তীরন্দাজ Blog কথাসাহিত্য ছোটগল্প লোকটা | জাহীদ ইকবাল | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ২০২৪
কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

লোকটা | জাহীদ ইকবাল | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ২০২৪

গল্পকার : জাহীদ ইকবাল | আলোচক : সায়মা ইসলাম

লোকটা প্রায়ই আসে।
কোত্থেকে আসে! কেন আসে! তার হাল-হকিকত, ঠিকানা-সাকিন কিছুই জানি না। তবে সে বেশিক্ষণ থাকে না। দুয়েকটি কথা খরচ করে চলে যায়। বিশেষ করে বাবা যখন বাসায় থাকে না, লোকটা ঠিক তখনই আসে। কেন আসে! জানি না।

কখনো খুব একটা কৌতুহল হয়নি।

লোকটা মাঝবয়সী। বেঁটেমতো। নিরীহ। মনমরা মুখচোরা স্বভাবের। কথা বলেন খুবই কম। যা বলেন তা বোধহয় মা ছাড়া পাশের দেয়ালও টের পায় না। তবে মা’র কণ্ঠস্বর চড়া। একটু দেয়ালে কান পাতলেই শোনা যায়।

মাসখানেক ধরেই লোকটা আসছেন। এর আগে তাকে কখনো কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

লোকটা এলে মা কখনোই দরজায় খিড়কি আঁটে না। দরজা কিছুটা হলেও খোলা রেখে কথা বলে।

আজ দরজা বন্ধ।
সে কারণেই কৌতুহল জাগল।
দরজা বন্ধ কেন!
দরজা বন্ধ হবে কেন!
কথা বললে কি মানুষ দরজা বন্ধ করে কথা বলে!
না। একদম না।

বিকেলের আলো একটু একটু করে মরে এসেছে।
এখনি সন্ধ্যা নামবে। আমি এক দৌড়ে দরজায় এসে কড়া নাড়ি।
মা মা চিৎকারে পুরো বাড়িটা কেঁপে ওঠে।
তবুও মা দরজা খোলে না।
আমার সন্দেহ ক্রমশই বাড়তে থাকে।

তর সয় না। আমি দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতেই দরজা হা হয়ে যায়।
দেখি মা কাঁদছে।
লোকটা নেই। নেই মানে কোত্থাও নেই।

লোকটা অনেক দিন হয় আসে না।
আসে না বলতে একদমই আসে না।
কেন আসে না? মাকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞেসও করি না।
মা কাঁদে।
যখন দরজা বন্ধ থাকে, আমি বুঝতে পারি মা কাঁদছে।

মাকে মাঝেমধ্যে বাবা কারণে-অকারণে অনেক বকাঝকা করেন। অসম্মান করেন। তুই-তোকারি করেন। বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করেন। এটা আমার পছন্দ না। বাবাকে আমি ভেতরে ভেতরে ঘৃণা করি।
তবে কেন যেন মায়ের মতো আমিও লোকটার জন্য অপেক্ষা করি।
লোকটা মাকে খুব ইজ্জত করে।

লোকটা আসে না। মা’র কান্নাও আর থামে না।
একদিন সে এলো।
আমি মিঠুর সঙ্গে উঠানে খেলছিলাম। বেশিরভাগ আমি উঠানেই খেলা করি।
সে এলে বিকেলের দিকেই আসে।
মা দরজা খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে বসতে দেয়।

উঠানে খেলা করলেও আমার সতর্ক চাহনি থাকে দরজার দিকে। কখন দরজা বন্ধ হয় অথবা লোকটা কখন বেরিয়ে যায়!

মাকে লোকটার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। কখনো করিনি।

লোকটা আজ দ্রুতই চলে গেল।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম মা বোধহয় আজও কাঁদবে।
কিন্তু না। মা কাঁদছে না। তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখ। মা আজ চোখে কাজল পরেছে। তাকে নতুন বউয়ের মতো লাগছে।
মা আমার হাতে একটি মাঝারি সাইজের পাকা পেয়ারা ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোর মামা এনেছে। খেয়ে দেখ খুব মিষ্টি। আমি একটা খেয়েছি।’
পেয়ারা হাতে নিয়ে আমি আর দাঁড়াই না। এক দৌড়ে মিঠুর কাছে চলে আসি।

‘লোকটা কে রে টগর?’
‘কোন লোকটা?’
‘এইমাত্র যে লোকটা চলে গেল!’
‘ও উনি! উনি তো আমার মামা হয়।’

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ ঘুটঘুটে অন্ধকারের বুক চিরে লোকটা পুনরায় ফিরে এলো। এই প্রথম সে একদিনে দুবার এলো।

