আচমকা ঘুম থেকে উঠে রেদোয়ান ঝিম মেরে বসে থাকে বাসি বিছানায়, বহদ্দারহাট থেকে কেনা সস্তা খাটে। অন্যদিন হলে ঘুম ভাঙামাত্রই রেদোয়ান ওরফে আমাদের রেদুমামা মুখে ব্রাশ নিয়ে ঢুকে যেত ওয়াশরুমে। সবার তাড়া থাকে সকালে টিউশনে যাবার কিন্তু রেদুমামার ভোতা চেহারা দেখে আমরা, মানে শুক্কুর ভাই, জিয়া ভাই, জেবল হুজুর ও আমি তব্ধা মেরে বসে পড়ি যার যার সিটে। মুখ দেখাদেখি করি পরস্পরের। তার সহি অর্থ দাঁড়ায় এই, বেইন্যা ফজরত ব্যাপার কী?
আমাদের বাসাটা অদ্ভূত সুন্দর। বাণিজ্যিক রাজধানীর একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব কোল ঘেষে, কর্ণফুলীর বারান্দায় এমন গ্রামীণ পরিবেশ রীতিমতো স্বপ্নের যোগ। যাদের শেকড় পোতা আছে গ্রামে, যারা গাছের ছায়ায় নিজেদের ফুয়েল ভর্তি করে, যারা পাখির ডাকে জেগে উঠে একটা নতুন দিন শুরু করার নিয়তে তাদের জন্য বাসাটা একেবারে খাপে খাপ মনসুর বাপ। কিন্তু কথা আছে। বিশাল এক পুকুরের পাড়ে হাত ত্রিশেক লম্বা স্কুল ঘরের লাহান টিনের চাউনি তো বটে টিনে ঘেরা এমন বেঢপ বাসায় থাকবে কোন জাতের ফ্যামেলি? তার উপর সমুখের অপ্রশস্ত রাস্তায় দিনরাত মানুষের হাঁটাহাঁটি, মাঝেমধ্যে ঝনঝনানি শুনিয়ে আসে-যায় ছোটখাট পরিবহন। বাসার পশ্চিম পাশে হাত দশকের দূরত্বে রাজ্যের নীরবতা নিয়ে বাস করছে মহল্লার হাজী বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান। কবরস্থান পাহারায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে খানসাতেক তাল গাছ! অত্র এলাকার মুরব্বিগোছের কেউবা এই পথে হাঁটা-চলা লোকদের নাকি এই বলে সতর্ক করেছেন, চোখ সামনে নিয়ে হাঁটবা, ফি-বছরেই লোক মরে এখানে পাকা তাল পড়ে। খেয়াল না করলে হতে পারে জান নিয়ে টানাটানি। না-হয় তাল গাছের দিকে যাবো না কিন্তু উত্তরের বিল থেকে হাওয়ার যে শক্ত জোয়ান পেরেক ছুটে আসে রাত-দুপুরে তা কী দিয়ে বাঁধি? এই প্রশ্নের উদয় আমাদের মাঘ-পৌষের বাঘ ডাকা শীত না-নামা পর্যন্ত আসার কথা নয় কিন্তু বর্ষার জলে বাড়তি যন্ত্রণা হিসেবে আগমন হয় জোঁক মহাশয়ের; একটু অসাবধান হলেই রক্তের উপর হাঙ্গামা!
