তীরন্দাজ Blog কবিতা প্রায় শূন্য | জাহিদ সোহাগ | দীর্ঘকবিতা ও কবিতার কথা
কবিতা গদ্য

প্রায় শূন্য | জাহিদ সোহাগ | দীর্ঘকবিতা ও কবিতার কথা

কবি বলছেন তাঁর লিখনরীতি নিয়ে। কিন্তু সত্যিই কি বলছেন? তীরন্দাজ-এর প্রধান সম্পাদক লেখাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে এ নিয়ে দ্বিধান্বিত। এই লেখা তাঁর কাছে গদ্য বলে মনে হয়নি। কবিতাও কি? না কি এ দুয়ের ভেদরেখা মুছে দিলেন জাহিদ সোহাগ না-গদ্য, না-কাব্য। এ হয়তো, অন্য এক জ্যঁর (genre)। পাঠক পড়ে নিজেই বুঝে নিন।

আমার এমন হয়, না লিখেও কবিতা লেখার আনন্দ পাই, যখন ওই ওই মুহূর্ত আমার ভেতরে ক্রিয়া করতে শুরু করে; তখন প্রায় স্থানু হয়ে যাই; কাগজ-কলম, পিসি-ল্যাপটপ বহু আগেই আমার হাত থেকে খসে গেছে, খসে গেছে হঠাৎ বাস থেকে নেমে সিগারেটের প্যাকেটের রাংতায় চট করে লিখে ফেলার বাসনা; আমার স্বপ্নের ভেতর টেবিল উড়তো, লেখার টেবিল, নিজের কামরা, মুদ্রিত সমুদ্র, প্রেসমেশিন;
এখন দেখি স্বচ্ছ কাচের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা অনিচ্ছা ক্রমাগত শ্যাওলায় ছেয়ে ফেলেছে সবটুকু স্বচ্ছতা; বেঁচে থাকি, আলোড়ন আসে, কোনো এক নক্ষত্রের মতো চিরকাল তা আমার পৃথিবীর রোদে এসে নামে না; কেবল মগজের ভেতর বসে থাকি; আমার যেমন হয়, সেই বিন্দুটি যখন এসে চিহ্ন তৈরি করে আর খুলে যায় রাশি রাশি বিন্দু আগমনের দরজা; প্রায় প্রতিজ্ঞাই ছিল, লিখবো না, আর মূর্ত করবো না ওই আলোড়ন; প্রথম যৌবনে যেমন ছিল কবিতা ছাড়া অন্য কিছু না লেখার ধনুকভাঙা-পণ; সেই পণই এখন নিচ্ছে প্রতিশোধ;
আমার প্রেম পর্যদস্তু হয়ে গেছে, ভবিষ্যত হয়নি বহুকাল জানা, একটি লাটিমের মতো কেবল ঘুরে ঘুরে নিজেরই চারপাশে এই আমি, যে আয়নায়ও ঠিক প্রতিবিম্ব ফেলে না, তাকে নিয়ে বেঁচে আছি, কেবল বেঁচে আছি; তবুও কি উদ্ধার নেই? আমি কান পেতে থাকি, আমি শুনতে পাই স্থির পানি ভেঙেচুরে অনেক হল্লা বিলিয়ে আসছে, আমার দিকেই আসছে নূহের নৌকার মতো, এই লৌকিক আমি লাফিয়ে তাতে উঠতে না পারলে তারও বিরাম নেই কোনো সুস্থিরতার; কখনও মনে হয় সেও এক নারী, অনেক নীলিমার ধূলি ভেঙে এসেছে, আরও অনেকটা পথ কেবল পথসঙ্গীর মতো তার সঙ্গে আমার হেঁটে হেঁটে বয়ে যাবে বেলা, যেখানে তুমি আছো আমার নিদ্রার অন্ধকার; নির্বাসনার ময়ূর;
কবিতা, তোমার লিখনভঙ্গিমা নিয়ে সেখানে পৌঁছাবে কী করে? বলো?

কোথাও ফলেছে গাঢ় রাত, বা এক থোকা আঙুর, লালাভ; যেন অনেক হারানো মার্বেল খুঁজে খুঁজে পেয়েছে তাকে; মৌচাক যেভাবে ঝোলে, অন্তর্গত ডালে তারও;

তোমাকেও বলি পাতা ঝরার আগে; দেখবে মেডিকেল-ব্লেড চকচকে, শিশুর জিভের মতো বেপরোয়া; ওই বৃত্তভবনে হঠাৎই ঝাঁ-আলো ফেলে চিত করে তছনছ প্রতিভা;

কী হয় তাতে, যদি ছেঁটে দিই, এভাবে, হ্যাঁ-সূচক; আর হাত-পা পুড়িয়ে তাপাই নিরীহ কড়াই;

