আপনার কোন বস নাই, আরামে আছেন মামা!- রিক্সায় বসে গলার ঘাম মোছে রানা।
রিক্সাওয়ালা ঘামেভেজা পিঠ মুচড়িয়ে পুলিশের লাঠির দিকে চোরা চোখে দেখে প্যাডেল চেপে চাকা ঘোরায়, বলে- ‘অফিসের ভিতর আপনাগো দুই একটা বস, আর আমাগো রাস্তাভরা বস।’
মোড় পার হয়ে ওভারব্রীজের কাছে আসতেই পুরো রাস্তা স্থির দাঁড়িয়ে গরগর করছে। মরুভূমির অজগরের মতো নড়েচড়ে গতি বাড়াচ্ছে রোদ।
-মামা এইখানে রাখেন, আপনার বসদেরকে সামলান, আমাকে নামায় দেন’। বারুদ উগরানো বাস, সিএনজি আর প্রাইভেট গাড়িগুলো পার হয়ে ফুটপাতে উঠে আসে রানা।
ধরাম করে মিনহাজ স্যারের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু সাবধানে টেনে বেরিয়েছে, যেন অফিসের কেউ টের না পায় যে আগামীকাল থেকে চাকরিটা নেই। মিনহাজ স্যার শান্ত মুখে তার পারফরমেন্স নিয়ে বালছাল বললেন, সবকথা রানার কানে ঢোকেনি, মূল বিষয় হচ্ছে, সে বাতিল। এখন এই হতাশা নিয়ে ঢাকা শহরে কোথায় যাওয়া যায়?
ওভারব্রীজের ওপরে উঠে ডানবাম ভেবে শেষে বামদিক দিয়ে সরসর করে নামে রানা।
ফুটপাতে মাটির হাতি, হাড়িকুড়ির খোলা দোকান। বয়সী গাছের স্থৈর্য্য মুখে সেঁটে টুলে বসে আছে বিক্রেতা। শান্তার জন্য একটা শানকি কিনে নেবে নাকি? নাহ, থাক হাত ভারী হয়ে যাবে। স্ত্রীর মুখের সঙ্গে বিক্রেতার নিস্পৃহ মুখটাও সঙ্গে করে কিছুদূর আনে রানা।
‘একদাম তিন’শ/আড়াই’শ’র কাপড়ের গাটওয়ালা ছেলেটির পাশে আখের রস বানাবার ভ্যান। ক্রেতার জন্য গ্লাসে তরল পানীয় ভরছে এক কিশোর। চিনিকলের হাওয়া বাতাসে বড় হওয়ার কারণে কি না কে জানে, আখের রস দেখে গা গুলিয়ে উঠলে প্রায় লাফিয়ে জায়গাটা পার হলো রানা।
উল্টোদিক থেকে আসা জনস্রোতকে একহাতে আড়াল করে, অন্যহাতে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ধরে, আরো কোন অদৃশ্য হাতে শাড়ির কুচি সামলে ধরে হাঁটা নারীটির কৌশল দেখতে তিরিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে দুজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো রানার। একজন ‘ধুরো’ বলে গা বাঁচিয়ে কচকচে সবুজ পেয়ারার ডালির দিকে এগিয়ে গেল। রানা পেয়ারা দেখলো- ভালোবাসে সে। কিনবে? না থাক। প্রিয় ফল খেতে হলে কোথাও বসতে হবে তাকে।
উল্টোদিকে গিয়ে আবারো ওভারব্রীজে উঠে আসে রানা। চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়া, চটচটে ঢাকা শহরের চলমান ট্রাফিক। তেতে ওঠা তাওয়ার মত স্টিলের পাতে জোর করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ায়। সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে স্কুলড্রেস পরা ছাত্ররা দলবেঁধে কোথাও যাচ্ছে। কেটে ফেলার ডালের পাতার মতো শ্রান্ত মুখ, অথচ এদের কলকল করে ওঠার কথা!
