মোহাম্মদ বা
বাংলাদেশ থিয়েটার
ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় ধাঁচে আধুনিক নাটকের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে রুশ সঙ্গীতজ্ঞ ও ভাষাবিদ গেরাসিম লেবেদিয়েফের হাত ধরে। যদিও ভারতের নাট্যশাস্ত্র অতি প্রাচীন। ইউরোপীয় নাটকের ইতিহাসে নাট্য নির্দেশক বলতে আমরা এখন যা বুঝি, তা ছিলো নাট্যকারেরই কাজ। অর্থাৎ নাট্যকারই ছিলেন নির্দেশক। আবার নাট্যকার শব্দটির আভিধানিক অর্থও নির্দেশক (Director) বলে অনেকে দাবি করেন। কিন্তু নাট্যকার (Playwright) বলতে আমরা সাধারণত ‘নাটক রচনা’ বুঝি, যদিও অনেকে Playwright শব্দের অর্থ নাট্যকার হওয়া উচিত বলে মনে করেন।
বাংলাদেশে সৈয়দ শামসুল হক নিজেকে নাট্যকার না বলে নাটককার হিসেবে পরিচয় দিতেন। পশ্চিম বাংলাতেও নাটককার শব্দের প্রচল আছে। যা-ই হোক, ইউরোপীয় নাটকের ইতিহাসে মূলত নাট্যকারই ছিলেন নির্দেশক। কিন্তু নাটকে অর্থাৎ দৃশ্যকাব্যে অভিনেতার ভূমিকা এতটাই প্রধান হয়ে ওঠে যে পরবর্তী কালে অভিনেতাই হয়ে উঠেন নির্দেশক। বিশেষত ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে নাটকের প্রচলিত ধারা ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিনয়ে সীমাবদ্ধ। সেই অভিনেতা প্রযোজনার কর্তৃত্ব গ্রহণ করতেন।
ইউরোপীয় নাটকের ইতিহাসে প্রাচীনকালে নাট্য প্রযোজনায় একজনের কর্তৃত্ব থাকতো বটে, তিনি ছিলেন নাট্যকার বা মঞ্চ ব্যবস্থাপক (Stage Manager)। তিনি মূলত প্রযোজনার শৃংখলা রক্ষা ও নাট্য প্রযোজনার সকল কাজের তদারকি করতেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাস্তববাদের বিকাশ ঘটে। সে সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক অভিনয় থেকে দলগত অভিনয়ের প্রবণতা দেখা দেয়। এসময় পাণ্ডুলিপি নির্বাচন, চরিত্রের ব্যাখ্যা, অভিনেতার প্রস্তুতি, নাটকের মহড়া, মঞ্চসজ্জা, প্রপস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আলো, সঙ্গীত, শব্দ ইত্যাদির সমন্বয়ের গুরুত্ব বাড়ে। ফলে একটি সফল প্রযোজনার জন্য নাটকের সকল কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনে একজনের ভাবনা ও কর্তৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ধারনাই জন্ম দেয় নির্দেশক বা পরিচালক-এর, যার শুরু মাত্র দেড়শো বছরের কিছুকাল আগে, ১৮৫৪ সালে।
২.
