অনেক বাতাস। থেকে থেকে শোঁ শোঁ শব্দ। ছাদে শুকাতে দেয়া কাপড়গুলো দুলছে। জোরে জোরে দুলছে আর শব্দ হচ্ছে। লম্বা একটা তারে কাপড়গুলো পর পর ঝুলানো আছে। নানা ধরনের পোশাক রয়েছে। নারী পুরুষ শিশু সবার পোশাকই ঝুলছে এই তারে। বাতাসে কাপড়গুলো একবার খুব উপরে উঠে যাচ্ছে আবার নামছে। প্রথম দিকে রয়েছে একটা পাঞ্জাবি। ঘিয়া রঙের। গোল গলা। একটা বুক পকেট দেখা যাচ্ছে। পকেটের নিচের দিকে কালো একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। কিসের দাগ? বলপেনের কালির দাগ কি? অনেক বয়স্কজনই বুক পকেটে বলপেন রাখেন। বলপেনের কালি লেগে এমন দাগ হয়ে যায়। সাবান দিয়ে কাঁচলেও এ দাগ খুব একটা ওঠে না। কে পরেন এই পাঞ্জাবি? তিনি কি স্কুল শিক্ষক? পাঞ্জাবিটা জোরে জোরে দুলছে আর পত্ পত্ করে শব্দ হচ্ছে। তার পাশেই ঝুলছে একটা জিন্সের প্যান্ট। ভারি জিন্স। এই জিন্সের প্যান্টের ক্লিপের সাথে আটকে আছে বলেই হয়তো পাঞ্জাবিটা এত বাতাসেও তার থেকে ছুটে যাচ্ছে না। আকাশি রঙের প্যান্ট। দুপায়ের হাঁটুর দিকটা ছেঁড়া। তার পাশেই দুলছে একটা শাড়ি, লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। চওড়া পাড়। পাড়ে কিছু লতার কাজ মূর্ত হয়ে আছে। লতার নকশাও লাল রঙের হওয়ায় দূর থেকে চট করে বোঝা যায় না। শোঁ শোঁ বাতাসে উড়ছে নামছে যেন ঝড়ের গতিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। কে পরে এই শাড়ি? কোন ফ্ল্যাটে থাকে সে? তার পাশেই দুলছে একটা শার্ট। আকাশি রঙের শার্ট। এক রঙের, অন্য কোন কাজ নেই শার্টে, হালকা রঙ। ফুল শার্ট। শার্টটি দুলছে। একপ্রকার উড়ছেই বলা যায়। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে শার্টের কলারের বোতামটি নেই। বাতাসে উড়ছে তারপরও মনে হয় শার্টটি কেমন যেন কুঁচকে আছে। তারপর দুলছে একটি ফ্রক। সাদা রঙের ফ্রক। ফ্রকের বুকের দিকটায় দুপাশে দুটি ফুল আঁকা। সবুজ সুতা দিয়ে বোনা দুটি ফুল। পাঁচ ছয় মাসের কোনও বাচ্চার ফ্রকই হবে। প্রচণ্ড জোরে দুলছে। ক্লিপ থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে পড়ছে। তার পাশেই রয়েছে একটি গামছা। লাল আর সবুজ চেকের গামছা। বেশ বড় সাইজের। কিন্তু উজ্জ্বলতা নেই। রঙ ফিকে হয়ে ত্যানা হয়ে গেছে। বাতাসের ধাক্কায় পত্ পত্ করে উড়ছে। এভাবে আর কিছুক্ষণ বাতাসের ধাক্কা খেলে ছিঁড়েও যেতে পারে। তার পাশে উড়ছে একটা ওড়না। নীল ফিনফিনে ওড়না। জর্জেট কাপড়ের। বাতাসের তোড়ে এমনভাবে উড়ছে নিচের দিকে নামছেই না। হালকা হওয়ার কারণেই পুরোটা সময় ভেসেই রয়েছে।
সাদা ফ্রকটি তারে আটকানো ক্লিপ থেকে মনে হয় এখনই বেরিয়ে পড়বে। পত্ পত্ শব্দ হচ্ছে আর বাতাসের ধাক্কায় একটু একটু করে ক্লিপ থেকে ছুটে যাচ্ছে। অনেক ক্ষণ ধরেই তীব্র বাতাস বইছে। থামার লক্ষণ নেই। বাতাসের ধাক্কা আর কাপড়গুলোর পত্ পত্ শব্দ গুমোট আর ভারী করে তুলেছে বিকেলের ছাদের আবহ। আকাশও মেঘলা হয়ে আছে। ধীরে ধীরে কালো হয়ে আসছে। বাতাসের ধাক্কা যেন বেড়েই চলেছে।
তার থেকে সাদা ফ্রকটির ক্লিপটা ছুটেই গেল। ফ্রকটা ছাদের উপর দিয়ে বাতাসে উড়ছে। উড়তে উড়তে ছাদ পার হয়ে গেল। তীব্র বাতাস আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে রাস্তায় খুব একটা লোকজন নেই। গাড়ি বা রিকশার তেমন চাপও নেই। অনেকটাই ফাঁকা হয়ে আছে রাস্তা। ফ্রকটি বাতাসে ভাসতে ভাসতে রাস্তার দিকেই উড়ে যাচ্ছে। একটা লোক খুব দ্রুতই হেঁটে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। আসন্ন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতেই হয়তো লোকটি দ্রুত হাঁটছিল। সে ছাড়া রাস্তায় আর কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। খুব জোরেই হাঁটছিল সে। সাদা ফ্রকটি উড়ে উড়ে তার পায়ের উপর এসে পড়ল। হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ফ্রকটি হাত দিয়ে তোলার জন্য পায়ের দিকে ঝুঁকলো। মাথা নিচু করতেই চোখ থেকে চশমাটি খসে পড়ল। হাতে ধরে ফ্রকটি তুলল লোকটি। তারপর চোখের সামনে ফ্রকটি মেলে ধরল। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাদা ফ্রকটির দিকে। বাতাসের শোঁ শোঁ, লোকটির চারপাশ সবকিছু যেন হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সেই মুহূর্তে চোখের সামনে এই সাদা ফ্রকটি ছাড়া পৃথিবীতে যেন আর কিছুই নেই। করুণ আর ছলছল চোখে লোকটি তাকিয়ে আছে ফ্রকটির দিকে। এক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। ঝাপসা হয়ে এলো তার চোখ। বৃষ্টিও শুরু হলো এ সময়। বৃষ্টির ফোঁটায় একাকার হয়ে গেল চোখের জল। ভিজে গেল ফ্রকটি। বৃষ্টি বাড়ছে। ফ্রকটি দিয়ে মুখ ঢেকে লোকটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিতে।
সাইদুল ইসলাম
জন্ম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় উত্তর সাহাপুর গ্রামে ১৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে। পিতার কর্মসূত্রে বসবাস করেছেন এবং বড় হয়েছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন। প্রধানত কবিতাচর্চা করলেও ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৫, অনুবাদগ্রন্থ ৩টি।