গল্প ও গল্পের আলোচনা
শুধু গল্প নয় গল্পের সঙ্গে থাকছে এই গল্পের আলোচনা। আলোচনাটি লিখেছেন আরেক গল্পকার সৈয়দ কামরুল হাসান। নিচের লিংকে ক্লিক করে আলোচনাটিও পড়ুন।
মঈনুসের গল্প | সৈয়দ কামরুল হাসান | আলোচনা
মফস্বল শহর কূলাউড়ার সড়কে প্রচুর বেবিট্যাক্সি, রিক্সা ও ভাসমান হকার দেখে ককো রীতিমতো তাজ্জুব হয়! সে এলোপাথাড়ি ট্র্যাফিকে সাবধানে মাউন্টেন বাইক হাঁকিয়ে এসে পৌঁছায় চৌমোহনায়। লেভেল ক্রসিংয়ে বাঁক নিতেই কেন জানি পেছন ফিরে তাকায়। হাইস্কুলের দীর্ঘ বারান্দাওয়ালা ঘরটি তার চোখে পড়ে, সাথে সাথে স্মৃতি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ঠিক সতেরো বছর আগে ককো এ স্কুলে পঞ্চমমানের ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলো। তার বাবা এখান থেকে মাইল দশেক দূরে ষাড়েরগজ পাহাড়ের প্রান্তিকে নলডরি ফরেস্ট অফিসে ডেপুটি রেঞ্জার হিসাবে কাজ করতেন। বনবিভাগে তার বাবার কাজ দীর্ঘমেয়াদী হয়নি। তিনি চাকুরি ছেড়ে ব্যবসায় মেতেছিলেন। তাতে সুশার না হলে জমিজমা বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে যেন অভিবাসী হন।
তেরো বছর বয়স থেকে ককো প্রথমে নিউজার্সির একাধিক শহর, এবং পরে আটলান্টায় বেড়ে উঠেছে। তার ভালো নাম কৌশিক আহমেদ, তবে ককো নামে সমাধিক পরিচিত, চার্লস্টন শহরের একটি ডকইয়ার্ডে সে মেকানিক হিসাবে কাজ করছে। বাবার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর ছোট ভাইবোনসহ পরিবারকে আর্থিকভাবে জিইয়ে রাখা তার দ্বায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সে উইকয়েন্ড ও সন্ধ্যার পর অভারটাইম কাজ করে।
কর্মক্ষেত্রে ককো বেহদ পরিশ্রম করে বটে, তবে ছুটিছাটার সামান্য সময়টুকু নিজের মতো করে কাটায়। নিউজার্সির হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে মাউন্টেন বাইক হাঁকানো ও তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করা তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল বছর সামারে সে তার ইন্ডিয়ান-আমেরিকান গার্লফ্রেন্ড ইলোরার সঙ্গে কেলিফোর্নিয়ার নাপা ভ্যালিতে প্রচুর বাইসাইকেলিং করেছে। আঙুর উৎপাদনের জন্য নাপা ভ্যালিকে বলা হয় ওয়াইন কান্ট্রি। সারা দিনমান মাউন্টেন বাইক হাঁকিয়ে তারা সন্ধ্যার দিকে ফ্রি ওয়াইন টেস্টিংয়ে যোগ দিতো। তারপর বিভোর হয়ে দাক্ষা খেতের প্রান্তিকে কোন ক্যাম্পসাইটে তাঁবু খাটাতো। তাদের তাঁবুটির ফ্ল্যাপ বা ছাদটি ছিলো ট্রান্সপারেন্ট, অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে তারা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেতো তারাভরা আকাশ। ইলোরার সঙ্গে তার ক্যাম্পিং ট্রিপটি জমেছিলো দারুণ, কিন্তু কাজে ফেরার পরই ইলোরা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনের চাকরি পেয়ে চেন্নাই ফিরে গেলো। তাতে তাদের মধ্যে ব্রেকাপ হয়ে যায়। ককো ও ইলোরার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে টানাপোড়েন চলছিল, ভেঙে যাওয়াতে বিষণ্ণ হয়েছিলো ককো, তবে মাস কয়েকে আস্তে-ধীরে সে রিকভার করেছে।
নাউ ককো ইজ সিঙ্গোল, বাংলাদেশে ফিরেছে সে বছর সাতেক পর। শেষ বার দেশে এসেছিলো বাবার লাশ নিয়ে। দাফনের সপ্তাহ খানেক পর পুরো পরিবার ফিরে গিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রে। তার কুটুমখেশদের অনেকেই ততদিনে অভিবাসী হয়ে পাড়ি জমিয়েছে ইতালি কিংবা আস্ট্রেলিয়ায়। তো সে ঢাকায় উঠেছে তার বাংলাদেশি-আমেরিকান ক্লাসমেট ইসমতের বাসায়। ইসমত আমেরিকান অ্যামবেসিতে কাজ করে। সে ককোকে তার ধা-ঝকঝকে মাউন্টেন বাইকখানা ধার দিয়েছে। এ মডেলের বাইকের একটি এক্সট্রা সুবিধা হচ্ছে, এটি ভেঙে চাক্কা-ফাক্কাসহ কয়েক খণ্ডে বড়সড় ব্যাগে পুরে ট্র্যাভেল করা যায়। ইসমতের কাছে ছোট্ট একটি ফোল্ড করা তাঁবু ও বেডরোল পাওয়া গেলে ককো ষাড়েরগজ পাহাড়ে ক্যাম্পিং করার সিদ্ধান্ত নেন। তার কেন জানি মনে হচ্ছিল, প্লেনের ভাড়া দিন-কে-দিন যেভাবে বাড়ছে, ভবিষ্যতে আর হয়তো স্বদেশে ফেরা হবে না। দেশে তার তেমন কোন প্রয়োজন নেই, তবে ইমোশন্যাল টানটি আছে। ভারী ইচ্ছা হচ্ছিল, শৈশবে যে এলাকাতে কিছুদিন বসবাস করেছে, পাঠশালায় পড়েছে, ওখানে তাঁবু খাটিয়ে একরাত্রি কাটাতে।
পুব দিকে পাহাড় নিশানা করে সে মাউন্টেন বাইক চালাচ্ছে। লেভেল ক্রসিং ছাড়িয়ে আসার পর থেকেই সড়কে কোন ভিড়ভাট্টা নেই। রোদের তেজ কমে এসেছে। চোখেমুখে হাওয়া লাগছে। প্যাডেলের চাপে নুড়িপাথরের সাথে ছিটকে ওঠছে লালচে ধুলো। তার মনে জন ডেনভারের ‘কান্ট্রি রোড টেক মি হোম,’ গানের লিরিকটি গুনগুনিয়ে ওঠে। আগ বাড়তে বাড়তে সে চেষ্টা করে মন থেকে ইংরেজি লোকগীতির গুঞ্জন সরিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কথা স্মরণ করতে। বাবার মৃত্যু পর থেকে তাদের আটলান্টার বাড়িতে কেউ আর রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট বাজায় না। ট্রেইলারে চা-এর কাঁচা পাতা ক্যারি করা একটি ট্র্যাকটার ধুলো উড়িয়ে পেছন থেকে কাছে চলে আসলে, সে বাইকটিকে সড়কের কিনারায় নিয়ে এসে পাস দেয়। তখনই ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে…’ সংগীতের কলিটি মনে ফিরে আসে। ভালো লাগার উষ্ণ অনুভূতি নিয়ে সে ধুলোর রেখা বাঁচিয়ে বাইক চালায়।
বাঁশের ঝাড় নুয়ে পড়ে সড়কে ফেলেছে শ্যামল ছায়া। তামাটে দেহের এক ঘর্মাক্ত পুরুষ বাঁখে করে নারিকেল বয়ে নিয়ে যেতে যেতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে দম ফেলে। মানুষটির কোমরে কসেবাঁধা গামছায় গোঁজা বাঁকানো একটি দা। এরকম একজন গাছি ককোর শৈশবে তাদের ফরেস্টে অফিসের বাসায় আসতো নারিকেল গাছের পাতা কেটে পরিষ্কার করতে। বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসাবে সে পেতো কয়েকটি নারিকেল। কোকো সড়কে পা দিয়ে বাইকটি দাঁড় করিয়ে ক্যামেরায় গাছি পুরুষের স্ন্যাপশট নেয়। হেলমেট পরা ককোর দিকে তাকিয়ে গাছি ভারি তাজ্জব হয়!
