সম্পাদকীয় নোট
কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়, সক্রেটিসের মৃত্যু দর্শনের ইতিহাসে আমাদের মানবীয় নৈতিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র বুদ্ধিজীবীদের কীভাবে বিবেচনা করবে? রাষ্ট্রের সীমা কতটুকু? বুদ্ধিজীবীরা যেসব বিকেকী প্রশ্ন উত্থাপন করেন, রাষ্ট্র কী সেসব বিষয়ে কৈফিয়ত দাবি করতে পারে? একবারে উপন্যাসের আদলে সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যু নিয়ে এই লেখা। সেই সঙ্গে লেখাটি চিন্তনের দিক থেকে অনেক গভীর। মানবীয় ভাবনাবিশ্বের দিক থেকে এটি তাই একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ লেখা। যারা সাহিত্যচর্চা করেন, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবেন লেখাটি তাদের নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে। একটু দীর্ঘ বলে (ছয় হাজার শব্দ) এটি তিন পর্বে প্রকাশিত হবে। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব।
পর্ব ২
সক্রেটিস তাঁর পিতার পৈত্রিক পেশা ভাস্কর্যশিল্প দিয়েই জীবন-জীবিকা শুরু করেন। কিন্তু জগৎ-জীবন ও জগৎ-জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তাঁকে এমন ভাবে ভাবিয়ে তুলে যে তিনি তাঁর পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবনঘনিষ্ঠ দর্শন ও দার্শনিক চিন্তায় আত্মনিয়োগ করেন। সক্রেটিসের পূর্বশিক্ষা, সমসাময়িক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল তাঁকে এক ভিন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। তিনি নিজ মন-মনন ও মেধা দিয়ে মানুষ ও মানুষের কল্যাণসাধনে ব্রতী হওয়ার দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেন এবং প্রচলিত সমাজের বিপরীতে এক ভিন্ন মানুষ ও ভিন্ন চিন্তার বাহক হিসেবে আবির্ভূত হন। সক্রেটিসের ভাষ্যকার জেলার তাঁকে চিত্রায়িত করেন এভাবে :
একদিকে স্বাবলম্বিতা, শুদ্ধতা, আত্মসংহতি, অন্যদিকে মানবিক করুণা ও সামাজিক আকর্ষণীয়তায় পরিপূর্ণ, সংস্কৃতিবান,তীক্ষ্ণধী, সদাপ্রসন্ন এবং অবিচলিত প্রশান্তির প্রতিমূর্তি সক্রেটিস সর্বস্তরের মানুষের অশেষ শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। এথেন্সের বাজারের ভিতর দিয়ে তিনি যখন হাঁটতেন, দুপাশের ভোগদ্রব্যে পূর্ণ দোকানগুলির দিকে চেয়ে বলতেন, ‘এসবের কোনো কিছুতেই আমার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই” (উদ্ধৃতি, হাসান আজিজুল হক, সক্রেটিস)।
ফলে এই জগৎ ও জীবনসংক্রান্ত প্রকৃতিবিজ্ঞনের আলোচনা তাঁর কাছে নিরর্থক মনে হলো; সত্য-শিব-সুন্দর – এই ত্রয়ী আদর্শের অনুসন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন; তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ালো প্রকৃতি নয়, মানুষ। ধর্ম-নৈতিকতা-জ্ঞান – এগুলো হয়ে দাঁড়ালো তাঁর গবেষণার বিষয়। তিনি নিজ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলেন, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের নিকট অন্য কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যপরায়ণতা, সুবিচার, আত্মসংযম, সদগুণ, সদাচার ইত্যাদি। সক্রেটিসের মনন-জগতের এই পরিবর্তন ঘটে তাঁর যৌবন বয়সে যখন তিনি প্রায় ৩৫ বছরের এক দীপ্তিমান যুবক – ঘটনাটি ঘটে পেলোপনেসিয় যুদ্ধের কিছু পূর্বে। ঠিক এই সময়ই তিনি লাভ করেন ডেলফির অ্যাপোলো-মন্দিরের দৈববাণী (প্রাচীন গ্রিসের এক বিখ্যাত ধর্মমন্দির। দৈববাণীর প্রত্যাশায় এখানে বহুলোকের আগমন ঘটে। পূর্বে এই মন্দির ছিল ধরিত্রী দেবী গেইয়ার। ফলে ডেলফিকে মনে করা হতো পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল। পাইমন নামক এক ড্রাগনকে ধরত্রীদেবী এই মন্দিরের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত করেন। কিন্তু দেবতা অ্যাপোলো পাইথনকে হত্যা করে গেইয়ারের মূর্তি সরিয়ে নিজ মূর্তি স্থাপন করেন। এরপর থেকে ডেলফি অ্যাপোলোর দৈববাণীর মন্দির হিসেবে পরিগণিত হয়। গ্রিক পুরাণের বহু কাহিনি এবং প্রাচীন গ্রিসের আর্থ-সামাজিক জীবনের সঙ্গেও ডেলফি সম্পর্কিত।)
