গল্প : সাকি সোহাগ | আলোচক : শায়লা সুলতানা
আমি নির্দোষ, আমি কোনো অন্যায় করিনি। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি নেশা করি না তা নয়, আমি শুধুমাত্র সিগারেট ছাড়া অন্য কোনো নেশা করি না। এই যে ভাই, হ্যালো, ও ভাই শোনেন, প্লিজ, আমি সত্যিই কোনো নেশা করি না। আমি মধ্যবিত্তের ছেলে হলেও এলাকায় আমার একটা সম্মান আছে, বোঝার চেষ্টা করেন। ও ভাই যায়েন না, শোনেন, শোনেন প্লিজ।
থানার সেল থেকে উদয় এক পর্যায়ে চিৎকার করতে শুরু করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এএসআই সুমন পারভেজ ওসির রুমে ঢুকলেন। উদয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ওখানে ডিউটিরত কনস্টেবল বলে উঠল – ‘কেরে বা চিল্লাওসিন কে? তুমি নিসা করোসিন কি করোসিন না তা তো টেস্ট করা হবিই।’
উদয় সেলের রড থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ল। পাশেই বাকি তিনজন চুপচাপ বসে আছে। তারা আসলে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার থেকেও উদয়ের করুণ কাহিনি দেখে অনেকটা চুপসে গেছে হাওয়া বের হওয়া বেলুনের মতো। একজন তো বলেই বসল, ‘ভাই কি আজই প্রথম পুলিশের হাতে ধরা খাইছেন?’
উদয় অনেকটা বিরক্ত মুখ নিয়ে বলল, ‘আরে কি যে বলেন! আমার বংশে পুলিশ সংক্লান্ত কোন ঝামেলা নাই।’
দু’জন মহিলা ও একজন বৃদ্ধলোক সেলের কাছে আসতেই বসে থাকা ওই তিনজনের একজন উঠে দাঁড়াল, ‘মা আমি কিছু খাইনি। আমি শুধু বসে ছিলাম ওদের সঙ্গ।’
‘তুই কিছু খেয়েছিস কি না সে তো আমি জানি!’
‘আমাকে বের করার ব্যবস্থা কর।’
‘আচ্ছা তুই কি ভালো হবি না কখনো? এই শেষ বয়সে এসে আমাদের এমন অত্যাচার করছিস কেন?’
আকাশ মেঘলা। কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবহাওয়াটা বেশ নরম। রাতে হয়তো বৃষ্টি নামতে পারে। ওসির রুম থেকে ওসি ও সুমন পারভেজ একসঙ্গে বের হলেন। দু’জন কনস্টেবল সেলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্দিদের স্বজনদের তাড়িয়ে দিল। ওসি সেলের কাছে আসতেই উদয় তড়িঘড়ি করে উঠে সেলের রড শক্ত করে ধরল, ‘স্যার আমি সত্যিই নেশা করি না। আমি একটা ভালো ছেলে স্যার। আমি ওই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম আর হঠাৎ…।’
‘এই আপনি চুপ করবেন? সেই কখন থেকে থানাটা মাথায় তুলে রাখছেন। একদম চুপ। আপনার নাম ঠিকানা ও বাসার মোবাইল নাম্বার দেন।’
সাদিয়া টিভি দেখছিল। হঠাৎ থানা থেকে ফোন আসায় অনেকটা চমকে উঠল। সাথে মেঘেরও গর্জন শোনা গেল। যখন শুনল উদয় থানায় তখন চিৎকার দিল জোর। ওপাশ থেকে সুমন পারভেজ ফোন কেটে দিলেন। উদয়ের বাবা তখনো বাড়ির বাইরে। পাশের রুম থেকে উদয়ের মা দৌড়ে আসেন,
‘বৌমা কী হয়েছে?’
‘মা, উদয় থানায়।’
‘থানায় মানে? কী করেছে ও?’