গাজিপুর চা-বাগানের তিপথে আসতেই আলো এক দম মরে যায়। সড়কের দু’পাশে হাট বসেছে। পাতায় রেখে ভাগা করে বিক্রি হচ্ছে ছোটমাছ। ককো বাইক থেকে নেমে সাইকেলটি ঠেলে ঠেলে ভীড় ভাঙে। একজন ক্যানভেসার মাইক্রোফোনে ফৈজী মিয়ার কাটা-ঘা ও জ্বালাপোঁড়ার মহাশক্তি তৈল বিক্রি করতে করতে বক্তৃতা থামিয়ে কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকায়। সে সচেতন হয় যে— তার বেশভূষা, হেলমেট ও অনেকগুলো গিয়ার লাগানো মাউন্টেন বাইক অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। দ্রুত হাট পাড়ি দিয়ে ফের প্যাডেলে পায়ের চাপ দেয়।
এবার সে অগ্রসর হচ্ছে কালুটির চা-বাগানের ভেতর দিয়ে। দুপাশে সমান করে ছাঁটা চা-গাছের সবুজ ঝোপ। এক জায়গায় টিলার ঢালে বিচ্ছিন্ন একটি ঝোপকে মনে হয়— যেন কোন সন্ন্যাসী আধো অন্ধকারে বসেছেন নিস্তব্ধতার গাঢ় তপস্যায়। বাগানের বাইরে বাম দিকে দৃশ্যমান হয় ষাড়েরগজ পাহাড়ের ঢেউখেলানো কালচে-নীলাভ বিস্তার। ডান দিকে দিগন্তপ্লাবী ধানের খেতে খেলছে আলাভোলা হাওয়া। কখন যে কালুটি ছাড়িয়ে সে এসে পড়েছে লক্ষ্ণীপুর চা-বাগানে, ঠিক বুঝতেও পারেনি। এদিকে চা এর ঝোপগুলো ভাইরাসে হলুদাভ হয়ে মরে গেছে। হঠাৎ করে গির্জার ঘণ্টাধ্বনি কানে আসতেই সে চমকে ওঠে! সাথে সাথে দেখতে পায় মিশনের সাইনবোর্ড। অন্ধকার হতে শুরু করেছে। মিশনের কাছে পড়ে আছে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। ভাবে, ওখানে তাঁবু খাঁটিয়ে রাত কাটিয়ে দেবে। তো সে নেমে পড়ে বাইকটি স্ট্যান্ডে দাঁড় করায়।
গির্জার টিমটিমে আলোজ্বলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে ইতিউতি করে, ভেতরে ঢুকবে কিনা ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পরিসরটি লক্ষ্ণীপুর চা-বাগানের অন্তর্গত। এখানে তো কোন গির্জা থাকার কথা না! আন্দাজ করে, হয়তো চা-বাগানের মালিক আর্থিক সংকটে পড়ে বেশ কয়েক একর ভ্যাকেন্ট ল্যান্ড খ্রিস্টান মিশনারির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এদিকে অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে উঠছে। বাম দিকে ষাড়েরগজ পাহাড়ের ঢেউ খেলানো রেখা সম্পূর্ণ মুছে গিয়ে তার চাঁদিতে ফুটেছে সন্ধ্যাতারা। জোতিষ্কটি থেকে ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে আসছে সবুজাভ সোনালি আভা। দিশা ধরে তাকিয়ে থাকলে চোখে কেমন যেন ধান্দা লাগে।
ক্যাচম্যাচিয়ে গির্জার কপাট খুলে ঝনাৎ করে তা বন্ধ হয়ে যায়। বেরিয়ে আসে লণ্ঠন হাতে কালোকোলা একজন মানুষ, তার মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চমকে ওঠে ককো! গুটিবসন্তের গাঢ় দাগে চোখ দুটি আধবোঁজা। মানুষটি লণ্ঠন তুলে ক্যারিয়ারে ব্যাকপ্যাকের ভারি লটবহরসহ মাউন্টেন বাইকখানা নিরিখ করে দেখে। তারপর হাতের জোরালো ইশারায় ককোকে গির্জার কমপাউন্ড থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। কাকো জানতে চায় – পাদ্রি মহোদয়ের বাসা কোন দিকে? সে অনুমতি চাচ্ছ – গির্জার আঙিনায় তাঁবু খাটিয়ে এক রাত্রি কাটানোর। প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় কালোকোলা মানুষটি চাপাস্বরে বিচিত্র ভঙ্গিতে গোঁ গোঁ আওয়াজ করে জোরালোভাবে ফের তাকে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা করে। মানুষটি স্পষ্টত বোবা, ককোর দিকে তীব্র নজর রেখে সে বুকে আঙুল দিয়ে ক্রশ চিহ্ণ আঁকছে। ভারি মুশকিলে পড়া গেলো তো, ককো ঠিক বুঝতে পারে না এর সাথে কীভাবে কমিউনিকেট করা যায়?
