ভোরের আলো ভালোমতো না ফুটতে নিশিমন ঘরে তার সদ্য মৃত স্বামীর লাশ রেখে নবাবি নৌকা ভাসিয়েছে পাথারের জলে। সেই কবে ছোট্ট বেলায় নৌকা চালিয়েছিল শখ করে, তারপর আর কখনো হাল ধরা হয়নি। আজ এই আলো আঁধারে চোখে নোনতা জলের দাগ থাকতে থাকতে অপটু হাতে আবার নৌকার হাল ধরেছে। আকাশে আবছা গাঢ় নীলের আভাস থাকলেও পাথারের জলে ঝুলে আছে অন্ধকার। নিশিমনের নবাবি নৌকা অন্ধকার ফুটো করেই ভাসতে ভাসতে যেন চলে যাচ্ছে দূর আকাশে মিটমিট করা তারার দিকে। ছেড়ে আসা ঘরে মৃত পড়ে আছে যে মকিম মাঝি, সে একদিন রাতে দূরের দৃশ্যমান তারাগুলো দেখিয়ে নিশিমনকে বলেছিল, দেখরে বউ, ওইখানে মনে হয় আল্লার আরশ। আল্লার আরশের নিচে আসমান জমিন। জমিনের মধ্যে অকুল পাথার। আর পাথারের পাড়ে শুধু তুই আর আমি।
তখন সদ্য বিবাহিত নিশিমন নাকের নথ দুলিয়ে বলেছিলো, যাও, তুমি আর আমি একা না। ওই যে ঝিঁঝিঁ পোকাগুলা ডাকে, ওরাও তো আছে আমাগো লগে।
লোকটা যখন হাসতো তখন মনে হতো হাসির শব্দে আশেপাশের গাছপালা নড়ছে। মকিম মাঝি তেমন হাসি হেসে সেই রাত দ্বিপ্রহরে জড়িয়ে ধরেছিল নিশিমনকে। গ্রন্থিল পেশী আর শক্ত পায়ের চাপে নিজের নরম দেহ পিষ্ট করতে করতে নিশিমন শুনেছিল লোকটা বলছে – থাকুক, ঝিঁঝিঁ পোকা থাকুক, আকাশের তারা থাকুক, পাথারের জল থাকুক, আর বুকের মধ্যে তুই থাক। আমাদের মিলনে যে ফল ধরবে তোর গাছে তার নাম রাখবো হাকিম। মকিম মাঝির ছেলে হাকিম হবে আমার নবাবি নাওয়ের সর্দার।
পুরোন সব কথা ভাবতে ভাবতে নিশিমন একা ভেসে চলে পাথারের জলে। কোথায় সেই মকিম মাঝি, কোথায় তার মানববৃক্ষের ফল নবাবি নাওয়ের সর্দার হাকিম! যে লোকটা বিগত দশ বছর একদিনের জন্যও ছেড়ে থাকেনি তাকে, গ্রামের লোকজনের বউ-পাগলা উপাধিতেও কর্ণপাত করেনি কোনদিন; সেই মকিম মাঝি এখন লাশ হয়ে পড়ে আছে ঘরে। সবই তো ঠিক আছে আল্লার দুনিয়ায়, শুধু লোকটা চারদিনের জ্বরে মরে গেল। অথচ পাথারের জল তো কাঁপলো না এতটুকু, ঝিঁঝিঁ গুলোওতো থামালো না শব্দ, সেই তো অন্ধকার কেটে ভোর হচ্ছে। শুধু দুনিয়াতে মকিম মাঝি নাই। আল্লাহ এ তোমার কেমন আচার! নিশিমন দাঁড় বায়। অন্ধকার ভাঙতে ভাঙতে আহাজারির নদী পেরিয়ে সে যেন যেতে চায় ওই দূর তারার কাছে আল্লাহর আরশ যেখানে।
ভোরের ভোঁতা একটা আলো ছড়াতে শুরু করেছে চারদিকে। জলের উপর ঝুলে রয়েছে কুয়াশা। তারপরও পাথারের অগভীর জলের তলে দেখা যায় লতাপাতা, মাছ, প্যাঁককাদা। নিশিমনের চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ে পাথারে। সেটার তরঙ্গ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যেন কেউ দুর্বল সাঁতারে কুয়াশা তাড়াতে চাইছে। নিশিমন কথা বলে নিজের সাথে – এই নাও, এই নবাবি নাওটা লোকটা পেয়েছিল তার দাদার কাছ থেকে। সেই আমলে এই নৌকায় করে