‘আমি জানি না মা। আমাদের এখনি যেতে বলল থানায়।’
কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠল সাদিয়া। এইতো গতকালই উদয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি এসে দাওয়াত করে গেছে। আগামীকাল উদয় বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাবে। এই মুহূর্তে এমন সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে লোকের কাছে কীভাবে মুখ দেখাবে সাদিয়ারা? পুলিশ ধরবে এমন কাজ উদয় করতে পারে না। আর যাই হোক উদয়ের মা এটা বিশ্বাস করবেন না। আশেপাশে জানাজানি না করে উদয়ের মা ও সাদিয়া থানার দিকে আসে। উদয়ের বাবাকে কল করা হয়।
উদয়ের বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর উদয়ের মা উচ্চৈস্বরে কেঁদে উঠলেন। কেঁদে উঠল আকাশদেবতা। একটুখানি ভিজিয়ে দিল প্রকৃতিকে। উদয়ের বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্ত্রীকে। জানালেন পৌর মেয়রও নাকি তাকে কল করেছেন। পৌর সদরেই উদয়দের বাসা। সেই সুবাদে মেয়রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক।
উদয়ের বাবা-মা ও সাদিয়া থানার মধ্যে ঢুকতেই দেখা গেল রুবেল ভাইকে। রুবেল ভাই ওদের পৌর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তাকে অবশ্য পাঠিয়েছেন মেয়র নিজেই। রুবেল ভাইকে সাথে নিয়ে ওরা ওসির রুমে গেল। সব শুনল, সন্ধ্যার পর হসপিটাল রোডের পাশে মহিলা মাদ্রাসার বারান্দায় উদয়সহ ওরা কয়েকজন গাঁজা সেবন করছিল। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পাঠানো তথ্যে থানা থেকে দু’জন এএসআই-সহ কয়েকজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে একটি ফোর্স যায় সেখানে। তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যে তাদের অজান্তেই বারান্দাটা ঘেরাও করে পুলিশ। পুলিশকে দেখে কয়েকজন পালালেও শেষে চারজন গ্রেফতার হয়। তার মধ্যে উদয় একজন।
উদয়ের বাবা-মা-সহ রুবেল ভাই নিজেও ওসি সাহেবকে অনুরোধ করলেন উদয়কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কারণ সত্যিই উদয় গাঁজা খায়নি। কোনো কারণবশত হয়তো সেখানে আটকে গেছে। কিন্তু ওসি সাহেব মাথা নাড়লেন। ঠিক সেই সময় সুমন পারভেজ ওসি সাহবের রুমে ঢুকলেন। পরক্ষণেই ঢুকলেন থানার সেকেন্ড অফিসার। তারা মাদক মামলার ফাইলটা রেডি করতে চান। ওসি সাহেব চোখের ইশারায় তাদেরকে আরেকটু দেরি করতে বললেন।
মা-বাবা ও নিজের স্ত্রীকে দেখে উদয় কান্নায় ভেঙে পড়ল। উদয়ের কান্না দেখে সাদিয়াও কাঁদছে।
সেখানে বেশ কান্নার রোল পড়ে গেল। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তদন্ত অফিসার। তিনি বেশ রাগি কণ্ঠে ধমক দিলনে সেখানে ডিউটিরত কনস্টেবলকে। কনস্টেবল সবাইকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দিল। শুধু কাউন্সিলর রুবেল ভাই সেখানে থাকলেন উদয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলার জন্য। রুবেল ভাই প্রথমেই ওই তিনজনকে জিজ্ঞেস করলনে যে, উদয় কি তাদের সঙ্গে সত্যিই গাঁজা খেয়েছে?
তারা তিনজনেই সুন্দর ও শুদ্ধ করে বলল, তারা আসলে উদয়কে চেনেই না। আর গাঁজা খাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমরা যখন সেখানে গাঁজা সিগারেট ভরছিলাম তখন এই ছেলেটা বারান্দাতেই ছিল। পুলিশের বাঁশি শুনে হঠাৎ দৌড়ে আমাদের কাছে আসে। ঠিক সেই সময় আমাদের চারজনকে একসঙ্গে আটক করে পুলিশ। আটক হওয়ার পর থেকে এই ছেলেটা পুলিশকে বলছিল যে সে নির্দোষ। সে গাঁজা খায়নি। বারবার বলছিল বলে, এক কনস্টেবল লাঠি দিয়ে ওর উরুতে দুইটা বাড়ি দেয়। তারপর থানার গেটে এসে এই ছেলেটা চিৎকার করে। তখন এএসআই লাঠি দিয়ে কয়েকটা বাড়ি মারে পাছায়। তারপর সবাইকে নিয়ে এসে এখানে রাখে।
রুবেল ভাই উদয়কে ডাক দেন। উদয় আসতেই উদয়ের মা আবার দৌড়ে আসেন রুবেল ভাইয়ের কাছে। এসে উনার দু’হাত জড়িয়ে ধরেন। অনুরোধ করেন যেকোনো মূল্যে তার ছেলেটাকে সেখান থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করার জন্য। রুবেল ভাই উনাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে যেতে বলে উদয়কে বললেন,
‘ঘটনা আসলে কী? তুমি ওদের সঙ্গে কেন?’
