৬ই ডিসেম্বার ১৯৭১। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, আকাশবাণী, অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে পাকিস্থানি বাহিনীর উদ্দেশ্যে মুহূর্মুহু প্রচারিত হয় মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত ঘোষণা – ম্যায় তোমহারা চারো তরফ সে ঘিরচুকা। হাতিয়ার ডাল দো। ঢাকার পতন আসন্ন জেনে সবাই পালাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মুক্তাঞ্চলে। আমরাও পালাচ্ছি দাউদকান্দির উদ্দেশ্যে। ওখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্মস ক্যাম্পে আমাদের শেল্টার। বুড়িগঙ্গার জলে পাকবাহিনী মাইন পেতে রেখেছে। আমাদের নৌকা ঘুরপথের বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষা-ধলেশ্বরী রুট বেছে নেয়। নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গেঁড়েছে। নদীর ওপারে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে।
নদীতে নৌকা নৌকাভর্তি সহস্র মানুষ। আদমজী জুটমিলের কাছাকাছি পৌঁছতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে কামান দাগা শুরু করে। লক্ষ্যভেদ করে কামানের গোলা এসে পড়তে থাকে নদীতে। গোলার আঘাতে নৌকাভর্তি মানুষ এবং নদীর জল ছিটকে উঠে যেতে থাকে আকাশে। জোয়ারের টানে ভেসে যেতে থাকে শত শত মানুষ। কামানের গোলার ভয়াবহ আওয়াজ, মর্টারের শেল ফাটার কড়কড় শব্দ আর ডুবন্ত মানুষের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আমরা ১০/১১ জন মানুষ নৌকার পাটাতনে মাথা নিচু করে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনছি। ভয়ে বিস্ফারিত চোখ, মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে থ্রি নট থ্রির বিরামহীন গুলি।
আচ্ছা, ১১ বছর বয়সে আমার দেখা এই ঘটনা কি চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া সম্ভব? তেমন পরিচালক এইদেশে আছে কি? নেই! তবে হ্যাঁ, হলিউড চেষ্টা করলে ঠিক পারত। ওদের সেই দক্ষতা-ক্ষমতা-সৃজনশীল চিন্তাশক্তি, টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সিস্টেম সব আছে। বিলিঅন-ট্রিলিঅন অফ ডলার ব্যয়ে নির্মিত ওদের ওয়র ম্যুভিগুলোই তার প্রমাণ। যুদ্ধের ছবি দেখা আমার একটা প্যাশান। পৃথিবীর নানা দেশে সংঘঠিত যুদ্ধের উপর নির্মিত ইওরোপ-আমেরিকা-রাশিয়ার অধিকাংশ চলচ্চিত্র আমার দেখা। মানুষের নিষ্ঠুরতা-বর্বরতা-উন্মাদনা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তার দালিলিক প্রমাণ এইসব চলচ্চিত্র। বছর কয়েক আগে বলিউডে হিন্দি ভাষায় নির্মিত অভিষেক বচ্চন আর দীপিকা পাড়ুকোনে অভিনীত মাস্টার’দা চলচ্চিত্রটির কথাই যদি বলি – আমরা কি পেরেছি এমন একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে? অথচ, চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনার পটভূমিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্র। কাহিনিতে সামান্য ট্যুইস্ট আছে বটে তবে তা হয়তো সেটা বাণিজ্যিক ভাবনা থেকে করা হয়েছে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও বিগত ৫৩ বছরে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার ভেতর স্টপ জেনোসাইড, ৭১-এর যিশু, আগামী, আগুনের পরশমণি, গেরিলা, মল্লার, মাটির ময়না, মেহেরজান উল্লেখযোগ্য। এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘১৯৭১ : সেই সব দিন’। ‘মুক্তির গান’ আমেরিকান সাংবাদিক লেয়ার লেভিনের ৭১-এ শরণার্থী শিবিরে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজের এডিটেড ভার্সন। লেয়ার লেভিনের কাছে এই একটি মাত্র কারণে সমগ্র বাঙালি জাতি চিরকাল ঋণী থাকবে। এছাড়া, আর কোন চলচ্চিত্রে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ এবং তার নৃশংসতা ও ভয়াবহতাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। হ্যাঁ, মাটির ময়নার বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ রয়েছে। নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাই নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা তাই সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে নির্মিত ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটিতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা-নিষ্ঠুরতা অনেকখানি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
