সৈয়দ মুজতবা আলীর যে-কোনো লেখাই দারুণ আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। এখানে প্রকাশিত চিঠি দুটিও সেরকমই। এই চিঠির ভেতর দিয়ে লেখক মুজতবা আলীকে আরও অন্তরঙ্গভাবে জানবার সুযোগ ঘটবে তাঁর অনুরাগী পাঠকদের। বলা দরকার দ্বিতীয় চিঠিটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। লক্ষ করবেন সেটাও। ১৪ সেপ্টেম্বর এই লেখকের জন্মদিন উপলক্ষে চিঠিগুলো প্রকাশিত হলো।
প্রথম চিঠি
১০৪ কনস্টিটুশন হৌস,
নিউ দিল্লী-১
২৫/৪/১৯৫২
প্রিয়বরেষু,
আপনি যে আমাকে স্মরণ করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন কিন্তু উত্তরে কি লিখব ঠিক করে উঠতে পারছি নে।
আপনি আশা করি লক্ষ্য করেছেন যে আমি কলকাতা ছেড়েছি অবধি কোনো বড় লেখা লিখিনি—একটি ছোট গল্পও লিখিনি। যা সব লিখি—‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘দেহলী-প্রান্তে’ ইত্যাদি, এগুলো চুটকি লেখা। আপিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিম্বা সাঁঝসকালে সময় চুরি করে এগুলো সাঙ্গ করি! কিন্তু মাসিক বসুমতির জন্য লিখতে হলে, এই ধরুন ‘নর্তকী’ শেষ করতে হলে, কিম্বা ছোটগল্প লিখতে হলে যে অবকাশের প্রয়োজন, তা তো আমার আদপেই নেই।
দিল্লীতে আমার মন টিকছে না, এবং একথাও অতি অবশ্য জানি যে এখানে থাকলে আমা-দ্বারা বড় কাজ কিছুই হবে না। ‘নর্তকী’ ছাড়াও তিনপুরুষের বর্ণনা দিয়ে একখানা বিরাট কলেবর দু’হাজার পাতার নভেল লেখার ইচ্ছা ছিল, আপনার কাছে কথা দিয়েছিলুম শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে প্রামাণিক বই লিখব (অচিন্ত্যবাবু লিখেছেন কিন্তু রামকৃষ্ণ তো অফুরন্ত – এসব স্বপ্নে পরিণত হবে। তাই দিল্লী থেকে পালিয়ে কলকাতা আসতে চাই এবং তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি কিন্তু কোনো দিক থেকে কোনো ভরসা পাচ্ছি নে।
তাই ‘দেহলী-প্রান্তে’ ‘ডিলি-ডেলি’ শত কাজ সত্ত্বেও লিখি এই ভরসায় যে যদি কলকাতায় কিছুই না পাই তবে ঐ দুটো লেখার উপর ভরসা করে চাকরী ছেড়ে কলকাতা চলে আসব। কিন্তু ও দুটো লেখার দর্শনীতে তো চলবে না – কি করি বলুন তো?
অবশ্য ‘বসুমতী’ এ-মাসিক সে-মাসিকে লিখতে পারি কিন্তু তাতে করে আর কটা টাকা হয়?
কলকাতা আসবার আরেকটা কারণ আছে। আমার গৃহিনী দিল্লীতে থাকতে চান না। তিনি সংস্কৃতে বি. এ.; শিক্ষাদান তাঁর ব্রত। তিনি বলেন, বাঙলা দেশ ছাড়া অন্য কোথাও তিনি করতে পারবেন না। আমারও বাসনা তিনি যেন তাঁর ব্রত উদযাপন করতে পারেন, এবং আমার সে ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। কলকায় আমাদের অন্ন-সংস্থান হলে তিনি অনেক কিছু করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমার দুঃখটা আপনি বুঝতে পারছেন কি? মা-সরস্বতীর সেবা করে এতদিনে বাঙলা ভাষার উপর অতিশয় নগণ্য একটুখানি অধিকার হয়েছে অথচ সে অধিকারটুকু কাজে লাগাবার সুযোগ পাচ্ছি নে। আপনি এবং আরো দু’একজন আমার লেখা পছন্দ করেন, আমাকে ভালো করে লিখতে বলেন সেও কি কম কথা?