বাংলা নাটকের ইতিহাসেও ইউরোপীয় নাট্য-নির্দেশনার ক্রমবিকাশের এই ধারা লক্ষ্য করা যায়। নাট্যশাস্ত্রের আদিকাল বাদ দিলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চে নাট্যযাত্রার শুরুর দিকে অভিনেতাই নাটকের মুখ্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ অভিনেতাই নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। সে সময় বাংলা নাটকে শ্রুতি-অভিনয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একক কোনো অভিনেতার কণ্ঠনিঃসৃত অভিনয় দর্শককে মোহাবিষ্ট করে রাখতো। সেই অভিনেতা স্বয়ং প্রস্তুত হতেন। গিরিশ-অর্ধেন্দু যুগ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। তবে গিরিশ ঘোষ একাধারে নাট্যশিক্ষক-নাট্যকার-অভিনেতা-মঞ্চাধ্যক্ষ ছিলেন বটে।
ইউরোপে নাট্য-নির্দেশনা ধারণার সৃষ্টির পরপরই বাংলা নাটকে তার প্রভাব পড়ে। শিশির কুমার ভাদুড়ীর কালে নির্দেশকের ধারণাটির যথার্থ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। শিশির ভাদুড়ী স্বয়ং আধুনিক নাট্য-নির্দেশনার কলাকৌশল প্রয়োগ করে নাটক করতেন। পরবর্তীকালে এইধারা অব্যাহত থাকে।
বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে এ অঞ্চলে অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় নাটকের বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। ঢাকায় ১৮৯২ সালে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয় নাটক মঞ্চায়নের জন্য এক জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতায়। সম্ভবত এটিই ঢাকার প্রথম থিয়েটার হল। পরে এটি লায়ন থিয়েটার নাম ধারণ করে। এ সময় পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন রঙ্গালয় বা প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হতে থাকে বটে, তবে সেগুলির অধিকাংশই ছিল জমিদার বা ইংরেজ শাসকদের বিনোদনের জন্য। সাধারণের প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নাটকের বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। তবে অফিস পাড়ায় বা শখের নাটক হিসেবে নাট্য মঞ্চায়ন হতো। সেগুলোর নাট্য-নির্দেশনা হতো অভিনেতাদের যৌথ নেতৃত্বে। সবাই মিলে একটা নাটক করি- এই ছিল শখের নাটকের ধারণা। এর মধ্যে উৎসাহী দু-একজন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতো, কিন্তু তা মোটেও নাট্য-নির্দেশক ধারণার পরিপূরক ছিল না।
স্কুল-কলেজে বার্ষিক নাটক হতো। একজন শিক্ষক হয়তো পুরো আয়োজনটির বা নাট্য মঞ্চায়নের দায়িত্ব নিতেন। তিনি অভিনেতাকে গড়িয়ে-পিটিয়ে নিতেন। এখনও সৌখিন নাটকের পরিচালকরা তাই করেন। এ ধরনের পরিচালকরা নাট্য আয়োজনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নাট্য নির্দেশনার কাজটিও করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দেশক হিসেবে তিনি অভিনেতার চরিত্র নিজে অনুকরণ করে দেখান। অভিনেতাকে অনুকরণের শিক্ষা দিয়ে প্রস্তুত করেন। অভিনেতার অঙ্গভঙ্গি, হাঁটাচলা থেকে শুরু করে সংলাপ প্রক্ষেপণ পর্যন্ত অভিনেতা নির্দেশককে অনুকরণ করেন। ফলে অভিনেতা তার শিল্পীসত্তার নিজস্ব সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, তিনি বিকশিত হন না।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সৌখিন নাট্যচর্চায় নির্দেশকের ভূমিকা ছিলো মূলত অনুকরণের শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি। আধুনিক নাট্য-প্রয়োগের শিক্ষা, জ্ঞান, তথা – সেসবের কিছুরই চর্চা হতো না পূর্ব পাকিস্তানে। সেই সময় প্রম্পট করে নাটক হতো; গ্রাম-গঞ্জে হ্যাজাক বাতি আর শহরে ফ্লাড লাইটের ব্যবহার, দৃশ্যান্তরে পর্দা ফেলে দীর্ঘ বিরতি, অনেক সময় নাটকের মাঝখানে অহেতুক গান ইত্যাদি ছিল নাটক মঞ্চায়নের বৈশিষ্ট্য।
পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম বাংলার আদলে দু-একটি নাটকের দল গড়ে উঠলেও নাট্য-নির্দেশক হিসেবে বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের সে রকম কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। প্রাক-স্বাধীনতাকালে দু’একজন নাট্য নির্দেশক কয়েকটি প্রযোজনার নির্দেশনা দিলেও সেই নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী হয়নি।
বাংলাদেশে আধুনিক নাট্যচর্চার প্রবাহটা শুরু হয় মূলত গ্রুপ থিয়েটার চর্চার মধ্য দিয়ে, একাত্তরের স্বাধীনতার পরে যাকে আমরা ‘নবনাট্য আন্দোলন’ বা ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আন্দোলন বলে থাকি। সেটির শুরু ১৯৭৩ সালে। ওই সময় থেকেই বাংলাদেশে নাটকের নিয়মিত প্রদর্শনী হতে থাকে এবং নাট্য নির্দেশনা একটি সম্পন্ন ‘ধারণা’ (কনসেপ্ট)নিয়ে স্পষ্ট হয়।
একদল তরুণ সংস্কৃতিকর্মী যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাঁদের স্বপ্নের ভিতর ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীন দেশে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ। তাঁরা ছিলেন সুশিক্ষিত ও উদ্যমী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের কেউ কেউ কলকাতায় অবস্থানকালে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় আধুনিক প্রয়োগ দেখে অনুপ্রেরণাও পেয়েছেন। থিয়েটারের স্বপ্ন দেখা এসব তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পর বিপুল উদ্যমে নবনাট্য আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ছাড়াও জেলা বা মহকুমা শহরে অনেক নাট্যদল প্রতিষ্ঠিত হয়। পেশাদারত্বের মনোভাব নিয়ে নিয়মিত নাট্য-প্রদর্শনী চলতে থাকে এবং তা দর্শনীর বিনিময়ে। নাটকের বিষয়বস্তুতে সাধারণ বিনোদনের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধ, সমাজ, রাজনীতি, মানবিক মূল্যবোধ প্রাধান্য পায়। অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় দলবদ্ধ হয়ে গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন দল। সেসব দলের প্রযোজনাতেও পাওয়া যায় সে চেতনার আভাস।
সদ্য স্বাধীন দেশে নতুন এক শিল্পসুষমার সন্ধান পায় সাধারণ মানুষ। তৈরি হতে থাকে বিশাল এক দর্শক শ্রেণি। এই দর্শককূল স্বাধীনতার আগে থিয়েটারের নতুন ধারার এই প্রয়োগের স্বাদ পায়নি। প্রম্পট ছাড়া অভিনয় হচ্ছে, মুহূর্তেই দৃশ্যান্তর ঘটছে আলোর মাধ্যমে – পর্দা পড়ে দৃশ্যান্তরের জন্য আর অপেক্ষা নেই। ঠিক ঠিক সময়ে নাটক শুরু হচ্ছে। দারুন শৃংখলার ব্যবস্থাপনা দেখে দর্শকরা অভিভূত। লাইট, সেট, কস্টিউম, মিউজিক ইত্যাদি সব মিলে অভিনেতারা যেভাবে ঘোরের মধ্যে দর্শককে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, তা দর্শকদের কাছে জাদুর মতো অকল্পনীয় মনে হতে থাকে। দিনে দিনে দর্শক সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর দর্শক প্রশংসায় ধন্য হয়ে উদ্যমী নাট্যকর্মীদের উৎসাহ বাড়তে থাকে।
