সম্প্রতি লালন সাঁইয়ের গানের দুটি ভাষায় অনুবাদের কথা জানা গেছে। হিন্দিতে এই অনুবাদ করেছেন মুচকুন্দ দুবে আর অহমিয়াতে করেছেন দেবযানী চলিহা। চলিহার অনুবাদগ্রন্থটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে আর দুবের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে দিল্লির সাহিত্য অকাদেমি থেকে। এখানে দেবযানী চলিহার বইটির গ্রন্থ আলোচনা প্রকাশিত হলো।
ফকির লালন সাঁই (১৯৭৪-১৮৯০)-এর মহান মরমি সৃষ্টি ক্রমেই বাংলার পরিসর ছাপিয়ে বিশ্বসভায় স্থান করে নিচ্ছে। ইউনেস্কো তালিকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষিক অনুবাদে লালনগীতির আজ স্বচ্ছন্দ ও সদর্প বিচরণ। ইতিমধ্যে ভারতীয় কূটনীতিক-শিক্ষাবিদ মুচকুন্দ দুবের হিন্দি অনুবাদ বিদ্বৎমহলে আদৃত হয়েছে।
অসমীয়া ভাষায় লালনগীতির রূপান্তর করেছেন মণিপুরি নৃত্যের কিংবদন্তি শিল্পী দেবযানী চলিহা। তাঁকে এই দুরূহ সাধনকর্মে প্রণোদিত করেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী। লালন সাঁইর গীত-এর ভূমিকাও লিখেছেন তিনি যা প্রাসঙ্গিক কারণেই উদ্ধৃতিযোগ্য :
অনুসন্ধিৎসু ও কৌতূহলী দেবযানী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লালনের গান পড়েছেন, আর বারবার শুনেছেন লালনের আখড়াই ঘরানার আদি সুরের গান। অনুবাদের জন্যে বেছে নিয়েছেন তাঁর পছন্দের নানা অনুষঙ্গের গান, যা লালন-পদাবলির প্রতিনিধিত্ব করে ভাব-ভাষা-ভাবনায়। এ-কথা বলতে পারি, তাঁর অনুবাদে মূলের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এক স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে লালনমগ্ন হয়ে এই অনুবাদের কাজ তিনি করেছেন। এই অনুবাদের মাধ্যমে লালনচর্চায় দেবযানী চলিহার নাম অক্ষয় হয়ে রইলো। অসমীয়-ভাষী সুধীজন বাংলার এক শ্রেষ্ঠ মরমি সাধকের সংগীত-বাণীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলেন অসময়ের এক কৃতী ভূমিপুত্রীর কল্যাণে। ‘আরশিনগরে’র ‘পড়শি’র দূরত্ব ঘুচিয়ে অবশেষে তিনি হয়ে উঠেছেন লালনপ্রেমীদের ‘মনের মানুষ’।
দেবযানী চলিহাও তাঁর ‘আমার কথা’য় ব্যক্ত করেন লালন অনুসন্ধিৎসার আদিঅন্ত। বিশ্বভারতীতে শিক্ষকতাকালে শান্তিনিকেতনে এক্সপ্রেস ট্রেনে যাওয়া-আসার কালে বাউলদের কণ্ঠে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ অথবা ‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষেরই সনে’ শুনে যে আগ্রহের বীজ উপ্ত হয় তা ক্রমে ফলবতী আকার ধারণ করে আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত লালনসমগ্র হাতে এলে। তার ওপর ড. চৌধুরীর সরাসরি প্রেরণা তো ছিলই। বিষয়টি তুলে ধরেছেন দেবযানী চলিহা :
২০১৬ সনের শেষের দিকে একদিন অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী আমাকে লালনের গানের অসমীয়া অনুবাদ করার জন্য বললেন। লালনের গান আমার ভালো লাগে খুবই কিন্তু অনুবাদ করার কথা কখনো ভাবিনি। অনুবাদ করতে পারব কিনা সে বিষয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, তবে আমি বলেছিলাম, চেষ্টা করব।
