আমার প্রেমিক একটা বনে বাস করে—এটা ভাবলে আমার অবাক লাগে। নির্জন, কচি বনটার একদিকে জলরঙা স্রোতস্বিনী। ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ছড়াছড়ি তার কিনারায়— সেদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতির দল খেলা করে বেড়াচ্ছে।
ডানপাশে আমি সে দৃশ্য দেখছি আর মাঝের পথ ধরে আমি হেঁটে ঢুকছি বনের ভেতরে। আজকে আমি আমার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি কতটা মেডিটেটিভ স্থানে সে বসবাস করে। পশু-পাখিও এখানে নিঃশব্দ; তারা অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে কেবল চোখের সামনে এসে। না হয় বোঝাই যেত না এ বন কোনো ভূতের ফাঁদ কি না।
একটা সাপ দেখে তাড়াতাড়ি সরে এলাম। হলুদ লাল সাপটা জিকজ্যাক করে চুপিচুপি চলে গেল।
ব্যাঙ, বানর, হরিণ লাফিয়ে গেল… তাদের দেখলাম, তারাও আমাকে দেখেছে। কিন্তু তাদের জিভ থেকে বাতাসে কোনো শব্দ বের হয়নি।
শুধু আমার কানের ছাতায় বাড়ি খাওয়া শোঁ শোঁ শব্দ শুনছি এখনো; আর কোনো শব্দ নেই।
অবাক লাগে যে, তারাও সোসাইটির মতন কলহ করে না, অযথা গর্জন না।
কিন্তু আমার প্রেমিক এর চাইতেও অধিক শান্তিপ্রিয়। তাই তো এত নিস্তদ্ধ বন অথচ সে এই বনের ভেতরে না বরং বনের নিচে বাস করে এবং সে এতটা নির্জনতা প্রিয় যে সে বেঁচেও নাই বরং মৃত বাস করে। নিজের শব্দও হয়তো তার সহ্য হয় না। আমার কোনো স্মৃতি মনে নেই। যতই বনের ভেতরে ঢুকছি— ধিকিধিকি করে এটুকু মনে পড়ছে।
এত এত মনে রাখার কাজ জগতে… প্রেমিক, প্রেম এসব মনে না থাকাটা স্বাভাবিক। আগে পেট তারপর প্রেম। প্রেমিকের চাইতে অফিসের বসকে মনে থাকে বেশি।
কবর খুলে আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি। আমি জানি শুধু তার কালচে-লালচে চুলটুকু খুলিতে থাকবে। আমার কাছে তার ঠিকানাও নেই। বহুদিন কলহঘেরা জীবন যাপনে অতিষ্ঠ হয়ে আমার পা দুটো একটা দিকে তাক করে ছুটতে চায় শুধু। আজগুবি! নিজে নিজেই পজিশন নিয়ে হাঁটতে থাকে।
ভেবেছি কোনো অসুখ হয়েছে কি না! পরে ভাবলাম তাকে না থামাই। গিয়েই দেখি পা জোড়া এতো ছটফট কেন করছে।
অবশেষে আজকে এসে পড়েছি। ঠিকানা জানি না; না জানি ছেলেটার নাম। আমাকে আচ্ছন্ন করা তার চুলের কথা মনে আছে। কারণ ছেলেদের চুল আমাকে অসম্ভব আকর্ষণ করে। না হয় সেটাও মনে থাকত না।
তার অবয়ব একবার দেখলে হয়তো মনে পড়তেও পারে। পায়ের স্বকীয় চলাতে আমি আজ থামলাম না; আমাকে টেনে নিয়ে তারা নিজে নিজেই এই বনে ঢুকে পড়েছে। তারা চেনে কোথায় যেতে হবে। আমার মগজে মনে রাখার মতন যে জায়গা নেই, ওটা হৃদয়ও বুঝে নিয়েছে। তাই মনে রাখার দায়িত্বগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভাগ করে করে নিয়ে নিচ্ছে দিনদিন।
আমাকে হৃদয়ের আদেশে নিয়ে গিয়ে পা জোড়া খাড়া করালো একটা ফুলভরা ভয়ানক কবরে। ভয়ানক কারণ, ফুল সর্বদা ভুল দিকে ধাবিত করে।