২৪শে আগস্ট দেখলাম সরকারি অনুদানে নির্মিতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘১৯৭১ : সেই সব দি ‘। সিনেমার নামটা দেখে প্রচুর আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্সে। কিন্তু দেখার পর চরম হতাশ হয়েছি। এই চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে একেবারে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কি, সেই ব্যাপারে আমাদের জেনারেশানের সম্যক জ্ঞান আছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা কাকে বলে তার সাক্ষী আমরা। ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ ক্র্যাক্ডাউনের মুহূর্ত থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি বিশেষ মিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের পরিবারকে ঢাকায় অবস্থান করতে হয়েছে। গুপ্তচরের চোখ ফাঁকি দিয়ে যুদ্ধের নয় মাসে আমাদের কয়েকবার ঠিকানা বদল করতে হয়েছে।
যে-বয়সে রূপকথার বইয়ে মুখ গুঁজে থাকার কথা, সেই বয়সে আমি বাড়ির নিরাপদ আঙিনা ছেড়ে মানুষের কাফেলার সঙ্গে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটেছি। নৌকার পাশে এসে পড়েছে পাকিস্তানি মিলিটারির কামানের গোলা। নদীতে কতো কতো লাশ ভেসে যেতে দেখেছি। ওই অল্প বয়সে আমার কিংবা আমার মতো অসংখ্য শিশুর কি এসব দেখার কথা ছিলো? শুধু মুক্তির জন্য, একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য, একটি পতাকার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আল বদর-আল শামস-এর গণহত্যার শিকার হয়েছে। দু’লাখের বেশি নারীকে বীরাঙ্গনা হতে হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধটা আমার কাছে নিছক গল্পকথা নয়, এক নারকীয় অভিজ্ঞতা। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমা দেখতে প্রাণের টানে ছুটে যাই। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসি অতৃপ্তি নিয়ে। আজ পর্যন্ত এই পটভূমিতে যতগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে প্রতিটিতে মুক্তিযুদ্ধকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কোন কোনটা ইতিহাস বিকৃতির শিকার হয়েছে, কোনোটাতে মুক্তিযুদ্ধের নামে উদ্ভট কল্পকাহিনি ফাঁদা হয়েছে। সেসব দেখে ক্রমাগত মনের কোণে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে। দর্শক হিসেবে মনে হয়েছে আমার সময়-অর্থ সবই বৃথা গেছে। একজন দর্শক কেন তার টাকা জলে ফেলবে?
যেসব কারণে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ চলচ্চিত্র আমাকে হতাশ এবং সংক্ষুব্ধ করেছে তা এখানে লিখে বলছি। এই চলচ্চিত্রে সংযমের বড়ো অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পরিচালক হৃদি হককে এই সিনেমায় কেন অভিনয় করতে হলো? তিনি না পেরেছেন পরিচালনায় মন দিতে, না পেরেছেন অভিনয়ে। নায়িকা হওয়ার সাধ থাকলে অন্য সিনেমায় নায়িকা হতে পারতেন তিনি। নিজের পরিচালিত সিনেমাতেই নায়িকা হতে হবে কেন তাঁকে? এটা দর্শককে কি বার্তা দেয়? এই চরিত্রটি চলচ্চিত্রটির মূল কাহিনির কোন পারপাস সার্ভ করেছে? হ্যাঁ, পরিচালকের বয়ান অনুযায়ী – এটা কমার্শিয়াল ম্যুভি। কিন্তু ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রের মতো একটা কমার্শিয়াল মুভির উদাহরণ যেখানে আমাদের সামনে আছে, সেখানে এমন কাঁচা কাজ কি করে মেনে নিই? চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্তরা জানেন, একটি সফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এডিটিং টেবিলে অর্থাৎ এডিটিংয়ের পর। তাই এডিটিংয়ের কাজটা করতে হয় নির্মোহভাবে। আমি এডিটিংয়ের দায়িত্বে থাকলে এই চলচ্চিত্রের অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় অংশ ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে কেটে দিতাম।
