ছোটবেলা থেকেই ভাগ্য পরীক্ষার বাতিক ডাবুর। ছোটবেলা মানে যখন স্কুলেও ভর্তি হয়নি। বছর পাঁচেক বয়স হয়তো। নিজেরই খেলনাপাতি নিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করত একা একাই। কখনও সামিল করে নিতো মা-বাবা কি বোনকে। নয়তো যাকে কাছে পেত তাকেই।
হয়তো একটা বল আছে ডাবুর কাছে। এলোমেলো ছুঁড়ে দিত ওপরের দিকে। বলটা ড্রপ খেতে খেতে যার গায়ে ঠেকবে, তাকেই ঘোড়া হতে হবে। আর সে হবে সওয়ারি।
বিস্কুট খেতে দিলে সেটা কয়েক টুকরো করে ভেঙে নিত ডাবু। প্রত্যেকের নামে একটা করে টুকরো ছুঁড়ে দিত উঠোনে। যার টুকরোটা প্রথম কাক এসে নিয়ে যাবে, তাকে গোটা একটা বিস্কুট দিতে হবে ডাবুকে।
এসব দেখে লোকের ডাবুকে বুদ্ধিমানই ভাবতো। ভবিষ্যৎবাণীও করতো, পাক্কা জুয়াড়ি হবে বড় হয়ে। তার লক্ষণও দিনে দিনে প্রকট হয়েছিল। বিশেষ করে সে যখন স্কুলে ভর্তি হল। লিখতে পড়তে আর গুনতে শিখল।
গলির দোকানে তখন লটারি বিক্রি হতো। ভাঁজ করা চিরকুটের মালা সুতোয় গেঁথে ঝোলানো থাকতো দোকানে। পয়সা দিয়ে একটা চিরকুট ছিঁড়তে হতো। ভাঁজ খুলে দেখা যেত পুরস্কারের নাম লেখা আছে ভেতরে। এক টুকরো পজেটিভ ফিল্ম কি একটা জিভছোলা থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের গামলা বালতি পর্যন্ত।
ডাবুকের সেই নেশা এমনই পেয়ে বসেছিল যে দোকানদারকে অনুরোধ করতে হয়েছিল লটারি বন্ধ করতে। সে পাড়ার মধ্যেকার ব্যাপার বলে সামলানো গেছিল কোনও রকমে। কিন্তু একসময় ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে গেছিল। বিশেষ করে ডাবু যখন হাই স্কুলে গেল। বাড়ি থেকে স্কুল কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথ। মাঝখানে একটা উন্মুক্ত অবাধ পৃথিবী। সেখানে গোটা কয়েক ঠাসাঠাসি বাজার। বাজারে হাজার হাজার দোকান। সেসব দোকানের গোলকধাঁধার ভেতর সীমাহীন হাতছানি। ভাগ্য পরীক্ষার অন্তহীন আড়ত। একেবারে পাইকারি হারে। ডাবু যেন পাগল হয়ে যেত সব দেখে শুনে। স্কুলের বাইরে গোটা সময় তার কেটে যেত সেসব রোমাঞ্চ আবিষ্কার করে করেই। এমনকি স্কুল পালিয়েও সে প্রায়ই বিলীন হয়ে যেত সেইসব কল্পলোকের ভেতর। ফুটো পকেটে ভাঙf আধুলি নিয়েও সারাদিন মনে মনে কোটিপতির মতোই সে ঘুরে বেড়াতো তার নিজস্ব ভালো লাগার জগতে। যেন সে এক অদৃশ্য রাজা।
ডাবু খেলাধুলা মোটেই করত না। খেলা বলতে সে বুঝতো ভাগ্য পরীক্ষার খেলা। সোজা কথায় জুয়া খেলা। বন্ধুরা যখন মাঠে বা পার্কে ফুটবল ক্রিকেট খেলত, বিশেষ করে বাজার বন্ধের দিনে, ডাবু বসে থাকতো মাঠের ধারে। কাউকে পাশে পেলে সে তার সঙ্গে শুরু করে দিত অন্য খেলা। চেনা হোক অচেনা হোক পরোয়া নেই। গায়ে পড়েই বলতো, ‘কে জিতবে মনে হয়?’ অথবা ‘ওই নীল জামা কি পারবে ফিফটি করতে?’
