সম্পাদকীয় নোট
নিজের উপন্যাসের প্রধান চরিত্রই গায়েব! হ্যাঁ, ঔপন্যাসিক সাদিক হোসেন মনে হয় এরকম এটা মতলব নিয়ে এই উপন্যাসটা লিখতে চাইছেন। তাঁর প্রধান চরিত্রের কোনো ছাপ যাতে উপন্যাসে না লাগে, সেই পথে তিনি এগুতে চেষ্টা করছেন। প্রধান চরিত্রকে প্রান্তিকতম চরিত্রের দিকে ঠেলে পাঠানোই যেন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এইটা করতে গিয়ে তিনি অদ্ভুত সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। প্রথমেই একটা বিজ্ঞ বেড়ালের উপস্থিতি ঘটছে। এরপর একজন ফরাসি লেখক কোনো কারণ ছাড়াই চলে আসবেন কলকাতায়। কিন্তু কেন তিনি আসবেন? কলকাতায় এদিকে চলতে থাকবে নাটক – ফ্যাসিবিরোধিতার নাটক। এইসব ঘটনা আর নাটকই যেন জীবনের অনিঃশেষ গল্প এই উপন্যাসের : ‘সাজিদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’। কিন্তু সত্যিই কি নেই? সেই রহস্য উন্মোচনের জন্যে এবার প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির দ্বিতীয় পর্ব।
সাজিদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই
পর্ব ২
মপাসাঁ কম গল্প লেখেননি। তারমধ্যে কোন গল্পে ব্রিয়াগানি চরিত্রটি রয়েছে সেটা খুঁজে পাওয়া সত্যিই বেশ কঠিন কাজ। শুরু করেছিলাম সকালের দিকে। খুঁজে পেতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। নাওয়াখাওয়া হয়নি। জানলার পাশে একটা কাক ডেকেই চলেছে। আমার সামনে মপাসাঁ সমগ্র। তাতে সিগারেটের ছাই। নিজেকে ক্লাউন মনে হচ্ছিল। গল্পটির নাম – দ্য ক্লাউন।
গল্পটি কোন শহরে ঘটছে? মপাসাঁ শহরটি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানাননি। তবে, কেন জানি না, আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম যাতে গল্পটিকে প্যারিসের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। প্যারিস সম্পর্কে আমি যে খুব জানি তা তো নয়। তবু প্যারিস বলতে আলো, লুত্রেক, ঘটনার ঘনঘটা, তর্ক – এসব মনে আসেই। এদিকে গল্পটি পড়তে পড়তে আমি এক আধো অন্ধকার অঞ্চলে ডুবে যাচ্ছিলাম। যেন রাত। আধখানা চাঁদ উঠেছে। পাইন গাছের ডালপালার ভেতর দিয়ে তার কিছুটা দেখা যায়। গ্যাসলাইটের আলো পর্যাপ্ত নয়। মাঝে মাঝে কুয়াশার সাদা দৃশ্যমান শুধু। পাথর বিছানো রাস্তাটি কুয়াশার নিচে। তার উপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটি চলে গেল।
ঘোড়ার গাড়িটির সঙ্গে গল্পটির সম্পর্ক নেই। ঘোড়ার গাড়ির উল্লেখই নেই গল্পটায়। তবু প্যারিসের বাইরে, এই আধা মফস্বলের মতো কোনো জায়গা, যেখানে কালেভদ্রে কেউ বিউগল বাজাবে না – সেইখানে, মূল রাস্তা থেকে বামদিক ঘুরে, অনেকটা দূরে – একটা দূর্গ। ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে কুয়াশাও সরে যায় খানিক – তখন দূর্গটিকে দেখা যায়। সেই দূর্গের শেষপ্রান্তে ফেরিওয়ালাদের চালাঘর।