ক্র্যাক প্ল্যাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের মুখে শুনেছি – প্রণম্য নাট্যকার সেলিম আল-দীন নতুন নাটকের স্ক্রিপ্ট দিলে তিনি সেটি পড়তে পড়তে সমানে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে কেটে ঢাউস স্ক্রিপটিকে দুই-আড়াই ঘণ্টায় নিয়ে আসতেন। কারণ, মঞ্চ কিংবা সিনেমা হলে বেশি সময় দর্শকদের ধরে রাখা যায় না। কিন্তু বাচ্চু ভাইয়ের এই নির্মম ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং দেখে সেলিম আল-দীন ঘরময় অস্থির পায়চারি করতেন আর দু’হাতের আঙুল দিয়ে নিজের মাথার ঝাঁকড়া চুল টেনে টেনে ছিঁড়তেন। সেইসাথে চোস্ত চোস্ত খিস্তিখেউড় সহকারে হাহাকার করে বলতেন, ওরে তুই কি আমার মতো এমন একটা লাইনও লিখতে পারবি যে আমার এত সুন্দর লেখাটাকে এভাবে কেটে বাদ দিচ্ছিস? বাচ্চু ভাই নীরবে হেসে তাঁর কাজ অর্থাৎ ঘ্যাচ্যাং ঘ্যাচাং অব্যাহত রাখতেন। একেই বলে এডিটিং, একেই বলে পরিমিতিবোধ। এই পরিমিতিবোধ না থাকলে কোনো সৃষ্টিই শিল্পোত্তীর্ণ হয় না।
একাধিক মোটাতাজা অভিনেতার সমাবেশ দেখা গেছে এই চলচ্চিত্রে! শরীরে এত গোস্তওয়ালা মানুষ ১৯৭১-এ আমি অন্তত এদেশে দেখিনি। আর চর্বিওয়ালা মুক্তিযোদ্ধা? ইম্পসিবল। আরে, মুক্তিযোদ্ধারা তো ভালোভাবে খেতেই পেত না। কচুর ঘ্যাঁট খেতে খেতে ওদের পেটে চড়া পড়ে গিয়েছিল। শরীরে চর্বি জমার সুযোগই তো ছিল না। একথার সত্যতা যাচাই করতে চাইলে যে কেউ করতেই পারে। এখনো তো কিছু মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন। আমাদের নায়কেরা কি চোখ থাকিতে অন্ধ? দুনিয়ার আর সব নায়ককে ওরা দেখে না? এখন তো ঘরে ঘরে নেটফ্লিক্স, হইচই, আরো কত কত অপশন। ক্যামেরা নির্মেদ দেহ চায়। তাছাড়া, ডেমোগ্রাফির কথাই যদি বলি, তাহলে ৭১-এ বাঙালির গড় আয়ু কত ছিল, ৫৪ বছরের বেশি কি? তখন আমাদের গড় আয়ু কেন এত কম ছিল তার স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডাটা অনুসন্ধান করে রিসার্চ করা উচিত ছিল না? ফিল্মমেকিং তো একটা কঠিন কাজ, নয় কি? একটা সার্থক চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হলে কত হোমওয়র্ক করতে হয়। কত শ্রম, কত মেধা ব্যয় করতে হয়।
এই চলচ্চিত্রে কেন এত প্রেম এবং রোম্যান্টিকতার ছড়াছড়ি? মুক্তিযোদ্ধারা তো প্রাণের ভয়ে নিরন্তর এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পালিয়ে বেড়িয়েছে। তাদের না ছিল আশ্রয়, না ছিল ঘুম, না জুটেছে তিনবেলার আহার। এমন রসে ডোবানো প্রেম করার অখণ্ড সময় কি তারা পেয়েছে? রাজাকারের ভয়ে অর্ধেক খাওয়া ভাতের প্লেট ফেলে রেখে পেটের ক্ষুধা ভুলে গিয়ে তারা জীবন বাঁচাতে সরে গেছে। এটাই রূঢ় বাস্তব চিত্র। হ্যাঁ, এঁদের মধ্যেও দু’একজন প্রেমিক অবশ্যই ছিলেন কিন্তু তাঁরা প্রেমকে পেছনে ফেলে যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে গেছেন। প্রেম তাঁদের প্রেরণা হয়ে ছিল। তাঁদের প্রিয়জনকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে তাঁরা বদ্ধপরিকর ছিলেন। এমনই এক ব্যতিক্রমী যোদ্ধা ছিলেন, যিনি রণাঙ্গনের পাশেই এক গ্রামে আশ্রয় নেওয়া প্রেমিকার সন্ধান পেয়ে তাকে এক পলক দেখতে মেশিনগান গলায় ঝুলিয়ে ভরা বর্ষার খালে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। প্রেম ছিল তাঁর প্রেরণাদায়ী শক্তি, মোক্ষ নয়। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেই একটি যুগান্তকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। কিন্তু তা করতে গেলে যে মেধার দরকার আমাদের তেমন মেধাবী নির্মাতা কই?
