তীরন্দাজ Blog বইপত্র বই ‘চেষ্টা কর ঐ শীর্ণ তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে’ | অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায় |বইপত্র
বই বইপত্র

‘চেষ্টা কর ঐ শীর্ণ তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে’ | অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায় |বইপত্র

ফ্রাঁসিস পজ, আঁরি মিশো, বোর্হেস ও জীবনানন্দ দাশের জন্মকাল। ‘আমি কালপুরুষের দিকে তাকিয়ে বলে উঠি, কী করে হা ঈশ্বর কী করে এমন হয় যে সাহিত্যকে দেখার দৃষ্টি বদলে দেওয়া এই চারজন পৃথিবীতে এসেছিলেন একই সূর্য পরিক্রমার সময়?’ যেমনভাবে বৃষ্টি এসেছে আমার বেড়ে ওঠায়, যেমনভাবে বিকেলমাঠে রং ধরেছে আমার বেড়ে ওঠায়, তেমনভাবে তিনি একে একে চিনিয়ে গেছেন ক্রিস্টোফার মার্লো, লা রোশফুকো, জাক প্রেভের, জ্যোতিভূষণ চাকী, বা আঁদ্রে জিদকে।

আষাঢ়ের ঘাট, রাধাকৃষ্ণ জিউয়ের একটেরে মন্দির, ধূপ-কর্পূরের গন্ধে মাতাল বাতাস আর বাদামি জলে ঝিকোনো রোদ থেকে ল্য আভর কতদূর? জানা নেই। ফোঁগজমারের সেই দুধসাদা বাগানবাড়ি থেকে কত দূরে আমার বাঁকাচোরা শ্যাওলা ধরা পাঁচিলের অলিগলি আর বালিকাবেলার কৃষ্ণচূড়া গাছ? দূরত্বের হিসেব জানা নেই। দূরত্ব কমে এসেছিল। সাপ্তাহিক কিছু হিসেব বেড়ে গিয়েছিল। রবিবাসরীয় বেলায় তড়িৎপায়ে প্যাডেলে চাপ, আমাকে ছুটিয়ে মারত একটি কাগজ। পাতলা সাদা কাগজের গায়ে কালচে ছোপ, যেন সাদা কাগজের গায়ে কিছুটা অন্ধকার মেশানো, যেন সন্তর্পণে মেশানো হয়েছে কিছুটা ফেলে আসা সময়, বিনামূল্যে পাওয়া সেই পত্রিকা আনতে আমার ছুটে যাওয়া ছিল একটি কলামের আশায়। কলামের ভিতরে ছিল এক মহাপৃথিবীর সন্ধান। সাদা কালো একেকটি ছবি। মাঝেমধ্যে না বোঝা ভাষার খসড়া। অনুবাদে চিনে নেওয়া সুদূরের আহ্বান যা আমার দেখা পৃথিবীর থেকে বহুদুরে অবস্থানকারী অসীম যন্ত্রণার দুনিয়া। নিস্তব্ধ মফস্বলের ভিতরে আমাকে এনে দিত মহাপ্রাণের সন্ধান।

কাঁচা বয়সের মায়া আমাকে প্রথম ভাবতে শেখালো ধর্ম কী। প্রথম ভাবতে শেখালো প্রেম কী। কী এক অতীন্দ্রিয় জগৎ কুয়াশাচ্ছন্ন আমায় আড়ালে লিখিয়ে নিয়েছিল, ‘ধর্ম হল যা ধারণ করে। তুমি আমার ধর্ম হয়ে ওঠো’। তারও কিছু বছর পরে জেরোম ও আলিসার সাথে পরিচয়।

‘ঘুমের মধ্যে এমন হয়’। তিনি লিখেছেন, বিশ্বাসে আমিও ঘুরেছি অদেখা ‘পের লাশেজ’ সমাধিক্ষেত্রে। রাতপাখির ডানায় ভর করে পৌঁছনো গেছে মপারনাস সমাধিক্ষেত্রের খোলা ফটকে, আবার কখনও মানিকতলার অখ্যাত কবরে খুঁজেছি তরু দত্তকে। তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন ১৮৯৯ সময়কাল। ফ্রাঁসিস পজ, আঁরি মিশো, বোর্হেস ও জীবনানন্দ দাশের জন্মকাল। ‘আমি কালপুরুষের দিকে তাকিয়ে বলে উঠি, কী করে হা ঈশ্বর কী করে এমন হয় যে সাহিত্যকে দেখার দৃষ্টি বদলে দেওয়া এই চারজন পৃথিবীতে এসেছিলেন একই সূর্য পরিক্রমার সময়?’ যেমনভাবে বৃষ্টি এসেছে আমার বেড়ে ওঠায়, যেমনভাবে বিকেলমাঠে রং ধরেছে আমার বেড়ে ওঠায়, তেমনভাবে তিনি একে একে চিনিয়ে গেছেন ক্রিস্টোফার মার্লো, লা রোশফুকো, জাক প্রেভের, জ্যোতিভূষণ চাকী, বা আঁদ্রে জিদকে।
বালিকাকে সহজভাবে নক্ষত্রপথ চেনানো সেই প্রাজ্ঞ পথপ্রদর্শকের নাম চিন্ময় গুহ। ভয়মিশ্রিত সমীহ থাকলে যেহেতু ‘সুন্দর করে লেখার ইচ্ছে তার সমস্ত গুণকে নষ্ট করে দেয়’, অতএব এহেন পর্বতের সম্মুখে নীরবে নত হওয়া ছাড়া আর কীই বা করার থাকে।