ব্রীজের নিচে কাঠ খোদাইয়ের ছোট্ট যন্ত্র নিয়ে উবু হয়ে বসা শিল্পী। শিরিষকাগজ ঘষে একটা স্বরে-আ মসৃণ হচ্ছে। বোরখা পরা মায়ের হাত ধরে অপেক্ষমান শিশুটি কাকচক্ষু নিয়ে একটি ‘ক’ চাইছে। যেন রানার শিশুকালের সেল্যুলইয়েডের পর্দা। শাড়ির আঁচল গাছকোমর বাঁধা মায়ের সঙ্ নারকেল পাতা দিয়ে বর্ণমালা বানানোর দিন।
রাস্তার পাশে দেয়ালে সাদাকালো ছবির পাশে ‘স্মরণ সভা’র পোস্টার, নাম রোদেবৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। নামহীন বিখ্যাত লোকটিকে রানা চেনে না! ইচ্ছে করছে লাল নীল রং দিয়ে লেখা ফ্রিজ সারাই, পোকামাকড় নিধন, কাজী অফিস, কিংবা ব্যাংকে চাকুরির কোচিং-এর প্রকট বিজ্ঞাপনগুলোর পাশে নিজেরও একটা ছবি সেঁটে দেয়, সেখানে লেখে- রানা নামের অখ্যাত লোকটিকে ধরিয়ে দিন, জীবন যার কাছে দিন দিন অচেনা হয়ে উঠছে।
এসব দেয়াল কি বড় বিলবোর্ডের মতো ভাড়া দেয়া হয়!
লেখার শব্দ
তখন বেশ বড় একটা ক্যানভাসে কয়েকটি রেখায় আঁকা সরল শৈশব আমাদের।
মফস্বল শহরে অর্থনীতির নাটবল্টু সামলানো চিনিকল। পাড়ার রাস্তায় ঢোকার আগে বাজার। পাড়ার শেষে কিছু আবাদী জমির ভেতর দিয়ে রাস্তা পেরোলে নদী। চিনিকলের বর্জ ফেলার জন্য নদীর সঙ্ জুড়ে দেয়া খাল। চিনিকলের স্কুল। নাতিদীর্ঘ এক বন পেরিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাই। ছুটির পর স্লেট দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে কচি শালপাতা পেড়ে হাত রঙ্গিন করি। কোন কোন হাফ স্কুলের দিনে বালি মাটির কোটরে জমে থাকা বর্ষার জলে হঠাৎ জন্মানো ব্যাঙ্গাচি ধরি জামা ভিজিয়ে। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে নির্ধারিত পাখার মারের সঙ্গে শুকনো ধুন্দুলের খোসায় সাবান মেখে গা ডলে গোসলও জোটে।
ততদিনে হাতের কাছে জুটে গেছে বই! যদিও আমাদেরকে বই পড়ে শোনাবার কেউ ছিল না। মা, মামা, খালাদের বইপত্র, এদিক সেদিক ছড়িয়ে থাকা দু’দিনের বাসী সংবাদপত্র, মুদি দোকান থেকে সদাই আসা কাগজের ঠোঙ্গা, সোভিয়েত ইউনিয়নের বদান্যতায় রঙ্গিন ছবিওয়ালা বই, ম্যাগাজিন এসবের পরও কুমিরের হা-খোলা মুখের মতো পড়ার ইচ্ছায় ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক, গাছের গায়ে ঝুলতে থাকা মধুফলের চুয়ে পড়া মধু, আকাশমুখী দুলফিফুল, জিয়া গাছের আঠায় নানান সাইজ, শেইপ, এসব পাঠের মধ্যেও মাথার ভেতর কথার একটা ভোতা স্রোত সারাক্ষণ অনুভব করি।
কিন্তু কি করে সেখান থেকে নিজে বেরুবো, অথবা সেসব ভোতা শব্দকে ধার এবং আকার দেব, বুঝে উঠতে পারি না।!