যাকে বলা, সে ভাবতো সরল প্রশ্ন। আসলে যে ডাবুর ফাঁদ, সে কথা তো আর বুঝতো না। হয়তো উত্তর দিয়ে বসত তার কথার। ওমনি ডাবু উল্টো কথা বলতো। অত্যন্ত জোর দিয়ে। প্রায় উপহাস কি তাচ্ছিল্য করার মতো করে। যাতে তাকে উত্তেজিত করা যায়। স্পষ্টতই প্ররোচনা দেওয়াই উদ্দেশ্য। সেই অবোধ শিকার হয়তো তর্কে জড়িয়েই পড়লো ডাবুর সঙ্গে। ডাবু তর্কটা টেনে নিয়ে যেত কিছুক্ষণ। তারপর পারদের উপযুক্ত উত্থান বুঝে মাটি চাপড়ে নাটুকে ভঙ্গিতে বলতো, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি ওরাই জিতবে’ অথবা ‘নীল জামা হাফ সেঞ্চুরি করবেই করবে।’
তারপর প্রতিপক্ষের মন বুঝে, ‘আমি দুই টাকা বাজি ধরতে পারি।’ তার বেশি পয়সা ডাবুর পকেটে থাকত না। কিন্তু কাজ ওতেই হত। সব মানুষের অন্তরেই তো লুকিয়ে আছে এক-একজন জুয়াড়ি। সেখানে সুড়সুড়ি পড়লে বাজির প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা মুশকিল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যদি নিজের শর্তে বাজি ধরার সুযোগ মেলে।
তারপর খেলার বাইরে শুরু হয়ে যেত আর এক খেলা। সেখানে উত্তেজনা কিছু কম থাকত না। পকেটে কুলোলে ডাবু নিরন্তর ইন্ধন জুগিয়ে যেত। বাজির মাঝপথেই টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিত। আড়াই টাকা হোক। তিন টাকা হোক।
বলাই বাহুল্য খেলার শেষেও রয়ে যেত তার রেশ। কারণ, মাঠের খেলায় কিছু নেই। কিন্তু ডাবুর খেলায় হাতে গরম নগদ পুরস্কার। হারলেও তো আর্থিক ক্ষতি হয়েই যেত। তার ভরপাই করতেও আবার ফন্দিফিকির ভাবতে হতো। তাই ফল যাই হোক, ডাবুর খেলা প্রভাব রেখে যেত বেশ প্রলম্বিত পরিসরে। এই উত্তেজনাই ডাবুকে আনন্দ দিতে ভীষণ। জেতাটা বড় কথা নয়। অংশ গ্রহণটাই …! যাকে বলে স্পোর্টসম্যানস স্পিরিট! সেইটে ছিল ডাবুর। একশ শতাংশ। মাঠে নেমে দৌড়লেই খেলোয়াড় হওয়া যায় না! খেলোয়াড়োচিত মনোভাব থাকা চাই। নিজেই নিজেকে বলত ডাবু।
শুধু চ্যারিটি না, এভরিথিং বিগিনস অ্যাট হোম। সে তো ডাবু জন্মেই শুরু করে দিয়েছিলো। ক্লাস টেনে উঠে সে আর এক কাঠি এগিয়েছিল। নিজের পাড়াতেই টিভির অনুষ্ঠান নিয়ে বাজি ধরার খেলা চালু করেছিল। চিত্রহার অনুষ্ঠানে আজ দিলীপ কুমারের গান দেবে কি দেবে না, এই নিয়ে বাজি। এটাই ছিল তার প্রথম শিল্পোদ্যগ।
বলাই বাহুল্য এখানে ডাবুই ছিল উদ্যোক্তা। আর জুয়ার উদ্যোক্তারা কখনো হারে না। তাই ডাবু প্রথম কাঁচা পয়সার স্বাদ পেল চিত্রহার থেকেই। তার পকেট বেশ ফুলে উঠল ছোট মূল্যের কাঁচা নোটে। আর তখনই তার মাথায় স্রোতের মতো আসতে লাগলো আইডিয়া। নিত্য নতুন জুয়া খেলার আইডিয়া। সেই বয়সেই ডাবু বুঝেছিল, টাকার চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর নেই।
টিভির অন্যান্য অনুষ্ঠান নিয়েও সে বেটিংয়ের আয়োজন করত। সিরিয়ালের বিশেষ কোনও চরিত্রের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। সেদিনের পর্বে একটি চরিত্রকে আদৌ দেখা যাবে কিনা সেই নিয়ে। এমনকি নির্দিষ্ট কোনও সিরিয়াল চলার সময় সেদিন লোডশেডিং হবে কিনা, সেই নিয়েও ডাবু বেটিং করত।