১৯৭১-এ একটি বুলেটের দাম ছিল ৪ আনা। ২০০১ সালে আগরতলায় অনুষ্ঠিত ‘প্রথম মুক্তিযুদ্ধ উৎসব’-এ গিয়ে ক্র্যাক্ প্ল্যাটুনের গেরিলাযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাই বলেছেন, ‘আমাদের জীবনের দাম ছিল তখন ৪ আনা’। রণাঙ্গনে পাকবাহিনীর ছোঁড়া ৪ আনা মূল্যের এক একটা বুলেটে এসে যখন প্রতি মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছিল, সেরকম সময়ে যুদ্ধ ফেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা পূর্ণিমা রাতে ঘাটলায় কাতচিৎ হয়ে প্রেমের বুলি আউড়াচ্ছে এটা বিশ্বাস করা যায়? এই চলচ্চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে? মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন সময় কি ছিল? এসব ভাঁড়ামো দেখে হাসি চাপা দায় হয়ে ওঠে। বিন্তি নামের সোমত্ত মেয়েটাকে একা ফেলে সবাই চলে গেল। সে কিভাবে বাঁচলো, কি খেলো তার উত্তর মেলে না। যেখানে রাজাকারের লোভাতুর চোখ সারাক্ষণ তার ঊপর নিবদ্ধ? এই চলচ্চিত্রে প্রতিটি ঘটনা একটা থেকে আরেকটায় জাম্প করেছে, যা দেখে দর্শক খেই হারাতে বাধ্য হয়েছে। আবেগ থাকা ভালো, কিন্তু সস্তা আবেগ একটি জাতীয় আবেগকে খেলো করে দেয়। বিশেষ করে, সেটা যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের মতো সিরিয়াস একটা ইস্যু। এই ধরনের আবেগী উপস্থাপনা মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্রহননের সামিল।
প্রতিটি চলচ্চিত্রের একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকে, আলোচ্য চলচ্চিত্রের সেই বক্তব্যটা ঠিক কি, তা বুঝে উঠতে পারিনি আমি। হুঁ, বলাই যেতে পারে আমি আর তেমন কি জাতের দর্শক? কিন্তু টিকেট, ফুয়েল, ড্রাইভারের মজুরি, মিনারেল ওয়াটার, পপকর্ণ, চিকেন নাগেটস, মূল্যবান সময় ইত্যাদি বাবদ জনপ্রতি আনুমানিক ব্যয় কম করে হলেও ১০০০ টাকা। এই পরিমাণ টাকা খরচ করে যে দর্শক সিনেমা হল পর্যন্ত পৌঁছালো তার প্রাপ্তিটা কি? সেই দর্শক কি বার্তা নিয়ে ঘরে ফিরলো? নায়ক-নায়িকার অভিনয় নৈপুণ্য, পোশাকআশাক, আবহসংগীত ইত্যাদি নিয়ে এরপর কোন কথা বলার অবকাশ থাকে কি? এসব তো মুখ্য নয়, গৌণ ব্যাপার!
