রায়হান রাফি পরিচালিত ‘দামাল’ চলচ্চিত্রটির গল্প তিনটি ধারায় এগিয়েছে। প্রেমের গল্প, ফুটবলের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধ। এই তিনটি বিষয় একটা প্রায় সত্যি গল্পের সাথে মিলিয়ে বা অবলম্বনে সিনেমাটা নির্মিত। আর সেটা হলো ’স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’, যারা ভারত জুড়ে খেলে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সমর্থন এবং তহবিল সংগ্রহ করেছিল। প্রচারে, ট্রেইলারেও সেই আভাস স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে এখনো ভালো মানের কোনো ফিকশন বা প্রামাণ্যচিত্র নেই। সেই জায়গা থেকে, বিষয়বস্তুটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং রায়হান রাফি সময়োপযোগী করে তা নির্মাণ করেছেন, এই সময়ের সেইসব দর্শকের জন্য, যারা সিনেমাকে শুধুই বিনোদনের জায়গা থেকেই দেখেন; সিনেমাকে শুধুই বিনোদনের মাধ্যম মনে করেন। এ ছাড়া তারা সিনেমা দেখেন না, বা দেখার জন্য সময় বরাদ্দ করেন না। টাকা খরচ তো তার অনেক পরের ব্যাপার। সেই জায়গা থেকে তাদেরকে ‘দামাল’ দেখানোর ইচ্ছা এবং প্রয়াস, সফল হয়েছে বলে আমি মনে করি। তাতে কাজ করেছে রাজ, সিয়াম, বিদ্যাসিনহা মিমের মতো জনপ্রিয় তারকার উপস্থিতি আর মমতাজের “ফুর ফুর ফুর” গানের ইউটিউব ভিডিও সেই দর্শকদেরকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করেছে। আর রায়হান রাফির আগের বিনোদনমূলক সিনেমাগুলোর প্রভাব তো আছেই, বিশেষ করে এখনো বাংলাদেশে বাণিজ্যিক সিনেমার খবর যারা রাখেন। তার সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’ ছবিটিও বিনোদনমূলক পরিচ্ছন্ন মুভি। রবির ওটিটি প্লাটফর্ম বিঞ্জে ‘ফ্রাইডে’ টিভি সিরিজটা তো বাংলাদেশের টিভি সিরিজের ইতিহাসেই একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রায়হান রাফির সিনেমা ব্যাপারটা তাই ওই দর্শকদের কাছে আলাদা ব্র্যান্ড।
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বলতেই আমরা যা দেখি সাধারণত পর্দায় সেই জায়গা থেকে বের হয়েছে দামাল। মুন্না আর দুর্জয় সিনেমার কেন্দ্রীয় দুইটা চরিত্র। যাদেরকে ধরে সিনেমাটা এগোয়, বর্তমান আর অতীতে ঘোরাফেরা করে। দুর্জয় (সিয়াম) ফুটবল পাগল কিন্তু সিলেকশনের সময় দেখা যায় তার বাঙালি পরিচয় তাকে ভালো দলে খেলতে বাধা দিচ্ছে। প্রতিভা থাকার পরেও সে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা আসলে শুধু ফুটবল নয়, ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাব যে, এটা হয়েছে প্রায় সবক্ষেত্রেই। বাঙালির সংখ্যা ৫৬ শতাংশ থাকার পরেও পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানি এবং বিশেষ করে পাঞ্জাবি পাকিস্তানিদের জন্যই স্বর্গ ছিল। তারা সব পদ, সব সুযোগ সুবিধা, রাজধানী, সবকিছু নিজেদের করায়ত্ত করতে থাকলো। তারা নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করলো পুরো পাকিস্তানের প্রভুজাতি হিসাবে। আর তাদের সব থেকে বড়ো হুমকি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা। তাই তারা করলো পূর্ব পাকিস্তান (প্রদেশের নাম