হতাশ ও খিন্ন হয়ে অতঃপর ককো বাইক ঠেলে গির্জার কমপাউন্ড থেকে বেরিয়ে আসে সড়কে। গ্রেইড করা সমতল সড়কে বাতি জ্বেলে বাইক চালাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। প্যাডেল মারতে মারতে সে নিজের ওপর বিরক্ত হয়। আজ ঢাকায় বন্ধু ইসমতের বাসা ছেড়ে কাকভোরে কমলাপুরে এসেছিলো ট্রেন ধরতে। দুপুরের ঘণ্টাদুয়েক পর সে কুলাউড়া জংশনে এসে পৌঁছেছিল। উচিত ছিলো, ঠিক তখনই বাইক হাঁকিয়ে পাহাড়ের দিকে মেলা দেয়া। কিন্তু সে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছে একটি রেস্তোরাঁয় বসে ডিমের মামলেট দিয়ে পরোটা খেয়ে। তারপর মফস্বল শহরের এদিক-ওদিক বাইকটি চালিয়ে আরো কিছুটা সময় কাটিয়েছে স্রেফ টনটর-মনটর করে। এখন তাকে অন্ধকারে গোনাগারি দিতে হচ্ছে। ক্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে কাকো জানে যে – পড়তি বেলা সাইট সিলেকশন করে সুরুজ ডোবার আগে তাঁবু খাটাতে পারলে – রাতটা উপভোগ করা যায়। অন্ধকারে শুধু সাইট খুঁজে পাওয়া নয়, তাঁবু খাটানোও ঝকমারি বিশেষ।
ভাবতে ভাবতে সে এসে পড়ে রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের প্রান্তিকে। এদিকের পথঘাট সম্পর্কে তার স্পষ্ট স্মৃতি আছে। বাগানের বেশ খানিকটা পাড়ি দিতে পারলেই পৌঁছানো যাবে নলডরি এলাকার বনবিভাগের অফিসের কাছে। ওখানে যেতে পারলে সে গার্ডদের কাছে অনুমতি চাইবে অফিসের কাছাকাছি খালি জায়গায় পাতকুয়ার পাশে তাঁবুটি খাটানোর। দরকার হলে তার বাবা যে একসময় ফরেস্টের ডেপুটি রেঞ্জার ছিলেন তাও উল্লেখ করবে। আশা করি ফরেস্ট গার্ডরা তাকে বিমুখ করবে না।
লণ্ঠনের আলোয় রোডব্লকটি চোখে পড়লে ককো ব্রেক কষে বাইক থামায়। সামনে গোড়ায় পাথরবাঁধা দীর্ঘ বাঁশ ফেলে সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ককো হাফপ্যান্ট পরা ধূসরচুলো চৌকিদারের সঙ্গে কথা বলে। দেহাতি চা-শ্রমিক মানুষটি দাঁতে খৈনি গুঁজে চিন্তিত মুখে তার কথা শোনেন। কিন্তু গেট খুলে তাকে পাস দিতে রাজি হন না। খুব বিনীতভাবে বলেন, ‘রাঙ্গিছড়া বিলকুল বিকি হো চুকা বাবু। আভি মালিক ভি নুতন, ম্যানেজার সাহেব ভি নুতন। কায়দা-কানুন সব বদল হো গয়া।’ ককো বুঝতে পারে, ম্যানেজারের কড়া হুকুম আছে – সন্ধ্যার পর কোন ট্রাক, ট্র্যাক্টর, রিক্সা বা সাইকেলকে বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে না দেয়া। এ অর্ডার না মানলে চৌকিদার চাকুরি হারাবে। বেশ কিছুক্ষণ চৌকিদারের সঙ্গে বাতচিত করেও তাকে বাঁশ তুলে গেট খোলার ব্যাপারে সে কনভিন্স করতে পারে না। অতঃপর খানিকটা নিরুপায় হয়ে ককো এদিকে কোথাও খালি জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানো যাবে কি না – চৌকিদারের কাছে জানতে চায়। এ প্রশ্নে তিনি বেজায় তাজ্জব হয়ে প্রথমে ধুন ধরে কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করেন! তারপর ঝোলা গোঁফ চুমরিয়ে বলেন, ‘বাবু আপ রাবার বাগান মে আপস চলে যায়ে।’ ককো জানতে পারে যে, কাছেই পঞ্চাশ একরের মতো জমিতে চারা লাগিয়ে নতুন এক প্ল্যানটার শুরু করেছেন রাবারের চাষ। গাছগুলো বড় হয়নি, ওখানে রাতের বেলা কোন চৌকিদারের পাহারা নেই। তিনি গেটের বাইরে এসে খানিক দূর হেঁটে গিয়ে ককোকে সংকীর্ণ একটি ট্রেইল দেখিয়ে দেন। সে চৌকিদারকে ধন্যবাদ দিলে তিনি ফের গোঁফ চুমরিয়ে বলেন, ‘বাবু হুঁশিয়ারছে রহো।’ তার উপদেশ হচ্ছে – ককো যেন রাবার বাগানের বাইরে না যায়। কারণ রাবার প্ল্যানটেশনের প্রান্তিকে আছে বাজ পড়ে আধপোঁড়া বিরাট বড় একটি চাপালিশ গাছ। ওই জায়গাটি ভারি খুঁতি, অর্থাৎ রাত বিরাতে ভুতপ্রেতের উপরি উৎপাত আছে।
এবার সে মাউন্টেন বাইকের হেডল্যাম্পের সাথে হেন্ডোলের ডগায় লাগানো সাইড ল্যম্পগুলোও জ্বালিয়ে দেয়। দু’পাশে চা-ঝোপের ভেতর দিয়ে তৈরি ট্রেইলে ঝরা পাতা মাড়িয়ে ছরছর করে বাইক আগ বাড়ে। আর চারপাশের নিঝুম প্রতিবেশ ভরে ওঠে ঝিঁঝি পোকার রহস্যময় ধ্বনিতে। ট্রেইলটি তাকে নিয়ে যাচ্ছে মস্ত মস্ত শেড ট্রি’র ঝুপসি অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন জঙ্গলে। দূরে কোথাও তীব্র স্বরে একটি পাখি ডাক ছাড়লে চমকে ওঠে ককো ব্রেক কষে। এদিকে পড়ে থাকা গাছের ডালপালায় ট্রেইল হয়ে পড়েছে দুর্গম। সে সাবধানে বাইক ঠেলতে ঠেলতে পখিটির চেরা স্বরে ডেকে ওঠার কথা ভাবে। সাথে সাথে তার স্মৃতি থেকে আচেনা কেউ যেন কুগান গেয়ে ওঠে! এ পাখিটির কণ্ঠস্বর তার চেনা। খেচরটি স্থানীয়ভাবে ‘ঝুটকুলি পাখি’ বলে পরিচিত। প্রমিত বাংলায় বা ইংরেজিতে একে কী নামে ডাকা হয় – সে ঠিক জানে না। অনেক বছর আগে তারা যখন নলডরি ফরেস্টের কাঠের বাড়িটিতে বাস করতো, তখন এ পাখি রাত-নিশীথে এসে পাতকুয়ার কাছের কড়ই গাছে বসে ডেকে উঠতো। তার মা পাখিটিকে একেবারেই পছন্দ করতেন না, বলতেন – এর কণ্ঠস্বর ডেকে আনে অশুভ আত্মাকে, সংসারে অমঙ্গল হয়। এরকম সংস্কারে তার বাবারও বিশ্বাস ছিল। দু-এক বার তিনি বন্দুকের আওয়াজ করে ঝুটকুলি পাখিটিকে তাড়িয়েও ছিলেন।