নামেই ফেরিওয়ালা। আসলে চোলাইয়ের কারবারি। চুরি ছ্যাচড়ামোতেও পিছপা নেই। মোদ্দা কথা হল – পেটে ভাত জোগাড়ের জন্য যা-কিছু করতে হয় – এরা সবেতেই আছে। দালালিতে আছে – ডাকাতিতে নেই। নেই; কারণ বেশিরভাগই বুড়ো। তবে তারা দল বেঁধে থাকে। মোট ১৮ জন। প্রতিরাতে মেতে ওঠে মোচ্ছবে।
মোচ্ছবের মক্ষীরানী এলোপ। সে একাই মেয়ে। সে একাই ১৮ জনকে গরম করে। ১৮ জনকে ঠান্ডাও করে। ঠান্ডা ওরা সহজে হয় না। ঘোড়ার গাড়িটি নাটকের পর্দার মতো – চলে গেলে চালাঘরটি ফুর্তি আর ফোয়ারায় দূর্গটির পাশে ভেসে ওঠে, হাওয়ায় কাঁপে। ভাসে। ভাসতেই থাকে। যেন ফানুস। গ্যাসলাইটের আলোয় দেখা যায় ছায়া ছায়া নাচ। ছায়া ছায়া কাজ।
এদের সর্দারটি ব্রিয়াগানি। সেও বুড়ো। শরীরে বল কম। একসময় ঘোড়া ছিল। এখন মহিষ হয়েছে। মন্থর। তবে টাকাপয়সার হিসাবে খাসা। যদিও ভাগাভাগিতে তার সমস্যা নেই।
প্রতিরাতে এলোপকে ১৮ ভাগে ভাগ করা হয়। ১৮ জন বুড়ো এলোপকে ১৮ রকমভাবে খেতে বসে। কেউ ব’সে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ আবার চামচের ধার ধারে না। সরাসরি মাংসে মুখ ডুবিয়ে দেয়।
এসব দেখে ব্রিয়াগানি হাসে। নিজের মধ্যেই হাসে। খেতে খেতে খানিক থেমে গিয়ে সকলের উদ্দ্যেশে বলে – বর্তমানে আমরা সাধারণতন্ত্রের মধ্যে রয়েছি। কিন্তু যদি কোনোদিন রাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে, তবে সকলেই আমাকে দলের রাজা বানাবে।
গল্পে নেই; তবু ভাবা যাক – বুড়ো ফেরিওয়ালারা সবে চালাঘরে ফিরেছে সেদিন। সারাদিন জুয়া আর চুরি করে ক্লান্ত। খানিক বিশ্রাম নিয়ে তবে হুল্লোড়ে মাতা যাবে।
এমন সময় একজন জোয়ান মরদকে নিয়ে হাজির হল এলোপ। কিছু বোঝবার আগেই সে সদর্পে জানিয়ে দিল – এই হল তার পেয়ারের লোক। এবার থেকে শুধু এর জন্যই সে খাবার পরিবেশন করবে।
যেখানে কোনোদিন বিউগল বাজেনি – সেখানে বিউগল বেজে উঠল। পাথর বিছানো রাস্তায় শুরু হলো ঘোরার খুড়ের শব্দ। কুয়াশা কেটে গেল।
একখানা আস্ত শুয়োর, তাও ঝলসানো, এখনো ধোঁয়া উঠছে, সকলের মাঝখানে রেখে ফানুসের ভেতর ফোয়ারা চালানো হলো। ছলকে পড়ল মদ। বুড়োদের চোখ ভারি হয়ে উঠল। তারা দুঃখে ঢলে পড়ল এ-ওর গায়ে।
এলোপকে আর ভাগ করা গেল না। জোয়ান মরদ, যে কিছুদিন আগে বলাৎকারের অভিযোগে জেল খেটেছে – সে ছুরি হাতে শুয়োরটাকে কাটতে শুরু করল। পাতলা কালচে লাল মাংস। উপরে চর্বির প্রলেপ। সে মাংসের টুকরোটা প্রথমে মদে ডুবিয়ে নিল। তারপর সেটা এলোপের বুকের উপর রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। যেন কুকুর, হাতের ব্যবহার ভুলে গিয়েছে, খেতে শুরু করল মদে জারিত মাংস।