থেকে বাংলা শব্দটাকে তারা ফেলে দিয়েছিল, যা ছিল ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক)। শুরু করল প্রোপাগান্ডা, ধর্মের নামে প্রোপাগান্ডা। ধর্মকে চরমভাবে ব্যবহার করল শোষণের হাতিয়ার হিসাবে। মুন্না পরে ওয়ারিতে খেলার সুযোগ পায়। সেটা সম্ভব হয় ওয়ারির একজন বাঙালি প্রাক্তন খেলোয়াড়ের যোগাযোগের জায়গা থেকে। এইরকম প্রতিটা বিষয়, সেটা ফুটবল হোক, আমলার চাকরি হোক, পুলিশ হোক, সেনাবাহিনী হোক, সব জায়গাতে বাঙালিরা বঞ্চিত হয়েছিল। সেগুলো নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সিনেমা তৈরি হচ্ছে, বা সামনে আরো আসছে। যেমন, তৌকির আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ আমরা দেখি একটা মফস্বল শহরে একজন পাঞ্জাবি পুলিশ ইন্সপেক্টর দায়িত্ব নিয়ে আসে, যার সব অধীনস্থ কর্মচারী হলেন বাঙালি। সারা বাংলাদেশে যদি চার শো থানাও হয় , তাহলে আমরা যদি পাকিস্তান থাকতাম , তাহলে সেই চার শো থানার ওসি থাকতো পাকিস্তানি। বাঙালি ওই চার শো পদ হারাতো। তারা কোনদিন ওসি হতে পারতো না। পাঞ্জাবিরা তাই চেয়েছিল। অর্থনৈতিক চরম সুবিধা আদায়ের জন্য তারা অভাবনীয় সব অন্যায় কাজ করে গেল বছরের পর বছর। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই বিস্ফোরণ তো আজ বা কাল হোক হবেই। এই জায়গাতে ‘দামাল’ সিনেমাটা খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে সেই বৈষম্যের কথা সামনে নিয়ে এসেছে। ক্রিকেট, হকিসহ অন্য আরো খেলা নিয়ে একটু গভীরে গেলে হয়তো আরো গল্প উঠে আসবে। গল্প তো সব বলা হয়ে ওঠেনি। পঞ্চাশ বছর হয়েছে বাংলাদেশের বয়স। সামনের পঞ্চাশ বছরে অন্তত আরো ৫০টি গল্প আসবে, ইতিহাস আরো পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে সিনেমার পর্দায়। রায়হান রাফিকে ধন্যবাদ এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করবার জন্য।
এবার দামালের গল্পে আসি। সিনেমাটা যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে সবাই প্রথমে দেখবে একটা ফুটবল প্লেয়ারের তারকা হবার গল্প হিসাবেই। তাই শুরুতেই সেভাবেই দর্শক দেখে। দুর্জয়ের ছোটবেলা থেকে শুরু করে তার বড়ো হওয়া। তার প্রেম। তার প্রভাব এলাকার ছেলে হিসেবে, যে ফুটবলার হিসেবে জনপ্রিয়। এই টুকরো টুকরো গল্প এবং হাসি-ঠাট্টা নিয়ে গল্প এগোতে থাকে। দর্শক ততক্ষণে স্থির হয়ে আসনে বসে। সিনেমার প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে। সেটা থাকতে থাকতেই শুরু হয়, আরেক খেলোয়াড়ের গল্প, নাম যার মুন্না (রাজ)। দর্শক আশ্বস্ত হন যে, না গতানুগতিক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা না।