বাইক ঠেলতে ঠেলতে এবার ককো অনুভব করে যে, ট্রেইলটি উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। তার ক্লান্ত লাগে, শরীর থেকেও ঝরছে প্রচুর ঘাম। বুঝতে পারে, সে বেরিয়ে এসেছে রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের জয়েল থেকে। বাইকের হোন্ডেল বাঁকিয়ে হেডল্যাম্পের আলো ফেলে সে আশপাশ দেখে নেয়। কোথাও রাবারের চারা গাছ দেখতে না পেয়ে ভারি বিভ্রান্ত লাগে। ট্রেইল উঠে যাচ্ছে আরো উপরে। দু’পাশ ভরে ওঠে ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালার ঘন অরণ্যে। পাথর ও জেগে থাকা শিকড়-বাকড়ে উষ্টা-বিষ্টা খেতে খেতে তার বিরক্ত লাগে। ঝুটকুলি পাখিটি যেন তাকে অনুসরণ করে কাছে এসে উড়ে যেতে যেতে ফের ডেকে ওঠে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বেহদ অন্ধকারে তার অন্তরাত্মা কী কারণে কেবলই ছম ছম করে। তখনই লুডুর ছকে ছুড়ে দেয়া ছক্কার দানের মতো আসমানে দৃশ্যমান হয় ছয়টি নক্ষত্রের একটি গুচ্ছ।
একধরনের ঘোরের ভেতর সে ওঠে আসে পরিচ্ছন্ন এক উঠানে। তার বাইক ঘিরে ভুক-ভুকাচ্ছে তিনটি তেড়ে আসা রাটা-কুকুর। বিশেষ কিছু ভাবার সুযোগ পায় না ককো। ছনে ছাওয়া ঘরের বারান্দা থেকে লণ্ঠন হাতে নেমে আসে একটি খাসিয়া মেয়ে। সে পরিষ্কার ইংরেজিতে জানতে চায়, ‘মে আই হেল্প ইউ?’ ককো তার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলে, মেয়েটি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে বারান্দায় উঠে বসার আহ্বান জানায়। বাইক স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বারান্দায় উঠে সে একটি বেঞ্চে বসে। মেয়েটি ঘরের ভেতর চলে গেছে। সে মোড়ায় চুপচাপ বসে থাকা এক প্রৌঢ়কে খেয়াল করে অবাক হয়! তিনি তার দিকে তাকাচ্ছেন না, কিছু বলছেনও না, দিস ইজ ইনডিড স্ট্রেঞ্জ! তো সে কথা বলে শেকহ্যান্ডের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিচিত হয়। মোড়ায় বসে থাকা প্রৌঢ়ের নাম বাবিয়াং লং, ভদ্রলোক নিজেকে খাসিয়াপুঞ্জির মন্ত্রী হিসাবে পরিচয় দেন। তারপর কোন কথা না বলে ফের নিশ্চুপ হয়ে কেমন যেন তব্দিল হালতে চেয়ে থাকেন দূরের আকাশে। তার সামনে একটি দাঁড়ে বসে ঝিমাচ্ছে তিনটি টিয়া পাখি।
চিনি মেশানো লেবুজল নিয়ে ফিরে আসে মেয়েটি। কাকো এবার খেয়াল করে যে – এ যুবতী জিন্স ও টপের সাথে আড়াআড়িভাবে পরে আছে খাসিয়া মেয়েদের চাদর জাতীয় সনাতনি পোশাক। লণ্ঠনের আলো পড়ে তার গোলগাল গণ্ডদেশে ছলকাচ্ছে লালচে আভা। হাত বাড়িয়ে তার সাথে শেইকহ্যান্ড করে মেয়েটি নিজেকে ইনট্রোডিউস করে, ‘আই অ্যাম লারিসা আকরতারি, গ্ল্যাড টু মিট ইউ’ বলে। এবার ককো তার আগমনের উদ্দেশ্য ও তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানোর বাসনার কথা জানায়। মেয়েটি ফের নিরাবেগভাবে কথা বলে, ‘নো প্রবলেম, খাসিয়া পুঞ্জির পেছনেই আছে পয়-পরিষ্কার করা খালি জায়গা, ইউ মে পিচ ইয়োর টেন্ট দেয়ার, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।’ জবাবে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে ককো মন্তব্য করে, ‘ইউ স্পিক ওয়ান্ডারফুল ইংলিশ মিস আকরতারি। কিউরিয়াস টু নো হোয়ার ডিড ইউ লার্ন সাচ ফাইন ইংলিশ?’ মৃদু হাসিতে গালে টোল ফেলে লারিসা জবাব দেয়, ‘আই ওয়েন্ট টু অ্যা খ্রিশ্চিয়ান মিশনারি ইস্কুল ইন শিলং ফর নাইন ইয়ার্স। পড়া শেষ করে ফিরে এসে এবার বাবাকে পুঞ্জি চালাতে হেল্প করছি।’ তার বাবা বাবিয়াং লং কেবল ছয়টি তারাজ্বলা আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে মৃদু হাসেন। তাতে সোনা দিয়ে বাঁধানো একটি দাঁত ঝিক করে ওঠে।
চার্জার টর্চের আলোয় পুঞ্জির পেছনে তাঁবু খাটতে তার কোন সমস্যা হয় না। ভারি ক্লান্ত লাগছে, তাই শুকনা খাবার খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে বেডরোল পেতে সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম আসে না। শুয়ে শুয়ে সে খাসিয়া বাপ-বেটির কথা ভাবে। শৈশবে অত্র এলাকায় বসবাসের ফলে খাসিয়া সংস্কৃতির সাথে তার যৎসামান্য পরিচয় আছে। পান ও কমলালেবুর ব্যবসার কারণে আর্থিকভাবে এরা ছিলো সচ্ছল। তবে স্কুলে খাসিয়া ছেলেমেয়েদের যেতে সে কখনো দেখেনি। হালফিল দিনকাল বদলে গেছে, বোধ করি খাসিয়া কৌমের মধ্যেও ছড়াচ্ছে শিক্ষা-দীক্ষা। লারিসা আকরতারিকে তো বেশ এজুকেটেড-ই মনে হলো। কিন্তু তার বাবা বাবিয়াং লং, চুপচাপ মানুষটি কেমন যেন বিচিত্র প্রকৃতির! তিনি এমন ভঙ্গিতে মোড়ায় বসেছিলেন যে, তাকে দেখাচ্ছিল আদিবাসীদের জাদুঘরে ডিসপ্লে করা মূর্তিটির মতো। ঝুটকুলি পাখিটি এখানে এসেও উৎপাত শুরু করেছে। থেকে থেকে ডাক ছেড়ে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে চেরা স্বরে। ইচ্ছা হয়, তাঁবু থেকে বেরিয়ে গাছের ডালা নিশানা করে ছুড়ে দেয় ঢিলা-পাথর। কাছেই গোটা কতক শিয়াল ডেকে উঠলে কম্বলে কুচিমুচি লাগা ককো শিউরে ওঠে। একটু পরই আশপাশের চরাচর ভরে ওঠে অসামান্য নিস্তদ্ধতায়।
কিন্তু তার ঘুম আসে আসে না। পাশ ফিরতেই স্মৃতিপটে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে – নাপা ভ্যালিতে ইলোরার সঙ্গে মাউন্টেন বাইক হাঁকিয়ে ক্যাম্পিং করার নানা ডিটেলস্। তাঁবুতে শুয়ে ইলোরা দৈহিকভাবে অন্তরঙ্গ হতে চাইতো পুরোমাত্রায়, কিন্তু প্রথমেই অনাবৃতিতে আপত্তি তুলতো। সে পছন্দ করতো – স্পর্শের মৃদু মৃদু নিষ্পেষণে ওয়ার্ম আপ হতে। প্রচুর সময় নিয়ে তপ্ত হতো সে, তারপর হাঁটুতে ভর দিয়ে ককোর দু’হাত মুঠো করে চেপে ধরে বুকের ওপর থেকে তার চোখে চোখ রাখতো। নিচে শুয়ে ডিম করা ক্যাম্পিং লণ্ঠনের আলোয় ককো দেখতে পেতো, খোল থেকে শামুকের নরম শরীরটি বেরিয়ে আসার মতো তার বক্ষদেশ থেকে সরে যাচ্ছে প্যাডেড ব্রা’র খোলস। এভাবে ইলোরা তাকে উদ্দীপ্ত করতো বটে, তবে তৎক্ষণাত অধিক কিছু করার সুযোগ দিতো না। নিচে পেপার-ওয়েট চাপা কাগজটির মতো শুয়ে থেকে তার মেলায় জলবেলুনের দিকে চেয়ে থাকা কপর্দকশূন্য বালকের মতো মনে হতো। তবে এ অসহায় পরিস্থিতির অবসান হতো দ্রুত। শিশুকাল থেকে আমেরিকায় বেড়ে ওঠা ইলোরা শরীরের ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ছিলো।