যেদিন আঁদ্রে জিদের ‘Strait Is The Gate’ উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ ‘শীর্ণ তোরণ’ পেয়েছিলাম, জেরোম ও আলিসা আমাকে নিয়ে ফেলল এক অদ্ভুত আঁধারে। এই আঁধার শান্তি নামিয়েছে, পরমুহূর্তেই ‘এক আকস্মিক নির্মোহ আলোকসম্পাতের মতো’ কাঁপিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য ভাষার অনুবাদ জেরোম ও আলিসার সাথে আমাকে এমন একাত্ম করে তুলতে পারতো কিনা জানা নেই, বাংলা অনুবাদটি আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চলল সেই কিশোরীবেলার অনন্ত জিজ্ঞাসার ভিতরে। অনুবাদক শ্রী চিন্ময় গুহ এক আশ্চর্য বুননে গড়ে তুললেন মায়াময় পরিবেশ যা আষাঢ়ের গঙ্গাপাড় ও ল্য আভরের শীতকে একটি সুতোয় বেঁধে ফেলেছে অনায়াসে। বুকোল্যাদের বাগানবাড়িটা নিমেষে হয়ে ওঠে কাগজি ফুলের বাগান। আবার অতল খাদের ধার। অনুবাদক শ্রী গুহ একটি সুতোয় বেঁধে ফেলতে পেরেছেন পৃথিবীর প্রতিটি চতুর্দশবর্ষীয় মননকে। জেরোম ও আলিসার প্রতিটি সম্বোধনে, তাদের অস্থিরতায়, তাদের সংযমে ও আর্তিতে দুটো দুনিয়া একাকার হয়েছে, প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

সংলাপে, চিঠিতে জেরোম ও আলিসার প্রতিটি আকুতি ও সংশয় সাধারণ বাঙালি মননের বুঝে ওঠার উপযোগী করে তোলার নিহিত সফল চেষ্টা এই অনুবাদে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। সম্পর্কের বুনটে ভিন্ন সংস্কৃতির ছাপ সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে অনুবাদের গুণে।

নৈকট্যর সাথে পবিত্রতার সম্পর্ক কী? অথবা বলা ভাল নৈকট্যের সাথে পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হবার সম্পর্ক কী? জেরোম ও আলিসার মাঝে বারবার ফিরে এসেছে যে আধ্যাত্মিক চিন্তন, তা কীভাবে শুদ্ধ করে তাদের যাবতীয় নৈকট্য ও দূরত্বকে? সবশেষে দূরত্ব কি পারে সকল ঐহিক যোগের সীমানা ছাড়িয়ে অপার্থিব বন্ধন সৃষ্টি করতে? আশ্চর্য হয়েছিলাম, আলিসার লেখায় কী সরলভাবে গভীর দেখা বেজে উঠেছে নতুনভাবে! ‘শীর্ণ তোরণ’ বইটির কাছে শুধু প্রশ্ন করতেই ফিরে যেতে হয় বারবার।

‘এত অস্থিরতার মধ্যে, এত অস্বস্তির মধ্যে যে মুহূর্তে তুমি আমার কাছে এগিয়ে এলে – যে কী গভীরভাবে আমি তোমাকে ভালবাসি; কিন্তু নিরাশভাবে, কারণ আমায় স্বীকার করতেই হবে যে দূর থেকে তোমায় আমি আরো ভালবেসেছি’ – আলিসার জেরোমকে লেখা এই চিঠিই আমায় ভাবিয়েছিল শরীরের বাঁধন পেরিয়ে গিয়ে কী সেই বায়বীয় মর্মে ছুঁয়ে থাকা যা মানুষের আবহমানকালীন বাসনা হয়ে ওঠে।

বিচ্ছেদ আসলে কিছুই নয়, ‘শুধু স্বাভাবিকতায় ফিরে আসা’। অভিমান কী সাবলীলভাবে বেজে ওঠে আমারই বাংলা ভাষায়। অথচ শুধু অভিমান বলে দাগিয়ে দেওয়ার কোনও উপায় রাখেননি লেখক ও অনুবাদক। জেরোমের স্বগতোক্তি হয়ে উঠছে নিজেকে খোঁজার উর্বর পথ। যে আত্মাকে আমাদের সমস্ত প্রিয় জিনিসগুলি দিয়ে ঊর্ধ্বে তুলে থাকি, আদর্শ বানিয়ে থাকি, বিচ্ছেদ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে নিজেদের অজান্তেই যেন পেরিয়ে যাই চৌকাঠ। ছুটে যাই কাল্পনিক পুণ্যের দিকে। শ্রমের ক্লান্তি মেলে। ধারণায় ডুবে থাকা মানুষ আত্মিক একাত্মতা খুঁজতে গিয়ে কি বারবার ভালবাসে নিজস্ব ধারণাকেই?

