দোস্তি
চাষারার শীতলক্ষ্যা পাড়ের পাকা ঘরটিতে ওরা চারজন। ভাদাইম্যা নুরু, বোতল মিজান, শহীদ মস্তান আর বোমা হামিদ। নদীচরা দখল করে ভাদাইম্যা নুরুই ঘরটি তুলেছে। ওরা চার দোস্ত মাঝেমধ্যেই আড্ডা দেয় এই বাড়িটিতে।
রাত প্রায় এগারোটা। তিন তাসের সাথে হুইস্কি পার্টি। স্মার্ট-টিভিতে চলছে বাংলাদেশী পর্ণ। বেশ জমজমাট মচ্ছব। হঠাৎ নুরুর মোবাইল বেজে ওঠে। বিগ বসের নম্বর। ‘অ্যাই হালার পুত, টিভিটা বন্ধ কর, বস ফোন দিছে…’ মিজান টিভি স্টিল করে রাখে।
নুরুর দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা তিনজন। বস কী বলছে ওরা ঠাওর করতে পারছে না। কথা শেষে নুরুই শহীদ আর হামিদকে বলে, ‘বসের অর্ডার, আজ রাতেই করতে হইবো অপারেশন। তোরা দুইজন আমার লগে থাকবি।’ এ অপারেশনে থাকতে হবে না ভেবে মিজান খুশিই হয়। আজ বউ স্পেশাল খাবার বানিয়েছে, বউকে বলেও এসেছে ওরা চারজন খাবে আজ রাতে। ও নুরুকে বলে, ‘অপারেশন কয়টায়? তার আগে চল্ আমার ঘরত। খাইয়া আসি।’ নুরু কোনো জবাব না দিয়ে মিজানের দিকে তাকিয়ে থাকে। বসের কথা তার কানে বেজে উঠছে, ‘এই শুন্, মিজানের লাশ আইজই শীতলক্ষ্যায় ভাসাইয়া দিবি শহীদ আর হামিদরে লইয়া। হালায় আমার লগে বেঈমানি করছে। বুঝবার পারছোস তো কী কইলাম!’
‘দুর্বল হইলে চলবো না’, নুরু নিজেকে বোঝায়। একদলা থুথু ফেলে সে ফ্লোরের ওপরেই … মাস্তানগোর আবার দোস্তি!
ডায়োজিনেস
ফার্মগেট এলাকায় যাদের যাতায়াত আছে তাদের চোখে নিশ্চয়ই পড়েছে। পাগলটির বয়স কত হবে? দেখে তো ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ বলেই মনে হয়। সম্পূর্ণ দিগম্বর। সুঠাম দেহ। গ্রীকভাস্কর্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ভদ্রলোকেরা না দেখার ভান করে। আশেপাশে হেঁটে চলা মহিলাদের দেখি আড়চোখে একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিতে। নাহ্, পাগলটা মোটেই ভায়োলেন্ট নয়। মাঝে মাঝে সে অট্টহাসি দিয়ে ভরাট গলায় চিল্লায়, ‘মানুষ কই গেল রে? মানুষ কই গেল রে?’ সেদিন দেখি এক গামছা বিক্রেতা লাল টকটকে নতুন গামছা লোকটিকে দিয়ে বলে, ‘এই নেও গামছাটা দিয়া সতর ঢাইক্যা ফালাও এলা!’ পাগলটি এবার হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে বলে ওঠে, ‘হারামজাদা, তুই কি পাগল হইছোস? আমি কাপড় পরুম কেন? কারে দেইখা আমি শরম পামু? মানুষ কই? মানুষ কই রে?’
আমার চোখে ভেসে ওঠে মানুষ খোঁজার তপস্যায় হারিকেন হাতে গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনেসের মূর্তি।
আমার গল্প লেখা
জীবনের প্রথম গল্পটি লিখি আশির দশকে, যখন আমি কলেজ পড়ুয়া ছাত্র। হঠাৎ করেই লেখা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এক তরুণ যুবকের মানসিক টানাপোড়েনকে উপজীব্য করে লেখা ছিল ঐ গল্পটি। গল্পটি উতরে গিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে পেশাগত ব্যস্ততা এবং সেইসাথে ডেইলি স্টারে নিয়মিত কলাম লেখায় মগ্ন থাকায় দীর্ঘসময় গল্প লেখার ফুসরত হয়ে ওঠেনি। বস্তুত নিয়ম করে গল্প লেখা শুরু করি ২০১৬ সালে। আমার গল্প লেখার ভিত রচিত হয়েছিল স্কুল-জীবন থেকেই। তখন থেকেই গল্প-উপন্যাসের আমি একজন একনিষ্ঠ পাঠক। শুধু পাঠ করা নয়, বরং পাঠের সময় গল্পকারদের লেখার কলাকৌশল নিয়ে ভাবতাম। গল্প তো শুধুমাত্র কাহিনি বর্ণনা নয়, বরং উপস্থাপনার মুন্সিয়ানাই একটি সফল গল্প হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত।
মনে পড়ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রখ্যাত রম্য-ঔপন্যাসিক শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লোটাকম্বল পড়ে আপ্লুত হয়ে চিঠি লিখেছিলাম। চিঠির জবাবে লেখালেখি প্রসঙ্গে তার উপদেশ ছিল, ‘গল্প লিখতে হলে মানুষ পাঠ করো, ভাবো তার সমাজ ও সময় নিয়ে। আর জোর করে গল্প লেখার চেষ্টা করো না, গল্প ধরা দিলেই লিখতে বসে যাবে।’ গুরুর নির্দেশ এখনো মেনে চলি আমি। কখনো জোর করে লেখার চেষ্টা করি না। ভেতর থেকে অনুপ্রেরণা পেলেই গল্প লিখতে শুরু করি।