পড়তে সময় লাগবে ৪ মিনিট
সৈয়দ আহমাদ তারেক বলেন, কবিতার শ্রমিক হয়ে যাওয়ার চেয়ে কবিতা হয়ে যাওয়া যায় না? তখন সন্ধ্যাটা অবারিত আলো-উৎসব আর কোলাহল যেনো জীবন্ত কবিতা। কান্দিরপাড় মোহনীয় হয়ে ওঠে পূবালি চত্তরে, কুমিল্লায়। মাটি, ঘাস আর দিঘির স্নিগ্ধতায় অবকাশে কবি লেখেন, আগামীকাল বেদনা বিষাদ।
বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আজহার ফরহাদ, প্রকাশক খায়রুল আনাম রায়হান, শিশিরবিন্দু প্রকাশনী। প্রকাশকাল- আগস্ট ২০১৫, দাম- দুইশত টাকা। বইটি পাওয়া যাবে – হয়তো পাওয়া যাবে না কারণ সৈয়দ আহমাদ তারেক বেচবেন কি বেচবেন না সে সিন্ধান্ত নিজস্ব – যেখানে তিনি নিজের সম্পাদিত সাহিত্যপত্রের দাম লেখেন ‘এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট’ অথবা ‘চোখের ভেতর কাটাকম্পাস’ – তাঁর অন্য একটি কবিতার বইয়ে লিখে দেন ‘ভারতে বিক্রয় নিষিদ্ধ’।
কবিতায় সৈয়দ আহমাদ তারেক এমনভাবে ফুটে উঠেন যে তাঁর ভাষা, গতি ও ছন্দ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে নিজেকে আলাদা করেন ইতিহাসের কবিতা থেকে এবং স্বতন্ত্র মহিমায় তা জ্বলজ্বল করতে থাকে মানসপটে। তখন সৈয়দ আহমাদ তারেককে পাওয়া যায় ‘নতজানু হবো’ প্রতিশ্রুতির পঙক্তিমালায় ‘কাল সমকালের সীমানা পেরিয়ে’ ‘রঙ্গমঞ্চের সিক্ত কান্নায়’ ‘শাদা কাফনের’ প্রার্থিব কালিতে লিখে রাখতে – ‘এই পৃথিবীর কে কোথায় দাঁড়িয়ে ক্ষণিকালয়ে।’
ফলে সৈয়দ আহমাদ তারেককে বুঝতে হলে কবিতার পাঠক না হয়ে কবিতার মতো ভেসে যেতে পারতে হবে। সাধারণের কাছে তিনি প্রচারবিমুখ, গণতন্ত্রীরা ভাবেন প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আর কমরেডরা ভাবেন নষ্ট যৌবন। তখন সৈয়দ আহমাদ তারেক আরও উদ্যাম। তার কবিতায় তিনি অনায়াসে লিখে দেন, ‘মন খারাপের ছুটি’; লিখে দেন ‘…স্বপ্নের পথে শূন্যতা ঝুলে থাকে’।
কবিতার চিত্র-উপমায়, দৃশ্যে, অঙ্গসজ্জায়, ব্যবচ্ছেদে বইটি নগর ও জীবনের বিচ্ছেদ। কান্না আছে, প্রহেলিকা আছে, আছে কান্নার রং নীল, আছে প্রহেলিকার রং শাদা। তবু সদা অশ্রু ঝরান কবি। বার বার তার মগ্নচেতনা ধরা দেয় পঙক্তির পর পঙক্তিতে, প্রাজ্ঞ বোধে। কবি লেখেন, ‘ছলনা ছিলো না’, ‘রং তুলি আর্ট হোম’ আবার লেখেন – ‘যে কোন ইশরায়’, ‘দীর্ঘশ্বাসের সিঁড়ি পথে ঝাপসা চাঁদ ঝুলে থাকে’ কিংবা ‘তোমার জন্যেই একা হয়ে যাই’। ‘ছলনা ছিলো না’ কবিতায় কবি লেখেন, ‘আমি জানি আগুনের দার্শনিক ভাষা।’