এদিকে সব ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া বড়বোন মেহেরুন্নেসা মেরী হাই স্কুলে উঠে গল্প লিখছে। গল্পের প্রধান চরিত্র মেডিকেল কলেজে পড়ে, প্রেমের গল্প। পড়ে আমার ছটফট লাগে, ভেতরের কথার স্রোতটাকে ভাষা দিতে ইচ্ছে করে।
তখন আমার ক্লাস এইট, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অনুবাদে পড়া শেষ। কাস্তে প্রতীকটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। মাঝে মাঝে ‘ডিয়ার ডায়েরি’ ধরনে বাঁধানো খাতায় লেখি। ক্লাস নাইন শুরু হবার আগে ছুটির সকাল। চিনিকলের ছাই উড়ে উড়ে আরেকপ্রস্থ কালো চাদরে ঢেকে দেওয়া উঠোনটাকে ঝাঁট দিচ্ছে গৌরাঙ্গের মা। মঙ্গায়পীড়িত নিঃস্ব তাদের পরিবারটি কয়েকদিন আগে এ এলাকায় এসেছে। গৌরাঙ্গ ও তার বোনের হাড় জিরজিরে শরীর দেখে আমরা সবাই শিউরে উঠেছি। তখনো আমার দূর্ভিক্ষ নিয়ে কোন বই পড়া, বা সিনেমা দেখার সুযোগ হয়নি।
ডায়েরি লেখার ইচ্ছে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলাম। কিন্তু লেখা হয়ে গেল কবিতা। কবিতার নাম ‘এই এখন, এক্ষুনি’।
পাঠ্যবইয়ের বাইরে শুধু রবীন্দ্র-নজরুল পড়া আমার কবিতার ধরন সমাজতান্ত্রিক, বক্তব্যও পরিস্কার যে এক্ষুনি সমাজ পালটে ফেলতে চাই, গৌরাঙ্গের পরিবারের আহার বাসস্থানের নিশ্চয়তা চাই। আবেগে ভরা সেই বিরাট কবিতা লিখে ফেলার পর মনে হলো আমার শব্দের, কথার ভোতা স্রোতে খানিকটা ঢেউ বয়ে গেল।
সেই থেকে কি শুরু! কবিতা দিয়ে ভেতরের শব্দগুলোকে বের করে দেয়ার প্রবণতা?
ডায়েরি, কবিতা আমার লেখালেখির ডাইভিং বোর্ড। হাঁটতে, দৌড়াতে শেখার পর এক্টু একটু করে সাঁতার শিখে একদিন নদীর ধারে পেতে রাখা লম্বা কাঠের তক্তা ধরে দৌড়ে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া।
বড় বোনের অনুসারী হয়ে আমিও আমার সেই স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা এক পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। কয়েকদিন পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কবিতা ঢাকার এক দৈনিক কাগজের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হলো। প্রকাশিত হওয়া যে লেখালেখির প্রণোদনায় প্রথমদিকে, কে না জানে!
প্রায় দশহাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনকারী চিনিকলে দেশের নানা অঞ্চলের মানুষের সমাহার। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য তৈরি হওয়া স্কুলও তার ব্যতিক্রম নয়। পদাধিকার ইত্যাদি কারণে স্কুলেও যে শ্রেণিবিভাজন ছিল না তা না, কিন্তু তখন আমাদের শিশুমন সেসব বুঝতো না, বা বুঝে ফেললেও কিছু করবার ছিল না। স্কুলে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যেতাম।
অফিসার্স ক্লাবে কর্মকর্তারা স্ত্রী-সন্তান সহযোগে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ‘ফাংশান’ করতো। এর আগে চলতো ধারাবাহিক মহড়া। একেকদিন একেকজনের বাড়িতে বিকেলের নাস্তার সঙ্গে সেসব মহড়া এতই লোভনীয় ছিল যে বিকেলের খেলার মাঠ ভুলে থাকতে কষ্ট হতো না।