সদ্য স্বাধীন দেশের বিশাল এক তরুণ গোষ্ঠী অদম্য প্রাণশক্তি নিয়ে থিয়েটারে যুক্ত হয়। একটি আধুনিক শিল্পমাধ্যম হিসেবে তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা। এই চর্চায় পেশাদারত্বের মনোভাব নিয়ে দলের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। আধুনিক নাট্যজ্ঞান প্রয়োগের চর্চা শুরু হয়। নাটকের কর্মকাণ্ডে শৃংখলার স্বার্থে বিভিন্ন কাজ বিভাজিত করে বিভিন্নজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেমন স্টেজ ম্যানেজার বা মঞ্চ ব্যবস্থাপক, দ্রব্যসামগ্রী ব্যবস্থাপক, বক্স অফিস ব্যবস্থাপক, প্রচার-প্রকাশনা ব্যবস্থাপক ইত্যাদি। এগুলো হচ্ছে নাট্য প্রযোজনার নেপথ্যের কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনার বিভাজন। তেমনি মঞ্চে যে প্রযোজনাটির প্রদর্শনী হবে, সেটির সৃজনশীল কাজেরও বিভাজন করা হয় এবং বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সেসব সৃজনশীল কাজ পরিচালনা করা হয়। যেমন আলোক পরিকল্পনা, মঞ্চসজ্জা, সংগীত পরিকল্পনা, কোরিওগ্রাফি, শব্দপ্রয়োগ ইত্যাদি। আর এসব কাজের সমন্বয় হয় নির্দেশকের মাধ্যমে। এর বাইরে পাণ্ডুলিপি নির্বাচনের পরপরই নির্দেশক দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রযোজনাটির প্রয়োগ পরিকল্পনা করেন। নির্দেশক মূলত নাট্যকারের টেক্সটকে পুনঃনির্মাণ করেন বলে তার ভাবনায় যে দৃশ্যকাব্য তৈরি হয়, তারই প্রয়োগ তিনি মঞ্চে ঘটাতে চান। তাই তার পূর্বপ্রস্তুতি হয় দীর্ঘসময়ের।
মঞ্চায়নের জন্য নির্বাচিত নাটকটি তিনি বার বার পাঠ করেন এবং অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসন্ধান করেন। এরপর তিনি আগ্রহী অভিনেতাদের নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেন। পাণ্ডুলিপি ব্যখ্যা, নাটক নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, টেক্সটের বাইরে সাবটেক্সট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির পর অভিনেতা নির্বাচন এবং শেষে নির্বাচিত অভিনেতাদের নিয়ে চলে দীর্ঘ মহড়া। মহড়াকালে চরিত্র বিশ্লেষণ, যৌক্তিক অ্যাকশন লাইন নির্ধারণ, চরিত্র নির্মাণের জন্য অভিনেতাকে নানা রেফারেন্স দিয়ে সহায়তা করা, অভিনেতার বুদ্ধিমত্তাকে আবিষ্কার, অভিনেতার সাথে মিথষ্ক্রিয়া, ইম্প্রোভাইজেশন, ইমাজিনেশন, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় অভিনেতা তৈরি… মহড়াকালে ইত্যাদি আরও কিছু হতে পারে। মঞ্চে যেহেতু অভিনয় বা অভিনেতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাই অভিনেতাকে তৈরি করা নির্দেশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
একজন নির্দেশক নাটকের চরিত্রসমূহের যেমন মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন, পাশাপাশি নাটকের স্বার্থে তাকে নাটকের পাত্র-পাত্রীদেরও মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে হয়। নাটকের পুরো অভিনয়টি আবার অন্য উপাদান, যেমন সেট, আলো, প্রপস, শব্দ, আবহ ইত্যাদি এবং অবশ্যই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের সমন্বয় করে ঘটাতে হয়। ফলে, তৈরি হয় একটা কার্যকর শিল্পরস। এই রসটুকুই গ্রহণ করেন ভোক্তা অর্থাৎ দর্শক। এই রসায়নের পুরো কারিগর হচ্ছেন নির্দেশক। তাই ভালো একটি নাটকের জন্য নির্দেশকের মাত্রাজ্ঞান বা পরিমিতিবোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরেও সংশ্লিষ্ট প্রযোজনার প্রয়োজনে নির্দেশকের চাহিদামত ওয়ার্কশপ, লেকচার বা বক্তৃতা, নানা ধরনের পাঠগ্রহণ, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভ্রমণ, ক্যামপিং ইত্যাদিও হয়ে থাকে। আধুনিক নাট্য প্রযোজনায় এগুলিই মূলত নির্দেশকের কাজ।