পাথারের জলে ভাসতেন নবাব জমিদাররা। মাঝির ছেলে মাঝি হয়ে মকিম পেয়েছিল এই নাও উত্তরাধিকার সূত্রে। তারপর কত যত্ন প্রত্যাশায় সে এই নৌকা বাঁচিয়ে রেখেছিল নিজের উত্তারিধিকারের জন্য। নিশিমনকে মকিম প্রায়ই বলত তার স্বপ্নের কথা। তার যখন ছেলে হবে, তখন তার নাম রাখা হবে মকিম। বাপের নামের সাথে মিলিয়ে পুত্রের নাম। দুজন মিলে এই নাও নিয়ে প্রতিবছর বৈশাখী আড়ংয়ে পাথারে খেলবে নৌকাবাইচ। ঘাটের সামনে বেঁধে রাখা তার নবাবি নাও দেখে পাথার দিয়ে বর্ষায় নতুন বউ নাইওরে যেতে যেতে মুগ্ধ হয়ে বলবে – ওই দেখা যায় বাপবেটার নবাবি নাও।
নিশিমন সেসব গল্প শুনে হাসতো আর হাসতো। আজ এই একলা পাথারে নবাবী নাওয়ের মালিক যে একমাত্র সে-ই। অদম্য কান্নায় নিশিমনের বুক ফেটে যায়। কী এমন ক্ষতি হতো আল্লাহ যদি একটা ছেলে দিত তাকে? মকিম মাঝি নাই, এখন হাকিম মাঝি তো অন্তত হাল ধরতে পারতো নাওয়ের। বিয়ের দশ-দশটা বছর চলে গেছে, একটা ছেলের জন্য তাদের প্রতীক্ষা শেষ হয়নি। গত আশ্বিনে লোকটা তাকে বলেছিল – চল নিশিমন, তোরে নিয়া গাওসুল পীরের মাজারে যাই। জিন্দাপীরের তাগা-পড়ায় নাকি কুবৃক্ষেও ফল ধরে। আমরা তো আর তা চাই না, চাই শুধু মানিক ধন। আমাগো নবাবী নাওয়ের সর্দার হাকিমরে।
লোকটার চাপাচাপিতে নিশিমন গিয়েছিল গাওসুল পীরের দরগায়। সেই মাজারের খাদেমের দেওয়া দোয়া-পড়া কালো তাগা পরেছিল কোমরে। কিন্তু আশ্বিন গেল, কার্তিক গেল, ঘরের চালায় নতুন লাউ ডগায় ফুটল কচি ফুল। শুধু ফুল ফুটল না তার জঠরে। মাঘের শীতে কাঁথা গায়ে স্বামী-স্ত্রী জড়াজড়ি করে কেঁদেছে। বাইরে ঘরের চাল যেমন ভিজেছে শিশিরে, তেমনি ভেতরে স্বামী-স্ত্রীর চোখের জলে ভিজেছে গায়ের কাঁথা। তবু আসেনি তাদের নবাবী নাওয়ের নায়ক।
তারপর আবার একদিন মকিম মাঝি ভাসিয়েছিল নাও। এবার নিশিমনকে নিয়ে সে গিয়েছিল আলেকান্দার অলৌকিক পয়গামী বৃক্ষের কাছে। ওই গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করে, এই বৃক্ষ নবী সোলায়মানের আমলে জন্মেছিল আরব দেশে। সেই কোন কালে সোলায়মানী পয়গাম নিয়ে কোন এক কামেল পীরমুর্শিদ সেই বৃক্ষের একটা ডাল ভেঙে এনে লাগিয়েছিলেন এই দেশে। তারপর থেকে এই বৃক্ষ মানুষের কাছে পয়গামী বৃক্ষ নামে পরিচিত। এই বৃক্ষের ডালে মনের আশা পূরণের উদ্দেশ্যে মানুষ রঙ-বেরঙের সুতা বাঁধে। কারণ পয়গামী বৃক্ষ যে কথা বলে স্বয়ং নবী সোলায়মানের সাথে। নিশিমন তার মনের আশার সুতা বেঁধে দিয়ে এসেছিল পয়গামী বৃক্ষের ডালে। ফেরার পথে মকিম মাঝি যখন অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে মুখ করে বাইছিল তার নবাবী নৌকা, ঘোমটা দেওয়া নিশিমন তখন তাকে বলেছিল – আমার এসব বিশ্বাস হয় না। সামান্য একটা গাছে সুতা বাধলে কি পূরণ হয় মনের আশা!