গানের গলা খুব সহজে তারায় পৌছাতো আমার। ঠিকঠাক উচ্চারণে কবিতা পড়তে পারতাম, নাচের ছন্দও অন্য অনেকের চেয়ে ভালো খেলে যেতো পায়ে। সুতরাং এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেবো এটাই স্বাভাবিক। এক পর্যায়ে এমন হলো- গীতি আলেখ্য বা এরকম কোন বড় অনুষ্ঠানে ধারাবর্ণনার জন্য আমার বিকল্প জুটতো না। হায়ারে যেমন খেলোয়াড় খেলতে যায়, তেমন করে অনুষ্ঠানের জন্য আমার ডাক আসতে থাকলো। তবে পরিবারের ফিল্টার ছিল, সবখানে যাওয়া নিষেধ। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে যেতো এবং ফিরিয়ে আনতো।
খেলোয়াড়েরা হয়তো পয়সাপাতি পায়, আমি পুরস্কার পেতাম বই আর জলখাবার। গরমাগরম লুচি বা পরোটার সঙ্গে রসগোল্লা। চিনিকলের প্রাপ্তবয়স্কদের অনুষ্ঠানে ধারাবর্ণনা করে ভেতরে তাৎক্ষণিক ভারিক্কিপনাও টের পেতাম না কি! কেমন করে যেন সেসব গীতিআলেখ্য লেখার ভার আমার ওপরে চলে এলো।
বিষয় নির্ধারণ করে দিলে রীতিমত খেটেখুটে লিখতাম। সেই আশির দশকে তখন তো গবেষণার সুযোগ নেই, হাতের কাছে রেফারেন্স বলতে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ আর নজরুলের ‘আমার প্রিয় নজরুলগীতি’ এই দুই বই।
তো, বসন্ত-উৎসবের গীতিআলেখ্যতে গান বা কবিতা গুঁজে দিয়ে বর্ণনাটুকুতে যথেচ্ছ কল্পনা মিশিয়ে লিখে দিতাম। সেসব গোজামিল নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। বরং উদার প্রশংসা জুটেছে।
স্কুলের পাট চুকলে কলেজ,, চিনিকল থেকে কয়েক মাইল দূরে। ইক্ষু বহনকারী ট্রাকের ভেতরে দু’ধারে কাঠের বেঞ্চি বানিয়ে দেয়া, তাতে আমরা কলেজ পড়ুয়ারা সকালে কলেজে যাই, বিকেলে ক্লাস শেষ হলে যাদের হয়নি তাদের জন্য অপেক্ষা করি। তারপর বাড়ি ফিরে আসি।
চিনিকলের সাংস্কৃতিক আবহে গড়া আমার মানসিকতাও সঙ্গে সঙ্গে গেল। কলেজের প্রতিযোগিতায় কবিতা লেখাসহ আরো দুটো ক্যাটাগরিতে ফার্স্ট হয়ে আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সবচাইতে আনন্দের ছিল পুরস্কারের এক ব্যাগ বোঝাই বই নিয়ে বাড়ি ফেরা! মানিক রচনাবলী আর বেশ কিছু ভালো বইয়ের গর্বিত মালিক আমি তখন। এর মধ্যে আর আমার সলজ্জ লেখালেখির কথা তখন কলেজে মোটামুটি প্রকাশ হয়ে গেল। সাহিত্যে আগ্রহীদের মনযোগ পেতে থাকলাম।
কলেজের দু’বছর দেখতে দেখতে চলে যায়। এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পালা। বলা যায় পুকুর থেকে সমুদ্রে এসে পড়লাম। বড়বোন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে বাংলা সাহিত্যে, আমি সমাজবিজ্ঞানে। ওর সুবাদে আমার দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই সহজ পদচারণা। ওর বাংলা বিভাগে সেসময়ের ডাকসাঁইটে অধ্যাপক সাহিত্যিক, নাট্যকারদের সঙ্গে পরিচিত হই।
আমার ভেতরের শব্দগুলো তখন দ্বিগুণ তিনগুণ স্রোত তুলে চলছে। আমার চারপাশের আওয়াজও তখন প্রবল, প্রকট। এর মধ্যেই আমার শব্দরাশিকে প্রকাশিত হতে দিতে চাই। ততদিনে ডাকবিভাগের হলুদ খামের সঙ্গে আমার সখ্যও বেশ পোক্ত। লেখা পাঠাই তখনকার গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক, সাপ্তাহিকের সাহিত্যপাতায়।