ইলোরার কথা ভাবতে গিয়ে তার সঙ্গে টানাপোড়েনের ব্যাপারটাও ফিরে আসে মনে। তাদের মধ্যে রুচি, মানসিকতা ও লাইফস্টাইলের প্রভেদ প্রচুর। ইলোরা একাডেমিক টাইপের। চেন্নাইতে সে মাত্র দু-বছরের কনট্রাকটে কাজ করতে গেছে। একটু পয়সাপাতিসহ ফিরে এসে ডক্টরেটের উদ্যোগ নেবে, ফের মাতবে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি ও গবেষণায়। অত্যধিক লেখাপড়া করে ডিগ্রি হাসিলের ধাত নেই ককোর। সে পছন্দ করে হাতে-কলমে কাজ করা। নিউজার্সিতে হাইস্কুলে পড়ার সময় সে বাবার সস্তা ঝরঝরে হয়ে আসা পুরানো টয়োটা গাড়ি মেরামত করে দিতো, ম্যানুয়েল দেখে সারাই করতে পারতো এয়ারকন্ডিশনার। মেকানিক হিসাবে তার আয়-উপর্জন মন্দ না। ফ্যামিলিকে ভরনপোষণের দ্বায়িত্ব সে এড়াতে চায় না। এখনই কারো সঙ্গে ঘর বাঁধার উপায় তার নেই। ককোর বড়সড় একান্নবর্তী পরিবার সম্পর্কে ইলোরার কোন আগ্রহ ছিলো না। যাক, ভালোই হয়েছে তার সঙ্গে রিলেশনশিপটি চুকেবুকে যাওয়াতে। সে ষাড়েরগজ পাহাড়ে তাঁবু খাটিয়ে একাকী ক্যাম্পিং করতে এসেছে। নিশীথের এই ঝিঁঝিমুখর পরিবেশে ইলোরার কথা ভেবে মন খারাপ করতে চায় না। তবে হাইকিং করতে গিয়ে বুটজুতা ফুঁড়ে পায়ে বিঁধে যাওয়া কাঁটাটির মতো ব্রেকাপের স্মৃতি তাকে পীড়া দেয়।
পাশ ফিরে শুয়ে সে খাসিয়া মেয়েটির কথা ভাবে। কী যেন নাম… লারিসা আকরতারি। শি সিমস্ নাইস, ফ্রেন্ডলি অ্যান্ড স্মার্ট। তার গোলগাল রলি-পলি দেহে একটু শেইপলি ব্যাপার আছে। ইলোরা একহারা গড়নের ফিগার সচেতন মেয়ে। শেইপলি কোন মেয়ের সঙ্গে ককো আজ অব্দি ডেট করেনি। আগামীকাল তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে, এখানে দিন কয়েক হাতে নিয়ে ক্যাম্পিংয়ে আসতে পারলে লারিসাকে নক করে ডেট এর জন্য সে ট্রাই করতে পারতো। সে চেষ্টা করে – লারিসার লণ্ঠনের আভায় লালচে হয়ে ওঠা মুখটি ভাবতে। তখনই মনে হয়, ইলোরা ফোর্সফুলি তাকে টেনে নিচ্ছে বুকের কাছে। বিভাজন থেকে উত্থিত জুঁই-সিনেমনের যুগ্ম সৌরভকে সে ঠিক অবজ্ঞা করতে পারে না। ইলোরা ককোর হাতখানা টেনে নিয়ে তার কোমরে প্যাচায়। সে অনুভব করে, হাতের নিবিড় পেষণে নিতম্বে খেলে যাচ্ছে ঊর্মি। তখনই নিজের অভ্যন্তরে বিষ্ফোরিত হয় সে। শিয়ালগুলো তাঁবুর কাছাকাছি এসে সমবেতস্বরে ডেকে উঠে ফের চমকে দেয় তার পিলে!
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে ককোর। তাঁবুর জিপার খুলে বাইরে সে মাথা বাড়ায়। সাথে সাথে রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। ঘাসপাতা ও ঝোপঝাড়ে সর্বত্র জমেছে এন্তার শিশিরবিন্দু। সুরুজের আলোয় তা ঝিলমিল করছে। একটি ভাঙাচোরা গাছের ল্যাতপ্যাতে ডালে বসে আছে কাঠঠোকরা পাখি। তার ঠোঁটে চেপে ধরা পতঙ্গ। খোড়ল থেকে তিনটি ছানা চিঁউচিঁউ ডাক ছাড়ছে। মা কাঠঠোকরা শাবকদের মুখে তুলে দিচ্ছে পতঙ্গের আহার। সে ক্যামেরা বের করতে চায়। কিন্তু কেন জানি এমন অবাক লাগে যে, ককো চমকে ওঠে! কি ব্যাপার? বেরিয়ে এসে চোখ কচলে ভালো করে সে তাঁবুর চারপাশে চোখ বুলায়। সারা পরিসর ভরে আছে শিশিরমাখা রাবারের ছোট্ট ছোট্ট চারাগাছে। খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রীর ঘরের ঠিক পেছনে – পানবুরুজের মধ্যিখানে পয়পরিষ্কার করা এক চিলতে ভূমিতে সে কালরাতে তাঁবু খাটিয়েছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে চারদিকে টর্চের আলো ফেলে পুঞ্জির অন্যান্য ঘরদুয়ারের অবস্থানও খুঁটিয়ে লক্ষ করেছিল। আস্ত একটি খাসিয়াপুঞ্জি উবে গেলো কীভাবে? সে চতুরদিকে আবার নিরিখ করে তাকায়, কিন্তু কোথাও পানবুরুজের কোন নিশানা দেখতে পায় না। তখনই তার চোখ ফের নিবদ্ধ হয় ভাঙাচোরা গাছটিতে। ফরেস্টে কাজ করা লোকের সন্তান সে, গাছপালা কম-বেশি ভালোই চেনে। বৃক্ষটি যে চাপালিশ প্রজাতির তা এবার বুঝতে পারে, তবে বাজ পড়ে জ্বলেপুঁড়ে জড়কি-মকড়ি লেগে গেছে, তাই কেমন যেন ভাঙাচোরা দেখাচ্ছে। চকিতে রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের দোহাতি চৌকিদারের হুঁশিয়ারি মনে পড়ে – ‘গাছটি খুঁতি, বাবু।’ শিউরে ওঠে ককো। তাঁবু গুটাতে গুটাতে নিজেকে বলে –‘লেটস্ গেট দ্যা হেল আউট অব হিয়ার।’
মাউন্টেন বাইকে ব্যাকপ্যাক চাপিয়ে তা ঠেলতে ঠেলতে খাসিয়া পুঞ্জির তালাশে ফের এদিকওদিক তাকায়। পায়েচলা ট্রেইল আপনা আপনি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে। দা হাতে কাজ করতে কয়েকজন দিনমজুর বাগানে ঢুকছে। সে থেমে তাদের কাছে খাসিয়া পুঞ্জি কোন দিকে জানতে চায়। তারা প্রথমে কিছু না বলে অর্থবোধক দৃষ্টিতে পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর তাদের একজন কান থেকে আধপোড়া বিড়িটি হাতে নিয়ে বলে ওঠে, ‘সাব, এইখানে দাঁড়াইয়া থাইকেন না, অসুবিধা আছে, জলদি সাইকেল চালাইয়া বড় সড়কে গিয়া উঠেন।’ দিনমজুর মানুষটি ম্যাচ জ্বেলে বিড়ি ধরিয়ে ইশারায় সবাইকে ট্রেইলের একপাশে সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিতে বলে। তো ককো বাইকে উঠে পড়ে। হাল্কাভাবে প্যাডেল মারতে মারতে সে স্পষ্ট অনুভব করে, দিনমজুররা পেছন থেকে বেজায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে! ‘হোয়াটস্ হেল ইজ গোয়িং অন হিয়ার, যিশাস ক্রাইস্ট’, বলে গজ গজ করতে করতে ককো বাইকের গতি বাড়ায়।
রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের কাছাকাছি বড় সড়কে এসে সে আর পিছন দিকে তাকায় না। ককোর ভেতর কেমন যেন অজানা এক অতঙ্ক ভর করেছে। কিন্তু এসব নিয়ে নীরবে প্রতিফলন করার সময় তার নেই। কুলাউড়া জংশনে ককোর পা চালিয়ে এখনই ফিরে যাওয়া উচিত। আজকের ট্রেনে তার সিলেট শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা। তো অজানা ভীতির রেসপন্সে সে তেড়িয়া হয়ে প্যাডেল মারে। কালুটি চা বাগানের কাছে একটি ছড়া-নদীর উপর কাঠ-বাঁশে তৈরি সেতু অতিক্রম করতে করতে সে উজান থেকে দু’পাশে চিলতে বালুচর নিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসা নদীটির দিকে তাকায়। ফকফকে সাদা বালুকার দিকে নজর পড়তেই সে ছড়া-নদীটিকে চিনতে পারে। ককো বাইকটি স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে নেমে আসে বালুচরে।
জলের বয়ে যাওয়া মৃদু স্রোতে ডানকানা মাছগুলো অবিকল আগের মতো বুঁজকুড়ি কাটছে। শৈশবে নলডরি ফরেস্ট বিটে বাস করার সময় তার বাবা একটি সেকেন্ডহ্যান্ড হোন্ডা মোটরসাইকেল কিনেছিলেন। মাঝেমধ্যে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে তিনি ককোকে এদিকে নিয়ে আসতেন। বালুচরে পা দিতেই পুরানো দিনের কোন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাওয়ার মতো নদীটির সান্নিধ্য তার কাছে ভীষণ ভালো লাগে। ছড়া-নদীটি একদিকে বেঁকে, বালুচরে ঢুকে পড়ে তৈরি করেছে ডিমভরা বোয়াল মাছের পেটের আকৃতিতে ছোট্ট এক অগভীর দহ। ককো তার কাছাকাছি হলে, বালুকায় গোঁট বেঁধে বসে থাকা একগুচ্ছ প্রজাপতি ডানা মেলেছড়ায় বর্ণিল আবহ। এ দৃশ্যও তার চেনা। মনে হয়, শৈশবে যে প্রজাপতিগুলো তার পদশব্দে উড়ে গিয়েছিল, তাদের ছানাপোনারা বোধ করি এ নদীটির কুলে কুলে আজকাল উড়ে উড়ে চয়ন করছে দণ্ডকলসের মধু।
ককো ঝুঁকে এসে ছোট্ট দহটির থির হয়ে আসা জলের দিকে তাকায়। ছোটবেলা বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে বেড়াতে আসলে সে ঠিক একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শরীর বাঁকা করে জলতলে দেখতো তার নিজস্ব ছায়া। সে নিজের প্রতিবিম্ব নিরিখ করে দেখার জন্য আরেকটু ঝুঁকে যায়। কিন্তু যাকে দেখতে পায়, তার ছায়ারূপ তৎক্ষণাৎ ককোর মধ্যে ছড়ায় ভীতি জাগানিয়া বিভ্রান্তি। না, নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়নি ককো, তার জায়গায় খাসিয়া মেয়ে লারিসা মুখখানা অভিমানি করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দিস ইজ ইনডিড ভেরী স্ট্রেঞ্জ! সে মাথা ঝাঁকিয়ে করোটি থেকে বিভ্রান্তির কুয়াশা কাটাতে চায়। কিন্তু এতে ফল কিছু হয় না, লারিসা এবার নীরব দৃষ্টিতে তাকে কী যেন বলতে চাচ্ছে। ককোর মধ্যে অজানা আতঙ্ক ফের জোরেশোরে ফিরে আসে। সে লম্বা লম্বা পা ফেলে বালুচর থেকে ফিরে বাইকের প্যাডেলে পা রাখে। কালুটি বাগানের শেড ট্রি’র ছায়ায় প্যাডেল মারতে মারতে সে গজগজ করে বলে, ‘হালি কাউ, দ্যা হৌল থিং সাউন্ডস্ লাইক অ্যা মিস্ট্রি স্টোরি, সো আনবিলিয়েবোল!’
সিলেটগামী ট্রেন আসবে আরো ঘণ্টাখানেক পর। তো কুলাউড়া শহরে না থেমে, মাউন্টেন বাইকটি ঠেলে ককো উঠে আসে রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। এবার বাইকখানি ডিসেম্বল করে বড়সড় ব্যাগটিতে পোরার পালা। ককো চাক্কা-ফাক্কা খোলাতে কনসেনট্রেট করে। তাকে ঘিরে জমে যায় রীতিমতো ভীড়। সে আলগা করে হেন্ডোলটি ব্যাগে পুরতে যায়। তখন ভীড়ের এক ফাঁক দিয়ে দেখে – ওভারব্রিজের গোড়ায় জীপ থেকে নামছে টিয়া। মেয়েটির পুরো নাম তাসনুভা আহমেদ। বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ কেরোলাইনা অঙ্গরাজ্যের শার্লট বলে একটি শহরে। সপ্তাহ দুয়েক আগে তারা একই ফ্লাইটে স্বদেশে ফিরেছে। দুবাই এয়ারপোর্টে ছয় ঘণ্টা স্টপঅভার ছিলো, তখন কথাবার্তা বলে তাদের মধ্যে খানিক চেনাজানা হয়েছে।
টিয়া একা না, তরুণ এক দম্পতি তাকে নিয়ে রিফ্রেশমেন্ট রুমের দিকে হাঁটছে। চাকাওয়ালা একটি ডাফোল-ব্যাগ টানতে টানতে টিয়ারও চোখ পড়ে ককোর ওপর। সে থেমে হাত নেড়ে ওয়েভ করতে করতে বলে, ‘ককো, হিয়ার ইউ আর, গুড টু সি ইউ অ্যাগেইন।’ ককো উঠে গিয়ে টিয়াকে ‘হ্যালো’ বলে তার সঙ্গে আসা দম্পতির সঙ্গে পরিচিত হয়। টিয়ার খালাত ভাই আসফার ও তার স্ত্রী রুমা তাকে ট্রেনে তুলে দিতে স্টেশনে এসেছেন। শুনে সে অবাক হয় যে, আসফার সাহেব রাঙ্গিছড়া চা-বাগানে ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইউনিভারসিটিতে টিয়া সোশিওলজিতে মাস্টার্স শেষ করতে যাচ্ছে। থিসিস হিসাবে সে মূলধারার জনগোষ্ঠী কর্তৃক আদিবাসীদের নিগৃহীত হওয়ার বিষয় নিয়ে গবেষণা করছে। ককো জানতে পারে যে, টিয়া রাঙ্গিছড়ার কাছাকাছি বস্তিতে সপ্তাদিন গবেষণা বিষয়ক ডাটা সংগ্রহ করে কাটিয়েছে। ককোর বাইক ডিসেম্বল করা শেষ হয়নি, তাই টিয়া ‘সি ইউ অ্যাগেইন’ বলে আত্মীয় দম্পতির সঙ্গে রিফ্রেসমেন্ট রুমের দিকে হেঁটে যায়।
বাইকের লুজ্ পার্টসগুলো ব্যাগে পুরে চাকা ঘর-ঘরিয়ে ককো প্ল্যাটফর্মের বুকস্টলের কাছে এসে থামে। টিয়া তার আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, এ সময় তার কাছাকাছি হতে চাচ্ছে না ককো। সে দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও ট্যাবলয়েডগুলো নাড়াচাড়া করে। দুবাই এয়ারপোর্টে হিপহ্যাগার জিন্সের সাথে ট্যাংকটপে ঊর্ধ্বাঙ্গ এক্সপোজ করা টিয়াকে দেখে ককোর মনে হয়েছিলো, শ্যামল গাত্রবর্ণের খানিক সেক্সি লুকিং মেয়েটি হয়তো ভারতীয় কিংবা হিস্পানিক।