আঁকাবাঁকা লতা সরালে আমি সুঘ্রাণ পেলাম। গোলাপি সাদা মাধবীলতার ঝুম কবরের মাথার দিকে ছায়া দিয়ে রেখেছে। কোনো মৌমাছিও নেই; নিঃশব্দ। এটা তো আরও ছমছমে ব্যাপার যে আমি ছাড়া কোনো প্রাণীই নেই আশেপাশে।
সুগন্ধের সাথে আমাকে স্বাগতম করা হলো। আমি কবর খুঁড়লাম আমার দু’হাত দিয়ে। মাটিগুলো এত নরম, এজন্যই তো ফুল ফুটেছে। ত্রিশ মিনিটে কবর খুঁড়ে ফেললাম। আমার পুরো শরীর আতরের ঘ্রাণে ভরে গেল; সবগুলোই প্রকৃত জ্যান্ত ফুলের। কোনো মৃত ফুলের বোতলভরা রসের সুবাস না।
আমার হাতজোড়া নোংরা হয়ে পড়লে পরিবেশের সাথে নিজেকে অসুন্দর লাগল। সবকিছু দৃশ্যের মতন সুন্দর হলে ভাল হতো।
অবশেষে আমি তার মুখ থেকে মাটি সরালাম। কিন্তু তার মুখটা ততদিনে পঁচে গেছে। শুধুই সাধারণ কঙ্কাল। অস্তিত্ব বলে কিছুই নেই মানুষটার। নিজেও জানি না, কতদিন পর এসেছি প্রেমিককে দেখতে।
চুলগুলো কিন্তু সত্যিই খুলিতে আটকানো— লালচে কালো চুল। শরীরের অবয়ব তো বোঝা যাচ্ছে না। কঙ্কাল হয়ে পড়েছে পুরোপুরি কিন্তু চুলগুলো একদম সতেজ। চুল নাকি মৃত কোষ। জন্ম থেকেই চুলের পরিচয় থাকে সে মৃত। আমার প্রেমিকের স্মৃতিও মৃত হয়ে জন্মেছে আমার মগজে; একদম চুলের মতন।
চুলগুলোতে কী যে মায়া! আমার নিয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওগুলো আমার খাটের হেড বোর্ডের ঠিক নিচেই রাখব আমার মাথা বরাবর। যাতে আমি আর সে পুরোপুরি মিশে বাস করতে পারি। চুল, প্রেমিক আর আমি— আমরা তিনই একই ধর্মের। জন্ম থেকেই আমদের পরিচয়, আমরা মৃত।
নিচে নেমে আমি তার অসহায় চুলে হাত বোলালাম। এত সুন্দর চুলগুলো অবহেলায় এতটুকু নষ্ট হয়নি। আগা বটানো স্যালন কাটা চুল।
বেশি সময় নষ্ট না করে, তার চুল আমার কালো ব্যাগে নিয়ে উঠে পড়লাম। কঙ্কালকে দেখে আর কি করব? সে আর এই কঙ্কাল এক নয়। মাটি চাপা দিয়ে ফুলের মূলগুলো আবার পুঁতে দিলাম।
তার চুলগুলো নিয়েই আমি ফিরছি এখন। ভাবছি, আমার প্রেমিক কেন বনে? আমাদের প্রেম কেমন করে হয়েছিল? সে এতটা একলা কেন? বিচ্ছিন্ন কেন?
এতদূরে… একটা বনের ভেতরেই বা কেন?
মা, বাবা কি নেই? তার জন্ম পরিচয় কি? মানুষ ছাড়া তো মানুষের জন্ম হয় না। একটা পিঁপড়েরও তো পিঁপড়ে থাকে। এমনকি মাছি, ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ারাও অন্য ব্যাকটেরিয়ার হাত পা থেকে গজায়। কিন্তু আমার প্রেমিকের জন্মের কোনো সূত্র পেলাম না।
তার চুলগুলো আমার ব্যাগে আছে, সব অনুভূতি এখন ওটাকে ঘিরে। চুল বড় অদ্ভুত, জন্ম থেকে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মৃত হয়েও সে বারবার জন্ম নেয়। শুধু জ্যান্ত একটা মানুষের সাথে কানেক্ট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এবং ভালো লাগে যে বারবার জন্ম নেয়। আমার প্রেমিকও যদি জন্ম নিত বারবার!