প্রতিদিন গ্যাসলাইটের আলোয় দূর্গটি আবছা হয়ে যায়। দূর্গটির পেছনে ডাঁসা চাঁদ ওঠে। পাইন গাছের ডালপালা অতোদূর পৌঁছুতে পারে না। গভীর রাত নামে। অথচ কোথাও যাবার নেই ১৮ জন বুড়োর। তারা খোঁড়া, কুঁজো, মাতাল। ফিরে আসে চালাঘরে। তারপর কোনোদিন ঝলসানো ভেড়ার সামনে, কোনোদিন আস্ত মহিষের মাথা, এমনকি চকচকে শিং, শিং-এর পাশে রাখা থাকে ছুরি ও গেলাস; কিন্তু মাংস খাওয়া হয় না।
এলোপ দু-পা ফাঁক করে। বুড়োরা দেখে কালো চুলের অন্ধকার। ভেতরে ঢুকে পড়ছে চামচ, বোতল, আর মহিষের শিং নিয়ে রোগা যুবক।
লাল মদে পোড়া মাংস। মাংসের উপর নুনের ছিটে। আজ মরিচ দেওয়া হয়নি। ছুরিতে এইমাত্র কাটা হয়েছে মহিষের চোখ। চোখদুটো বলের মতো এলোপের জিভের ডগায় নড়নড় করে।
প্যারিস থেকে বেশ খানিকটা দূরে, আলোর থেকে তর্কের থেকে বেশ অনেকটা দূরে – এইভাবে রাত নামলে প্রায় কালো অঞ্চলটিতে তাঁবুর মতো পেটমোটা মোচ্ছব চলছিল। বুড়ো; তায় সামর্থ্য নেই নেই – এতোদিন বাধা দেয়নি সেজন্য। তবে ব্রিয়াগানি ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করছিল নিশ্চিত।
এলোপ তখন আয়নার সামনে প্রসাধনে ব্যস্ত। মুখের একপাশে সবে গোলাপি আভা যুক্ত করতে পেরেছে। ওদিকে তার মরদটি ছাল ছাড়ানো শুয়োরটার গায়ে অলিভ ওয়েল মাখাচ্ছে। ব্রিয়াগানি সন্তর্পণে তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। ইশারা করে বাকি বুড়োদের। তারা এগিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে সে যুবকটিকে জাপটে ধরে। বুড়োরা সজাগ ছিল। আন্দাজ পাবার আগেই তাকে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়।
মুখের একপাশ গোলাপি। তাতে আঁচড় পড়েনি। অন্যপাশটি চমকেছিল।
এখন আলো নিভে গেছে। এলোপকে তার প্রেমিকের সামনে বসানো হলো।
ব্রিয়াগানি একবার এলোপের দিকে তাকাল। একবার যুবকটির দিকে। তার হাতে মদের বোতল। অনায়াসে বোতল উপুড় করে নিচ্ছে। হেঁচকি তুলছে। হাসি থামিয়ে আবার পরক্ষণেই গম্ভীর। যুবকটিকে বলছে, হাঃ। এই হল আমাদের রাজার প্রদত্ত শাস্তি। রাজাকে গিলাটিনে চাপিয়ে একদিন আমরাই তাঁর শিরোচ্ছেদ করেছিলাম। আর এখন তোর জান না নিয়ে এই শাস্তি দিচ্ছি।
সে হঠাৎ এলোপের দিকে নাটকীয় ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, তুই তো জানিস আমি সততার প্রতীক। ব’লেই পিচপিচ করে হাসতে শুরু করে দিল। ব্রিয়াগানিকে নকল করে বাকি ১৭ জন বুড়োও হাসল।
গল্পটা এখানেই শেষ। কিন্তু আমি ভাবি প্রত্যুত্তরে এলোপ কী কী বলতে পারত। অথবা কী কী বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে পারেনি।
আবার মনে হয়, এই গল্পে এলোপকে যেভাবে দেখানো হয়েছে তার পক্ষে কি কিছু বলা অদৌ সম্ভব ছিল?