টিয়া চোখমুখ শুকনা করে দুবাই এয়ারপোর্ট লউঞ্জের রকিংচেয়ারে বসে ল্যাপটপে খুটখাট করছিলো। একটু আগে কুপন ব্যবহার করে একটি ইন্ডিয়ান রেস্তেরাঁর ব্যুফেতে ভরপেট খেয়ে ককোর মেজাজ ছিলো দারুণভাবে চাঙ্গা। সে কাছে গিয়ে টিয়াকে জানিয়েছিলো, ‘ইফ ইউ কেয়ার ফর ইন্ডিয়ান ব্যুফে, ইটস্ ফ্রি, ইনফরমেশন কাউন্টারে গিয়ে বোর্ডিংপাস দেখালে ওরা কুপন দিয়ে দেবে।’ এ তথ্যে শুধু খুশিই হয়নি, সে দাঁড়িয়ে ককোর কব্জি চেপে দিয়ে নিজে থেকে পরিচিত হয়েছিল। তখন সে জানতে পারে যে, টিয়া দেশে যাচ্ছে তার থিসিসের জন্য ডাটা সংগ্রহ করতে। সে ঢাকায় গিয়ে উঠবে বনানীতে তার নানা-নানীর বাসায়।
ডিরেকশন জেনে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে টিয়া চলে গিয়েছিলো ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁটির দিকে। হাসিতে চোখ দুটি ছোট হয়ে আনন্দে তার মুখের খানাখন্দ ভরে যাওয়ার মিনি ইমেজটি ককোর বুকে ঝিক করে উঠেছিল। পেছন থেকে অ্যাপিল ছড়ানো তার দেহলতাটি অবলোকন করে ককোর মনে হয়েছিলো, ইট ইজ টাইম টু ফরগেট অল আবাউট ইলোরা, অ্যান্ড পারহেপ্স ফাইন্ড এনাদার গার্ল অ্যান্ড স্টার্ট ডেটিং এগেইন।
দুবাই এয়ারপোর্ট লাউঞ্জের রিক্লাইনার চেয়ারে রিল্যাক্স হয়ে বসে জেটলেগের ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়েছিল ককো। টিয়া ফিরে এসে তাকে হাফ-স্লিপ হালতে দেখতে পায়। তো সে কোন শব্দ না করে সরে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক পর সে আবার ফিরে এসেছিল স্টারবাকের তপ্ত এক পেয়ালা কফি নিয়ে। তারপর তাকে, ‘রাইজ অ্যান্ড শাইন ইফ ইউ কেয়ার টু ক্যাচ দ্যা ফ্লাইট টু ঢাকা,’ বলে জাগিয়েছিল। ফ্লাইটের তখনো ঘণ্টাদেড়েক দেরি। তো কাছাকাছি বসে কফি পান করতে করতে জমে উঠেছিল তাদের কথাবার্তা। বোর্ডিংয়ের কল হওয়া মাত্র টিয়া ব্যাকপ্যাক নিয়ে ঢুকেছিলো লেডিজ রুমে। বেরিয়ে আসে সে চুড়িদার সালোয়ারের সাথে ফ্লোরাল ডিজাইনের প্লিট দেয়া লং কামিজ পরে। একদম পরী সেজে সে ককোকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলো! তার পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্লাশঅনের কৃত্রিম বর্ণের ওপর সহজাত লজ্জার রক্তিমাভা ফুটিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো, ‘আমার নানা-নানী খুব কনজারভেটিভ। মাত্র হজ করে মক্কাশরীফ থেকে ফিরেছে। দে হেইট সিয়িং মি ইন জিন্স এন্ড ট্যাংকটপ।’ লাইনের চাপে সামনে বাড়তে বাড়তে ককো ঘাড় বাঁকিয়ে মৃদুস্বরে বলেছিল, ‘দ্যাট ইজ টোটালি আন্ডারস্টুড।’ তখনই তাদের মধ্যে বিনিময় হয়েছিল গাঢ় দৃষ্টি। আর ককোর মনে হয়েছিলো, ‘দিস গার্ল ইজ ভেরি প্রিটি অ্যান্ড কুল।’
আত্মীয়দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে ওঠার সময় ফার্স্টক্লাস-এসি কম্পার্টমেন্টের দোরগোড়ায় ফের দেখা হয় টিয়ার সঙ্গে। তারা নিরিবিলি একটি কুপেতে বসে। জিন্সের সাথে রিক্সার মোটিফ আঁকা একটি ফতুয়া পরেছে টিয়া। সে মেকআপ নেয়নি, তাই তাকে কেমন যেন আটপৌরে ও ফ্রেন্ডলি দেখাচ্ছে। ককো, ‘সো নাইস টু সি ইউ এগেইন, আই গেজ কোইন্সিডেন্টালি’ বলে বাতচিতের সূত্রপাত ঘটায়। রাঙ্গিছড়ার কাছাকাছি ক্যাম্পিং করতে গিয়ে ককোর একটু ঝামেলা হয়েছিল জানতে পেরে টিয়া সহানুভূতি দেখিয়ে বলে, ‘ আগে জানতে পারলে তোমাকে আফসার ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম। হি ইজ সাচ অ্যা জেনারাস হোস্ট, তোমার তাঁবু খাটাতে কোন সমস্যাই হতো না।’ ককো আলোচনার মোড় পাল্টিয়ে জানতে চায়, ‘সো টেল মি আবাউট ইয়োর ডাটা কালেকশন।’ টিয়া বিষণ্ণ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার ল্যাপটপ অন করতে করতে বলে, ‘যে ডাটা আমি কালেক্ট করেছি, তার কোয়ালিটি খুবই রিচ, আই অ্যাম হেপি আবাউট দ্যা আউটকাম। কিন্তু একটা কথা বলি, বাংলাদেশী সমাজ খুব লিবারেল, আই লাভ বাংলাদেশ, আই হ্যাভ রেসপেক্ট ফর মাই প্যারেন্টস্ কানট্রি, সো ডোন্ট গেট মি রং, কিন্তু এখানকার মূলধারার কিছু সুপার পাওয়ারফুল মানুষ আদিবাসীদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছে, আদিবাসীরা কোর্ট-কাচারিতেও ন্যায়বিচার পাচ্ছে না।’
কথা বলতে বলতে সে ল্যাপটপের স্ক্রিনে রাবার বাগানের চারাগাছের আলোকচিত্র দেখিয়ে বলে, ‘এগারো বছর আগে এই জায়গাটি ছিলো খাসিয়া পুঞ্জির নিজস্ব সম্পত্তি। সোকল্ড রিচ অ্যান্ড পলিটিক্যালি পাওয়ারফুল গাই এখানে রাবার বাগান করতে চাইলো। খাসিয়ারা তার কাছে সস্তায় জমি বিক্রি করতে অস্বীকার দ্বন্দ্ব বাঁধে তাদের মন্ত্রী বাবিয়াং লঙের সাথে… এবং এ ঘটনা গড়াতে গড়াতে এমন ট্র্যাজিডি হয়ে দাঁড়ালো… তোমাকে কী বলবো।’ মন্ত্রী বাবিয়াং লঙের কথা শুনে বারুদের ঘষায় ম্যাচকাঠিটি জ্বলে ওঠার মতো পুরো ঘটনা জানতে ককোর কৌতূহল উথলে ওঠে। ‘ইফ ইয়োর ডাটা ইজ নট কনফিডেনসিয়েল… ওই যে ট্র্যাজিডির কথা উল্লেখ করলে, আসলে কী ঘটেছিল’ বলে ককো প্রশ্নবোধকভাবে তাকায়।
টিয়া ক্লিক করে ছবি বদলায়। স্ক্রিনে এবার কালুটি চা-বাগানের কাছাকাছি ছড়া-নদীটির বালুচর ভেসে ওঠে। দেখামাত্র ককোর ভেতর কী যেন তোলপাড় হতে থাকে। টিয়া ছবির দিকে ইশারা করে জবাব দেয়, ‘ডাটা ইস ইজ্যুয়েলি কনফিডেনসিয়েল, কিন্তু খাসিয়া পুঞ্জিতে যা ঘটেছে, এলাকার স্থানীয় লোকজন তা জানে, আমি উপাত্ত সংগ্রহ করেছি লোকেল মানুষজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, সো দিস ইজ সাম হোয়াট পাবলিক নলেজ, তোমার সাথে এ ডাটা শেয়ার করতে আমার কোন সমস্যা নেই।’