তখন দেশে সামরিক শাসন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংকটে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন দীর্ঘায়িত হতে থাকে। ডিপার্ট্মেন্টে সময় দেয়ার বদলে আমি বাইরের বইপত্র ও লেখালেখিতে নিমগ্ন হতে থাকলাম। ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক লেখার আমন্ত্রণ জানায়, অধ্যাপক যাঁরা লেখালেখির সঙ্গে জড়িত, এমন দু’একজন ভারি উৎসাহ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাজনীতিবিমুখ হয়ে থাকা যায় না। সারা ক্যাম্পাস প্রতিবাদমুখর। আমিও ব্যতিক্রম নই।
কবিতা ছাড়াও অন্য মাধ্যমে কথা বলার প্রেক্ষিত তৈরি করতে ইচ্ছে করে, আমি গল্প লিখতে শুরু করি। ছাপালেখা একটা বড় বাঁধাই খাতায় আঠা দিয়ে সেঁটে নিচে প্রকাশিত হওয়ার তারিখ লিখে রাখতাম। পৃষ্ঠাসংখ্যা গুনে রাখিনি, তবে প্রায় সবগুলো পাতা ভরে এসেছিল প্রকাশিত লেখা দিয়ে।
এর মধ্যে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো দানা বেঁধে উঠলো। ডাক্তার মিলন নিহত হলেন। নূর হোসেন বুকে পিঠে শ্লোগান লিখে পুলিশের গুলিতে শহিদ হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান তৎপরতা লেগেই থাকতো, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত হতো এবং আমরা আবাসিক হল খালি করার নোটিশ পেতাম।
এমনি এক নোটিশের দিন দুই আগে এক বন্ধু আমার কবিতার খাতাটি চেয়ে বসলো, সে মন দিয়ে পড়তে চায়। কেউ আগ্রহী হয়ে লেখা পড়বে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে! দিলাম। ফেরত পাবো, জানি তো। কিন্তু হল খালি করার ডামাডোলে, পুলিশ রেইডের মুখে সে আমার খাতাটি সঙ্গে নিতে ভুলে গেল। আমার সে সময়ের লেখালেখি সব হারিয়ে গেল।
এরপর ১৯৯৬-তে কর্মসূত্রে বিলেতে চলে যাই উচ্চতর শিক্ষা নিতে। হা করে নিঃশ্বাস নেয়া ব্যস্ততার ভেতর বাংলা লেখালেখি থেকে দূরে চলে গেলেও লন্ডন শহরে ক্যামডেন টাউনের হরেক পশরার উইকএন্ড মার্কেট ঘুরে এসে, কিংবা রিজেন্টস পার্কের সাতশো গোলাপ দেখে অথবা গৃহহীন কাউকে রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বাড়ি ফিরে বই নিয়ে পড়তে বসার আগে কিছু সময় ধরে বাংলা লিখতাম। সেসব লেখা খাপছাড়া, মনের অস্থির প্রকাশ। না ডায়েরি, না কবিতা, না গল্প।
অনেক পরে যখন বাংলা ব্লগের জন্ম হলো তখন বুঝলাম সেসব আসলে দৈনন্দিন ব্লগই ছিল। ততদিনে বিবাহিতের তকমা জুটে গেছে। জীবনসঙ্গী চিত্রশিল্পী রাকীব হাসান। কেনিয়ায় নায়রোবিতে তার আর্টের পড়াশোনা শেষে কর্মজীবন। ওয়েস্টল্যান্ড নামের একটি এলাকায় তার স্টুডিও গ্যালারি।
রাকীব নায়রোবীস্থ ফ্রেঞ্চ কালচারাল সেন্টারের গ্যালারিতে আমার কবিতা থেকে তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে একটি একক প্রদর্শনী করেছিল ‘The Crimson Poems and the Blue Edge’ নামে। সেই চিত্রপ্রদর্শনীতে ছবির সঙ্গে সঙ্গে কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদও দর্শক পাঠকের মনযোগ পেয়েছিল। সেটি ছিল ১৯৯৯ সাল।