আমি তোমাকে দুঃখ বলি না; তুমি স্পষ্টতই, দ্রাক্ষা; অনেক অশ্রুর কাচ জমিয়ে জমিয়ে জন্ম দিয়েছ নিজেকে;

আমার আঙুলই বরং সাপ, দুই হাতের, দশটি; ছোবল বা বিষগ্রন্থি কিছু আছে বা নেই; হয়তো নিরীহ, ছাড়া পেলে নিরেট ঘুমিয়ে পড়বে, কুণ্ডলী পাকিয়ে, কালো প্যান্টের পকেটে;

কখনো বলি, এই বাড়িয়েছি হাত; টলোমলো সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে; আকাশে কামান দেগে ছিটকে পড়ে বিদ্যুৎ, আর বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি সন্ধ্যায়; আমাকে কে ছোঁবে, কে নেবে বুকের ওপর এই বিরামহীন আঙুলগুচ্ছ;

কোথাও রূঢ় নখ, দুজনের অজস্র আঙুলে;

এসো পরিত্যক্ত, এসো একা, রাত্রি খামছে এই ভোর, এই আসন্ন ভোর; জেগে উঠি;

এখনও বন দুপাটি লাইনের ওপরে ঝনঝন; ট্রেন যাবে, পাখিদের চুরমার ঘুমের ধুলো উড়িয়ে;

আমারও তীব্র শরীর, ঘুম; অস্থি কামড়ে আছে ঘুম ঘুম ঘুম; হয়তো তোমারও;

অনেক বসন্ত ও কুহু কুহু ভরা ডালপালা সরিয়ে সরিয়ে এসেছি, দুজন, নদীর রেখায়; তুমি রয়ে যাও সংগীতে, আমি ছিটকে চলি অন্যমনস্ক, ইঞ্জিনে;

আমার ভেতরে কাক, দাঁড়কাক, ওড়ে, দুইটি তিনটি, বা একটি;

আমিও মানুষ চিনতে পারিনি, বা খুব চেনার পর কেবল দেখি, কাক, দাঁড়কাক, একটি দুটি, হাওয়া লাগায় পালে;

কাক, তুমি ঠুকে দাও কাকের গ্রীবা; তার রক্তদানায় বুনে দাও কী; আর নীলজ্বালা রোদে খোঁজো নিরাময়;

এই পেয়েছি যাকে, না-চাওয়ার চেয়েও তীব্র সে, এক তরণীতমসা ডুবে থাকে চোখের তারায়;

এসো কাক, আরও দাঁড়কাক, আরও নখর ইচ্ছার মতো; এসো কাক, আরও কাক, আরও দাঁড়কাক;

ভাবি, প্রতিশোধ নেব; এই তো জ্বালিয়ে রাখছি অঙ্গার; তুমি হও আরও ভ্রষ্ট, আঘাতে আরও দ্বিধাহীন;

আমি তো এক থাবায় ছিঁড়ে নিতেই পারি তোমার চামড়া, মেদ ও মাংস; কিন্তু কী হবে এ দিয়ে, বা কঙ্কাল নিজেই যদি হেঁটে এসে চুরমার হয় জুতার তলায়;
তবুও ক্ষমা নেই; ক্ষমা যেন চাবুকেরই স্তন্য পান করছে;

পালটা আঘাত করব, ভেবে, বাঁচতেই ঘৃণা লাগে; কিন্তু এত এত আগুন ও অঙ্গার দিয়ে কী করি, কী করি;

ছিলাম দ্বিধাগ্রস্ত; যুক্তি ও জনতার পায়ে, একা; তুমি অনুল্লেখ, জানা ঢেউ; তবুও বাড়িয়েছি, যেন সব সাঁকো নয় কেবল সংযোগের, অসমাপ্ত হাড়ের প্রান্তেও বসে থাকে নিছক শালিক;

যা ছিল ভুলের সামান্য নিচে, তাকে ফুটতে দেব, দাও, বারবার চাবুকের শূন্যে ওঠার সম্মতি;

রাতও, এত দগ্ধ; শুতে যাই, ঘুমের ওপর ভেসে ওঠে নিভন্ত তক্তা; আমি কোথায় যাই, কোথায় যাই;

ধান ছিটিয়ে উঠানে, আর স্তূপ স্তূপ খড়ে একা চাঁদ; তুমি কি তাকে চেনো, চেনো তাকে; তার চিৎকার শ্রুতির বাইরে ফেটে পড়ে;

তাকে শাস্তি দাও; প্রজ্ঞা ও প্রবঞ্চনার চাবুক একসাথে ওঠাও;