একদিকে মনন-জগতের যুদ্ধ ও ডেলফির বাণী এবং পরবর্তীতে পেলোপোনেসিয় যুদ্ধোত্তর অবস্থা তাঁর জীবনকর্ম ও জীবনাদর্শ নির্ধারণ করে দেয় এবং তিনি তাঁর জীবন-পথ স্থির করে নেন। প্রকৃতিবিজ্ঞানের অসারতা উপলদ্ধি করে তিনি পথে-প্রান্তরে, বাজারে, জনাকীর্ণ সমাবেশে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি নৈতিক প্রশ্ন নিয়ে জনসাধারণ বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন এবং তিনি তাঁদের অভিমত জানতে চান। ফলে অচিরেই তিনি এথেন্সবাসীর নিকট একজন আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপকতা ও গভীরতা সম্পর্কে চারফেন নামে তাঁর এক বন্ধু একবার ডেলফির দৈবজ্ঞের নিকট প্রশ্ন করেন : ‘সক্রেটিসের চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি?’ উত্তরে দৈবজ্ঞ জানান : ‘না, তাঁর চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ নেই।’ দৈবজ্ঞের এই বাণী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তিনি রাজনীতিবিদ, কবি, শিল্পীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট আলাপ-আলোচনা থেকে বুঝতে পারেন, তাঁরা কেউই জ্ঞানী নয়, বরং তাঁরা জ্ঞানী হবার ভান করে। ফলে একদিকে যেমন তাঁর অনেক সুহৃদের সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তাঁর অনেক বিপজ্জনক শত্রুরও সৃষ্টি হয়। সক্রেটিসের ভাষায় :
এই অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ আমার অনেক নিকৃষ্ট এবং বিপজ্জনক শত্রুর সৃষ্টি হয়েছে এবং আমার বিরুদ্ধে অপবাদের সূত্রপাত ঘটেছে। আমাকে অপর সবাই জ্ঞানী বলে আখ্যাত করছে। কারণ আমার কথা যারা শুনেছে তারা মনে করে, অপর সকলের মধ্যে যে-জ্ঞান নেই আমার সে-জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু এথেন্সবাসীগণ! সত্য হচ্ছে শুধু এই যে একমাত্র বিধাতাই জ্ঞানী – অপর কেউ নয়। দৈবজ্ঞ আমাকে জ্ঞানী বলে অবশ্যই একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষের জ্ঞানের মূল্য সামান্যই। তিনি যখন আমার নাম উল্লেখ করেছেন তখন সে-নামকে শুধু একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সক্রেটিস সম্পর্কে বলতে চান নি। এ নামের উল্লেখ করে তিনি যেন বলতে চেয়েছেন : ‘হে মনুষ্যবৃন্দ, তোমরা স্মরণ রেখো, শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী একমাত্র সেই ব্যক্তি যে সক্রেটিসের ন্যায় জানে যে, তার জ্ঞানের মূল্য প্রকৃতপক্ষে কিছুই নয়।’ এই মনোভাব নিয়ে এবং আদেশ শিরোধার্য করে আমি ঘুরে বেড়াই এবং দেশী কিংবা বিদেশী, যাদের জ্ঞানী বলে বোধ হয় তাদের জ্ঞানের সন্ধানে রত হই। অনুসন্ধানে যদি দেখা যায়, এরূপ কেউ সত্য জ্ঞানী নয়, তা হলে আমি দৈবজ্ঞের বাণীর তাৎপর্য় অনুসারে তাদের বলি, ‘দেখুন, আপনারা সত্যিই জ্ঞানী নন।’ আমার এই কাজটি অবশ্যই আমাকে সর্বক্ষণ নিমগ্ন রাখে। অপর কোনো সর্বজনীন বা ব্যক্তিগত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় আমি পাইনে। ফলস্বরূপ দৈবজ্ঞের বাণীর প্রতি আমার নিষ্ঠা আমাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে (সরদার ফজলুল করিম অনূদিত, প্লেটোর সংলাপ [সক্রেটিসের বিচার এবং মৃত্যুর কাহিনী সংবলিত]।
ডেলফির বাণীলাভের পর সক্রেটিসের জীবনপদ্ধতি ও জীবনাচরণের বিঘ্ন ঘটে। ৪৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিদ্বন্দ্বী স্পার্টা এথেন্স আক্রমণ করলে পেলেপোনেসিয় যুদ্ধের সূচনা হয়। এথেন্স ছিল গণতন্ত্রকামী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র, অপরপক্ষে স্পার্টা ছিল রক্ষণশীল, অভিজাততান্ত্রিক, পশ্চাৎমুখী ও সমরবাদী রাষ্ট্র। ফলে পরস্পর বিপরীতমুখী এই দুটি রাষ্ট্রের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির মধ্যে বিদ্বেষমূলক কারণই এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ। এ সময় সক্রেটিসের বয়স ৪০ বছর, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এথেন্সের স্বর্ণযুগের সূচনাকারী শক্তিশালী শাসক পেরিক্লিস। তাঁর শাসনামলে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা-দীক্ষা-রাজনীতি-দর্শন-বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চরম উন্নতি ঘটে, আইনব্যবস্থার পূর্ণ বিকাশসাধন হয় এবং পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার দুই বছরের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ ৩০ বছরব্যাপী এই যুদ্ধে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্পার্টানরা এথেন্স অধিকার করে এবং ধনতান্ত্রিক শাসক তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় তারা বহু লোককে বিনা বিচারে আটক ও হত্যা করে। ঠিক যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সক্রেটিসকে নির্দেশ দেয়া হয় সালামিসের লিয়নকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেফতার ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য। কিন্তু তিনি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশ না মেনে সোজা বাড়ি চলে গেলে শাসকগোষ্ঠী তাঁর উপর ক্ষুদ্ধ হয়। পরাজিত এথেন্স তার পূর্ণ গৌরব ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নানা সমস্যা ও অস্থিরতা দেখা দিতে শুরু করে। হাহাকারপূর্ণ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয় এথেন্সে। সক্রেটিস এথেন্সের এই উত্থান-পতনের প্রত্যক্ষদর্শী। এথেন্সের এই উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সক্রেটিসের জীবনের অগ্রযাত্রা। পোলেপোনেসিয় যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের পর খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে শাসকগোষ্ঠী সক্রেটিসকে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে একটি প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে সক্রেটিসের যখন বিচার শুরু হয় ও বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে হেমলক বিষপানে হত্যা করা হয় তখন তাঁর বয়স প্রায় ৭০ বছর। ঐতিহাসিকদের নিকট প্রশ্ন – যে মানুষটির আর কয়েক বছর পর স্বাভাবিক মৃত্যু হতো তাঁকে এভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্য কী ছিল? এর উত্তরে ঐতিহাসিকগণ ঐক্যমত পোষণ করে বলেন :
সক্রেটিস আজীবন নিজের বিবেক নির্দেশিত কাজ করেছেন ও বিবেক নির্দেশিত পথে চলেছেন, কর্তৃপক্ষের অন্যায় নির্দেশ মান্য করার জন্য অন্যকে নিজ বিবেক বিরুদ্ধ পথে না চলতে অনুরোধ করেছেন, সত্য-শিব-সুন্দরের আদর্শে জীবনযাপন করার জন্য জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছেন, জেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং জ্ঞানবান ও প্রজ্ঞাবান মানুষকে রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচন করার অনুরোধ জানিয়েছেন, মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি জাগ্রত করার জন্য সদা সচেষ্ট থেকেছেন, দীর্ঘদিনের লালিত প্রথা ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সৃষ্ট অচলায়তন অবস্থা থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি যুবকদের প্রশ্ন করতেন,‘আমি যদি জুতা মেরামত করতে চাই, তাহলে আমি কাকে নিয়োগ করবো?’ স্বাভাবিকভাবে যুবকদের উত্তর ছিল, ‘ওহে সক্রেটিস, একজন মুচিকে’। এভাবে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতে করতে তিনি সবশেষে প্রশ্ন করতেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কার উপর ন্যস্ত হওয়া উচিৎ?’ ফলে ৩০ জন স্বৈরশাসকের মধ্যে ক্রিটিয়াস নামক তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র সক্রেটিসকে যুবকদের শিক্ষাদান করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে বলেন,‘আপনি আপনার মুচি, কাঠমিস্ত্রি এবং তাম্রকারদের শিক্ষাদান করলেই অপেক্ষাকৃত ভালো কাজ হতো। তাদের এই শিক্ষার ফল ইতোমধ্যে অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়েছে।’ ঐতিহাসিকদের অভিমত, উপর্যুক্ত বিষয়গুলো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকবর্গকে বিচলিত করে। ফলে শাসকবর্গের সঙ্গে সক্রেটিসের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তারা সক্রেটিসকে ‘ভিন্ন’ দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেন, সক্রেটিসের শিক্ষা ও জীবন পদ্ধতিকে শাসকবর্গ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। শুধু ৩০ জন স্বৈরশাসকের সময়ই নয়, সক্রেটিস ৪০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দশজন সেনাপতির বেআইনিভাবে শাস্তির বিরোধিতা করেন, অভিজাতদের নানা কাজের বিরোধিতা করেন। তাই ৩০ জন স্বৈরশাসকের সময় অনেক গণতন্ত্রী দেশত্যাগ করলেও সক্রেটিস দৃঢ়তা নিয়ে এথেন্সেই থেকে যান।