ঝড়ের বেগে হল থেকে বেরিয়ে আসার সময় একজন আমার মুখের সামনে একটা বাটন মাইক্রোফোন এগিয়ে ধরে প্রশ্ন করলেন, সিনেমাটা কেমন লাগলো একটু বলুন। আশাভঙ্গের ক্ষোভে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত যখন জ্বলে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে বেছে বেছে এই আমাকেই কিনা প্রশ্নটা করা হলো? নিজেকে সামলে নিয়ে সামান্য কাষ্ঠহাসি হেসে শুধু বলেছি, নো কমেন্ট।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে সংবেদনশীল ঘটনা। যেসব নবীন পরিচালক এই বিষয়টিকে নিয়ে ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হবেন তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ – আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি কিন্তু এই যুদ্ধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, তারা দয়া করে ফ্যান্টাসির জগত থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করবেন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে অস্ত্রটাকে শানিয়ে নিতে হয়, ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে লড়াই করা যায় না। তাতে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়।
কোথায় যেন পড়লাম এই চলচ্চিত্র দেখে স্বনামধন্য অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা নাকি কেঁদে ফেলেছেন! কেন কেঁদেছেন তিনি? চলচ্চিত্রটি দেখে হতাশ হয়ে? নাকি ৭১-এর স্মৃতি মনে করে? এমন কী আছে এই চলচ্চিত্রে যা দেখে তাঁর পক্ষে অশ্রু সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল? চোখের জল এতো সস্তা হলে তো সমস্যা। অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকীও নাকি এই সিনেমার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কী কারণে করেছেন? পরস্পর পিঠ চুলকানি নয় তো? অভিনেতা আফজাল হোসেনও এই চলচ্চিত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘একটা সিনেমা মনের মধ্যে যতটা গৌরব, যে পরিমাণ সুখকর অনুভূতির জন্ম দিয়েছে – যতটা ভাবাচ্ছে, কম করে বললে মনে সন্তুষ্টি আসবে না। ভালোর প্রশংসা মন খুলে করা উচিত… হৃদি হকের প্রথম চলচ্চিত্র ৭১ সেইসব দিন মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে…’। আফজাল হোসেনের ভাষ্য যদি সত্যি হয় তাহলে এক সপ্তার মাথায় সিনেমাটা হলে আর চললো না কেন? এমন বন্ধু কিংবা সুহৃদ থাকলে কারো কি আর শত্রুর প্রয়োজন হয়? একজন ভালো অভিনয়-শিল্পী যে একজন ভালো ক্রিটিক হবেন এমন কোনো কথা নেই। এই সিনিয়র আর্টিস্টদের তখনই দায়িত্ববান বলা যেত যদি তাঁরা এভাবে প্রশংসায় ভাসিয়ে না দিয়ে জুনিয়রের নির্মাণ ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিতেন। সেটাই হৃদি হকের ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে থাকতো। মনিষীরা কি আর এমনি এমনি বলেছেন, নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো? নিন্দুক ভুলগুলো ধরিয়ে দেয় বলেই বুদ্ধিমান ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে। অবশ্য যদি নিতে চায়।
প্রখ্যাত চিত্রকরেরা মূল ছবি আঁকার আগে প্রায়শই ট্রেসিং পেপারে পেইন্টিংয়ের বিষয়বস্তুর একটা খসড়া লে-আউট করে নেন। তারপর বড়ো ক্যানভাসে রঙ চাপিয়ে সেটাকে বিশাল রূপে উপস্থাপন করেন। চিত্রকর্মের মতো চলচ্চিত্রও প্রধানতম শিল্পমাধ্যমের একটি। এই শিল্পের প্রতি নির্মাতার সততা এবং দায়বদ্ধতা দর্শকের কাম্য। ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেওয়ার আগে এই বিষয়ের উপর প্রয়োজনীয় পড়াশোনা এবং গবেষণাটা করে নেবেন। যাতে আপনাদের শ্রম, মেধা, উদ্দেশ্য দর্শক তথা ভাবিকালের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। কারণ, আপনাদের নির্মিত চলচ্চিত্র রেকর্ড হিসেবে আর্কাইভে স্থান পাবে এবং রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে! আপনারা যদি ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন তাহলে তা সর্বনাশ ডেকে আনবে।