মূল ফরাসি থেকে রিয়াদুল ইসলাম অনূদিত
নোবেল বিজয়ী ফরাসি লেখিকা আনি এর্নোর ‘একটি মেয়ের স্মৃতিচারণ’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। এই প্রকাশনা উপলক্ষ্যে একটি সাহিত্য পত্রিকার পক্ষ থেকে ফরাসি সাংবাদিক ক্যাথেরিন এলি তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকারে আনি এর্নোর জীবনের অনেক কিছুই তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকারটি গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি এখানে তুলে ধরা হলো।
ক্যাথেরিন এলি : আপনার রচিত ‘একটি মেয়ের স্মৃতিচারণ’ বইটিকে কেন সাংঘর্ষিক গ্রন্থ বলা হয়?
আনি এর্নো : আমার জীবনের তিনটি ঘটনা রয়েছে, যে ঘটনাগুলোতে আমাকে দিনের পর দিন ডুবে থাকতে হয়েছে। আমি প্রথম ঘটনাটি বর্ণনা করেছি “লজ্জা” উপন্যাসে। এতে আমার বাবা আমার মাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। সালটা ছিল ১৯৫২। দ্বিতীয়টি আমার গোপন গর্ভপাত নিয়ে, যে ঘটনাটি গল্পের মতো করে “শূন্য আলমারিগুলো” বইয়ের দ্বিতীয় লেখায় বর্ণিত আছে। এরপর থাকে তিন নম্বরটি, ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকাল। ২০ বছর বয়সে আমি এটির উপর একটি বই লিখেছিলাম। বইটি ছিল বাস্তবতা থেকে অনেক দূরের একটা বই। কিছুটা পরীক্ষামূলক, পরে এটি আর প্রকাশিত হয়নি। উপলব্ধি করেছিলাম যে এরকম কথাসাহিত্য থেকে আমার বের হয়ে আসা উচিত।
আমার দ্বিতীয় লেখায় আমি আত্নজীবনীমূলক কথাসাহিত্যে ফিরে যাই। ঘটনাটি ১৯৫৮ সালের। এই বইটা নিয়ে লোকে কথা বলে। অনেকে আবার কিছুই বলে না। কিন্তু এতে এমন কিছু আছে যে-কারণে এটিকে একটা ভালো বই হিসেবে উল্লেখ করব। আমি আসলে বিষয়বস্তুর ভিতরে ডুব দেইনি। ২০০৩ সালে ৫০ পৃষ্ঠা লিখলাম কোনো সাহিত্যিক উদ্দেশ্য ছাড়াই। সত্যি কথা বলতে সেটাই ছিল লেখার কাঁচামাল। কিন্তু নতুন করে কিছু বাধার সম্মুখীন হলাম। আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখলাম, “আমাকে যদি মরে যেতে হতো তবে তা ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালের জন্য নয় যা আমি লিখেছিলাম ‘বছরগুলো’ বইয়ের জন্য।” তারপরে আমার স্তন ক্যান্সার হলো। এর ফলে, আমার আর কিছু করার থাকল না। আমাকে এই গ্রীষ্মকাল নিয়ে লেখার জন্যই অনেকটা বাধ্য হতে হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি লিখব না, ততক্ষণ পর্যন্ত একটা দূরত্ব রয়ে যাবে। তখন আসলে আমার দুঃসময় চলছিল। আমার জন্য সত্যি কিংবা বাস্তবতা কী হতে পারে, এই প্রশ্নই অপেক্ষা করছিল। আসলে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে, করতে হবে আরও অনেক কিছু।
আমি লিখেছিলাম ‘আমি’ এবং ‘সে’ সর্বনাম ব্যবহার করে। অনেকবার শুরু করলাম, অনেকবার কাটাকুটি করলাম। আমাকে এরপর গ্রীষ্মকালের সামাজিক-ঐতিহাসিক ছবি তৈরির প্রকল্প হাতে নিতে হলো। কিন্তু তা দেয়ালের সাথে যুতসইভাবে সাঁটানো সম্ভব হয়নি। আমার বয়স ছিল সাড়ে সতেরো। আর আমি একটু দূর থেকেই এসব বাস্তবতাকে সাথে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। তারপরে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের মতো করেই কয়েক বছর কেটে গেল। অবশেষে এই লেখা দিনের আলো দেখল।
ক্যাথেরিন এলি : এবার আপনার পুরাতন বইগুলো্র দিকে তাকাই। আপনার বাবাকে নিয়ে কিভাবে উপন্যাস লেখা অসম্ভব হলো?
আনি এর্নো : আমার বাবাকে উপন্যাসে আনার জন্য তিনটি বইয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। কিন্তু সবগুলোই ভেস্তে গিয়েছে। সত্যের শক্তিকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। এখানে বিবাহ বিচ্ছেদ রয়েছে, রয়েছে আমার শক্তিশালী অতীত। পাঠে তা খুঁজে পাওয়া, সাহিত্যের মাঝে তা নিয়ে আসা কিংবা আমি যে জায়গা থেকে উঠে এসেছি সেখানে যে অনুভূতি দীর্ঘকাল ধরে স্থায়ী ছিল তা সাহিত্যের পরিভাষায় বর্ণনাযোগ্য ছিল না। সেসব কোনো বইয়ের বিষয়ও হতে পারত না। একমাত্র উপায় ছিল তা প্রত্যাখ্যান করা। এটি প্রকাশ করতে হলে এর কাছে পৌঁছাতে আমাকে নিজের মধ্যে আবেগের সঞ্চার করতে হয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে সাহিত্য সম্ভব, উপন্যাস নয়।
ক্যাথেরিন এলি : লেখার সাথে যদি আবেগের দূরত্ব থাকে, তা কি পড়ার সময় অধিকতর আবেগ তৈরি করতে পারে?