এত অসুবিধার ভেতরে সবচে বড় সুবিধা বাসাটার চারপাশে গ্রাম আছে, গ্রামের গন্ধ আছে। আর আছে পানির দড়ে ভাড়ার সুবিধা। দুই বছর আগে রেদুমামা যখন আমাদের বাড়িতে ছেলের শহরে পড়াশোনার টেনশনকে নিজ হাতে তুলে নিয়ে আমার আব্বাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এই বলে, ভাববেন না নানা, ছেলে থাকবে একেবারে মায়ের পেটে। শহরে যাচ্ছে বটে ময়লা আর জ্যামের নহরে নয়। তার কথাগুলো ম্যাজিকের মতো শুনছিলাম কিন্তু শহরের এই বাসায় এসে দেখি, এটা রেদুমামার বয়ানের চেয়ে ঢের বেশি। তবে মনের খসখসানি কিছুটা থেকে যায় বৈকি। মানুষ যেখানে শহর থেকে গিয়ে বহুতল বিল্ডিঙের আলিশান ফ্ল্যাটে আরামসে থাকে; ঝা-চকচকে রেস্টুরেন্টে নানা কিসিমের নয়া পদে পেট ভরার গল্প করে সেখানে কি না আমি একেবারে খাদের কিনারে! রেদুমামা বয়সে বছর তিনেক সিনিয়র আমার, পড়াশোনায়ও। রিসতায় এলাকাতো মামা হন তিনি। সেই হিসেবে পদ্মপুর থেকে তার হাত ধরে আমার শহর নামক অচিন কারখানায় আসা। আজব লীলা রেদুমামার, গাড়ি থেকে নেমে ভরদুপুরে কোথায় হোটেল ধরে পেট তাজা করবো তা না, সোজা তিনি নিয়ে গেলেন আমার হবু টিউশনে। সিস্টেম মন্দ না; সন্ধ্যায় পড়াবো তার বিনিময়ে দুপুর আর রাতের খাওয়া। সবকিছুই নতুন আমার জন্য মগার যার পাশে থাকে রেদুমামার মতো সর্বজান্তা লোক তারে ঠকাতে পারে কে! টিউশনে খেয়েদেয়ে যখন ঢুকি তালতলার বাসায় আমার ভিমরি খাওয়ার দশা। এই তাহলে রেদুমামার নিশ্চিন্ত থাকার নমুনা!
কলেজ-ক্লাস-টিউশন সব মিলিয়ে আমাদের সময় চলে যায় কর্ণফুলীর জোয়ার-ভাটার সমান্তরালে। শুক্কুরবারের অলস বিকেলে চলে ফুটবল, রাত গভীর পর্যন্ত তাস পেটানো। পাঁচ জনের ব্যাচেলর বাসায় গাইগুই নেই, কাজিয়া-ফ্যাসাদ নেই। তুই তোকারি কিছু আছে তবে সে অর্থে না; সবাই প্রায় বন্ধুর মতো, অনায়াসে শেয়ার করা যায় সময়ের যত কালিমা। তাস পেটানোর এক রাতে আমিই প্রস্তাব করি বিষয়টা। পদ্মপুর ছেড়ে এই দূর নগরের একটা জায়গার নাম আমরা বদলে দিচ্ছি এই উত্তেজনায় যেন কাঁপছে আমাদের তরুণ-হৃদয়। হুম, তালতল আবাসিক, এটাই ফাইনাল। জেবল হুজুর এক গাল হেসে বলে, ওই যে ফকির সওদাগর আছে না, তার উল্টো হয়ে গেল ব্যাপারটা। শালা, যেখানে নেই এটাচ বাথরুমের ব্যবস্থা, গোসল সারতে হয় পাশের বড় পুকুরে, এটা কোন তালের আবাসিক এলাকা? দেখো আবার নেমপ্লেট কেউ ফেলবে তো ফেলবে মানহানি মামলা করে কি না! সিটি কর্পোরেশন জানলে ট্যাক্স বসিয়ে দিলে আমারে ডাকবে না, বলে দিলাম। রেদুমামা একটা ঘোরের মধ্যে ছিল এতক্ষণ, হুজুরের কাউন্টারে জেগে ওঠে। অ্যা, ফকির সওদাগরকে আপনি চেনেন? নামে ফকির, দেখেন নাই তাদের বাড়িঘর? শোনেন নাই তার পোলাপাইনদের ব্যবসাপাতির খবর? স্বাধীনতার আগে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে আসলে এই ফকির সওদাগরের বাড়িতেও আসছিলেন, এবার বোঝেন ঠেলা! উত্তেজনায় আবার রেদুমামার হয় উল্টো কারবার, তুই-তোকারির বদলে একেবারে বলে বসে আপনি। আমরা হাসি। এই মসলা দিয়ে স্বাদু হয় আমাদের সময়, কখনো একটু বাতচিতে বাড়ে ব্যাচেলর বাসার সৌন্দর্য। যথারীতি তাস পেটানো বন্ধ রেখে আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সাইজের একটা বোর্ডে মার্কার কলমে বড় বড় হরফে লেখি, তালতল আবাসিক, মাতব্বর পাড়া, সোনাতলী, চট্টগ্রাম।