একটা বাতাস এলে আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমায় ঘিরে একটা ঘূর্ণি তৈরি হলে বুঝলাম এমন এক ঘূর্ণিপাকে আমি একদা পড়েছিলাম। স্মৃতি মনে পড়তে লাগল— এমন ঘূর্ণিতেই আমি ঘুরতে ঘুরতে একদা উপরের দিকে উঠেছিলাম; অনেক উপরে। আবার ঘূর্ণি আচমকা বন্ধ হলে, তলিয়ে পড়লাম। হ্যাঁ, মনে পড়ছে— কিন্তু আমি মরিনি, কারণ আমাদের ধর্মই মৃত।
তারপর আমি নিজেকে একটা বাড়িতে খুঁজে পেলাম। বাড়িটা ছিল শূন্য। আমি ক্লান্ত ঘুমিয়ে উঠে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম; ডুঁকরে কাঁদার শব্দ। এতটা করুণ যে বুক ছিঁড়ে যায়।
ইতিমধ্যে আমি আবিষ্কার করি, আমার শূন্য ঘরে কেউ আছে— এবং যে কাঁদছে সে আমাকে দেয়া একটা পুরস্কার। আমার হৃদয় থেকে তার জন্ম। আমার ভেতর থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। তার দেহ বড় গড়নের, সুগ্রীব ও সুন্দর এবং লম্বা তার ঠ্যাঙ। কিন্তু শিশুর মতন ঘাপটি মেরে সে বসে কাঁদছিল— মনে পড়ছে।
আমি তার কাছে এগিয়ে গেলে সে মুখ তুলে আমাকে দেখল এবং এক লাফে তার দীর্ঘ হাতে জাপটে ধরল। সেই থেকে সমস্ত শূন্যতা উবে গিয়ে ঘূর্ণি বাতাসের মতন সে আমার জীবনকে ঘিরে ধরল যেন।
আমাকে তার শীতলতা আচ্ছন্ন করে রাখত। আমি তাকে সন্তানসম স্নেহ এবং ভালবাসতে শুরু করি। সে আমার সন্তানই; নাহ্ সন্তান থেকেও বেশি। সে আমার হৃদয় থেকে তৈরি; জরায়ু থেকে না। তার জন্ম আর দশটা প্রাণীর মতন ছিল না। তার জন্ম হয়েছিল আমার হৃৎস্পন্দন থেকে। তাই তো সে এতটা নির্জনতা প্রিয়। নির্জন বনের মাঝখানে, মাটির গভীরে থাকতে সে ভালোবাসে— একটা হৃৎপিণ্ডের মতন। সবটা মনে পড়ছে আমার।
ভাবলাম, ঘূর্ণি দেখে স্মৃতি মনে পড়ল নাকি… নাকি মেমোরি ডিস্টরশন হলো? নাহ্, স্মৃতিই হবে। সে আমার প্রেমিক, শূন্য নির্জন বনে তার বসবাস। লালচে কালচে চুল হাতে আমি বাড়ি ফিরছি। এখন আমার হৃৎপিণ্ড তার জন্য অশান্তি নিয়ে কাঁদা শুরু করেছে। আমার প্রেমিক! খাড়া নাক, প্রশস্ত বুক, আর লম্বা লম্বা ঠ্যাঙ নিয়ে সে প্রায়ই আমাকে দেখে থাকত। তার গলা আর আমাকে প্রিয় বলে ডাকা এসব… সব মনে পড়ছে।
কান্না যখন ডুঁকরে বেরিয়ে এল, মনে হলো আমি আবারও সে কান্নার শব্দ শুনছি যা সেইদিন শূন্য ঘরে শুনতে পেয়েছিলাম। যে কান্না আমার বুক ছিদ্র করে দিচ্ছিল। কিন্তু এটাতো আমার নিজেরই কান্না!
সঙ্গে সঙ্গে আমি আবিষ্কার করলাম আমার সামনে সে-ই। আমার প্রেমিক, লম্বা ঠ্যাঙ, সুগ্রীব, সুন্দর এবং প্রশস্ত সেই বুক।
সব উত্তর স্পষ্ট হলো, সেদিনের কান্নাটা তাহলে আমার নিজেরই ছিল। হ্যাঁ, সেই ব্যথা যে ব্যথা একজন গর্ভধারিণী মা সন্তান জন্ম দিতে অনুভব করে। ততটা সমান ব্যথা দিয়ে আমি কেঁদেছিলাম তখনও; জীবনে ঘূর্ণি নামার রাতে এবং সে জন্মেছিল এবং আজও সে জন্মেছে।
তাও সন্দেহ হলো; থলেতে হাত দিলাম। লালচে কালচে চুলগুলো কি আছে? নাকি আবারও ভুল ভেবে ভুল দেখছি?
দেখি নাহ্ নেই, সবটা সত্যি— ভুল দেখছি না। আমি দৌঁড়ে গিয়ে তার প্রশস্ত বুকে মাথা রাখলাম।
নিজের শূন্যতা ঘিরে ঘূর্ণির মতন সে আমাকে পেঁচিয়ে ধরল।
তাইবা তুলবি
জন্ম ২০০১ সালের ২৫শে জুন, চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গল্পের জগতে নতুন, কিন্তু প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।