অধৈর্য হয়ে ককো এবার জানতে চায়, ‘হোয়াট অ্যাকচুয়েলি হ্যাপেন্ড, কি ঘটেছিলো?’ টিয়া ঝুঁকে এসে বলে, ‘আই অ্যাম গিভিং ইউ সাম ব্যাকগ্রাউন্ড ফার্স্ট। খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী বাবিয়াং লঙের মেয়ে লারিসা আকরতারি… শি ওয়াজ অ্যান এজুকেটেড ইয়াং ওয়োম্যান। তুমি তো জানোই, ষাড়েরগজ পাহাড়ের উল্টা দিকে ইন্ডিয়া। খাসিয়ারা ধর্মে খ্রিস্টান। লরিসা শিলঙের একটি মিশনারি স্কুলে অনেক বছর পড়াশুনা করেছে।’
টিয়া একটু পজ্ নিয়ে পুরো স্ক্রিন জুড়ে বালুচরের ছবিটি ফ্লাশ করে। ককো ফের অধৈর্য হয়ে বলে, ‘সো হোয়াট?’ টিয়া জবাব দেয়, ‘আই নিড টু গিভ ইউ অ্যা লিটিল মোর কনটেক্সট, ওই যে রিচ অ্যান্ড পলিটিক্যালি সুপার পাওয়ারফুল গাই… সে খাসিয়া পুঞ্জির মানুষজন সবাইকে, বিশেষ করে বাবিয়াং লংকে নানাভাবে হেরাস করছিল। তো তার মেয়ে লারিসা আকরতারি মৌলভিবাজারে যায় এর বিহিত হিসাবে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে। ফেরার পথে কুলাউড়া থেকে সে রিক্সা ধরে কালুটি বাগানের ভেতর দিয়ে পুঞ্জিতে ফিরছিল। পথে সন্ধ্যা নামে… অ্যান্ড ইট ওয়াজ ভেরি স্যাড, এ ছড়া-নদীটির ব্রিজের তলায় ওঁত পেতে বসে ছিলো ভাড়াটে মিসক্রিয়েন্টরা। তারা রিক্সাওয়ালাকে মুখে রুমাল গুঁজে, গাছের সাথে বেঁধে লারিসাকে বালুচরে ফেলে গ্যাংরেপ করে।’
শুনে ককোর বুকের ভেতর ভারি অশান্তি লাগে। লারিসা ও বাবিয়াং লঙের সঙ্গে তার যে গতরাতে দেখা হয়েছে, এ কথা টিয়াকে বলবে কি না ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ককো চুপ মেরে আছে দেখতে পেয়ে টিয়া ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করতে করতে বলে, ‘লিসেন, দিস ইজ নট অল, দ্যা ইনজাস্টিজ ওয়াজ সো হিউজ, দ্যা ট্র্যাজিডি ওয়াজ সো বিগ… তোমাকে কী বলবো… রেপের ঘটনা ঘটার দু-দিন পর রাতের বেলা কে বা কারা খাসিয়া পুঞ্জিতে বের-আগুন দেয়। বের-আগুন কী তুমি বুঝ, ককো? স্থানীয়দের ভাষ্যানুযায়ী… বের আগুন হচ্ছে, বাড়িঘরের চারদিক ঘিরে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন দেয়া। আরো দুজন খাসিয়া মানুষের সাথে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মৃত্যু হয় সদ্যধর্ষিতা লারিসা ও তার বাবা বাবিয়াং লঙের। তারপর পুঞ্জির বাদবাকি মানুষজন ষাড়েরগজ পাহাড় অতিক্রম করে পালিয়ে যায় ইন্ডিয়ার দিকে। অ্যান্ড নাউ দেয়ার প্রাপার্টি ইজ টার্নড্ ইনটু অ্যা রাবার গার্ডেন।’
ককোর হঠাৎ করে শরীর খারাপ লাগে। সে বাথরুমের অজুহাত দিয়ে উঠে পড়ে। কিন্তু বাথরুমের ছোট্ট আয়নাটির দিকে তাকাতে তার আতঙ্ক হয়। কুপেতে ফেরার পথে সে করিডরে একটু সময় থামে। ঠিক বুঝতে পারে না, গতরাতে তার অভিজ্ঞতার কথা… হুইচ ইজ সো আনবিলিয়েবোল, টিয়াকে পুরো বিষয় বললে সে কী তাকে বিশ্বাস করবে? কাচের জানালার ওপাশে ছুটে যাচ্ছে ধানের খেত ও গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বাছুরসহ গাই-গরু। ট্রেন এসে থামে বরমচাল স্টেশনে।
কুপেতে ফিরে এসে দেখে, টিয়া জানালা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তুকমার শরবত বিক্রেতা ছেলেটির ছবি তুলছে। ককো তার পাশে বসে। ডিজিটাল ক্যামেরাটি ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে টিয়া মন্তব্য করে, ‘ইউ লুক ভেরি ডিস্টার্ভড্ ককো। আমার ট্র্যাজিক ডাটা শুনিয়ে তোমার মন খারাপ করে দেইনি তো? এ ডাটাগুলোর কথা ভাবলে আমারই যা খারাপ লাগে।’ ককো এ আলাপে এনগেজ হতে চায় না, তাই জানতে চায়, ‘সিলেটে তোমার প্ল্যান কী?’ টিয়া জবাব দেয়, ‘আত্মীয়দের বাসায় উঠছি, আগামীকাল তারা আমাকে জাফলং নিয়ে যাবে। তারপর পুরো একটা দিন কাটাবো সিলেটের স্থানীয় পত্রিকার অফিসে খোঁজখবর নিয়ে। খাসিয়া পুঞ্জিতে ঘটা ট্র্যাজিডির খবর নাকি লোকেল পেপারে ছেপেছিল। ওই পেপারের একটা কপি আমার চাই।’
একটু বিরতি নিয়ে টিয়া এবার জানতে চায়, ‘সিলেটে তোমার কি পরিকল্পনা?’ ককো অন্যমনষ্কভাবে জবাব দেয়, ‘আমি হোটেলে উঠবো। আগামীকালটা আমারও ফ্রি আছে, ভাবছি ভোরবেলা মাউন্টেন বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়বো জাফলঙের দিকে।’ টিয়া খুশি হয়ে রেসপন্স করে, ‘লাভলি, পারহ্যাপ্স উই উইল মিট এগেইন ইন জাফলং।’
ম্রিয়মানভাবে ককো বলে, ‘আই ডোন্ট নো, হয়তো জাফলঙে আমাদের ফের দেখা হয়ে যাবে’, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে কোন উচ্ছ্বাস ফোটে না। সে জানালা দিয়ে চলমান দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে শৈশবে তার জাফলং যাওয়ার কথা ভাবে। একবারই সে জাফলং গিয়েছিলো মা-বাবার সঙ্গে। শিলাপাহাড় কেটে বেরিয়ে আসা স্বচ্ছতোয়া নদীজলের দিকে তাকিয়ে ভেসে যাওয়া গুচ্ছগুচ্ছ মাছ দেখার কথা তার মনে পড়ে। আর কেবলই মনে হতে থাকে, আগামীকাল বাইক হাঁকিয়ে জাফলং পৌঁছে সে কী ফের বহতা জলের দিকে তাকাতে পারবে। আর যদি-বা তাকায়, আর যদি তাতে ভেসে ওঠে লণ্ঠনের আভায় লালচে হয়ে ওঠা গোলগাল একটি মুখ, তাতে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে? কেন জানি বিভ্রান্তির কুয়াশায় তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে, মাথা ঝিমঝিম করে। ট্রেনটি ঝমঝমিয়ে পাড়ি দিচ্ছে ইলাশপুরের ঢালার ব্রিজ।
টিয়া চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘আর ইউ ফিলিং অলরাইট ককো?’ জবাবে সে মৌন থাকে।