এলোপ যেন গেলাস থেকে ছলকে পড়া জল। উবে যাবার পর যার চিহ্নটুকুও গায়েব হয়ে যায়।
অন্যদিকে ব্রিয়াগানি ঠিক উল্টো। সেই বহুবছর আগের কোনো মফস্বলে সে আবার ফিরে এলো বুঝি। ঘোড়ার খুড়ের শব্দটি মিলিয়ে গেলে পর তাকে আবার চালাঘরটির ভেতরে পায়চারি করতে দেখা যাবে। প্রাচীন আমোদ ফিরে আসবে। তবে নতুন শহর কিংবা মফঃস্বলে এবার সে একা। দোস্তদের খুঁজছে।
কিন্তু শহরের আনাচেকানাচে কতো যে গলি লুকিয়ে থাকে তা কেই বা জানত। এলা ‘ব্রিয়াগানি ক্যাফে’টার সন্ধান না দিলে তা আড়ালেই থেকে যেত। এমনকি যেভাবে আমি ‘দ্য ক্লাউন’ গল্পটায় চালাঘরটির অবস্থান নির্মিত করেছে – সেই যে বড়োরাস্তা থেকে বামদিক ঘুরে কিংবা দূর্গটি, যা আসলে, ক্যাফেটায় যাবার আগে যে পাঁচিলঘেরা পতিত জমিটারই আভাস সেটাতো এখন এমি নিজেই বুঝতে পারছে। লেখক নিজের লেখার গোপন সূত্রগুলো বুঝবে তা আর নতুন কী – কিন্তু পাঠক কিভাবে তা বুঝে ফেলে?
এলা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
সাদার্ন এভিনিউয়ের সেই গলিটা আবার দেখতে পাই। ভাঙা পাঁচিল, পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে পোড়ো বাড়িটা উঁকি দিচ্ছে – আর আমরা সরু রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
এলা বিশেষ কথা বলছে না। আমিও চুপ। এই অঞ্চলে বেশ পাখির ডাক শোনা যায়। বিদেশি পাখিও আসে সরোবরে। ছোটো ছোটো ফ্লাই ক্যাচার আমাদের মাথার উপর দিয়ে দ্রুত উড়ে গেল।
আসলে আমি ভাবছিলাম সাজিদের কথা। সাজিদের সঙ্গে আমি আমার সম্পর্ককে নস্যাৎ করব কোন উপায়ে?
সাজিদকে এমনভাবে লিখতে চাই যেন সে নেই। যে নেই – আসলে সে আছে। যেমন জেএনইউ থেকে হারিয়ে যাওয়া নাজিব আহমেদ। সেই কবে হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে বলে কি সে নেই হয়ে গেছে?
তবে সাজিদ গায়েব হোক। ভ্যানিশ হয়ে যাক।
আমরা ক্লাউনের মতো তাঁর চারপাশে খানিক নাচানাচি করি।
(চলবে)
সাদিক হোসেন
১৯৮১ সালের ১১ই ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগণার মহেশতলায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইনফর্মেশন টেকনলজি নিয়ে পড়াশোনার শুরু। কিন্তু এই পড়াশোনা ব্যবহারিক অর্থে বৃথা যায়। পরবর্তীকালে মাল্টিমিডিয়া চর্চা করে বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন। ইতিমধ্যে অনেকগুলো বই বেরিয়েছে সাদিক হোসেনের। প্রকাশিত গ্রন্থ : দেবতা ও পশুপাখি (কবিতা সংকলন, ২০০৭) সম্মোহন (গল্প সংকলন, ২০১১), মোমেন ও মোমেনা (উপন্যাস, ২০১৪), গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময় (গল্প সংকলন, ২০১৪), রিফিউজি ক্যাম্প (গল্প সংকলন, ২০১৭), মোন্দেলা (উপন্যাস, ২০১৯), হারুর মহাভারত(গল্প সংকলন, ২০১৯), আনন্দধারা (গল্প সংকলন, ২০২১)। পুরস্কারও অর্জন করেছেন তিনি। ‘সম্মোহন’ বইটির জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি যুবা পুরস্কার (২০১২) ও ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার। ‘গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময়’ বইটির জন্য পেয়েছেন নমিতা চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০১৫)।