সুতরাং চুপ থাকতে হয় কাব্যতৃষিতের। স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি কবিতার সুলতান। তবে তিনি এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন নিমেষেই যখন তিনি বিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করেন সুনীলের কবিতা : ‘শুধু কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি’। সত্তরের ত্রিদিব দস্তিদার, আবুল হাসান, সাবদার সিদ্দিকীর জিগরি দোস্ত, চট্টগ্রামের স্পার্ক জেনারেশনের অন্যতম লেখক, ঢাকার রেখায়নে উজ্বলতা ছড়ানো সৈয়দ আহমাদ তারেক কেনো নিভে গেলেন সে প্রশ্নটা অনেকের। তবে অনেকেই জানেন যে সৈয়দ আহমাদ তারেক নিভে যাননি। তিনি কবিতায় কেনো থিতু হলেন সেটিও প্রশ্ন অনেকের। এ ক্ষেত্রেও নিকটজনেরা জানেন, শব্দ-স্বজনেরা মানেন যে কবিতার চেয়ে শক্তিমত্তা সাহিত্যে আর কিছুতে নেই। তাই কবির কবিতায় অনায়াসে উঠে আসে চেনা প্রতিবেশ। আবার কাব্যের চেয়ে সত্য ও আনন্দও সাহিত্যে আর কিছু হয় না, হয় না মৌলিক। তাই তিনি বেছে নিতে ভুল করেননি। ডুবে থেকে সরোবরে, কমল তুলেন না, পদ্ম হয়ে ফুটে থাকেন।
সাহিত্যে এ ধরনের প্রতিভা বিরল, বিস্ময়ও। যেনো ‘মগ্ন দেবদূত’ হয়ে যান ‘সবুজ পাতায় বিমর্ষ দুপুর, উদাসী সন্ধ্যে’। লেখেন, ‘বিশ্বাস করেছিলে/ সীমাহীন সুদূরে চিত্রে/ ফুল, কাব্য আর ফসলের দূর্গে/ হেসে উঠবে মানুষ। কিন্তু ‘আজ সেই সব কান্না, সুরভিত স্তব্ধতা’, আর ‘আমাদের বেঁচে থাকা তাই রুগ্ন জাগরণ’। কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ব্যবহারে তিনি এতই অভিনব যে তার কাব্যসৌন্দর্যের কাছে থমকে যেতে হয় পাঠককে। একটি লাইন বারবার পড়তে হয়। প্রতিবারই ভিন্ন অর্থ দেয় পঙক্তিটি। ‘প্রতুষে দেবদারু’ কবিতায় ‘পাখির উরুতে রহস্যময়ী ফুলের বাঁশ ঝাড়’, ‘অন্ধ পৃথিবীর শীতকালীন সান্ধ্য অধিবেশন’, ‘আম্মা আমিও আসছি’ কবিতায় ‘সরাসরি সম্প্রচারিত আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু’।
এরকম অনন্য পঙক্তি পাওয়া যায় তার সকল কবিতায়। যাপনেও তিনি এমনি অভিনব, রহস্যজন। সদা পরিপাটি আপাদমস্তক ভদ্রলোকের আড়ালে তিনি ‘গৃহের সন্ন্যাস’। তাই চেনা যায়, চেনা যায় না চেনা দৃশ্যগুলো। অচেনা হয়ে ওঠে, বিশেষ হয়ে ওঠে দৃশ্যকল্প। অভিনব ঈঙ্গিতময়তায় তিনি লেখেন, ‘চুপিসারে যদি হয়ে যাও পাঁচ প্রদীপের শিখা…’, আবার ‘হাত ঘড়ি’ কবিতায় লেখেন, ‘কোথাও নেই চুম্বনের দাগ উপোসী ঠোঁটে’। ‘মাটি থেকে যায়’ কবিতায় তিনি লেখেন ‘এই পৃথিবীতে অন্যমনস্কতার দিগন্তরেখা নেই।’ ‘আমার হবে না কবিতায় তিনি লেখেন, ‘তোমার চিবুক থেকে মেঘমালা দূরে সরে যাচ্ছে’। স্মৃতির চুম্বন কবিতায় ‘চারদিকে সূর্যাস্তের রঙ খোঁজে বিশ্রাম’।
তার কবিতায় সংকেতের ব্যবহার নিপুন। সৈয়দ শামসুল হক যেমন বলতেন, সংকেত হলো জলপ্রবাহে বয়ে যাওয়া ধূলিকণার মতো, যা অণুপরমাণু আকারে পড়তে পড়তে পলি তৈরি হয়, পলি জমে জমে তৈরি হয় বদ্বীপ, তেমনি আমাদের মানস গঠনে চেতনে অবচেতনে কবিতার সংকেত পলির মতো কাজ করে এবং আমাদের প্রাজ্ঞ করে। সৈয়দ আহমাদ তারেকের কবিতাও বোধের জাগরণে তীক্ষ্ণ শানিত তরবারি হয়ে অপসারণ করে চিন্তার পঙ্কিলতা।