উদয় কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়র সাহেবের কল এলো। রুবেল ভাই সেখান থেকে একটু দূরে গিয়ে উনার সঙ্গে কথা বললেন। আসলে
এবারের পৌর মেয়রটা অনেক ভালো। সাধারণ মানুষের বিপদআপদে উনাকে পাওয়া যায়। যতটুকু পারেন উনি হেল্প করেন। উদয়ের বাবা মেয়রকে কিছু না বললেও মেয়র বিষয়টা জানার পরপরই উদয়ের বাবাকে কল দেন। যে কারণেই হোক মেয়র সাহেব উদয়কে চেনেন। খুব ভালো জানেন। তাই হয়তো তিনি নিজেও চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। ততক্ষণে মেঘের ঘোর অন্ধকার কেটে একফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। রুবেল ভাই মেয়রের সঙ্গে কথা বলে আবার সেলের কাছে যান। উদয়কে ডাক দেন। তখনি স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক সেলের কাছে আসে। নিউজের জন্য সকলের একটা ছবি লাগবে। ওসি সাহেবের নিকট হতে সকল তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তার অনুমতি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু উদয়কে দেখে সবাই থমকে যায়। এই ছেলে এখানে কী করে? ও অনেক ভালো ছেলে। এলাকায় কারো সঙ্গে কোনো ঝামেলা নাই। নোংরা ছেলেদের সাথে তার উঠবস নাই। তাইলে সে এখানে কেন?
উদয় সাংবাদিকদের চেনে। তাদেরকে বারবার বলে সে নির্দোষ। সে গাঁজা খায়নি।
প্লিজ আপনারা আমাকে নিয়ে অন্ততপক্ষে নিউজ করবেন না। আমাকে মোটামুটি এলাকার মানুষ ভালো জানে। নিউজ দেখলে সবাই খারাপ ভাববে।
করুণস্বরে অনুরোধ করল উদয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! উদয়কে তারা বিশ্বাস করলেও বাকিদের জন্য হলেও ছবি তুলতে হলো এবং নিউজ হলো। সাংবাদিকরা চলে যেতেই একজন মাথা ফাটা লোককে নিয়ে থানায় এসে হাজির হলো একদল। বৃষ্টির পানি নিয়ে ঝগড়া। একজনের চালের পানি আরেকজনের বাড়ির উঠনে এসে জমাট বেঁধেছে। থানার মধ্যে উচ্চৈস্বরে কান্নাকাটি আহাজারি চলছে। একটা ছেলে ডিউটি অফিসারের রুমে গিয়ে অভিযোগ করতে চায় জানাল। ঠিক তখনি সেকেন্ড অফিসারও চলে এলনে সেখানে। ওসি সাহেবের রুমে ওসি সাহেব নেই। থানায় লোকে লোকারণ্য। কেউ কান্নাকাটি করছে কেউ এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। ওসি সাহেব তখন দোতলায় তদন্ত অফিসারের সাথে সিগারেট খাচ্ছেন। কষে একটা টান দিয়ে তদন্ত অফিসার কমল আহসানকে কিছু একটা বলতে যাবেন ঠিক তখনি তার জরুরি তলব ওয়্যারলেস ওয়াকিটকিতে। ওয়াকিটকির ভলিয়ম কমিয়ে দিয়ে কথাটা তদন্ত অফিসারকে বলেই ফেললনে, ‘কমল সাহেব, আসলে থানার সৌন্দর্য কোথায় জানেন?
কমল সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া উপরের দিকে উড়িয়ে দিয়ে মাথা নাড়লেন। ঠিক যেন প্রশ্নটা তিনি বোঝেননি। পরক্ষণেই তিনি বললনে,
‘আসলে আপনার কথাটা বুঝতে পারলাম না ঠিক!’
