গিছিলাম…।
সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি সাদা গদির ওপর বসে, ক্যাশবাক্সের ওপার থেকেই খুব মনোযোগ দিয়ে শোনেন পুরোটা।
ঋষিদাসের কাহিনি শেষ হলে সমীরেন্দ্র চ্যাটার্জি ক্যাশবাক্সের ওপার থেকে কাছে এসে একটা চেয়ারে বসে বলল, তুই ঠিকই কইছস ঋষি, তয় এমপি সাবরে আরেকট কথা বলতি হবে। তুই কবি, আগের রাতে তুই কামরুজ্জামানরে তোর ভেসালের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখছিস। আর কিছু না, এইটুকুই।
–কত্তা আমি তো তারে দেহি নেই।
–আরে বোকা, তুই দেখছিস, তুই এখন মনে করতি পারতিছিস না। আমি তোরে মনে করাই দিলাম।
ঋষিদাসকে সব বুঝিয়ে নিজের মোটর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে সমীরেন্দ্র তাকে নিয়ে গেল এমপি সাহেবের বাড়িতে।
সেখানেও ঋষিদাস তার কাহিনির পুরোটা বলে একই রকমভাবে, ‘বাড়িতি চাইল ছিল না। আমি মিয়াগরে ধানের ক্ষেতে কুইচ্যা চিংড়ি ধরব্যার গিছিলাম…। তবে এবার সে সঙ্গে এটাও জুড়ে দিল যে নিখিল যেদিন থেকে নিঁখোজ সেই রাতে কামরুজ্জামানরে তার ভেসালের কাছে সে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছে।
এমপি সাহেবও সমীরেন্দ্রের মতো খুব মনোযোগ দিয়ে বৃত্তান্তটা শুনল। তারপর গলাটা একটু উঁচু করে বলল, তুমি অন্ধকার রাতে কী করে চিনলে যে ওটা কামরুজ্জামান ছিল?
এ প্রশ্নে ঋষিদাস ঘাবড়ে গেল। কত্তা তো তারে এই কথাটা শিখায় দেয় নাই। সে ভেবে পেল না উত্তরে কি বলবে। তাকে কেমন দিশেহারা মনে হয়। সেই অবস্থা থেকে সমীরেন্দ্রই তাকে উদ্ধার করল, কেন ঋষি তুমি যে আমারে কলে, কামরুজ্জামান তোমার ভেসাল থেকে মাছ কিনার জন্যি তোমারে ডাকিছিল, আর তুমি হারিকেন নিয়ে ভারা থেকে নেমি তারে কল্যা যে সকালের আগে তুমি মাছ বেচবা না। এমপি সাবরে সেই কথাডাও কও। আমারে তুমি যা যা কইছো সব কও।
সমীরেন্দ্রের কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয় ঋষি। মুখে কোন কথা বলে না।
সে কিছুতেই বুঝতে পারে না, এখানে সে কি করছে। সে তো কোন দোষ করেনি। সে যখন দ্যাহোডা দেখেছে তখন তো সে জানতোও না সিডা কার দ্যাহো। তার তো এখন সমীরেন্দ্রের গদিঘরে থাকার কথা নয়। এমপি সাহেবের চকচকে ঘরে ফ্যানের নিচে থাকার কথা নয়। এখন তার থাকার কথা মিয়াদের ধানের ক্ষেতে, ঠেলা জালটা নিয়ে। সকালের দিকে একটু ইলশেগুড়ি বৃষ্টি হয়েছে, এরকম দিনে ছোট মাছগুলো ওপরে উঠে আসে। ঠেলা জালটা পানির নিচে দিলেই মাকাল ঠাকুর কৃপা করেন।
মিছিল শেষ হওয়ার আগেই ঋষিদাস বাড়ির দিকে রওনা দিল। দিনডা তার নষ্ট হইছে। রাইতে ভেসাল না বাইলে কাইল সবাই মিলে ভুকা থাকা লাগবি।
সেদিন রাতেই কামরুজ্জামানের দোকানের সব মালামাল লুট হয়ে গেল, আগুন লেগে দোকানের খানিকটা পুড়েও গেল।
পরদিন তাকে আর লক্ষ্মীকোল গ্রামে কেউ দেখতে পেল না।
তবে যে রাতে কামরুজ্জামানের দোকানে আগুন লাগল, সে রাতেই আগুনে পুড়ে গেল সুরবালার বাড়ি। গ্রামের লোকজন আগুন নিভিয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরের ভেতর থেকে একটা কয়লা দেহ বের করে আনল।
তবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারল না, ওটা সত্যিই সুরবালার দেহ কি না।
লক্ষ্মীকোলে দুর্গা পুজোর সাজ সাজ রব পড়ে গেল। নদী পাড় হওয়া লোকের সংখ্যাও বাড়তে শুরু করল। সমেদ মাঝি গুদারা পার করে আর যাত্রীদেরকে বলে, শেষবারের মতো নিখিলের সঙ্গে তার কি কথা হয়েছিল। একই কাহিনি। কোন কিছু বাদ না দিয়েই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে। আর বৃত্তান্ত শেষ করে বলে, ছাওয়ালডা খুব ভাল ছিল, ভুটের আগে আমারে একখান নৌকা বানাইয়া দিবার চাইছিল। তয় দিব্যার পারল না। সবই আল্লার ইচ্ছা।
নিখিল না থাকলেও লক্ষ্মীকোল গ্রামে পুজোর জৌলুস একটুও কমল না। সবাই আর সব বছরের মতো মন্দিরে গেল, ঠাকুর ভোগ খেল, আরতি খেলা, ধুনুচি নাচ দেখল, মহালয়ার সময় মাইকে বীরেন্দ্র ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী বাজানো হল। রাতুলই ওপরের দিকে কথা বলে সব ব্যবস্থা করেছিল।
রাহেলাও আগের মতো স্কুলে যেতে শুরু করল। এমনকি ফরিদপুর থেকে সে বিজ্ঞান-শিক্ষা বিষয়ে ট্রেনিংও শেষ করে এল।
শুধু ঋষিদাস মালো, ননীবালা আর তাদের ছেলেমেয়ে দু’টো চ্যাটার্জি বাড়ির মন্দিরে ঠাকুর দর্শনে গেল না। ননীবালা অনেকটা জোর করেই হাঁটুর ওপরে ধুতি পরা ঋষিদাস মালো আর তাদের আদুল গায়ের ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে গুদারা ঘাটের দিকে রওনা দিল। ননীবালা সবাইকে নিয়ে যাবে তার বাপের বাড়ির গ্রামে। তার বাপের বাড়ির গ্রামের নাম জীবন নগর।