কেনিয়াতে নব্বই দশকের দিকে সামাজিক নিরাপত্তার তেমন নিশ্চয়তা ছিল না। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিই এর জন্য দায়ী। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব নেই। ধনী গরীবের মধ্যে দৃষ্টিক্টু রকমের ফারাক, অথচ এক্সপ্যাট্রিয়ট হিসেবে আমাদের কিছু করার নেই। বলা বাহুল্য, ভারতীয় বংশোদ্ভুত (মুহিন্ডি) এবং পশ্চিমাবিশ্বের শ্বেতাঙ্গ (মুজুঙ্গু) মানুষজন এই বিভাজনে মূল ভূমিকা রাখে।
মুহিন্ডি এবং মুজুঙ্গুরা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ে না, রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ছিনতাইয়ের শিকার হয়। তাদের বাড়ির সুউচ্চ গেইটে দ্বাররক্ষী এবং সিকিউরিটি কোম্পানির পাহারা।
দেশি দূতাবাসের অনুষ্ঠানাদিতে গিয়ে, কেনিয়ার নয়নাভিরাম প্রকৃতির নিরাপদ জায়গাগুলোতে আরো অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঘুরে বেড়িয়ে দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আমার কেন যেন এমন সোনার কারাগার ভালো লাগছিল না।
এমন সময় রাকীবের এক একক প্রদর্শনীতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ এলেন সে সময় নাইরোবিতে কর্মরত ক্যানাডিয়ান হাই কমিশনার, বার্ণার্ড দ্যুসো। ভদ্রলোক চিত্রকলার অত্যন্ত উঁচুমানের সমঝদার। তাঁর সঙ্গে আমাদের ভালো বন্ধুত্ব হলো। একদিন কথাপ্রসঙ্গে বার্ণার্ড বললেন- আপনারা কেন ইমিগ্রেশন নিয়ে ক্যানাডা আসছেন না, তাহলে উত্তর আমেরিকাতে চিত্রপ্রদর্শনী সহজে করতে পারতেন।
মানুষের স্থানান্তরের পেছনে ভৌগলিক, আর্থ-রাজনৈতিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় যে বিশ্বপ্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষের জীবনের যে ছক, তাতে সে ঘুরপাক খায়, একে পোশাকি ভাষায় ডেস্টিনি বলা যেতে পারে। সেই ছকে পড়ে আমরাও মে মাসের এক অতিক্রান্ত দুপুরে ক্যানাডার মন্ট্রিয়াল শহরে এসে নামলাম।
নাইরোবিতে কর্মস্থল থেকে বেশ বড়, প্রায় তিন’শ কেজির এয়ার শিপমেন্ট বিদায়ী উপহার হিসেবে পেয়েছি। সুতরাং এবার আমার ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে এসেছি, সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশ এ বসবাস করবার, সমাজ-সংস্কৃতি ও মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা, যা আবারো মাথার ভেতর অবরুদ্ধ শব্দের বহতা নদী।
ক্যুবেক ফরাসি ভাষাভাষী প্রদেশ। এরা নতুন অভিবাসীদেরকে ফরাসি ভাষা শেখার সুযোগ দেয়। আমিও মন্ট্রিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রেঞ্চ শিখি। ফের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। গুছিয়ে বসে সংসার বড় হয়, সন্তান আসে। ম্যাকগিল এবং মণ্ট্রিয়াল ভার্সিটিতে সামাজিক-স্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে কাজ পাই। খুব ব্যস্ত জীবন। কিন্তু ঐ যে শব্দের ভার, কথার ভার যা সারাদিন চাপা দিয়ে কাজ করে যাই, তারা রাতের বেলা জাঁকিয়ে বসে ফিস ফিস করে- ‘কি হে, কিছু লিখছো না যে!’
আরে না, কি লিখবো! লেখা টেখা হবে না আমাকে দিয়ে। তাছাড়া সময় কই?’