মকিম মাঝি দাঁড় ফেলে শক্ত করে চেপে ধরেছিল তার মুখ। চুপ, একদম চুপ নিশিমন। আল্লাহ চাইলে কী না হতে পারে! নবী সোলায়মান পশু, পাখি, বৃক্ষ এমনকি জ্বিনের ভাষা জানেন। তুই কী মনে করছিস, নবী সোলায়মানরে পয়গামী বৃক্ষ বলবে না তোর কথা? তারপর উপরে ঘন নীল আসমানের দিকে তাকিয়ে নিচের পাথারিয়া জলের ভাসানে চোখের জল এক হয়েছিল তাদের। ও আল্লাহ, ও পয়গামী বৃক্ষ, তুই আরও শত বছর বেঁচে থাক। শুধু নবী সোলায়মানরে বলিস, সোনার নবাবী নাও খালি পড়ে রয় নতুন মাঝির অপেক্ষায়।
আকাশে আলো স্পষ্ট হতে থাকে খুব ধীরে ধীরে। নিশিমন নবাবী নাওয়ের দাঁড় ধরে কেঁদে চলে। আসলে কে ছিল বন্ধ্যা? সে নিজে, নাকি ঘরে লাশ হয়ে পড়ে থাকা মকিম মাঝি? কার দোষে নবাবী নাওয়ের হাল আজ তার হাতে! আল্লাহ, নবীর দোহাই দেওয়া পয়গামী বৃক্ষ তো কথা রাখেনি। গত ছদিন আগে মকিম মাঝি আবার আশায় বুক বেঁধেছিল। নিশিমন শুধু নিজের শূন্য মাতৃত্বের ক্ষোভে বলেছিল – যে পুরুষ পারে না একটা শূন্য কোল ভরে দিতে, তার আবার কিসের নাও সওয়ারির বাহাদুরি?
এই প্রথম লোকটাও সমান তেজে তার চুলের গোছা টেনে ধরে বলেছিল – যে নারীর গর্ভফুল শূন্য তার কেন এত তেজ? এমন নারীরে মানুষ বলে বাঁজা। নিশিমনও যেন কোন এক গায়েবী ক্ষোভে আটকুঁড়ে বলে গাল দিয়েছিল লোকটাকে। তারপরই মকিম মাঝি নাও ভাসালো পাথারের জলে। এবার সে যাবে পাথার ভেঙে বড় নদী ছাড়িয়ে ওপার ডাঙায়। সেখান থেকে সোনাভান পরীর দেশে। এবার না হয় অন্য নারীর গর্ভেই জন্ম নেবে তার নাওয়ের মালিক।
সেই যে লোকটা গেল, ঘরে ফিরল দুদিন পর। ঝড়বৃষ্টি ডিঙিয়ে মকিম মাঝির গায়ে তখন জৈষ্ঠ্যের রোদে পোড়া মাটির উত্তাপ। রক্তবর্ণ চোখে নিশিমনকে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছে। আসবে নিশিমন, আমাদের নবাবী নাওয়ের মাঝি ঠিক আসবে। হাকিম মাঝির নতুন নাও ভাসবে পাথারে। পাথার ছাড়িয়ে গাঙ, গাঙ ছাড়িয়ে দূর সমুদ্দুর। তারপর ওই দেখা যায় আল্লার নবী সোলায়মান, পয়গামী বৃক্ষ, নূরের আরশ। সেই জৈষ্ঠ্যের তাপ মকিম মাঝির গায়ে ছিল চারদিন। তারপর আজ লোকটা ঘরে মরে পড়ে আছে।
ভোরের আলোয় যখন কুয়াশা দৃশ্যমান, মৃদু বাতাস খেলছে জল-জলীয় খেলা, তখন নিশিমন আর তার নবাবী নাও মাঝ পাথারে। নিশিমনের মনে হয় দূরের পার ছেড়ে আসা মকিম মাঝি যেন এখনও দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষায়।
ভোরের নিস্তেজ সূর্যটা উঠতে থাকে আকাশে। মাঝপাথারে নাও নিয়ে ভাসতে থাকা নিশিমন কি নিয়ে ফিরবে মকিম মাঝির দরজায়? কিন্তু সে নতুন উদিত দুঃখের সূর্যের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদে। নিজের শূন্য জঠর খাঁমচে ধরে আর্তনাদ করে – ও পয়গামী বৃক্ষ, ও আল্লাহর নবী সোলায়মান, তুমি তো পশু-পাখি-বৃক্ষের ভাষা বোঝো, শূন্য গর্ভফুলের ভাষা কেন বোঝ না?
সুমন মজুমদার
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকর্মী ও নাট্যকার। প্রকাশিত উপন্যাস ও মঞ্চস্থ নাটক : রাইমঙ্গল।
চিত্রকর্ম : তানভীর হাসান