কেবল শূন্য, কেবল শূন্য, প্রায় শূন্য, প্রায় শূন্য; নিপাখি নিপাখি নিপাখি, জন্মের আগে আগে, বা জন্মাতে জন্মাতে খসে পড়ছে সব; ডালগুলো জ্বলছে বর্শার মতো;

যদি বলো, তার একেকটা ভেঙে ভেঙে ছুড়ে মারি; অন্ধ ও বাকরুদ্ধ;

ঘাস; যেন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সাপ; এমন নিবিড় দুপুরে একা; আমাকে কে খুঁজে পাবে; এসেই বলি তাদের কানে কানে, আর দোলায় যত অহেতু হাওয়া;

আমার করোটি ভরে যতই পান করি রোদ, তাম্রপাত্রেও রয়েছে ভিক্ষার গহ্বর, আমাকে কে ফেরাবে, কে ফেরাবে;

ফেরার পথও ছিঁড়ে যায়, নৌকাও;

এখনও কত রক্ত বাকি; পাবে, বড় হও, বড় হও ছুরি; কারও সাথে তুলনা ভালো নয়; এখন খেয়েদেয়ে বাঁচো, পেনসিল ধরা শেখো, নামতাও; ঠিক দীর্ঘ হবে, ঘাতকের মুঠো পেলে তুমিও, ঘসে ঘসে হবে, চকচকে চাঁদ;

এখন মায়ের নিভন্ত স্তনের কাছে স্তন্য চাও, বাবার বুকে মাঠ;

আমারও ছিল, অন্ধ অনুরাগ; প্রেমের ছুতোয় গনগনে লোহা নিয়েছি জিহ্বায়;

১০

ওই তো স্কুল, দরজার পেছনে দাঁড়ানো, অন্ধকার; ও ভয় দেখাবে না; থলি ছিঁড়ে ওরও বেরিয়ে পড়েছে হলুদ ঠোঁট ও প্রতিভা; সঙ্গে তো থাকেই কত কেউ, বন্ধু, আরও উঁকি দিলে পাবে দু-একটি গুলতি-খাওয়া বক, যারা মশলায় জ্বলবে;

তোমার স্তন স্তন্যদানের পর ব্লাকবোর্ডের সামনে; পেছনে হিজিবিজি; আমি এক শস্যদানা, ভরদুপুরে তোমার আঁচল খসে যাবে, গুপ্ত সিন্দুকের মতো নাভি, আমি চুপটি করে বসে থাকব; আমার আঙ্গার আগুন ছাড়াই লাল;

১১

চিহ্ন, কোথায় তুলে রাখি; সন্ধ্যায়, এক উন্মাদ নাচতে উঠেছিল মাথায়; চারদিকে তারই স্বজন এখন তুলেছে ধুয়া; আমি তাকে নৌকার মতো বেঁধে রাখি;

হতো যদি বাজিকর, আমার হাড় দিয়ে দেখাত বাজি, আর ঝুলত চামড়ার রশিতে, হাওয়ায়; দিতাম, দিতাম তাকে;

নিজেরই পূতিগন্ধে রাঙাবে সে, রাঙাবেই, অন্যের দুনিয়া; আমি তাকে নাচতে দিই আমারই রক্তদানায়;

১২

বাসো, তুমি না-বাসো তোমাকে; আমি এখনও উট, মাঝপথে আসন্ন সন্ধ্যা; মুছে যায়, মুছে যায় রেখা; দূরে যদিও জ্বলে, জ্বলতে পারে লণ্ঠন; আপাতত আমি নির্বাসনায় দাঁড়িয়েছি, নিজের পায়ে; উপরে তারাগাছ ফলভারে নত;

শিশুর ঘুম, আমারও ঘুমে এসে লাগে; আমাদের পৃথক শয্যা জুড়ে দেবে তারা, অর্ধবৃত্ত, প্রায় রংধনু যেন;

ধুলোবালি ঝেরে, নিজেরই তলোয়ার বাঁকা গ্রীবায় কেন রক্তাক্ত হই, সারারাত্রি ধরে;

১৩

দুপুরবেলা, নিজের ছুটিতে বসে আছি; সোম বা মঙ্গল; প্রায় প্রতিদিনই; আর এই দুপুর কর্মহীনের চেয়েও অনুদ্যোগী; দু-একটা পাখি হঠাৎ শিকার ধরতে বেরোয়, হঠকারী যেন, বা বলতে আলোড়ন আছে এখনও শূন্যে;

সংগম শেষে ঘুমানো যায়, বা ঠান্ডা বিয়ার; বা যুগপৎ; হয়ত দুপুরের গর্তে কারফিউ উঁকি দিয়ে আছে; হয়ত তুমিও ঊরুভর্তি ঘামে ডুবে আছো;

জাহিদ সোহাগ

কবি, গল্পকার ও নাট্যকার। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১১।

Exit mobile version