শব্দকে ভোতা শব্দ দিয়ে ঠান্ডা মেরে বসিয়ে রাখি।
কিন্তু ভেতরের ওই আপাত নিস্তরঙ্গ স্রোতে প্রতিদিন ঢেউ বাড়তে থাকে।
দিনের বেলায় ফরাসি, ইংরেজি এসব ভাষায় কাজকর্ম সারি। কিন্তু বাড়ি ফিরলেই বাংলা শব্দমালা একটা শতভূজা অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আবিষ্কার করি যে, মনে মনে প্রতিদিন দেশে ফিরে যাচ্ছি, নিজের শৈশব কৈশোরে ফিরে যাচ্ছি।
তখন ২০০৫, এমনি একদিনে, অফিসে নিজের ডেস্কে বসে কিছু সায়েন্টিফিক পেপার রিভিউ করছিলাম, হঠাৎ ইচ্ছেটা এত প্রবল হলো যে আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দ্রুত বইপত্র ঠেলে প্রিন্টার থেকে কিছু সাদা কাগজ নিয়ে লিখতে বসে গেলাম, বাংলায়। একটি গল্প লেখা হলো, নাম- কমলা।
মন্ট্রিয়ালের বা ক্যানাডা, ইংল্যান্ডের গল্প নয়। পুরোই আমার ছেড়ে আসা মফস্বলের শহরের পটভুমি। এই গল্প লেখার আগে প্রায় দশ বছর কেটে গেছে, এক বসায় এমন করে কোন লেখা লিখিনি। বেশ একটা ঝাঁকি লেগেছিল সেদিন, মনে আছে। চাকুরির জন্য না, আমি নিজের লেখা লিখছি!
বন্ধুদের আড্ডায় ‘কমলা’ পড়ে শোনালাম। বিলেত থেকে প্রকাশিত ‘সুরমা’ পত্রিকা গল্পটি এক চমৎকার ইলাস্ট্রেশেনের সঙ্গে পুরো পাতা জুড়ে ছাপলো। মাঝখানের রাইটার্স ব্লক উধাও হয়ে লেখার উত্তেজনা আর আনন্দ দুইই ফিরে এলো আবার। এরপর সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। খুলে গেল অন্যরকম যোগাযোগের এক জগৎ। এখন আর চিঠির খামে লেখা পোস্ট করতে হয় না। চেনা জানা সাহিত্যের পরিধির মানুষের সঙ্গে, সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকলাম। আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত কেউ কেউ আবারো লিখতে অনুরোধ করেন, লেখা চান। সেসব লেখা লিখে উঠতে পারলে এক অনির্বচনীয় ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে।
দেখলাম, শৈশবে যে অব্যক্ত শব্দস্রোত গ্রাস করেছিল, তাদেরকে সামান্য অবয়ব দেয়ার কাজটা খুব ভালোবাসি। নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবি, শৈলী এবং আঙ্গিক নিয়ে ভাবি, লেখা এডিট করতে সময় নিই। তারপরও নিয়মিত লেখা হয়।
মানুষ আসলে নিজের অভিজ্ঞতা লেখে। সে অভিজ্ঞতা একেবারে সরাসরি, সরেজমিনে হতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। আমি লিখি দেশের সঙ্গে আমার সংযোগের কথা, যে সংযোগ মানচিত্র পেরিয়ে কোথাও খোয়া গেছে বলে আপাতভাবে মনে হলেও তা খুঁজে বেড়ানোর আখ্যানও আছে সেখানে।
কেন, কোন তাড়না থেকে গল্প লিখি তা স্পষ্ট করে বলা সহজ না। কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনা কাউকে গল্প লেখার জগতে পৌছে দেয় কি না জানি না, তবে একটা পরম্পরা তো থাকেই, আছে। যেপরিবেশে আমি বড় হয়ে উঠেছি, এর সঙ্গে সাহিত্যপাঠের ধারাবাহিকতা সম্ভবত আমাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিয়েছে।
কবিতা দিয়ে আমার লেখালেখির শুরু। আমার অনেক কবিতায় শৈশবের শোনা গল্পের অনুষঙ্গ আছে। তো, কবিতায় যা বলতে পারি না তা গল্পের পরিসর ও আবহে বিস্তার করতে চাই, এটাও হতে পারে গল্প লেখার তাড়নার জায়গা। গল্পের জগতে পৌঁছাতে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হয়নি। এ জগৎটা খুব স্বাধীন জগৎ।