‘আপনার অভ্যাস অনেক খারাপ হয়ে গেছে!’
‘কেন?’
‘আপনি বারবার কেন আসছেন?’
‘আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না।’
‘এতদিন যখন আসেন নি তখন কেমন করে ছিলেন?’
‘অনেক কষ্টে ছিলাম।’
‘মিথ্যা কথা!’
‘আজ আমি তোমাকে নিতে এসেছি।’
‘আমি যাব না।’
‘টগরও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে।’
‘টগর যাবে না।’
‘কেন?’
‘ওর বাবা ভীষণ একা হয়ে যাবে…। তাছাড়া টগরকে যাহেদ অনেক ভালোবাসে।’
‘যাহেদ কী কিছু টের পেয়েছিল?’
‘কিছুটা। নরমাল ড্রেলিভারি না হলে ধরা পড়ে যেতাম। শোনেন আপনাকে একটা কথা বলি।’
‘বলো।’
‘আগে বলেন, আপনি কী আমার কথা রাখবেন?’
‘রাখব।’
‘আপনি জীবনে আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। কোনোদিন দেখা করারও চেষ্টা করবেন না।’
‘কিন্তু শিউলি! তোমাকে তো আমার অনেক কথা বলার ছিল!’
‘থাকতে পারে। কিন্তু আমি আর আপনার কোনো কথা শুনব না। আপনার কাছে আমার যেটা দরকার ছিল, সেটা আমি পেয়ে গেছি। আপনি মানুষটা ভবঘুরে। দায়িত্বজ্ঞানহীন। নির্বোধও। তা না হলে ঘরে নতুন বৌ রেখে, হুটহাট করে নিখোঁজ হয়ে যেতেন না। আপনাকে এখন আর আমার কোনো প্রয়োজন নেই। দোয়া করবেন এবার যেন আমাদের একটা কন্যা সন্তান হয়!’

দরোজায় কান না পাতলে জানা হতো না, লোকটা সম্পর্কে।

ছোটগল্প : লোকটা | গল্পকার : জাহীদ ইকবাল | আলোচক : সায়মা ইসলাম

মাত্র ছয়শ শব্দের গল্পটি এক বালকের নিজের সাথে নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের কথোপকথন। সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপের মেদ-চর্বিহীন গল্পটি বালকটির মা ও আগন্তুককে ঘিরে তার সংশয়পূর্ণ মনের একটি নিঁখুত টলটলে ছবি আঁকে পাঠকের মনে।
“লোকটা এলে মা কখনোই দরজায় খিড়কি আঁটে না। দরজা কিছুটা হলেও খোলা রেখে কথা বলে।
আজ দরজা বন্ধ।
সে কারণেই কৌতুহল জাগল।“
গল্পের শুরুতেই এক বালকের নিজমনে এই কথোপকথন পাঠককে সজাগ করে, মনে কৌতুহল জাগায়। গল্পের পরিসর খুবই ছোট। একটি ঘরের কোণ তার সামনের উঠোন। গোপন বা রুদ্ধ বিষয়ের প্রতি বালকমনের যে জিজ্ঞাসা বা কৌতুহল তারই ভিত্তিতে লেখক গল্পটি এগিয়ে নিয়েছেন এবং গল্পের ইতি টেনেছেন। গল্পটির সাবলীলতা পাঠককে বালকের সাথে এমনভাবে একাত্ম করে তোলে যে পাঠকও লোকটির পরিচয় উদঘাটনে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। উঠোনের খেলা ফেলে বালকটির পেছন পেছন পাঠকও উৎকর্ণ চক্ষু-কর্ণ-মন নিয়ে বন্ধ দরোজার গায়ে আড়ি পাতে, তার মনে তৈরি হওয়া সংশয়ের ঘোর কাটাতে।
গল্প কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর পাঠকের মনে লোকটি সম্পর্কে চিরাচরিত যে ধারণা তৈরি হয়। বালকটির কথায় তা আবার প্রশ্নবিদ্ধও হয়।
”মাকে মাঝেমধ্যে বাবা কারণে-অকারণে অনেক বকাঝকা করেন। অসম্মান করেন। তুই-তোকারি করেন। বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করেন। এটা আমার পছন্দ না। বাবাকে আমি ভেতরে ভেতরে ঘৃণা করি। তবে কেন যেন মায়ের মতো আমিও লোকটার জন্য অপেক্ষা করি। লোকটা মাকে খুব ইজ্জত করে।”
ছোট্ট এই অংশটির মধ্য দিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যকার অশ্রদ্ধার সম্পর্ক বালকটির মস্তিষ্কে যেভাবে বিদ্বেষের বীজ বপন করেছে তা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার।
গল্পের মূল চমৎকারিত্ব এখানেই ‘লোকটা’ যাকে নিয়ে গল্পটির নামকরণ, গল্পে তাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই তাকে ঘিরে পুরো গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। এখানে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা উম্মোচিত হয়েছে একটি বালকের অনুসন্ধিৎসু মনের মধ্য দিয়ে। লেখক খুব সজ্ঞানে এবং সর্ন্তপণে বালকটিকে দিয়ে এমনভাবে গল্পটি বলিয়ে নিয়েছেন যে, গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠকের সামনে একটি বালকমনের নিষ্পাপ নিষ্কলুষ ছবিটি যেমন ধরা দেয়, একই সাথে দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের চিরাচরিত প্রেম-কামনা-চাওয়া-পাওয়ার জটিল বিষয়গুলিও উম্মোচিত হয়। গল্পকার খুবই পরিমিত সীমারেখায় পরিপূরক দু’টি পক্ষকে এমনভাবে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন যে, দুই পক্ষই পাঠকের সামনে স্পষ্ট জীবন্ত হয়ে ওঠে কিন্তু কেউ কাউকে ছাপিয়ে যায় না। গল্পটির আখ্যান চিরাচরিত সাধারণ হলেও লেখকের গল্প বয়ানের রীতিটি পাঠককে আকৃষ্ট করে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে।
জাহিদ ইকবালের ‘লোকটি’ ছোটগল্পটি যেন রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিরই সার্থক রূপায়ন, ”ছোটোগল্পগুলি ছেলেরা দখল করতে চায়, কিন্তু হাত ফসকে যায়। আসলে এর ভেতরের খবর বড়োদের জন্যই।”

Exit mobile version