উল্টে আমাকে বাকি জীবন এখানে ঘাঁটতে হবে ফাইল। তার জন্য তো আরো মেলা লোক রয়েছেন, এবং তারা ও কাজে আমার চেয়ে অনেক বেশী তালেবর।
তবে কেন তাদেরই একজন এ কর্ম করেন না? আর আমি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। পাঁচ নম্বর পার্ল রোডে আবার সেই কর্ম শুরু করি পূর্বে যা করেছিলুম। আমজদিয়ায় থানা খাব, হাতীবাগানে দাওয়াত মারব, ‘বসন্ত-রেস্টুরেন্ট‘ ডবল ডিমের মামলেট থেতে খেতে উজীর-নাজির কতল করব, রকে বসে বিড়ি টেনে, জমিয়ে গুষ্ঠিসুখ অনুভব করব।
আমার পক্ষে দিল্লীর দোস্ত অপেক্ষা কলকাতার দুষমন ভালো।
নমস্কারান্তে
মুজতবা আলী
দ্বিতীয় চিঠি
(১)
১১/১/৪৯
প্রীতিভাজনেষু,
আশা করি, গাঁধী-ঘাটের একটা ছবি রহমানের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়েছেন। যদি না করে থাকেন তবে লোক পাঠাবার সময় শ্রীযুক্ত রহমানকে ফোন করে বলতে পারেন (Writers Bldgsএ ফোন করে Chief Architect Mr. Rahman বললে ঠিক-ঠিক জুড়ে দেবে) যে, ডঃ আলীর সঙ্গে যে-কথা হয়েছিল সেই সম্পর্কে আপনি লোক পাঠাচ্ছেন। তাহলে লোকটিকে রাইটারস বিল্ডিঙে ঢোকার জন্য পাসের হাঙ্গামা অল্পই পোয়াতে হবে। লোকটি যদি ছবি বাবদে গুণী হন তবেই ভালো হয়। রহমানের কাছ থেকে পছন্দমাফিক ছবি বেছে নিয়ে আসতে পারবেন।
আমার মনে হয়, ঘাটের ছবিখানা কাগজের মধ্যিখানে ছাপালে ভালো হবে। প্রবন্ধটা আশে-পাশে। বিবেচনা করে দেখবেন।
পলডি অজরামর। তাকে যে কোনো দিন খাড়া করে দিতে পারবেন। যদি আপনার ভয়ঙ্কর ভালো লেগে গিয়ে থাকে, এবং রীতি যদি থাকে, তবে মাসিক সাপ্তাহিক উভয়েই ছাপতে পারেন – আপনার খুশী। আমি রান্না করেই খালাস। আপনি যদি দুই কিস্তিতে খেতে চান খাবেন। তবে কিনা একদম না খেলে একটু দুঃখ হবে বৈকি!
রায়োকোয়ানের শেষ প্রুফ আমাকে দেখানো যেতে পারে এই রকম ধারা একটা ভাসা-ভাসা প্রস্তাব হয়েছিল মনে পড়ছে।
যে-সংখ্যায় গাঁধী-ঘাট বেরুবে তার একখানা যদি রহমানকে পাঠান তবে তিনি নিশ্চয়ই খুশী হবেন। আমরাও ভবিষ্যতে তাঁর কাছ থেকে ইডা সিডা পেতে পারি। এ-সংখ্যার ‘শ্রীমতীতে’ তাঁর একটা বাড়ীর প্ল্যান বেরিয়েছে যদিও খুব ভালো হয়নি। রহমানের বাড়ীর ঠিকানা জেনে নিয়ে পাঠাব। আশা করি কুশলে আছেন।
মুজতবা আলী
২৩ তারিখের জন্য সুভাষ বাবু সম্বন্ধেই লিখিব।
[২]
১৯/১/৪৯
প্রীতিভাজনেষু,
বসুমতী নিরাময় হয়েছেন দেখে আনন্দিত হলুম। সোমবারে তিনি ‘গাঁধীঘাটে’ গঙ্গাস্নান করে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছেন।
পৌষের ফসল চাষারা ঘরে তুলে ফেলেছে – আমরা এখনো ‘বসুমতী’ মরাইয়ে তুলতে পারিনি—জমিদার তথা কর্তৃপক্ষের উষ্ণ হওয়ারই কথা। গর্দিশ, গর্দিশ, সবই গর্দিশ।
রহমানকে আমি একখণ্ড কাগজ সোমবার দিন ভোরবেলাই পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। নগদ চার পরসায় আমাদের পাড়ার কিয়োস্ক থেকে (সেখানে বসুমতী সাড়ম্বর বিক্রী হয় এবং রববারে যে মেশিন গোশা করে গুম হয়েছিলেন সে খবরটাও তাদের অজানা ছিল না) কিনে। নিজের বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে আপন পিঠ চাপড়াতে গিয়ে হাতটা ডিসলোকেট করে ফেলেছি।
‘নেতাজী’ লেখাটি আশা করি পছন্দ করবেন। আপনাকে পুনরায় করজোড়ে অনুরোধ কোনো লেখা পছন্দ না হলে “থাক্, এটা না হয় চলেই যাক” বলে চালিয়ে দেবেন না। তবে এখনো কিছুদিন ঈষৎ অনুকম্পার সঙ্গে লেখাগুলো পড়বেন! আমার স্টাইলটা জমতে একটু সময় লাগছে।
পৌষের বসুমতী হস্তগত হলেই রায়োকোয়ান নিয়ে বসব। এবারে লম্বা একখানা ছাড়বার বাসনা রাখি।
মুজতবা আলী
কাল য়ুনিভার্সিটি ইনষ্টিটুটে বক্তৃতা দিতে গেলে আজ আমাকে গোবরা যেতে হত!
[৩]
প্রিয়বরেষু,
রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে লেখা আজকের ডাকে এই সঙ্গে অন্য খামে ছাড়লুম। সময়মত পৌঁছানো, আল্লার হাতে – পোষ্টাপিস হাত গুটিয়ে আছেন।
মুজতবা আলী
[৪]
প্রীতিভাজনেষু,
পলডি রসিকতাগুলো আশা করি পছন্দ হবে। এক কিস্তির জন্য আটটাই প্রশস্ত। এক লাইনে দুটো বা চারটে করে বোধ করি ভালো হবে—তা সে নিশ্চয়ই ব্লক বানানো ইত্যাদি আপনি বোঝেন বেশী।
তাড়াতাড়িতে, আপনার
মুজতবা আলী
প্রচ্ছদের ছবি : সংগৃহীত