আনি এর্নো : লিখতে গিয়ে যদি আবেগ অনুভব না করি, তাহলে আমি লিখি না। একই সাথে আমি এটি প্রকাশও করব না। আমি মনে করি না যে শব্দ আবেগ তৈরি করে। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি – হ্যাঁ, এটি অবশ্যই শব্দ। কারণ কিছু না থাকলে আমরা কিছুই লিখি না। তবে এমন নয় যে শব্দ শুধু এই আবেগকে প্রসারিত করে।
ক্যাথেরিন এলি : তাহলে আপনার মাকে নিয়ে লেখা কি একটি স্থান এবং একটি সময়কে আবিষ্কার করার মতো কিছু ছিল যা আপনি মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে পারতেন?
আনি এর্নো : হ্যাঁ, আমি তার মৃত্যুর ঠিক পরেই একটি লিখেছিলাম এবং লেখাটি একটা স্থানকে নির্দেশ করেছে। সংলাপকে তুলে ধরেছে। প্রতিটি বই আসলে এমন একটি ঘর যেখানে আমি প্রতিনিয়ত চলাফেরা করি। যেখানে অন্যদের সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। তাই, বইটা শেষ করা বেশ কষ্টকর ছিল।
ক্যাথেরিন এলি : আপনার কাজ এই দৃশ্যমান প্যারাডক্সের চারপাশে ঘোরে। আপনার জীবন নিয়ে লেখা, কিন্তু তাকে “পাবলিক বা গণ বিষয়” করে তুললেন?
আনি এর্নো : আমি আমার বিষয়আশয় নিয়ে লিখি, কিন্তু একজন আমিই যে আমি নই: আমি জীবন নিয়ে লিখি আমার সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা নিয়ে। কিন্তু তা জীবনের সংগতি খোঁজার জন্য নয়। আমার যে অসংগতি ছাড়া আর কিছুই নেই। কোনো স্থায়ী পরিচয় নেই, নেই নিজের কোনো স্মৃতি। স্মৃতি আসলে বস্তুগত, এটি নিজের বাইরের একটা দিক।
ক্যাথেরিন এলি : সমাজবিজ্ঞান তাহলে কিছুই শেষ হয় না?
আনি এর্নো : সমাজবিজ্ঞান বলতে আমার কাছে অনেক কিছু বোঝায়, কিন্তু যেটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো স্মৃতিকথা, পুনরুত্থানের সুখ। যে বই নিয়ে প্রশ্ন করছেন সেটি একটি ভুলে যাওয়া গ্রীষ্ম নিয়ে লেখা। এখন আমি ভারমুক্ত। এরকম সৃষ্টিশীল কাজের মাঝে অনেক আনন্দ খুঁজে পাই। আমি ‘লা কলোনি’ বইয়ের শিরোনাম নিয়ে ইতস্তত করেছি, কিন্তু এটি মেয়েদের বিষয়আশয় নিয়ে লেখা। যৌনতা জীবনের বড় জিনিস, তবে এটা সবসময় ভালো সেটা সত্যি নয়। আমি নারীর জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম, চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম একটি সত্তার জীবনের শুরুর বাস্তবতায় পৌঁছাতে, যেখানে ইচ্ছেমতো বাছাই করার সুযোগ থাকবে। এটি আমার সাথে ঘটেছে, এবং লেখার মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলাম অন্যদের জীবনেও এমন কিছু রয়েছে কিনা। তাহলে আমি আর একা থাকতাম না।
ক্যাথেরিন এলি : ক্যারোল মার্টিনেজ বলেছেন যে তিনি নারীদের নিয়ে একটি রোমান্টিক ইতিহাস লিখেছেন। আর আপনি?
আনি এর্নো : আমি ‘নারীদের বিষয়’ নিয়ে লিখি, তবে একচেটিয়াভাবে নয়। যে পুরুষরা ‘একটি মেয়ের স্মৃতিচারণ’ পড়েছেন তাদের অনেকেই আমাকে বলেছেন যে এগুলো তাদের কাছে লজ্জা ও অপমান ছাড়া নতুন কিছু নয়।
ক্যাথেরিন এলি : আপনি লিখেছেন : “যে বিষয়গুলো আমার সাথে ঘটেছে, আমি তাই লিখেছি।” আপনি কি এরকম বিষয়ের একজন ফেরিওয়ালা?
আনি এর্নো : হ্যাঁ, আমি যদি এটি না লিখি তবে তার কোনো অস্তিত্ব থাকত না এবং ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকাল চিরতরে হারিয়ে যেত। এই স্মৃতিকথা লেখা আমার দায়িত্ব অথবা বলতে পারেন বাধ্যবাধকতার মতো।
মোঃ রিয়াদুল ইসলাম
ভাষাশিক্ষক ও অনুবাদক। সহকারী অধ্যাপক (ফরাসি ভাষা), আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, শাবিপ্রবি। প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ দুটি।