একটি নাট্য প্রযোজনা মূলত নির্দেশকের সৃজিত শিল্পকলা। যে কোনো শিল্পই শিল্পীর দীর্ঘ সাধনার ফল। শিল্পী যে সৃজনীচিন্তাটি ধারণ করেন, সেটি তাকে বহন করতে হয়, লালন করতে হয়। সে জন্য তার একটি যাত্রাও থাকে। এরপর একসময় তিনি তা প্রসব করেন। নাটক যেহেতু যৌথশিল্প, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সাহিত্য-পেইন্টিং-সংগীত-নৃত্য-আবৃত্তি শিল্পের মতো নানান কলা। তাই নির্দেশককে শিল্পের এসব কলাগুলোরও সম্যক ধারণা রাখতে হয়। নির্দেশককে হতে হয় সমাজ ও রাজনীতি সচেতন। সমাজবিজ্ঞান তার অবশ্যপাঠ্য। আর নাটকের প্রয়োগক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা যেমন গণিত, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি তার প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন। তাই এসব বিষয়কেও তার সার্বক্ষণিক চর্চায় রাখা দরকার। মোটকথা একজন নাট্য নির্দেশককে হতে হবে সর্বগুণে গুণান্বিত চৌকষ শিল্পী।
স্বাধীনতার পর নবনাট্য আন্দোলনের চর্চায় এভাবেই আমরা নাট্য নির্দেশককে আবিস্কার করলাম। চৌকষ এই শিল্পীর শিল্পকর্ম তাই সহসাই দর্শকূলকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতার পরে যে বিপুল উৎসাহ ও প্রাণশক্তি নিয়ে বাংলাদেশের তরুণরা নাট্যকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার পেছনেও রয়েছেেএক-একজন নাট্য নির্দেশক। অনেক সময় এই নির্দেশক একাধারে নাট্যকার, সংগঠক ও অভিনেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন। আধুনিক নাট্যচর্চার ধারণায় এসবের প্রত্যেকটি কাজের ক্ষেত্র আলাদা আলাদাভাবে সুশৃংখল। যেহেতু স্বাধীনতার পরেই বাংলাদেশে এই চর্চার শুরু, তাই বলা যায় ইউরোপে ‘নাট্য নির্দেশক’ ধারণা সৃষ্টির প্রায় দেড়শো বছর পরে বাংলাদেশে তার নিয়মিত চর্চা শুরু হয়।
নাট্য নির্দেশকের কাজের এখতিয়ার নিয়ে বিতর্কও আছে। অনেকে মনে করেন নাট্য নির্দেশক দৃশ্যকাব্য তৈরিতে এত বেশি স্বাধীনতা গ্রহণ করেন যে নাট্যকার গৌণ হয়ে পড়েন। নির্দেশক নাট্যকারের পাণ্ডুলিপি পুনর্নির্মাণের নামে নাট্যকারকে খর্ব করে ফেলেন। ফলে অনেক সময় নাটকটি নাট্যকারের নাকি নির্দেশকের তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশে নাট্যকার সেলিম আল দীনের প্রায় সাত ঘণ্টার পাণ্ডুলিপিকে নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ আড়াই ঘণ্টার দৃশ্যকাব্যে নিয়ে এসেছেন। সারা বিশ্বেই নির্দেশকের এই অপার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু একথা মানতেই হবে নাট্য প্রযোজনায় নির্দেশকই এখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নির্দেশকই নাট্য প্রযোজনার শেষকথা। যদিও মঞ্চে অভিনেতৃবর্গের অভিনয়ই মূলত নাটকের প্রধান এবং একমাত্র প্রাণশক্তি।
মোহাম্মদ বারী : অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক, দলপ্রধান অনুস্বর।