কবিতায় আধুনিক শব্দব্যবহারেও তিনি তারুণ্যের চেয়ে এগিয়ে। তার মৃণালিনী ছাত্রী নিবাস কবিতায় তিনি লেখেন, ‘এয়ারটেল নাম্বারে কাকে বলো:/ দেখা না হলে নাই, যেন অন্তত একটা এসএমএস পাই। প্রেমে তিনি অপরূপ, তার ‘সর্বনাশে, অভিলাষে’ কবিতায় পাওয়া যায় ‘ভেজা-লাবণ্য ঠোঁটে বলে, ভালো আছেন-/ লাভ লেনের বাসা চিনতে পারলেন তাহলে?’ আবার বিরহেও তিনি নীরব। ‘আজ আকাশ সারাদিন মেঘলা থাকবে’ কবিতায় লেখেন ‘চায়না গার্ডেনে মুখোমুখি কেউ নেই, সোহানা রাকা,/ দু’মগ কফি পান দীর্ঘ চুমুকে একা একা’।
কবিতায় তিনি ভিন্নলোকের সৃষ্টি করেন লৌকিক উপাদানে। তার কবিতায় পরিবার, আত্মীয়তা, রক্তমাংসের মানুষ অবিকল ফুটে উঠে বাস্তব হয়ে। তাই চেনা চিত্রিত অচেনা হলেও তাকে দুর্বোধ্য বা কোনো ইজমে ফেলা যায় না। কবিতা চিন্তাধারায় বৈশ্বিক, অগ্রসর মানুষ তিনি। ধারণ করেন সাহিত্যের অবারিত সৌন্দর্য ও জ্ঞান। যেথা পান চিত্রময়ী বর্ণনার ধ্বনি, তিনি কুড়িয়ে আনেন। আপন আবেশে মিশিয়ে নেন বিশ্বসাহিত্যের সমান্তরালে। তাই যারা ভালো লেখে, ছলনাহীন কবিতাজীবন যাপন করে, তাদের তিনি অন্তর্জন। হয়তো অন্তরে ধারণ করেন তাদেরও। তিনি তাই চিত্রকল্পে অচেনা উন্মেষের কাছাকাছি সহজ-সরল মাটির কবিতাও লেখেন, যা পাঠককে তো বটেই, অন্য কবিকেও করে তোলে আরো নান্দনিক।
‘আগামিকাল বেদনা বিষাদ’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রিয় বিকেলের ট্রেনে যেও’ কবিতাটি কবির নিজস্ব প্রিয় কবিতা। এ কবিতায় কবি সম্পর্কে যাবতীয় প্রশ্ন, কৌতুহলের মিথ ভেঙে তিনি রহস্যের উন্মোচন করেছেন। ভালোবাসাহীন ঢাকা শহরে কী করে একটি যুবক খ্যাতির বিড়ম্বনা কাঁধে নিয়ে প্রেমের খোঁজে ফিরে গেছেন কুমিল্লায় – সে ঘটনায় আভাস পাওয়া যায় এ কবিতাটিতে। পাওয়া যায় সে সময়ের উত্তাল বাস্তবতা, আর তার সাথে পাড়-মাতাল নাগরিক জীবনের চানখারপুল, আজিমপুর, হৃষিকেশ দাস রোড; পাওয়া যায় উন্মূল ছিন্নভিন্ন হাক্কার দোকান, শামসুর রাহমান, মাঁতিস, জহির রায়হান, ববিতা, শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন এবং আবুল হাসান।
কবিতায় জাদুবাস্তবতা কিংবা জীবনানন্দীয় পরাবাস্তবতা এবং অন্যসব বাস্তবতা অবাস্তবতা ভেঙে নতুন এক নান্দনিক কাব্যধারা বিনির্মাণে সৈয়দ আহমাদ তারেক একাকার হয়ে গেছেন কবিতার মধ্যে। তাই ‘চোখের জল অবিরল’, ‘সমূহ ক্ষতি’, ‘একা একা’, ‘মসৃণতা শীতলে’, ‘ভালোবাসা অমাবস্যা’, ‘পাপ ভুলে’ ইত্যাদি কবিতা পড়তে পাঠকের ভালই লাগবে। সব মিলিয়ে তার কবিতা সুখপাঠ্য, অন্তর্ভেদী, সুন্দর-অসুন্দরের বিভাবিত অভিজ্ঞান বিশেষ।
আরিফুল হাসান : কবি