তার আগে তো রাজ আর বিদ্যা সিনহার প্রেম-বিয়ের গল্প নিয়ে যে গান, ‘ফুর ফুর ফুর’, এর দারুণ চটকদার কথা এবং সুরে মমতাজের কণ্ঠে গাওয়া, তা সিনেমা রিলিজ হবার আগেই সবার মুখে মুখে ফিরছিল। এবং গানের মধ্যেই এমন সব দৃশ্য আছে যা দর্শককে সিনেমাটা দেখানোর ব্যপারে আগ্রহী করে তুলবে। রাজের ফুটবল প্রেমকে সামনে নিয়ে আসবে। একজন ফুটবলার যে বিয়ের দিনেও প্র্যাকটিসে চলে যায় আর সেজন্য রাতে বউ তাকে ঘরে ঢুকতে দেয় না, এই হাস্যরসাত্মক দৃশ্য আর গান , আরো বেশি দর্শককে এই সিনেমা দেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। এটা পরিচালকের হয়তো একটা জরুরি কৌশল দর্শককে সিনেমা হলে টেনে আনার, যারা ইতিমধ্যে সিনেমা হলে চলে এসেছেন তাদেরকে সিনেমাতে পুরোপুরি নিমজ্জিত করার, এবং এই মোড়কের আড়ালে একটা ভালো এবং মূলানুগ মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বয়ান দেয়াই হয়ত ছিল পরিচালকের লক্ষ্য। কারণ, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা শুনলেই অনেকে দেখতেই চান না। একই রকম গতানুগতিক বস্তাপচা ফর্মুলা-ছবিতে মানুষ বার বার প্রতারিত হচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকে।
সেজন্যই বলছি আবারো, ফুটবল আর প্রেমের গল্পের মোড়কে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এই সময়ের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে নিয়ে এসেছেন রায়হান রাফি, যে দর্শকরা নেটফ্লিক্স দেখে নিয়মিত, গেম অব থোর্ন্স নিয়ে আলাপ করে, নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম কোথায় কি এসেছে, হলিউডে কি চলছে, কোরিয়ান সিনেমা কি (পুরো ওয়ার্ল্ড সিনেমা বলতে যা বোঝায় সেটা নিয়ে হয়তো জানে না), এইসব খবর নিয়মিত রাখে আর সক্রিয় থাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
যেভাবে বানালে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাটা একটা নির্দিষ্ট কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌছাবে, সেভাবেই রাফি সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন।
প্রথমে বর্তমান সময়ের মহিলা ফুটবল দলের ইস্যু নিয়ে শুরু, তারপর সেটা চলে গেল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গল্পে। যাতে দর্শক বর্তমান আর অতীতের একটা মেলবন্ধন খুঁজে পায়। তার সাথে এলো দুইজন ফুটবলারের প্রেমের গল্প, তাদের যুদ্ধে জড়ানোর গল্প, তাদের যুদ্ধে যাবার এবং তাদের পরিবারের গল্প। ফুটবল খেলে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের গল্প। দর্শক সিনেমার পর্দায় আটকে যাওয়ার পর শুরু হলো মূল গল্প, যেটা দিনশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের, রাজাকারের, পাকিস্তান আর্মির, বাংলাদেশের জনগণের গল্প। চটকদার গান, কমেডি আর প্রেমের দৃশ্যের মাধ্যমে দর্শককে নিয়ে যায় গল্পের ভেতরে (আফিম সিনেমার যে কাজ আরকি), সেখানে দর্শকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প এমনভাবে বলা যে দর্শক সেটাকে নেবে কিন্তু কোনো ভাবেই সিনেমাটিকে শুধুই মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে না।
৭ই মার্চ এল, ২৬শে মার্চ এল, সব গল্পই এল বিভিন্নভাবে। এই সময়ের, এই ডিজিটাল সময়ের, ওটিটি যুগের নতুন দর্শককে এইভাবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলাটা , তাদের আগ্রহের জায়গাটাকে আরও বাড়াবে অবশ্যই। এখানেই পরিচালক সফল।