মুখে মুখে ইতিমধ্যে রটে গেছে তালতল আবাসিকের নাম। কেউবা বিরস বদনে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় বাসা নেয়ার বদলে ইয়া উঁচু তালগাছ দেখে চোখের ক্ষিধে নিয়ে, মনে মনে গজরাতে গজরাতে চলে যায় গন্তব্যে। এহেন আবাসিকের গোড়াপত্তনকারী বাসিন্দাদের একজন রেদুমামা যখন বেইন্যাকালে বাসি বিছানায় বসে থাকে মুখ ভার করে আর বিরতি দিয়ে তালাস করতে থাকে খাটের তলায় তখন এই অভূতপূর্ব কাণ্ড দেখে এক চোট হেসে ফেলি আমরা। বসে থাকলো ভালো কথা খাটের তলায় কী? দূর থেকে তাকালে বাহিনীর লোকদের মতো একটা টিনের বক্স, যেখানে রাখা আছে রেদুমামার ইস্ত্রি করা কাপড়। বক্সের ডানে ভালো-মন্দ মিলিয়ে জোড়া তিনেক পরনের জুতো। বামে শুয়ে আছে নিরহ ফুটবলটা। এসব প্রতিদিনকার জিনিস, বারবার রেকি করার কী আছে? সন্দেহ জাগার একশো একটার সবচে বড় কারণ সবসময়কার লেগে থাকা হাসির চিহ্নটি নেই রেদুমামার চেহারায়। তার এমন আচরণে আমাদের মনে বিবিধ প্রশ্ন কিলবিল করলেও জেবল হুজুর যেন খুঁজে পায় রাজ্যের মজা। এই রেদু, স্বর্ণের ডেকচি পাইছো নাকি ঘুমে? তোমার তো আবার মাগনা জিনিসের ভাগ্য ভালো! মুখরে মোটকা বানায়ে লাভ নাই, ঝেড়ে কাশো এবার। রেদুমামা গাঢ় নিচু করে খাটের তলদেশ দেখে নেয় আরেকবার। খেয়াল করি, ঘুম ভেঙে যেখানে বসেছিল রেদুমামা সেখান থেকে এদিক ওদিক করেনি এক সুতো। জায়গায় বসে শরীর নেড়ে পরখ করছে খাটের তলা আর রুমের চারপাশ। এবার জেবল হুজুরের নেতৃত্বে নিজেদের খাট থেকে নেমে যাই রেদুমামার খাট বরাবর। আমাদের বাসাটা আজব কিসিমের। পূর্ব-পশ্চিম করে সার বেঁধে শুয়ে আছে খাট। খাটের লাগোয়া উত্তর পাশে পড়ার টেবিল প্রত্যেকের। টেবিলের বুকে কিছু একাডেমিক ও নিয়োগ পরীক্ষার বইপত্র, এক কোণায় একটা ফ্যান। শুক্কুর ভাই গায়ে হাত দিয়ে দেখে রেদুর। না, কোন জ্বরজারি নেই। তাহলে? রেদুমামা ইশারা করলে সবাই বসে যাই পাশে জিয়া ভাইয়ের খাটে।
বুঝলা, সারা রাত ঘুমাইতে পারিনি। রেদুমামা মুখ খুললো এবার। তার অবশ্য গালগল্পের একটা খ্যাতি আছে। তবুও সকাল বেলার টিউশনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমরা সমস্বরে জানতে চাই, তারপর?
কী আর? লোকে যা করে, আমি না করলে মাইন্ড করবেন না উনি!
আমরা খেয়াল করি, রেদুমামা তার জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি, যেভাবে বসা ছিল, ঠিক সেভাবেই আছে। তার নানা ছিল মাইজভান্ডারি লাইনের বড় লোক, পদ্মপুরে বাবাজান কেবলার খাস খাদেম। কিন্তু নাতি রেদুর এমন মারফতি খেলের আগামাথা কিছু বুঝতে পারি না আমরা।
তা করলা ঠিকাছে কিন্তু খাটের তলায় কী? জেবল হুজুরের জিজ্ঞাসা।
দেখলাম সে আছে কি না! রেদুমামার জবাব।
এত খেলা বোধহয় জিয়া ভাইয়ের হজম হচ্ছে না। কী বালের গপ মারোছ, খুলে বল। নইলে খবর আছে!