‘হাহা কমল সাহেব আসলে থানার সৌন্দর্যটাই হচ্ছে এটা।’
ওসি সাহেব নিচ তলায় মানুষদের আহাজারি দৌড়াদৌড়ি দেখালেন আঙুল দিয়ে। ডিউটিরত কনস্টেবলদের সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে যার জায়গায়। এএসআই দৌড়াদোড়ি করছে এ রুম থেকে ও রুমে। পাবলিকরা একে অন্যেকে ফোন করছে। কেউ কাঁদছে। কেউ ভিতরে ভিতরে খুশি হচ্ছে কারো গ্রেফতারে। আসলে এগুলোই হলো থানার সৌন্দর্য। রাত যত গভীর হয় থানার সৌন্দর্য তত বাড়ে।
রাত সাড়ে দশটা। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। চাঁদনি রাত। থানার সামনের খোলা মাঠটা জ্বলজ্বল করছে। অন্যান্য দিন ওসি সাহেব এরকম সময়ে স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে হাঁটেন। নতুন বিয়ে করেছেন। খুব আনন্দ পান ভদ্রলোক। আজ এখনো রাতের খাবারটা খাননি। বউ ফোন করে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে মাথা ফাটা লোকটার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কয়েকবার ফোন দিয়েছে ওসি সাহেব ধরতে পারেননি বা ধরা হয়ে উঠেনি।
উদয়ের মুখ থেকে রুবেল ভাই সব শুনে হতবাক। উদয় কাঁচা বাজারের মধ্যদিয়ে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় হসপিটাল রোডে আসে। সেখানে একটা দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিল। কারণ আকাশের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। একটু এগোতেই বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাতে আশেপাশে দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজতে থাকে সে। ঠিক তখনি মনে হলো মাদ্রাসার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানো যেতে পারে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখা গেল কয়েকটা ছেলে সেখানে গোল হয়ে বসে আছে। সেদিকে উদয় নজর দিল না। সে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে বারান্দার ওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। সিগারেট ঠিক ফুরিয়ে আসছিল কি না উদয়ের আর মনে নেই। শুধু এতটুকু মনে আছে পুলিশের বাঁশি শুনে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে দৌড়ে বসে থাকা ছেলেদের কাছে চলে আসে সে। ঠিক তখনি তিনজন কনস্টেবল ওদের চারজনকে ধরে ফেলে।
মাথা ফাটা ব্যক্তিকে নিয়ে হসপিটালে গেল এক পুলিশ। এদিকে সাদিয়া তার শাশুড়ির গলা ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। উদয়ের বাবা মেয়রের কাছে চলে গেছেন। রুবেল ভাই যখন ফোন করে মেয়রকে সব ঘটনা খুলে বলেন তখন মেয়র নিজেও অবাক হন। একটা নির্দোষ ছেলে কেন সাজা পাবে? তিনি ওসিকে ফোন করেন এবং সব ঘটনা খুলে বলেন। ওসি তখনো বলেন, ‘সে যদি সত্যিই নির্দোষ হয় আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেবে। এখানে আমাদের কিছু করার নাই। আমরা একদম স্পট থেকে তাকে গ্রেফতার করেছি। তাছাড়া বিষয়টা নিয়ে নিউজ হয়েছে। এখন চাইলেই তো সম্ভব না। আপনি নিজেও জানেন । এদিকে আমার এসআই মামলার এজাহার গঠন করছে।’
মেয়র সাহেব শুধু বললেন, ‘ওসি সাহেব। আমি নিউজের ব্যাপারটা দেখছি। আপনি জাস্ট এজাহারটা এখনও নিয়েন না। আমাকে আধাঘণ্টা সময় দেন।’
উদয় নির্দোষ। সে কখনো গাঁজা সেবন করতে পারে না। অনলাইন নিউজ পোর্টালে উদয়দের নিউজটা হওয়ার পর থেকে এলাকার ফেসবুক গ্রুপগুলোতে বেশ ঝড় উঠেছে। কারণ উদয়কে মোটামুটি সবাই চেনে, জানে। রাত সাড়ে বারোটায় নিউজটা ডিলিট করা হয়। তার কিছুক্ষণ পরেই উদয়কে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি তিনজনের নামে মাদক সেবনের এজাহার দায়ের করে থানা পুলিশ।