যে ধারণার সাথে আলিসার বাঁধন ছিন্ন হয় কীভাবে সেই ধারণার কাছেই জেরোমের বারংবার ফিরে আসা, সেই ভাবনার জন্যে ফের সেই বয়সকে ছুঁতে ইচ্ছে হয়। আলিসার সমুদ্রপ্রতিম ভালবাসা ও ভয়ের কাছে ধীরে ধীরে ছোটো হয়ে আসে মৃত্যু, পাঠক তা টের পান আকস্মিক আঘাতের নির্লিপ্ততায়। অনুবাদক মাধ্যম হয়ে ওঠেন মোমের আলোময় এক গভীর থেকে গভীরতর যাত্রার। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে অনুবাদক শ্রী গুহ ছাড়া সত্যিই তৈরি হতে পারতো ‘অলঙ্ঘনীয় সব পাঁচিল’। ‘আলোর পথযাত্রীদের সমস্ত অভিজ্ঞান মিথ্যে হয়ে যাবে’ এই অনুবাদক ছাড়া।

আগেই বলেছি অনুবাদের সহজতায় কী এক অপ্রকাশ্য জাদুতে আঁদ্রে জিদের ‘Strait Is The Gate’ উপন্যাসটি আমার কাছে তার সংস্কৃতির ভিন্নতার আড়াল রাখেনি। সেই অপ্রকাশ্য জাদুর কিছুটা উত্তর পেয়েছি চিন্ময় গুহর অনুবাদক সম্পর্কিত আরেকটি প্রবন্ধে। তিনি লিখছেন, ‘এ ছাড়া তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মহাকাল। অনুবাদক জানেন না, কিন্তু মহাকাল জানে অনুবাদক নিজে অজান্তে সমকালের দাস, কারণ সমকালের দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুদ্রাদোষ অনুবাদকের শিরা উপশিরায় রক্ত চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে আঠেরো শতকের শেক্সপিয়র অনুবাদক জাঁ ফ্রাসোয়া দ্যুসি শেক্সপিয়রকে বানিয়ে তোলেন ফুরফুরে ছন্দোবদ্ধ জোড়া-পঙক্তির নিওক্লাসিকাল কবি। একইভাবে উনিশ শতকের রোমান্টিক ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার আলেকসাঁদর দ্যুমা-র হাতে শেক্সপিয়র হয়ে ওঠেন বিস্ময়চিহ্নদীর্ণ এক রোমান্টিক। আবার বিশ শতকের অনুবাদক-কবি ইভ বনফোয়া-র পুনর্নির্মাণে তিনি হয়ে ওঠেন আলব্যের কাম্যু-র উপন্যাসের নায়কের মতো নিরাসক্ত।
কাজেই ভিন্ন এক সমাজ-সংস্কৃতিতে এক সমান্তরাল শব্দজালের ইশারা তৈরি করতে গিয়ে অনুবাদককে এক সীমাহীন মানসিক চাপের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, তাঁর সুষুম্না বেয়ে নেমে আসে রক্তের লাল মুক্তো’।
ফলে শীর্ণ তোরণের ভিতরে প্রবেশের পথ হয় উন্মুক্ত।

এখানেই অনুবাদক শ্রী গুহ তুলে ধরলেন আঁদ্রে জিদের মৃত্যুর আগের শেষ উক্তি – ‘সংগ্রামটা সবসময়ই যুক্তির সঙ্গে যুক্তিহীনতার’। যুক্তি ও যুক্তিহীনতা, সংশয় ও নিশ্চয়তা, প্রেম ও বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও ঐহিকতা নিয়ে ‘Strait Is The Gate’-এর এই পুনর্নির্মাণ হয়তো সৃজনকর্মের চেয়েও বেশি রক্তপাত হেনেছে। অনুবাদক শ্রী গুহ আমাদের সম্মুখে সাজিয়ে দিলেন দুটি কিশোর মনন ও প্রশ্নের অসীম ক্ষমতা।
ভাবনার চোরাস্বস্তি জানায় বাঙালির একজন চিন্ময় গুহ আছেন। ভাবতে শেখানো, মস্তিষ্কের পৃথিবীর বাউন্ডারি যত্নে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং চিন্তনের গভীর সুড়ঙ্গে পথ দেখানো অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁকে এক কৃতজ্ঞচিত্তের প্রণাম।

শীর্ণ তোরণ | আঁন্দ্রে জিদ | অনুবাদ : চিন্ময় গুহ | সাহিত্য অকাদেমি ১৯৯৭

Exit mobile version