গোটা পাড়াকে সে জড়িয়ে ফেলেছিল এই টিভির জুয়ায়। বিশেষ করে পাড়ার মেয়েদের। যত কাকিমা মাসিমা বৌদি আছে, সব্বাইকে। দু টাকা পাঁচ টাকার ব্যাপার। সেটুকুর ব্যবস্থা তারা করেই ফেলতো। আর সব গিয়ে জমা পড়তো ডাবুর তহবিলে। ডাবু নিজেই ঘরে ঘরে গিয়ে টাকা তুলতো। জিতলে পুরস্কারও পৌঁছে দিতে ঘরে ঘরে। ফলে ডাবুর তহবিল সচল থাকতো সর্বদা।
পাড়ায় টিভিও ছিল হাতেগোনা অল্প কয়েকজনের বাড়িতেই। সেই সব বাড়িতেই গোটাপাড়া জড়ো হতো টিভি দেখার জন্য। বিশেষ করে, বাজি ধরা অনুষ্ঠান দেখতে। আর বলাই বাহুল্য, সেইসব অনুষ্ঠানকে চরম উত্তেজক করে তুলেছিল ডাবু একা হাতে, নিজ গুণে।
অচিরেই ডাবুর তহবিল ফুলেফেঁপে উঠেছিল। অর্থাৎ আরও বড় অনুপ্রেরণার ঝর্ণাধারা বর্ষিত হয়েছিল তার ওপর। নিত্যনতুন আইডিয়া উদ্ভাবনের তার প্রতিভায় যেন জোয়ার এলো। আর সবাই জানে ভাগ্যলক্ষ্মী সর্বদা বীরের পক্ষে। যেন সেই কারণেই ঠিক সেই বছরই শুরু হল বিশ্বকাপ ক্রিকেট। উনিশশো তিরাশি সাল। ডাবুর সামনে সুযোগ এসে গেল তার নিজস্ব খেলাকে বিশ্বস্তরীয় উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়ার।
গোটা বিশ্ব জানে সে বছর ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু অল্প লোকেই জানে, লাভবান শুধু কপিল দেব আর তার ছেলেরাই হয়নি, হয়েছিল ডাবুও। এক্কেবারে চুপিসাড়ে। পুলিশ প্রশাসনের অজ্ঞাতসারে। পাড়ার কাকি বৌদি আর মাসিমাদের ঘরোয়া বিনোদনের ছেলেখেলা জালের মত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা শহরে। এমনকি প্রতিবেশী গ্রাম শহর আর লাগোয়া এলাকাতেও। আর সেই সর্বব্যাপী জুয়ার জালের মূল সুতোটা ধরা ছিল ডাবুর একা হাতে। ঠিক একা নয় অবশ্য, কারণ এত বড় একটা আয়োজন পরিচালনা করার জন্য তাকে বেশ কিছু এজেন্ট নিয়োগ করতে হয়েছিল। বলা যায় একটা কোম্পানিই গড়ে উঠেছিল, যার সিইও ছিল ডাবু, যে সেই বছরই মাধ্যমিক পাস করেছিল কোনও রকমে। মাত্র একুশ দিনের বিশ্বকাপে এতসব ঘটেছিল ডাবুর জীবনে।
পরবর্তীকালে সেই কথা মাথায় রেখে ডাবু নিজের আইনসম্মত কোম্পানির নাম রেখেছিল প্রুডেনশিয়াল মানি মেশিন।
আসলে বেশ কয়েক বছর বেটিং ব্যবসা চালানোর পর ডাবু ধরা পড়েছিল। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে ছাড়া পেয়েছিল। তারপরই সে ঠিক করেছিল, বেআইনি ব্যবসা আর সে করবে না। তাই এই ফাইন্যান্স কোম্পানি। রীতিমতো সরকারি খাতায় রেজিস্টার্ড কোম্পানি।
চোদ্দ বছর ডাবু উদয়াস্ত খেটেছিল এই কোম্পানির জন্য। নিজে মালিক হয়েও অন্য এজেন্টদের সঙ্গে কাজ করতো এজেন্টের মতোই। একফোঁটা তার অহংকার ছিল না। নিজের কর্মচারীদের কাছে ডাবু হয়ে উঠেছিল রোল মডেল। অনেকের কাছেই গডফাদার। অবশেষে ফল দিয়েছিল তার এই পরিশ্রম। দুকূল ছাপিয়ে সে ভেসে গেছিল সাফল্যের সুনামিতে। দেখতে দেখতে ডাবু হয়ে উঠেছিল, যাকে বলে সেলিব্রিটি।