তবে এ কথা সত্য যে, ৩০ জন স্বৈরশাসকের শাসনকাল মাত্র দুই বছর স্থায়ী ছিল। এরপর গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। সক্রেটিসের জীবনের অন্তিম সময়ে এথেন্সের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, সমাজব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় দাসশ্রম। এছাড়া গণতন্ত্রীদের মধ্যে ক্ষমতার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তিস্বার্থ, দ্বন্দ্ব, ঘনঘন শাসক পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে এথেন্সে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর এই ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দুরবস্থায় শাসকদের রোষানলের শিকারে পতিত হন মহামতি সক্রেটিস।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৪০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই মর্মে একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয় যে, ৩০ জন স্বৈরশাসকের ক্ষমতা গ্রহণ বা তার পূর্বের কোনো কাজের জন্য সক্রেটিসের বিচার করা যাবে না। তবে শুধুমাত্র ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ৪ বছরের কার্যকলাপের জন্য সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা যাবে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সক্রেটিস পূর্বের মতো বর্তমান শাসনকালেও তাঁর শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছেন।
এথেন্সের আইন অনুসারে যেকোনো নাগরিক যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে ‘অপরাধমূলক’ অভিযোগ করতে পারত। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী সক্রেটিসের ক্ষেত্রে জনৈক কবি মেলিটাস সাক্ষীদের সামনে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনান। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সক্রেটিসকে একজন বৈধ বিচারক বা রাজা আরকনের নিকট হাজির হতে হয়। এথেন্সের আইন অনুসারে সক্রেটিসকে কেন্দ্রীয় এথেন্সের রয়্যাল স্টোয়া নামে স্তম্ভসারি বিশিষ্ট অট্টালিকায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের উত্তর দিতে বলা হয়। অভিযুক্ত সক্রেটিস এবং অভিযোগকারী মেলিটাসের বক্তব্য শুনে রাজা আরকন এই মর্মে আদেশ দেন, সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটি এথেন্সের আইন অনুসারে ‘শুনানির’ জন্য গ্রহণযোগ্য, এবং সে অনুসারে ‘প্রাথমিক শুনানির জন্য’ একটি তারিখ নির্ধারণ করে জনগণকে অভিহিত করার জন্য রয়্যাল স্টোয়াতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ্যে টানিয়ে দেয়া হয়।
মেলিটাসের অভিযোগ পাঠের মধ্য দিয়ে রয়্যাল স্টোয়াতে বিচারকের সম্মুখে ‘প্রাথমিক শুনানি’ শুরু হয়। সক্রেটিস তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের উত্তর দেন। এরপর বিচারক পরস্পরকে প্রশ্ন করার অনুমতি প্রদান করেন। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠন করেন (ঐতিহাসিকদের মতে, দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত এই লিখিত অভিযোগপত্রটির অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও এরপর এটি আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।)
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র এবং হলফনামায় স্বাক্ষর করেন অভিযোগকারী মেলিটাস, মেলিটাসের পুত্র পিথোস এবং অ্যালোপেকির সোফ্রনিসকাস। অভিযোগকারী তার আবেদনে শাস্তিস্বরূপ সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড কামনা করেন।
(তৃতীয় ও শেষ পর্ব আগামী সংখ্যায়)
প্রদীপ রায়
প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক। বার্ট্রান্ড রাসেলের History of Western Philosphy-সহ দর্শনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের অনুবাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
পড়ুন পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ১) নিচের লিংকে ক্লিক করে
সক্রেটিস যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে (১)