খবরের ঠেলায় কি না জানি না। রেদুমামা এবার একটু ধাতস্থ হলেন। গলা খাকারি দিয়ে শুরু করলেন।
আরে তোরা তো বুঝোস না মানুষের মান সম্মান। কাল রাতে কে এসেছিল জানিস? কাদের সাথে আমার উঠাবসা? বললে তো বলবি, গাল ঝারছি।
কে আসছে রে? সবার কৌতূহলী প্রশ্ন।
তার চোখ, তার মুখ, তার চাহনি, তার রুচি কোনটা আগে বলবো? এরকম মানুষের কথা যদুমধুরে বলাও মানা। বলা যায়? প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রেদুমামা।
এবার কিছুটা বিরক্তি ভর করে আমাদের উপর। শুক্কুর ভাই বড় একটা গালি দিয়ে রেদুমামাকে তাড়া দেয়, ভাই রংবাজি না করে আসল কাহিনি ছেড়ে দে, না হয় সকালে নাস্তার বিল তোকে দিতে হবে।
আরে শুন না, রাতের বয়স তখন শেষের দিকে। মজার ঘুম পেয়ে নাক ডাকছি সমানে। আরে, দেখি আমার শিয়রে বসে আছেন খোদ ঐশ্বরিয়া রায়! ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। না, তিনি তো আর জগতের আর দশটা নারী নন! শুধু বলিউড কেন পুরো মহাদেশ, বলতে পারো পুরো পৃথিবী যার তরে দিওয়ানা সেই তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, গান শোনালেন। আর কী করলো জানিস?
রেদুমামার এমন গল্পে আমরা রীতিমতো কাঁপছি। কী বলে এসব! কী হলো রে?
সে, মানে আমার প্রিয় অ্যাশ আমাকে পরিস্কার বাংলায় বললো, আজকের রাত তোমার-আমার!
তালতল আবাসিক চার তরুণের হাসিতে যেন ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ জেগে ওঠা ভরা নদীর ঢেউয়ের মতো পুরুষ্ট হাসি। কী শুনছি এসব? এরকম আচোদা গল্প জীবনে কেউ শুনছে? জিয়া ভাই নিজেকে শুনিয়ে প্রশ্ন করে।
চার তরুণের হাসির তোড়ে রেদুমামার মুখ ফ্যাকাশে হবার কথা কিন্তু না, তার চেহারা যথারীতি সকালের ঠাঁট ধরে আছে। যেন বলতে চাইছে, একরত্তিও মিছে নয় বাঁচাধনেরা।
জিয়া ভাই হুঙ্কার ছাড়ে, অ্যা, এসব আমদানি করছো, না? বাকিরা তো ঘাস খায় এখানে!
রেদুমামা মেসে তার সবচে কাছের শুক্কুর ভাইকে ডাকে। একটা সন্দেহ ভাব নিয়ে সে বসে রেদুমামার খাটে, তারই পাশে। গেঞ্জি গায়ে আর সাদা লুঙ্গিতে রেদুমামাকে দরবারি খাদেমের মতো লাগছে একেবারে, খেয়াল করি। রেদুমামা কী যেন দেখায় শুক্কুরকে। এক নজর দেখে মুখে হাত দিয়ে লাজুক কিশোরীর মতো এদিকে ছুটে আসে শুক্কুর ভাই।
ব্যাপার কী?
যাও, দেখো গিয়ে…
বাকি তিন জন দিল্লির লাড্ডু দেখার মতো করে এক পা সামনে দেই তো আরেক পা পেছনে। রেদুমামা ইশারায় ডাকে। একটা জাদুর খেলা চলছে যেন।
শুক্কুর ভাই বলেন, আমাদের রেদু তো আর ব্যক্তিগত নাই, দেশ-মহাদেশ নিয়ে তার খেলা। না জানি এবার ভারত-পাকিস্তান ছেড়ে নেপাল-ভূটান, বার্মা-লংকার দিকে কবে যাত্রা শুরু করে! সিরিয়াসলি বলে শুক্কুর ভাই, আরে অ রেদু, শোন ভাই, এবার যে-ই আসুক আমাকে ডাকবি কিন্তু!
ততক্ষণে আমরা খেয়াল করি, রেদুমামার মুখের কোণায় গভীর রাতে আস্ত বাঘ শিকারের হাসি।
ইলিয়াস বাবর
জন্ম ১৫ মে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা। ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন দৈনিক, সাহিত্যপত্রিকা, লিটলম্যাগ ও ওয়েবজিনে লেখালেখি করেন। প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশের অপেক্ষায়। সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘স্রোত’ ও ‘সুচক্ররেখা’-র সম্পাদনার সাথে জড়িত।