অনুবাদ করতে শুরু করে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম যে আমার ভুবন লালনময় হয়ে গেল। লালন ছাড়া কিছুতে আর মন দিতে পারছিলাম না। কি উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ এবং সহজ সরল দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখতে পান লালন – রামকৃষ্ণর কথা মনে করিয়ে দেয়। রাম-রহিম, টাকা-মাটি, মাটি-টাকা সবই সমান। নানক, কবীর, তুকারাম, তুলসীদাস সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে লালনের ভাবসাধনায়। লালনের সঙ্গে তিনি সাযুজ্য পান তাঁর জন্মভূমি আসামের শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের। কারণ তাঁরা উভয়েই তাঁদের সাধনা, তত্ত্ব, দর্শন প্রচারে সংগীতকে ভাব-অবলম্বন জ্ঞান করেছেন।
১৩০টি লালনগীতি বাংলা থেকে অসমীয়া ভাষায় রূপান্তর করেছেন দেবযানী যার মধ্যে বহুল প্রচারিত গান থেকে অপ্রচলিত গানও স্থান পেয়েছে। মূলত এই নির্বাচনে অনুবাদকের ভালো লাগাই প্রধান।
বইয়ের শুরুতেই শোভাবর্ধক হিসেবে যুক্ত হয়েছে নন্দলাল বসু অঙ্কিত লালন স্কেচ। পরিশিষ্টে আছে দেবযানী চলিহার হস্তাক্ষরে লালনগীতির অসমীয়া অনুবাদের প্রতিলিপি ।
বাংলা এবং অসমীয়া উভয় ভাষাই উচ্চারণ এবং দৃশ্যগত দিক থেকে কাছাকাছি প্রায় – ফলে এই দ্বিভাষিক বই কেবল লালন প্রচারে ভূমিকা পালনই করবে না বরং বাংলা ও অসমীয়া ভাষাবন্ধনেও ভূমিকা রাখবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা এখানে একটি বহুল প্রচলিত লালনগীতির বাংলা ও অসমীয়া রূপ পাশাপাশি উদ্ধৃত করে বিষয়টি পাঠককের গোচরে আনতে পারি :
বাংলায়-
আট কুঠুরি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা-কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়নামহল তায়
অসমীয়ায় –
আঠটা কোঠা নখন দৰজা অঁটা
মাঝে মাঝে জালবি কটা
তাৰ ওপৰত সদৰ কোঠা
আইনামহল পায়
বাঙালি ও অসমীয়া পাঠক-পাঠিকা তাদের নিজ এবং প্রতিবেশী ভাষায় প্রিয় সাধক কবি লালন ফকিরকে, তাঁর অসাধারণ গীতসুধাকে যেমন এই বইয়ের মাধ্যমে আস্বাদন করবেন তেমনি ভাষা ও ভূগোলের সীমাভেদী অভেদ মানুষের মঙ্গলসাধক মনীষারও সন্ধান পাবেন।
এই মহার্ঘ্য গ্রন্থের মধ্য দিয়ে দেবযানী চলিহা লালনচর্চা ও গবেষণার ধারায় নিজের নাম সোনার অক্ষরে স্বাক্ষর করলেন নিঃসন্দেহে।
লালন সাঁইর গীত ॥ অসমীয়া রূপান্তর দেবযানী চলিহা ॥ অক্টোবর ২০১৭॥ প্রকাশক : শোভা প্রকাশ, ঢাকা ॥ প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ ॥ পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২৮৮ ॥ মূল্য : পাঁচশত পঁচাত্তর টাকা।
পিয়াস মজিদ
কবি, প্রাবন্ধিক, কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
ঋণ : বাংলা একাডেমি ফোকলোর পত্রিকা, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৯