বিষয়টা তখনো উদয়ের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত গড়ায়নি। এলাকারও তেমন কেউ জানে না। তবে কিছু কিছু লোকজন জানে। উদয় থানা থেকে বাসায় এসে গোসল করে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে মা বাবা ও স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলে, ‘সত্য সব সময় সুন্দর। আমি নির্দোষ ছিলাম তাই দেখ ছাড়াও পেলাম। আমি ভিতরে ভিতরে জানতাম আমার কিছুই হবে না।’
পরের দিন সকাল সকাল উদয়কে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন উদয়ের মা। এলাকায় থাকলে নানান জনের নানান কথা হবে। উদয়ের শ্বশুর বাড়িতে আজ দাওয়াত আছে ওদের। দুপুরে যেত, সেই যাওয়াটা একটু আগেই না হয় গেল! বিষয়টা সাদিয়াও ভেবে দেখল। তারপর গোসল সেরে খেয়ে দেয়ে সাদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা দিচ্ছিল উদয়। হঠাৎ লক্ষ্য করল সাদিয়ার কানে ও গলায় গয়না নেই। প্রথমে ভাবল হয়তো পরতে ভুলে গেছে। তাই মনে করিয়ে দিল। মনে করিয়ে দেওয়ার পরেও যখন সাদিয়া কানে এবং গলায় গয়না পরলো না তখন উদয়ের কেমন যেন খটকা লাগল। নিশ্চয় কোনো কারণ আছে?
কারণ অবশ্যই আছে। উদয় সহজ সরল একটা ভালো ছেলে। সে গাঁজা খায়নি, সে নির্দোষ, সে কোনো অন্যায় করেনি, সত্য কখনো চাপা থাকে না, সে জানে সে অবশ্যই ছাড়া পাবে। কিন্তু সে শুধু জানে না গতকাল রাতে সে যখন থানার সেলে আটক ছিল, সাদিয়া, তার শাশুড়ি ও রুবেল ভাই তখন সাদিয়ার কানের দুল ও গলার চেইন নিয়ে একটা জুয়েলারিতে যায়।
ছোটগল্প : গয়না | গল্পকার : সাকি সোহাগ | আলোচক : শায়লা সুলতানা
‘গয়না’ গল্পে লেখক থানায় ঘটে চলা নিত্য পরিচিত ঘটনারই বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। থানার ছোটবাবু বলি আর বড়বাবু বলি, তাদের অনেকের কাছে দোষী-নির্দোষের তেমন প্রভেদ থাকে না। পার্থক্য হয়ত এইটুকু যে, দোষীর কাছ থেকে বেশি আর নির্দোষের কাছ থেকে কম নজরানা মেলে। অন্যায়ের প্রতিকার তাদের দিয়ে কতটুকু হয় তা প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু যত আইনের প্রবর্তন হয়, ততই তাদের প্রাপ্তির ঝুলি ভারি হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
উদয়ের মনে সাহস ছিল, সে কোনো অন্যায় করেনি। অতএব ছাড়া সে পাবেই। কিন্তু নিজের সততার কারণে সে ছাড়া পায়নি, বরং তার ছাড়া পাওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য কিছু, যা পাঠককে আহত করে।
‘গয়না’ গল্পটির শব্দচয়ন সহজ, গতিশীল। পাঠ করতে করতে মনে হচ্ছিল উদয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব ঘটনাকেই তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। এই যে বাস্তবতাকে গল্পের মধ্য দিয়ে এমন করে পাঠকের মস্তিষ্কে গেঁথে দেয়া, এখানেই গল্পটির সার্থকতা।
সৎ মানুষের বিড়ম্বনা আর নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় গল্পটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। শেষে চমকও আছে। পাঠক যখন প্রায় ভেবে নিচ্ছে, উদয় হয়তো সত্যি সত্যিই তার ভালোমানুষির জন্য ছাড়া পেয়েছে, তখনই অনেকটা আকস্মিকভাবে গয়না বিক্রির ঘটনাটি সামনে চলে এল। সমাজের এক অন্ধকার কুটিল ছবি পাঠক দেখতে পেল।