এক তো প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল শিল্পপতি হিসাবে, তার ওপর ওঠাবসা নেতা মন্ত্রী আর চিত্র তারকাদের সঙ্গে। যে পাড়ায় সে চিত্রহারের জুয়া খেলাতো, সেই পাড়ার লোকেদের নাগালের বাইরে চলে গেছিল ডাবু। এখন ডাবুর কোম্পানির এজেন্টরা আসে ঘরে ঘরে। আগে কাকী বৌদিরা দু পাঁচ টাকা দিত ডাবুর হাতে। ফেরত পেতো হাতে হাতে। দুগুণ তিনগুণ টাকা। এজেন্টরাও সেই একই কথা বলে। ডাবুর কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে টাকা ডবল কয়েক বছরের মধ্যেই। জীবনের সমস্ত পুঁজি লোকে তুলে দেয় এজেন্টদের হাতে। শুধু তো এ পাড়া নয়, ওপাড়া সেপাড়া। সমস্ত পাড়া। সমস্ত শহর জেলা প্রদেশ। এমনকি, ভিন্ন রাজ্য পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল ডাবুর আর্থিক পরিষেবা। ডাবু তখন দেশের গর্ব। এমন কথাই বড় মুখ করে রোজ বলতেন বড় বড় নেতা মন্ত্রীরা। সে তো আর এমনি এমনি না।
#
আজ আবার ডাবুর জন্মদিন। পঞ্চাশতম। মনে পড়ে পায়েসের বাটি। মায়ের আঁচল, হাতপাখা। গরমকালেই সে জন্মেছিল। তাই জন্মদিনের সঙ্গে তালপাতার পাখা জড়িয়ে আছে তার স্মৃতির ভেতর। তখন তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই ফ্যানও ঘুরতো না মাথার উপর। তবু আরামেই পায়েস খেতো ডাবু। কারণ, মা অবিরাম বাতাস করতেন তালপাতার পাখা দিয়ে। লাল পাড় দিয়ে কিনারা বরাবর মুড়ে সেলাই করা পাখা। আজও চোখ বুঁজলে সে বাতাসের স্নিগ্ধতা অনুভব করতে পারে ডাবু।
ভাবতে ভাবতে চোখ খোলে ডাবু। ভীষণ বোঁটকা গরম পড়েছে আজও। বসে বসেই সে ঘামছে দরদর করে। এক ফোঁটাও হাওয়া লাগছে না তার গায়ে।
ডাবু মুখ তুলে তাকায় সিলিং এর দিকে। পুরোনো নোনা ধরা সিলিং। মোটা মোটা কড়িবর্গার ঢাঁচা। বহু জায়গায় খসে পড়েছে পলেস্তারা। চারিদিকে ঝুলছে মাকড়সার জাল ঝুল আর কালি। কবেকার কালো ঝুল জড়ানো তার থেকে ঝুলছে একটা হলুদ ল্যাম্প। কিন্তু কোনও ফ্যান নেই।
ঘরের চার দেওয়ালের দিকে চোখ ফেরায় ডাবু। একটাও জানলা নেই কোনও দেওয়ালে। দম আটকে আসে তার। সামনে দেওয়াল-জোড়া দরজা। একটু বাতাসের জন্য ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ডাবু। সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে বাইরে। তাকেই ডাকে ডাবু, ‘শুনছেন?’
বাইরের লোকটি দাঁড়ায় ডাবুর সামনে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। ডাবু আবার বলে, ‘আজ আমার জন্মদিন। একটা হাতপাখা হবে?’
লোকটা ডাবুর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হাতের খবরের কাগজটা দেখিয়ে বলে, ‘এতে চলবে?’
ডাবু হাগড়ের মতো ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চলবে চলবে। ওতেই চলবে।’
‘নিন তাহলে।’
ডাবু দরজার মোটা মোটা লোহার গরাদের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে কাগজটা নেয়। তারপর সেটা দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে সরে আসে দরজা থেকে। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ির ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘হ্যাপি বার্থডে ডাবু! হ্যাপি বার্থডে…!’