ভিএফ এক্স-এর দুর্বলতা চোখে পড়েছে। আমি বিশ্বাস করি এখনো সেগুলো চাইলে আরো রিয়্যালিস্টিক করা যেতে পারে। একটা জরুরি সিনেমা দামাল। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ব্যাপারে সবাইকে আরো বেশি আগ্রহী করে তুলতে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমাদের ফুটবলের গুরুত্বটা সবাইকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে এই সিনেমা আলাপে-আলোচনায় ফিরে আসবে। তাই আমি অনুরোধ করবো অনেকের পক্ষ থেকে যে, যদি সম্ভব হয়, হাতে বাজেট আসে, ভি এফ এক্স-এর জায়গা থেকে যদি আরো রিয়্যালিস্টিক করে গ্যালারি এবং অন্য ব্যপারগুলো আনা যায়, তাহলে দর্শক, নির্মাতা, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সবাই আরো সাড়া দেবে। এই চলচ্চিত্র সারা পৃথিবীতে দেখানো যেতে পারে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের আগ্রহী করে তুলতে।
দামাল-এ কবিতার ব্যাবহার ব্যপারটা ভালো কিন্তু ওই একই ব্যাপার, সবাই জানে এমন একটা কবিতাই সিয়াম পড়েছে, বিদ্রোহী কবিতা, যা দর্শক আগে থেকেই শুনেছে। যে পাঞ্জাবি পাকিস্তানি আর্মি সেও শায়েরির মধ্য দিয়ে তার বাজে চিন্তাভাবনাকে প্রকাশ করেছে। আরেকটা জিনিস আমরা বুঝলাম, দোষ আসলে ভাষার না, দোষ আসলে ওই মানুষের যে সেই ভাষা বা কথাটাকে তার মতো করে অর্থ করে নিয়েছে, মূল লেখক কিন্তু সেই অর্থে লেখাটা লেখেননি। একটা সুন্দর উর্দু শায়েরি যার অর্থ পবিত্র প্রেম নিয়ে। কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষাপটে (টর্চার সেলের বন্দী নারী সামনে) সেটার অর্থ হয়ে গেছে নোংরা উদ্দেশ্যমূলক। এই জায়গা আলাদা গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে। যেন বলছে, ভাষা খারাপ না, খারাপ মানুষ ভাষাকে খারাপ করে ফেলে। কবিতাটার অর্থ ছিল অনেকটা এইরকম :
রাত আসলেই চাঁদকে খুঁজে নিয়ে আসো,
দিনের আলোতে চাঁদকে কোথায় খুঁজে পাবে?
সিনেমাতে উর্দুটাকে ঠিকঠাক বলা হয়েছে, যেন মনে হয় যিনি উর্দু বলছেন তিনি আসলেই পশ্চিম পাকিস্তানি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাতে প্রায়ই দেখি শুদ্ধ উর্দু বলছে না, কিন্তু পাঞ্জাবি পুলিশ অফিসারের সেটা করার কথা না। বা অন্য অনেকেই সিনেমাতে ব্যাপারটা ঠিক করে খেয়াল করেননি বা দায়সারাভাবে কাজটা করেছেন। বাঙালি যে রাজাকার সে যে ভুলভাল উর্দু বলে হাসির খোরাক হয়েছে, সেটাও জরুরি ছিল। ভাষা তো স্বতঃস্ফুর্ত ব্যাপার। সেটা ভালোভাবে না জেনে বা ভুলভাল করে বলে বা ক্ষমতার লোভে বা চাপে বলতে গেলে যে সেই ভাষাকে খারাপভাবে বা হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করার সম্ভাবনা থাকে, সেটা ভুলভাল উর্দু উচ্চারণে আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জায়গাগুলোতে ‘দামাল’ সিনেমা আলাদা এবং অনেককে পথ দেখাবে।
‘দামাল’ গতানুগতিক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা থেকে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে মুক্তি দিয়েছে। এবং বিনোদনের মোড়কে অনেককেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে পেরেছে। এখানেই দামাল আলাদা। ব্যবসাসফল হবার সব ধরনের সম্ভাবনাই ছিলো সিনেমাটাতে, সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও।